ভূমিকা: ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যা শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। কুরআন ও হাদীছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি গভীর আগ্রহ ও প্রেরণা পাওয়া যায়। ইসলামী দর্শন অনুসারে, প্রকৃতির সবকিছু আল্লাহর সৃষ্টি এবং মানুষের উচিত সেই সৃষ্টির গভীরতা অন্বেষণ করা। এভাবে ইসলাম প্রকৌশল বিদ্যা শিখতে এবং প্রয়োগ করতে অনেক অনুপ্রেরণা দেয়।
(১) কুরআন প্রাকৃতিক ঘটনা অধ্যয়ন করতে উৎসাহিত করে: আল্লাহ তাআলা বলেন, سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ ‘মহাবিশ্বে ও তাদের নিজেদের মধ্যে অচিরেই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলি দেখাব; যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে, এটি (কুরআন) সত্য’ (ফুছছিলাত, ৪১/৫৩)। এই আয়াতটি আমাদেরকে প্রকৃতির নিদর্শনগুলো খুঁজে বের করার জন্য উৎসাহিত করে। যেমন- বিদ্যুৎ, আলো ও চুম্বকত্ব এবং এসবের মাধ্যমে এমন প্রযুক্তি তৈরি করতে, যা মানবতার উপকারে আসে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ ‘আর তিনি তোমাদের জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন রাত, দিন, সূর্য ও চাঁদকে এবং তারকাসমূহও তাঁর নির্দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন...’ (আন-নাহল, ১৬/১২)। এই আয়াত আমাদের সৌরশক্তি অধ্যয়ন করতে উৎসাহিত করে, আর নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
(২) মুসলিম বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদের উত্তরাধিকার: ‘রোবোটিক্সের জনক’ হিসেবে পরিচিত আল-জাযারীর জলঘড়ি এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলো আধুনিক অটোমেশন এবং রোবোটিক্সের পূর্বসূরি ছিল। তার কাজ আমাদের মেকানিক্যাল এবং ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমের একত্রিতকরণ নিয়ে গবেষণার অনুপ্রেরণা দেয়, যা কন্ট্রোল সিস্টেম এবং Ioহাফিযাহুল্লাহ (ইন্টারনেট অব থিংস)-এ গবেষণার পথ খুলে দেয়।[1]
‘অপটিক্স ও দৃষ্টিবিজ্ঞানে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী আল-হাজেন আধুনিক ফাইবার অপটিক্স এবং ইমেজিং প্রযুক্তিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছেন। তার পরীক্ষামূলক পদ্ধতি ও আলো অধ্যয়ন ফোটোনিক্স এবং ইলেকট্রনিক্স সেন্সরগুলোর উন্নয়নকে গাইড করেছে।[2]
তার বই ‘দ্য বুক অব ইনজেনিয়াস ডিভাইসেস’-এ প্রাথমিক প্রোগ্রামেবল মেশিনের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা ডিজিটাল সিস্টেমের উদ্ভাবনের জন্য উৎসাহ দেয়। যেমন- সার্কিট ডিজাইন এবং এম্বেডেড সিস্টেম।[3]
ইসলামী নীতি খিলাফাহ (অধিকার): প্রকৌশলীরা পৃথিবীর সম্পদের রক্ষক এবং তাদের উচিত প্রযুক্তির টেকসই ও নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, টেকসই শক্তি সিস্টেম ডিজাইন, বৈদ্যুতিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং দক্ষ ডিভাইস তৈরি করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ ‘আর স্মরণ করো, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করব। তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যারা তাতে ফ্যাসাদ করবে এবং রক্তপাত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসার সহিত তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না’ (আল-বাক্বারা, ২/৩০)।
(৪) জ্ঞান অর্জনকে উপাসনা হিসেবে দেখা: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিমের ওপর ফরয’।[4] আল্লাহ তাআলা বলেন, يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ‘...তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/১১)।
(৫) মানবতার উপকারে সমস্যা সমাধান: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ ‘আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয়, যে মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকার করে’ (সিলসিলা ছহীহা, হা/৯০৬)।
প্রকৌশল বিদ্যা বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে মনোনিবেশ করে। যেমন- নবায়নযোগ্য শক্তি সিস্টেম, চিকিৎসা ডিভাইস ইত্যাদি আর এগুলো ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী মানবতার উপকারে আসে।
(৬) বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে সেতুবন্ধন: ইসলাম বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে। প্রকৌশলীরা এই প্রেরণা খুঁজে পেতে পারে—
আল্লাহর সৃষ্টির সঠিকতা: এটি প্রকৃতির পেছনের গাণিতিক এবং শারীরিক নীতিগুলো অধ্যয়ন করতে উৎসাহিত করে। যেমন- চৌম্বক তরঙ্গ, সার্কিট তত্ত্ব ও সিগন্যাল প্রসেসিং। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ ‘আর তিনিই রাত ও দিন এবং সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টি করেছেন; প্রত্যেকেই (নিজ নিজ) কক্ষপথে বিচরণ করে’ (আল-আম্বিয়া, ২১/৩৩)।
আসমান-যমীনের আন্তঃসংযোগ: প্রকৌশল বিদ্যায় ডিজাইন করা আন্তঃসংযুক্ত সিস্টেমে প্রতিফলিত হয়। যেমন- শক্তি গ্রিড, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম। আল্লাহ তাআলা বলেন, أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ ‘যারা কুফরী করে তারা কি দেখেনি যে, আসমানসমূহ ও যমীন ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিয়েছি আর আমি সকল প্রাণবন্ত জিনিসকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছি। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?’ (আল-আম্বিয়া, ২১/৩০)।
উপসংহার: ইসলামের শিক্ষার আলোকে প্রকৌশল বিদ্যা অধ্যয়ন শুধু একটি পেশাগত দক্ষতা অর্জন নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক এবং মানবিক দায়িত্বের মতো। ইসলাম বিজ্ঞান, নৈতিকতা এবং মানবকল্যাণের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে উৎসাহিত করে, যা ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিদ্যার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে পারে।
নাফিউল হাসান
প্রভাষক, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বাংলাদেশ।
[1]. Al-Jazari, The Book of Knowledge of Ingenious Mechanical Devices, 1206.
[2]. IIbn al-Haytham, Book of Optics, 1021.
[3]. BBanu Musa, The Book of Ingenious Devices, 850.
[4]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪।