কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

‘নাজ্দ’ হতে শয়তানের শিং বের হওয়া বিষয়ক হাদীছের ব্যাখ্যা

ভূমিকা :

হাদীছে বর্ণিত নাজ্দ শব্দটি দ্বারা ইরাককে বুঝানো হয়েছে। শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ-কে বুঝানো হয়নি। যারা কবরপূজারী, মাযারপূজারী তারাই এসব ভুল ব্যাখ্যা প্রচার করে। তারা শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ-এর উপর চরমভাবে ক্রুদ্ধ। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ মাযার, কবরের উপর নির্মিত ভবনগুলো ভেঙ্গে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেছেন বিধায় তাদের অন্তরে এতো ক্ষোভ। তাঁর রচিত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ ও অন্যান্য গ্রন্থ বাতিলের দূর্গে প্রবলভাবে আঘাত হেনে তাওহীদের বীজ বপন করেছে।

সঠিক ব্যাখ্যা : এক্ষণে আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছ দ্বারা ‘নাজ্দ’-এর সঠিক মর্ম পেশ করব ইনশাআল্লাহ। ‘শয়তানের শিং বের হবে নাজ্দ হতে’ কথাটির দ্বারা ইরাককে বুঝানো হয়েছে। যেমন-

দলীল-১ : আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন,

ذَكَرَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَأْمِنَا، اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَفِي نَجْدِنَا؟ قَالَ : اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَأْمِنَا، اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَفِي نَجْدِنَا؟ فَأَظُنُّهُ قَالَ فِي الثَّالِثَةِ : هُنَاكَ الزَّلاَزِلُ وَالفِتَنُ، وَبِهَا يَطْلُعُ قَرْنُ الشَّيْطَانِ

‘একদা আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ করলেন যে, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য বরকত দাও শামে (সিরিয়াতে)। হে আল্লাহ! বরকত দাও আমাদের জন্য ইয়ামানে। তারা (ছাহাবীগণ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আর আমাদের নাজ্দের (ইরাকের) জন্য (দু‘আ করুন)? তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য বরকত নাযিল করো শামে। হে আল্লাহ! আমাদের জন্য বরকত দাও ইয়ামানে। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের নাজ্দের মধ্যেও? আমার ধারণা তিনি তৃতীয়বারে বললেন, সেখান হতে ভূমিকম্প, ফিতনা হবে এবং সেখান হতে শয়তানের শিং উদিত হবে’।[1]

দলীল-২ : ছালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বলেছেন,

يَا أَهْلَ الْعِرَاقِ مَا أَسْأَلَكُمْ عَنِ الصَّغِيرَةِ، وَأَرْكَبَكُمْ لِلْكَبِيرَةِ سَمِعْتُ أَبِي عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ يَقُولُ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : إِنَّ الْفِتْنَةَ تَجِيءُ مِنْ هَاهُنَا- وَأَوْمَأَ بِيَدِهِ نَحْوَ الْمَشْرِقِ مِنْ حَيْثُ يَطْلُعُ قَرْنَا الشَّيْطَان-

‘হে ইরাকের অধিবাসী! ছোট ছোট বিষয়ে জানতে চাও অথচ বড় বড় পাপ করে থাকো। আমি আমার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে শ্রবণ করেছি যে, তিনি বলতেন, নিশ্চয়ই ফিতনা এখান হতে আসবে। আর তিনি স্বীয় হাত দ্বারা পূর্ব দিকে ইশারা করলেন যে, এখান থেকে শয়তানের শিং বের হবে’।[2]

দলীল-৩ : ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন,

رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يُشِيرُ بِيَدِهِ يَؤُمُّ الْعِرَاقَ : هَا، إِنَّ الْفِتْنَةَ هَاهُنَا، هَا، إِنَّ الْفِتْنَةَ هَاهُنَا، ثَلَاثَ مَرَّاتٍ مِنْ حَيْثُ يَطْلُعُ قَرْنُ الشَّيْطَانِ-

‘আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেখেছি, তিনি ইরাকের দিকে তাঁর হাত দ্বারা ইশারা করে বললেন, সাবধান! নিশ্চয়ই ফিতনা এখান হতে হবে। সাবধান! নিশ্চয়ই ফিতনা এখান হতে হবে। একথাটি তিনি তিনবার বললেন। (অতঃপর বললেন) এখান থেকেই শয়তানের শিং বের হবে’।[3]

পর্যালোচনা : (১) মুসনাদে আহমাদের টীকায় বলা হয়েছে, إسناده صحيح على شرط الشيخين ‘এর সনদ শাইখায়নের শর্তে ছহীহ’।[4] (২) আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, وإسناده صحيح على شرط مُسلم ‘এর সনদ মুসলিমের শর্তে ছহীহ’।[5]

‘ইরাক হতে শয়তানের শিং বের হবে’- কথাটি ইমাম ত্ববারানী আল-মু‘জামুল কাবীর (হা/১৩৪২২) গ্রন্থে, হাফেয হায়ছামী মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ (হা/৫৮১৬) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ মর্মে আরও হাদীছ রয়েছে যা কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় উল্লেখ করা হলো না।

