কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত শিরক : ধরন ও প্রকৃতি (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

post title will place here

(১০) তাছাউফ চর্চায় শিরক : তাছাউফের শায়খ বা পীরের চেহারা বা আকৃতি কল্পনা করে মোরাকাবা, ধ্যান, যিকির বা অন্য যেকোনো ইবাদত করা শিরক। কোয়ান্টাম মেথডে মেডিটেশনের একটি ধাপে গিয়ে গুরুর ছবি কল্পনা করতে হয়। আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার সময়ে গুরুর ছবি স্মৃতিতে নেওয়ার সিস্টেম রয়েছে। তাছাউফ চর্চায় পীর গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করে থাকেন। এখানে স্বীয় পীর বা কোনো বুযুর্গকে বহুদূর হতে ডাকা এবং মনে করা যে, তিনি এটা জানতে ও শুনতে পারছেন। অনেক সময় ‘ইয়া গাউছুল আযম’, ‘ইয়া খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী’ ইত্যাদি বলে ডাকতে এবং নিজেদের ফরিয়াদ পেশ করতে দেখা যায়। কতেক পীরের কিছু সংখ্যক অনুসারী তাদের বাড়িতে পীরের জন্য একটি ঘর সারা বছর সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। একটা বড় খাটের ওপর চাদর বিছিয়ে বড় বড় কোল বালিশ সেট করে ‘বিশেষ আসন’ তৈরি করা হয়। পীরের ছবিকে মালা পরিয়ে সযত্নে ঐ ঘরে টাঙিয়ে রাখা হয়। ফুল ও জরি দিয়ে ঘরটি সুন্দর করে সাজানো হয়। সারা বছর ঐ ঘরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। মাঝে মাঝে মুরীদরা ঐ ঘরে ঢুকে ছবি ও আসনের সামনে আদবের সাথে চুপ করে বসে থাকেন।

(১১) পীরের সম্মানজনিত শিরক : বাংলাদেশে পীরের বাড়ি বা আস্তানার খাদেম, গরু, কুকুর, বিড়াল, মাছ, কচ্ছপ ইত্যাদির প্রতি মানুষকে অন্ধ সম্মান করতে দেখা যায়। পীরে বা মাযারের খাদেম, গরু, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদিকে দেখামাত্র অনেককে দাঁড়িয়ে যেতে দেখা যায়। এরা এগুলোর সামনে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষ নেক মাক্বছাদ পূরণের আশায় অনেককে আবার এসব গরু, কুকুর, বিড়ালের পা ধরে বসে থাকে। পীর, ওলী-আওলিয়াদের কবরের মাটি ও সেখানে জ্বালানো মোম বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী মনে করা হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধরনের কর্মকান্ড অহরহ পরিলক্ষিত হয়। আওলিয়াদের কবরের মাটি ও সেখানে জ্বালানো মোমবাতি বিভিন্ন রোগের অনেক উপকারী মহৌষধ মনে করে অত্যন্ত যত্নের সাথে ব্যবহার করা হয় এবং এর দ্বারা রোগমুক্তি হলে তা কবরস্থ ব্যক্তির দান বা তাঁর ফয়েয বলে মনে করা হয়।

(১২) গায়রুল্লাহর নামে যিকির বা অযীফা জনিত শিরক : বাংলাদেশের অনেক মানুষ আল্লাহর যিকিরের ন্যায় কোনো নবী, রাসূল, পীর, ওলী, বুযুর্গ ও আলেমের নাম জপে আর বিপদে পড়লে তার নামের অযীফা পড়ে। যেমন- ‘ইয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন’, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’, ‘নূরে রাসূল’, ‘নূরে খোদা’, ‘হক বাবা’ ইত্যাদি। তারা মনে করে থাকে যে, কামেল পীরের গোনাহ নেই। আল্লাহ তাআলা পাক, কামেল পীরও পাক। তারা নিষ্পাপ। এ ধরনের কথা বলে ও বিশ্বাস করে। পীরের পায়ে সিজদা করা বা কদমবুসি করা অনেকের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পীরের পায়ে সিজদা করা, নেক মাক্বছাদ পূরণ বা রোগমুক্তির নিয়্যতে পীরের পা চাটা, পায়ে চুমু খাওয়া, গাড়ি চাটা, দাড়িতে চুমু খাওয়া, ব্যবহার্য বা অন্য কোনো বস্তু চাটা বা চুমু খাওয়া, মাযারে চুমু খাওয়া ইত্যাদি করা। আল্লাহর সত্তার সাথে মিশে যাওয়ার চেতনায় অনেকে সরাসরি শিরকে জড়িয়ে পড়েন। অনেকের ধারণা মুরীদ যখন ‘ফানাফিল্লাহ’ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন সে আল্লাহর সত্তার সাথে মিশে বিলীন হয়ে যায় এবং তার পৃথক কোনো অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে না। খাওয়া, ঘুমানো, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি কাজকর্ম তখন আর নিজস্ব থাকে না। এগুলো সব আল্লাহর হয়ে যায় অর্থাৎ এ সব কাজ আল্লাহ নিজেই করেন (নাঊযুবিল্লাহ)। মজ্জাগতভাবে শিরকে ডুবে থাকতে থাকতে তারা বলে বেড়ান আল্লাহ যা করান, তাই করি। আল্লাহ ছালাত আদায় করান না, তাই আদায় করি না, আল্লাহ গাঁজা টানাচ্ছেন, তাই টানি। তাক্বদীরে ছালাত থাকলে তো আদায় করব (নাঊযুবিল্লাহ)।

