কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আরাফার দিনের গুরুত্ব ও ফযীলত

আরাফার দিন অতি মর্যাদাসম্পন্ন এক দিন। যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখকে আরাফার দিন বলা হয়। এ দিনটি অন্যান্য ফযীলতপূর্ণ দিনের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ। দ্বীনে ইসলামের পূর্ণতা লাভ, বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিন। হাদীছে বলা হয়েছে, 

عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ، قَالَتِ اليَهُودُ لِعُمَرَ: إِنَّكُمْ تَقْرَءُونَ آيَةً لَوْ نَزَلَتْ فِينَا لاَتَّخَذْنَاهَا عِيدًا، فَقَالَ عُمَرُ: إِنِّي لَأَعْلَمُ حَيْثُ أُنْزِلَتْ، وَأَيْنَ أُنْزِلَتْ، وَأَيْنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ أُنْزِلَتْ: يَوْمَ عَرَفَةَ وَإِنَّا وَاللَّهِ بِعَرَفَةَ -قَالَ سُفْيَانُ: وَأَشُكُّ- كَانَ يَوْمَ الجُمُعَةِ أَمْ لاَ اليَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ.
ত্বারেক ইবনু শিহাব আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণিত আছে যে, ইয়াহূদীরা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলল, আপনারা এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করে থাকেন, যদি সেটি আমাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হতো তাহলে আমরা সে দিনটিকে ঈদ হিসাবে উদযাপন করতাম। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু এ কথা শুনে বললেন, আমি অবশ্যই জানি কখন তা অবতীর্ণ হয়েছে, কোথায় তা অবতীর্ণ হয়েছে, আর অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় ছিলেন। হ্যাঁ, সে দিনটি হলো আরাফার দিন। আল্লাহর শপথ! আমরা সে দিন আরাফার ময়দানে ছিলাম। আয়াতটি হলো,اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَاَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِىْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِيْنًا ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করেছি ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের জীবনবিধান হিসাবে মনোনীত করেছি’ (আল-মায়েদা, ৫/৩)।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু রজব আলাইহিস সালামসহ অনেক উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে, এ আয়াত নাযিলের পূর্বে মুসলিমগণ ফরয হিসাবে হজ্জ আদায় করেননি। তাই ফরয হিসাবে হজ্জ আদায় করার মাধ্যমে দ্বীনে ইসলামের পাঁচটি ভিত্তি মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো।
উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সূরা আল-মায়েদার এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে দুটি ঈদের দিনে। তা হলো জুমআর দিন ও আরাফার দিন।
এ দিন হলো ঈদের দিনসমূহের একটি দিন। আবূ উমামা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,يَوْمُ عَرَفَةَ وَيَوْمُ النَّحْرِ وَاَيَّامُ التَّشْرِيْقِ عِيْدُنَا اَهْلَ الاِسْلاَمِ وَهِىَ اَيَّامُ اَكْلٍ وَشُرْبٍ ‘আরাফার দিন, কুরবানীর দিন ও আইয়ামে তাশরীক (কুরবানীর পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া ও পান করার দিন’। ইতোপূর্বে আলোচিত উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, فَإِنَّهَا نَزَلَتْ فِى يَوْمِ عِيدٍ فِى يَوْمِ جُمُعَةٍ وَيَوْمِ عَرَفَةَ ‘সূরা আল-মায়েদার এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে দুটি ঈদের দিনে। তা হলো জুমআর দিন ও আরাফার দিন’।
উক্ত হাদীছ দুটি দ্বারা বুঝা যায় যে, আরাফার দিনকে ঈদের দিনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
আরাফার দিনে ছিয়াম পালন করা : এ দিনে ছিয়াম পালন করা অনেক ফযীলতপূর্ণ। আবূ ক্বাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ اَحْتَسِبُ عَلَى اللّٰهِ اَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِىْ قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِىْ بَعْدَهُ ‘আমি আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে আশা করি যে, তিনি আরাফার দিনের ছিয়ামের বিনিময়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।
মনে রাখতে হবে যে, আরাফার দিনে ছিয়াম তারাই রাখবেন, যারা হজ্জ পালনরত নন। যারা হজ্জ পালনরত, তারা আরাফার দিনে ছিয়াম পালন করবেন না।
আরাফার দিনে হজ্জ পালনরত ব্যক্তি রাসূলে কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুসরণ করেই সে দিনের ছিয়াম পরিত্যাগ করবেন। যেন তিনি আরাফাতে অবস্থানকালীন সময় বেশি বেশি করে যিকির, দু‘আসহ অন্যান্য আমলে তৎপর থাকতে পারেন।
কিন্তু এ দিনে আরাফার ময়দানে অবস্থানকারী হাজীগণ ছিয়াম পালন করবেন না। হাদীছে এসেছে-
عَنْ مَيْمُوْنَةَ أَنَّ النَّاسَ شَكُّوْا فِيْ صِيَامِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَرَفَةَ فَأَرْسَلَتُ اِلَيْهِ بِحِلَابٍ وَهُوَ وَاقِفٌ فِي الْمَوْقِفِ فَشَرِبَ مِنْهُ وَالنَّاسُ يَنْظُرُوْنَ‏.
