(খ) আল্লাহ আকারবিশিষ্ট বা সাকার :
আল্লাহর আকারের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি নিরসন : এটা অবশ্যই সঠিক কথা যে আল্লাহ কেমন এ প্রশ্নের জবাবে ‘নিরাকার’ বলা কুফরী হলেও আকারবিশিষ্ট বা সাকার বলা ভুল নয়। আল্লাহর আকারের ক্ষেত্রে তিন প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি/আক্বীদা লক্ষ্য করা যায়: (১) দেহবাদী (২) সংশয়বাদী (৩) ছহীহ আক্বীদা।
(১) সাকার/দেহবাদী : তারা হিন্দু-বৌদ্ধদের মতোই মূর্তিপূজক। তারা মুর্দা মানুষ বা মাখলূকের মূর্তিপূজা করে। আর দেহবাদীরা চিরঞ্জীব আল্লাহর মূর্তি নির্ধারণ করে পূজা করে। কারণ, তাদের আল্লাহ না কি দাড়ি-গোঁফ গজানোর উপক্রম নওজোয়ান এর মতো। অনেক সূফীবাদীদের আক্বীদা বিশ্বাস এরূপ দেখা যায়। বাংলাদেশের দেওয়ানবাগী পীর ও আযহারউদ্দীন ছিদ্দীক্বী তথা মানিকগঞ্জের পীর ও তাদের মুরীদদের আক্বীদা এরূপ। দেওয়ানবাগী বলেছে, আরশে মুআল্লায় গেলে দেখা যাবে দেওয়ানবাগীই সেখানে বসে আছে- নাঊযুবিল্লাহ। এসব কথা লিখতে, বলতে ও পড়তে অন্তর কাঁপছে। কিন্তু তাদের কোনো ভয়-ভীতি নেই। কত বাতিল ও নির্লজ্জ হলে এমন কথা বলতে ও বিশ্বাস করতে পারে। আক্বীদার ক্ষেত্রে অজ্ঞ ও অস্পষ্ট ধারণাসম্পন্ন কিছু আলেম দেহবাদী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আল্লাহকে আকারবিশিষ্ট বা সাকার বলতে ভয় পায়। তাই তারা নিরাকারের পক্ষ অবলম্বন করে নিজেদের বিপদমুক্ত মনে করেন। আবার অনেকে আল্লাহর আকার কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর না জানার কারণেও নিরাকার বলে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। অথচ এক্ষেত্রে প্রশ্ন করা ও উত্তর দেওয়া উভয়টাই সমান অপরাধ। মারাত্মক ভুল হলো এমন প্রশ্ন করা যে, আল্লাহর আকার কেমন? এই প্রশ্ন করাও হারাম এবং উত্তর দেওয়া হারাম। এরূপ প্রশ্ন করার যেমন অনুমোদন ও দলীল কুরআন-সুন্নাহতে নেই, উত্তর দেওয়ারও অনুমতি কুরআন ও ছহীহ হাদীছে নেই।
(২) আল্লাহর সাকার প্রশ্নে সংশয়বাদী : এক্ষেত্রে অনেক ছহীহ আক্বীদার বাঘা বাঘা আলেমও জড়িয়ে গেছেন। তারা বলে থাকেন, আল্লাহ নিরাকার নন, সাকারও নন। কিন্তু এ ব্যাপারে সন্তোষজনক দলীল দেওয়া হয় না। এর কারণ আল্লাহর আকার নিরাকার এই শিরোনামে সালাফদের থেকে আক্বীদা বিষয়ক কোনো অধ্যায় তেমন চোখে পড়ে না বললেই চলে। যার জন্য অধিক সতর্কতার কারণে হয়তো মধ্যমপন্থা অবলম্বন হিসেবে تَوَقُّف ক্ষান্ত থাকার নীতি অবলম্বন করা হয়ে থাকতে পারে। আল্লাহ এইসব উদ্দেশ্যের কারণে তাদেরকে নেকীও দিতে পারেন।
আমার জানা মতে, এই মাসআলাটি ভারতউদ্ভূত ও ভারতসংশ্লিষ্ট আক্বীদাগত বিষয়। জাহমিয়া ও মু‘তাজিলারা আল্লাহর তানযীহের কারণে আল্লাহর ছিফাত অস্বীকার ও অপব্যাখ্যা করে। কিন্তু ভারতবর্ষের অনেক আলেম এটা করে আল্লাহ নিরাকার এইজন্য, আল্লাহকে সাকার বলা যাবে না। এর দ্বারা যদি এই উদ্দেশ্য পোষণ করা হয় যে, তিনি দেহবিশিষ্ট নন, তাহলে তো কিছুটা ঠিক আছে। কিন্তু সাকার বা আকারবিশিষ্টই বলা যাবে না এমন বিশ্বাস করা হলে তখন সেটা অবশ্যই আপত্তিকর হবে। ভারতবর্ষের আহলেহাদীছ তথা ছহীহ আক্বীদার আলেমগণ আল্লাহকে সাকার বলেই জানেন ও বিশ্বাস করেন, তারা কয়েকটা দলীলের সূত্র ধরে আল্লাহকে সাকার বলেন। যথা :