(১৩) শিরকের গন্ধযুক্ত নাম ব্যবহার জনিত শিরক : যে সকল নাম বা সম্বোধনে শিরকের সংস্পর্শ পাওয়া যায়, সেগুলোকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। জাহেলী যুগে মানুষ নিজের সন্তান-সন্ততির নাম সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদির নামের সাথে সংযুক্ত করে রাখত। যেমন- আবদে শামস বা সূর্যের গোলাম, আবদে মানাফ বা মানাফের গোলাম ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের নাম রাখতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। পীর বা ওলীকে এমন কোনো উপাধিতে সম্বোধন করা উচিত নয়, যা অর্থগতভাবে আল্লাহ তাআলার জন্য প্রযোজ্য। যেমন- গাউছুল আযম (সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী), গরীবে নেওয়াজ (গরীবরা যার মুখাপেক্ষী), মুশকিল কোশা (যার মাধ্যমে বিপদাপদ দূর হয়), ক্বাইয়ূমে যামান (যামানা ক্বায়েম করেছেন যিনি) ইত্যাদি। অনেক পীর আছেন যারা ছালাত, ছওম ইত্যাদি ইবাদতের ধার ধরেন না; কিন্তু ব্যাপক সাধনা করেন এমনকি দু’তিন দিন না খেয়ে পার করে দেন। তারা কথা কম বলেন আর লোকজনের সাথে মিশা থেকে বিরত থাকেন। দিনের বেশিরভাগ সময় চুপ থেকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পার করে দেন। তাঁরা বলেন, আমরা দিলে দিলে ছালাত পড়ি। পীর বা দরবেশ দাবীদার একদল লোক বলে থাকেন, ‘কুরআন শরীফ মোট ৪০ পারা। ৩০ পারায় যাহেরী ইলমের বিষয় আছে আর বাকি ১০ পারায় মা‘রেফতী বিদ্যা আছে। এ ১০ পারা আমরা সীনাযোগে পেয়েছি। শরীআতের আলেমরা এসবের খবর রাখেন না। অনেকের ধারণা, মুরীদ যখন মা‘রেফাতের উচ্চ শিখরে পৌঁছে যান, তখন তার জন্য শরীআতের হুকুম-আহকাম, ছালাত, ছওম ইত্যাদি মাফ হয়ে যায়।

(১৪) সন্তানের নামকরণে নবী ও পীর-আওলিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন : শিশুদের নামকরণের ক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলাদেশের মানুষ শিরকের চর্চা করছে। যেমন- গোলাম মুছত্বফা (মুছত্বফার গোলাম), আব্দুন নবী (নবীর দাস), আব্দুর রাসূল, আলী বখশ (আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দান), হোসেন বখশ (হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দান), পীর বখশ (পীরের দান), মাদার (‘মাদার’কে বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলের হিন্দুরা বড় ঋষি বলে জানে) বখশ (মায়ের দান), গোলাম মহিউদ্দীন (মহিউদ্দীনের গোলাম), আব্দুল হাসান (হাসানের গোলাম), আব্দুল হুসাইন (হুসাইনের গোলাম), গোলাম রাসূল (রাসূলের গোলাম), গোলাম সাকলায়েন ইত্যাদি নাম রাখা।