ফিতনা বলতে এখানে ‘কুফরী’কে বুঝানো হয়েছে। যেমন, আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, رَأْسُ الكُفْرِ نَحْوَ المَشْرِقِ ‘কুফরীর উৎস পশ্চিম দিকে’।[6]

নাজ্দ-এর অর্থ : আরবের অভ্যন্তরে নাজ্দ নামে অসংখ্য এলাকা রয়েছে। নাজ্দের অর্থ নিমণরূপ-

(১) আল্লামা মাজদুদ্দীন ফীরোযাবাদী রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেন,

النَّجْدُ : الطريقُ الواضِحُ المُرْتَفِعُ، وما خَالَفَ الغَوْرَ، أي : تِهامَةَ، وتُضَمُّ جِيمُهُ مُذَكَّرٌ، أعْلاهُ تِهامَةُ واليَمنُ، وأسْفَلُهُ العِراقُ والشامُ، وأوَّلُهُ من جِهَةِ الحِجاز ذاتُ عِرْق-

‘উচ্চ ভূমিকে নাজ্দ বলা হয়। অর্থাৎ উচ্চ ও স্পষ্ট রাস্তা যা গওর (নিমণভূমি, গুহা, তলা) অর্থাৎ তিহামার (নিমণাঞ্চল) বিপরীত। ঐ সকল যমীন এবং এলাকা যেগুলো তিহামাহ ও ইয়ামান হতে শুরু হয়েছে এবং ইরাক ও শাম পর্যন্ত বিসত্মৃত। হিজাযের দিক হতে যাতু ইর্ক নামক স্থানের সূচনাস্থল’।[7]

‘যাতু ইর্ক’ হলো ইরাকের অধিবাসীদের জন্য মীক্বাত যেখান হতে তারা হজ্জের ইহরাম বাঁধেন।

(২) আল্লামা ইবনে মানযূর আফরীকী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন,

 النَّجْدُ مِنَ الأَرض : قِفافُها وصَلَابَتُها وَمَا غَلُظَ مِنْهَا وأَشرَفَ وارتَفَعَ واستَوى

‘নাজ্দ ভূ-পৃষ্ঠের ঐ অংশটি যা উচ্চভূমি, শক্ত স্থান, শক্ত ভূমি, উচ্চে হয়ে থাকে’।[8] তিনি আরও বলেছেন,

وَمَا ارْتَفَعَ عَنْ تِهامة إِلى أَرض الْعِرَاقِ، فَهُوَ نَجْد-

‘যমীনের ঐ উঁচু অংশ যা তিহামাহ হতে শুরু করে ইরাকের যমীনের দিকে গিয়েছে। (আর) এটাই হলো নাজ্দ’।[9]

প্রতীয়মান হলো যে, উঁচু ছাদ ও যমীনের উচ্চ স্থানকে নাজ্দ বলা হয়। আর আরবে অসংখ্য নাজ্দ রয়েছে। মু‘জামুল বুলদান প্রণেতা শায়খ আবু আব্দুল্লাহ ইয়াকূত ইবনে আব্দুল্লাহ আল-হামাবী নিমেণাক্ত নাজ্দসমূহ গণনা করেছেন-

(১) নাজ্দে আলূয (২) নাজ্দে আজা (৩) নাজ্দে বারক (৪) নাজ্দে খাল (৫) নাজ্দে সারা (৬) নাজ্তে আফর (৭) নাজ্দে ইকাব (৮) নাজ্দে কাবকাব (৯) নাজ্দে মুরী (১০) নাজ্দে ইয়ামান (১১) নাজ্দে সার।[10]

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, ‘নাজ্দ’ দ্বারা ইরাককে বুঝানো হয়েছে। কোনো ব্যক্তিকে বুঝানো হয়নি। সুতরাং এ হাদীছ দ্বারা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ-কে তিরস্কার করার ব্যর্থ চেষ্টা করা নিকৃষ্টতম অপকর্ম। আবেগের বশে তাড়িত না হয়ে নিরপেক্ষভাবে কুরআন-হাদীছ অধ্যয়নের দ্বারা নিজের আক্বীদা, চিন্তা-ভাবনাকে শুদ্ধ করতে না পারলে পরকালে ভয়াবহ পরিণতি হবে। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন!


[1]. বুখারী, হা/৭০৯৪।

[2]. মুসলিম, হা/২৯০৫।

[3]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৩০২।

[4]. প্রাগুক্ত, তাহক্বীক্ব : আব্দুল মুহসিন আত-তুরকী, শু‘আইব আরনাঊত ও অন্যরা।

[5]. তাখরীজুল আহাদীছি ফাযাইলিশ শাম ওয়া দিমাশক, হা/৮। তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। দেখুন : সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৯৪।

[6]. বুখারী, হা/৩৩০১; মুসলিম, হা/৮৫; মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৫৭৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৭৪; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হা/৬৩৪০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হা/৪০০৩, আরও অনেক গ্রন্থে।

[7]. ১/৩৫২।

[8]. লিসানুল আরব, ১৪/৪৫।

[9]. প্রাগুক্ত।

[10]. মু‘জামুল বুলদান, ৫/২৬৫; লিসানুল আরব, ১৪/৪৭। বিস্তারিত দেখুন : শায়েখ মুফতী মুবাশ্বির আহমাদ রববানী, আহকাম ওয়া মাসায়েল, পৃঃ ৬৯-৭৪।

Magazine