(ক) رُؤْيَةُ اللَّهِআল্লাহর দর্শন বা দীদার : কুরআন ও ছহীহ হাদীছে ভূরিভূরি দলীল পাওয়া যায় যে, মুমিনরা ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহকে দেখতে পাবে।[1]
আল্লাহ সাকার বা আকারবিশিষ্ট হওয়ার বা বলার অর্থ আল্লাহ দর্শন ও দীদারযোগ্য সত্তা। কারণ নিরাকার জিনিস কখনো দর্শন ও দীদারযোগ্য হয় না। উল্লেখ্য যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগের মুমিন ছাহাবীরাই শুধু নয়; বরং সকল মুমিন মুসলিমের একটা অদম্য আশা-আকাঙ্ক্ষা যে, আল্লাহকে দেখবে। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ দর্শন ও দেখা দিয়ে তাদের সে আশা পূর্ণ করবেন। এমনকি মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি শর্তযুক্তভাবে দেখা দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু শর্তে টিকেননি (আল-আ‘রাফ, ৭/১৪৩)।
(খ) لِقَاءُ اللَّهِআল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ : বহু আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের সাক্ষাতের লোভ দেখিয়েছেন। ‘সৎ আমল করো, আমার সাক্ষাৎ পাবে’ (আল-কাহফ, ১৮/১১০)। যারা কাফের, তারা আল্লাহর সাক্ষাৎ চায় না। এরকম আয়াত কুরআন মাজীদে প্রায় ১৫/১৬টি রয়েছে। আল্লাহর সাক্ষাৎ ও দীদার এ দুটি বিষয় প্রায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এ দুটি ছিফাতই আল্লাহর সাকার হওয়া অনিবার্য করে দেয়। আল্লাহর সাক্ষাৎ ও তাঁর দীদার দর্শন হচ্ছে জান্নাতের নেয়ামতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান নেয়ামত।
(গ) ذَاتُ اللَّهِআল্লাহর যাত বা সত্তা : আল্লাহর যাত বা সত্তার সাথে তার বহু ছিফাত জড়িত। যেমন- চেহারা, হাত, দুই হাত, পা, চক্ষু, গোছা ইত্যাদি ছিফাত। এগুলো ছহীহ হাদীছে উল্লেখিত হয়েছে। এ সবগুলো ছিফাতের নির্দেশনা হলো আল্লাহ সাকার, দীদার ও দর্শনযোগ্য সত্তা। ক্বিয়াস বা অনুমানভিত্তিক ছিফাত সাব্যস্ত করা যাবে না। যেমন- মুখ-নাক, কান, চুল, গলা, কপাল, পেট, পিঠ, ইত্যাদি।
(ঘ) صُورَةُ اللَّهِ আল্লাহর ছুরত : আল্লাহর যাতের আকার-আকৃতিতে ক্বিয়ামতের দিন মুমিন বান্দারা আল্লাহকে দেখতে পাবে। এ ব্যাপারে আল্লাহর صُورَةُ (আকার) উল্লেখসহ ছহীহ বুখারী বর্ণিত হাদীছ,
يَجْمَعُ اللهُ النَّاسَ فَيَقُولُ : مَنْ كَانَ يَعْبُدُ شَيْئًا فَلْيَتَّبِعْهُ، فَيَتْبَعُ مَنْ كَانَ يَعْبُدُ الشَّمْسَ، وَيَتْبَعُ مَنْ كَانَ يَعْبُدُ القَمَرَ، وَيَتْبَعُ مَنْ كَانَ يَعْبُدُ الطَّوَاغِيتَ، وَتَبْقَى هَذِهِ الأُمَّةُ فِيهَا مُنَافِقُوهَا، فَيَأْتِيهِمُ اللهُ فِي غَيْرِ الصُّورَةِ الَّتِي يَعْرِفُونَ، فَيَقُولُ: أَنَا رَبُّكُمْ، فَيَقُولُونَ: نَعُوذُ بِاللهِ مِنْكَ، هَذَا مَكَانُنَا حَتَّى يَأْتِيَنَا رَبُّنَا، فَإِذَا أَتَانَا رَبُّنَا عَرَفْنَاهُ، فَيَأْتِيهِمُ اللهُ فِي الصُّورَةِ (وفي رواية : في صورته) الَّتِي يَعْرِفُونَ فَيَقُولُ: أَنَا رَبُّكُمْ، فَيَقُولُونَ: أَنْتَ رَبُّنَا.