(১৫) বিপদে পড়লে জিন, ফেরেশতা, পীর-আওলিয়াদের ডাকা : দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ, পীর ও মাযারপূজারী অনেক লোককে দেখা যায় যারা বিপদে-আপদে, রোগ-শোকে আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে পীর, ওলী, জিন ও ফেরেশতাদের আহ্বান করে থাকেন। যেমন- ‘ইয়া গাউছুল আযম বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী’, ‘ইয়া খাজা বাবা’, ‘ইয়া সুলতানুল আওলিয়া’, ‘হে পীর কেবলাজান’, ‘হে জিন’, আমাকে রক্ষা করুন, আমাকে বিপদ হতে বাঁচান, আমার মাক্বছাদ পুরা করুন, সন্তান দিন ইত্যাদি। কোনো কোনো মূর্খ লোক বালা-মুছীবতের সময় বুযুর্গ লোকদের উদ্দেশ্যে দু‘আ করে, ফরিয়াদ জানায়। এভাবে গায়রুল্লাহকে ডাকা এবং তাদের কাছে নিজের ফরিয়াদ পেশ করা, তা কাছ থেকে হোক আর দূর থেকেই হোক।

(১৬) পীর, ওলী-আওলিয়ার স্মৃতিচিহ্নের তা‘যীম করা এবং এদের কাছে গায়েবী সাহায্য চাওয়া : বাংলাদেশের অনেকে পীর-ওলীদের স্মৃতিচিহ্নকে এমন তা‘যীম করে যে, তা শিরকের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পীর হয়তো কোনো গাছের নিচে বসতেন বা বিশ্রাম নিতেন। পীরের মৃত্যুর পর মুরীদরা ঐ গাছ বা পাথরের গোড়ায় আগরবাতি, মোমবাতি, ধূপ ইত্যাদি জ্বালিয়ে মীলাদ পড়ায় এবং বিপদমুক্তির জন্য ফরিয়াদ করে। খানজাহান আলীর মাযারের পুকুরে কুমির আছে, চট্টগ্রামে কথিত বায়েজীদ বোস্তামীর মাযারে কচ্ছপ আছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় গজার মাছ, জালালী কবুতর ইত্যাদি পীর-ওলীদের স্মৃতি বহন করছে বলে মানুষের বিশ্বাস। অজ্ঞ অশিক্ষিত মানুষেরা মাযারের ব্যবসায়ী খাদেমদের খপ্পরে পড়ে এ সব কচ্ছপ, গজার মাছ, কুমির, জালালী কবুতর ইত্যাদিকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করে এবং এদের জন্য বিভিন্ন খাদ্যবস্তু পূজাস্বরূপ নিয়ে যায় ও এদের কাছে সাহায্যে প্রার্থনা জানায়।

(১৭) মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তন ও টাকা স্পর্শ : সিলভা, কোয়ান্টাম মেথড বা অন্য কোনো মেথডের (পদ্ধতি) দ্বারা মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো এবং সকল সমস্যার সমাধান লাভ করার মাধ্যমে জীবনে সফলতা অর্জন করার কথা বলা। দেশের অনেক মানুষ কপালে টাকা স্পর্শ করে তা সম্মান করে থাকে। টাকা-পয়সা মানুষের সম্পদ, যা তার প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে টাকা-পয়সা মানুষের খাদেম, কিন্তু মানুষ টাকার খাদেম বা গোলাম নয়। সম্পদের সম্মান হচ্ছে তাকে সংরক্ষণ করা, তাকে অবজ্ঞা বা তুচ্ছ জ্ঞান না করা। পায়ের নিচে ফেলে এটাকে দলিত-মথিত না করা। মাথা ও কপাল ঠেকিয়ে আল্লাহর ইবাদতকে মাধ্যম করে তাকে সম্মান জানানো হয়। তাই কপালে টাকা স্পর্শ করে টাকাকে সম্মান করা বা Money is the Second God বলা টাকাকে পূজা করারই শামিল। এ কাজটি অনেক মুসলিম ব্যবসায়ীর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। দোকান খোলার পর প্রথম বিক্রি হলেই তারা এ কাজটি করে থাকেন।[1]

(১৮) গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাসজনিত শিরক : অনেকের ধারণা মানুষের ভালো-মন্দ, বিপদ-আপদ, উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে হয়। কেউ বিপদে পড়লে বলা হয়, ‘এ ব্যক্তির ওপর শনি গ্রহের প্রভাব পড়েছে’। কারো আনন্দের খবর শুনলে বলা হয়ে থাকে, ‘এ ব্যক্তি মঙ্গল গ্রহের সুনযরে আছে’। অনেকের ধারণা চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ মানুষের ভালোমন্দ, জন্ম-মৃত্যু, বিপদ-আপদের ওপর প্রভাব রাখে।

(১৯) কোনো মাস বা সময়কে ভালো বা খারাপ জানা : আমাদের দেশের জনগণের বড় একটা অংশ সময় ও দিনক্ষণের ভালো-মন্দে বিশ্বাসী। মুহাররম, কার্তিক প্রভৃতি মাসে বিয়ে-শাদী করা উচিত নয়, রবি ও বৃহস্পতিবারে বাঁশ কাটা যায় না (এ ধরনের বিশ্বাসের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অনেক এলাকা যেখানে বাঁশের হাট রয়েছে, সেসব হাটগুলো সাধারণত রবিবার ও বৃহস্পতিবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে হয়), সোম ও বুধবারে গোলা হতে ধান বের করা যায় না, শুক্র ও রবিবারে পশ্চিম দিকে যাত্রা করলে ক্ষতি হবে, শনি ও মঙ্গলবারে বিয়ে করা ও ঝাড়ু বাঁধা উচিত নয়, রাতের বেলা ঝাড়ু দিলে আয়-উন্নতি হয় না, রাতে আয়না দেখলে কঠিন পীড়া হয়, রাতে নখ কাটা ঠিক নয়, নতুন বউকে ভাদ্র মাসে শ্বশুরবাড়িতে রাখা হয় না (কারণ নতুন বছরের পা ভাদ্র মাসে শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য দেখা অকল্যাণকর), ভাদ্র ও পৌষ মাসে মেয়েলোকের সওয়ারী পাঠানো যায় না, আশ্বিন মাস যাবার দিন মুটে বানিয়ে গরুকে গা ধৌত করা ও ‘গো ফাল্গুন’ বলে মান্য করা ইত্যাদি।

(২০) গায়রুল্লাহর নামে কসম করা : আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর নামে কসম করল, সে কুফরী করল অথবা শিরক করল’।[2] মূলত আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো নামে কসম করলে কসম হয় না। যেমন- রাসূলুল্লাহর কসম, কা‘বাঘরের কসম, নিজ চোখের কসম, বিদ্যা বা বই-এর কসম ইত্যাদি।

(২১) অসীলা গ্রহণ ও শুভ-অশুভ আলামত : আল্লাহকে পাওয়ার জন্য বা তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বা তাঁর ক্ষমা ও সাহায্য পাওয়ার আশায় কোনো জীবিত বা মৃত পীর, ওলী বা বুযুর্গ ব্যক্তিকে অসীলা বা মাধ্যম গ্রহণ করা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনো বস্তু, স্থান, শব্দ বা সংকেত পসন্দ করা বা না করা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। এটা দোষের কিছু নয়। তবে ভালোকে নিশ্চিতভাবে ভালো এবং মন্দকে অকল্যাণকর বলে জানতে হলে শরীআতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন। তাওহীদের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে শুভ-অশুভ লক্ষণে বিশ্বাস করা স্পষ্টভাবে শিরকের পর্যায়ে পড়ে। ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীছে এ বিধানটি আরও দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়। এ হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অশুভ বা অযাত্রায় বিশ্বাস করা শিরক, এ কথা তিনি তিনবার বলেন’।[3] পাখি ও প্রাণীর চলাচলের গতিপথকে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবরা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের আলামত বলে মনে করত এবং তাদের জীবন পরিকল্পনা এসব আলামতকে কেন্দ্র করে অবর্তিত হতো। শুভ বা অশুভ আলামত নির্ধারণের এই চর্চাকে আরবীতে তিয়ারা (পাখি উড়িয়ে ভাগ্য নির্ধারণ) বলা হতো। যেমন- বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে কোথাও যাত্রা করা হলে, যদি কোনো পাখি তার উপর দিয়ে বামে উড়ে যেত, তাহলে সে ভাবত তার দুর্ভাগ্য অবশ্যম্ভাবী; ফলে সে সফর বাতিল করে বাসায় ফিরে আসত।