‘ক্বিয়ামতের দিন যখন সমস্ত মানুষকে একত্রিত করা হবে, বলা হবে- যে যার ইবাদত করতে, তার অনুসরণ করো। ফলে, যারা সূর্যের পূজা করত, তারা সূর্যের অনুসরণ করবে। আর যারা চন্দ্রের পূজা করত, তারা চন্দ্রের অনুসরণ করবে। যারা ত্বাগূতসমূহের ইবাদত করত, তারা তাদের অনুসরণ করবে। অতঃপর আল্লাহর ইবাদতকারীরা অবশিষ্ট থাকবে। তাদের মধ্যে মুনাফেক্বরাও থাকবে। আল্লাহ তাআলা স্বীয় আকৃতি ব্যতীত অন্য আকৃতিতে তাদের নিকট আসবেন, যা তারা চিনে না। অতঃপর বলবেন, ‘আমি তোমাদের প্রতিপালক’। মুমিনগণ বলবেন, আপনার থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আমরা এখানেই অবস্থান করব, আমাদের প্রতিপালক না আসা পর্যন্ত। যখন আমাদের রব আসবেন, তখন আমরা তাঁকে চিনে নিব। অতঃপর আল্লাহ তাঁর স্বীয় আকৃতিতে আসবেন, যেটা তাদের নিকট পরিচিত। অতঃপর বলবেন, ‘আমি তোমাদের প্রতিপালক’। তারা বলবে, হ্যাঁ, আপনি আমাদের প্রতিপালক’।[2]
আল্লাহর আকার ও নিরাকার বিষয়ে ব্যাকরণ : এ ব্যাপারে ব্যাকরণ হচ্ছে সূরা আশ-শূরার ১১ নং আয়াতের শেষাংশ।
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘তাঁর (আল্লাহর) সাদৃশ্য কিছুই নেই অথচ তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’। এই আয়াতাংশের দুটি ভাগ রয়েছে। দ্বিতীয় অংশ গোপন করে শুধু প্রথমাংশ ‘আল্লাহর সদৃশ কিছুই নেই’ গ্রহণ করলে নিরাকারের দলীল হয়। আর উভয় অংশ গ্রহণ করলে আল্লাহ সাকার সাব্যস্ত হয়। তবে আল্লাহর আকারের মতো কারো আকার নেই, যেমনভাবে তাঁর শ্রবণের মতো কারো শ্রবণ নেই, তাঁর দর্শনের মতো কারো দর্শন নেই অর্থাৎ তাঁর আকার তাঁরই মতো।
চতুর্থ প্রশ্ন : ‘বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক কী?’
বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্কের বিষয় তাওহীদ ও ইবাদত এবং দ্বীন বলতে যা বুঝায়। মহান আল্লাহ বলেছেন,وَما خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আর আমি জিন ও মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছি শুধু আমার ইবাদতের জন্য’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৬৬)।
কবরের দ্বিতীয় প্রশ্ন ما دِينُك؟ ‘তোমার দ্বীন কী?’ দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো হাদীছে জিবরীলে উল্লিখিত হয়েছে। গোটা দ্বীন পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক সাব্যস্ত হয়। কমপক্ষে মৌলিক বিষয়গুলো অবশ্যই পালন করতে হবে।
কবরের তৃতীয় প্রশ্ন, مَنْ نَبِيُّكَ؟ ‘তোমার নবী কে?’ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে অবশ্যই তাঁর সঠিক পরিচয় ও হক্বসমূহ জানতে হবে ও আদায় করতে হবে এবং কেবল তাঁর দিয়ে যাওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী আল্লাহর ইবাদত করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, একজন মুসলিম হিসাবে প্রত্যেককে আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। কেননা আক্বীদা সঠিক না হলে আমল কাজে আসবে না। সঠিক আক্বীদার উপরই নির্ভর করে আমলের ক্ববূলিয়াত। যে রবেব ইবাদত করব তাকে চিনতে ভুল করলে পরকালে আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।
[1]. আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/২৩; ইউনুস, ১০/২৬, ‘যিয়াদাহ’-এর তাফসীরসহ; ছহীহ মুসলিম, ১৮১/২৯৭; তিরমিযী, হা/২৫৫২, ৩১০৫; ইবনু মাজাহ, হা/১৮৭; এছাড়াও আল্লাহর দীদার বিষয়ে আরও বহু হাদীছ রয়েছে— ছহীহ বুখারী, হা/৮০৬; আবূ দাঊদ, হা/৪৭৩০।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫৭৩, ৭৫৩৭, ৭৪৩৯।