ইসলাম এ ধরনের সকল কুপ্রথাকে বাতিল করেছে। সকল মুসলিমকে এ ধরনের বিশ্বাস হতে উদ্ভূত আবেগ বা চেতনাকে পরিহার করতে বিশেষভাবে যত্নশীল হতে হবে। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ অজ্ঞাতসারে এমন কাজে জড়িয়ে পড়ে যা এ জাতীয় বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাহলে এ থেকে পরিত্রাণের জন্য অবশ্যই তাকে নিম্নের দু‘আ পড়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে-اَللَّهُمَّ لاَ خَيْرَ إِلاَّ خَيْرُكَ وَلاَ طَيْرَ إِلاَّ طَيْرُكَ وَلاَ إِلٰهَ غَيْرُكَ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনার কল্যাণ ব্যতীত কোনো কল্যাণ নেই এবং আপনার দেওয়া শুভাশুভত্ব ব্যতীত কোনো শুভ বা অশুভ নেই এবং আপনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই’।[4] শুভ-অশুভ লক্ষণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা নিরর্থক। বৃহৎ শিরকের আশঙ্কা থেকে ইসলাম এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। মূর্তি, মানুষ, তারকা, সূর্য ইত্যাদি পূজার উৎপত্তি হঠাৎ করে হয়নি। উল্লিখিত বিষয়গুলো দীর্ঘকালব্যাপী চর্চার মাধ্যমে পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসের ক্রমবিকশ ঘটেছে। বৃহৎ শিরকের শিকড় যত বিস্তার লাভ করে, আল্লাহর একত্বের প্রতি মানুষের বিশ্বাস তত বিলুপ্ত হতে থাকে। এভাবে শয়তানের কুমন্ত্রণায় মুসলিমদের বিশ্বাসের মূলভিত্তি ধ্বংস হওয়ার পূর্বেই তা সমূলে উৎখাত করতে হবে।

উপসংহার : শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তাআলার নিকটে সর্বদা আন্তরিকভাবে দু‘আ করা ও সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিরক হতে বাঁচার জন্য আমাদেরকে দু‘আ শিখিয়েছেন,اَللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوْذُبِكَ أَنْ نُشْرِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ وَنَسْتَغْفِرُكَ لَمَا لاَ نَعْلَمُ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! জেনে-বুঝে শিরক করা থেকে আমরা আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং আমাদের অজ্ঞাত শিরক থেকে আপনার নিকটে ক্ষমা চাচ্ছি’।[5] এ কারণে বান্দার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান কাজ হলো— তাওহীদের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা। নিজের ঈমান, আক্বীদা ও যাবতীয় আমল শিরকমুক্ত রাখা, যাতে কোনো আমল বরবাদ না হয়। তাওহীদের প্রকৃত জ্ঞান না থাকলে, কোনো জ্ঞানই পরিপূর্ণ নয়। তাওহীদবিহীন কোনো আমলও গ্রহণীয় নয়। তাছাড়া ইক্বামতে দ্বীনের মূলকথাই হচ্ছে তাওহীদকে সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করা ও এর উপর মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল থাকা। আর এজন্য তাওহীদকে বিনষ্টকারী শিরক নামের মহা অপরাধ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখা জরুরী। অন্যথা যেকোনো সময় শয়তানের খপ্পরে পড়ে যে কারো ঈমান ও জীবনের যাবতীয় সৎকর্মের সাধনা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এহেন গুরুতর পরিণতির হাত থেকে যেমন নিজেকে রক্ষা করা আবশ্যক, তেমনি এত্থেকে অন্য সকল মুসলিমকেও রক্ষা করা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা শিরক নামক মহাপাপ থেকে আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!

ড. মোহাম্মদ হেদায়াত উল্লাহ

সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস, সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।

[1]. ড. মুযযাম্মিল আলী, শিরক কী ও কেন, (ঢাকা: তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃ. ৩৫০।

[2]. তিরমিযী, হা/১৫৩৫, হাদীছ ছহীহ; আবূ দাঊদ, হা/৩২৫১।

[3]. তিরমিযী, হা/১৬১৪, হাদীছ ছহীহ; আবূ দাঊদ, হা/৩৯১০; ইবনু মাজাহ, হা/৩৫৩৮।

[4]. আহমাদ, হা/৭০৪৫; সিলসিলা ছহীহা, হা/১০৬৫।

[5]. আহমাদ, হা/১৯৬২২।

Magazine