মায়মূনা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, লোকজন আরাফার দিন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছিয়াম রাখা সম্পর্কে সন্দেহ করছিল। (তিনি বলেন,) তখন আমি তাঁর নিকটে কিছু দুধ পাঠালাম। এ সময় তিনি আরাফায় অবস্থানরত ছিলেন। তখনই তিনি সেই দুধ পান করলেন আর লোকজন তা দেখছিল’।
এ দিনে শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সকল হারাম ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মুসনাদে আহমাদে ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে যে, اِنَّ هٰذَا يَوْمٌ مَنْ مَلَكَ فِيْهِ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ غُفِرَ لَهُ ‘এ দিনে যে ব্যক্তি নিজ কান ও চোখের নিয়ন্ত্রণ করবে, তাকে ক্ষমা করা হবে’।
মনে রাখা দরকার যে, শরীরের অঙ্গসমূহকে হারাম ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে হেফাযত করা যেমন ছিয়ামের দাবি, তেমনি হজ্জেরও দাবি। কাজেই সর্বাবস্থায় এ দিনে এ বিষয়টির প্রতি যত্নবান হতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ বাস্তবায়ন ও নিষেধ পরিহার করতে হবে।
আরাফার দিনে অধিক পরিমাণে যিকির ও দু‘আ করা : নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সবচেয়ে উত্তম দু‘আ হলো আরাফার দিনের দু‘আ। আর সর্বশ্রেষ্ঠ কথা যা আমি বলি ও নবীগণ বলেছেন, তা হলো,
لاَ اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيْرٌ
‘আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোনো মা‘বূদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই, আর সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য এবং তিনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান’।
উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্দিল বার্র আলাইহিস সালাম বলেছেন, ‘এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আরাফার দিনের দু‘আ নিশ্চিতভাবে কবুল হবে। আর সর্বোত্তম যিকির হলো লা-ইলাহা ইল্লাললাহ’। ইমাম খাত্তাবী আলাইহিস সালাম বলেছেন, ‘এই হাদীছ দ্বারা বুঝা যায় যে, দু‘আ করার সাথে সাথে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা ও তাঁর মহত্ত্বের ঘোষণা দেওয়া উচিত’।
আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন : আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَا مِنْ يَوْمٍ اَكْثَرَ مِنْ اَنْ يُعْتِقَ اللّٰهُ فِيْهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَاِنَّهُ لَيَدْنُوْ ثُمَّ يُبَاهِىْ بِهِمُ الْمَلاَئِكَةَ فَيَقُوْلُ مَا اَرَادَ هٰؤُلاَءِ ‘আল্লাহ রব্বুল আলামীন আরাফার দিনে এত অধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যা অন্য কোনো দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন, অতঃপর তাদের নিয়ে ফেরেশতাগণের সামনে গর্ব করে বলেন, ‘তোমরা কি বলতে পারো, আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কী চায়?’
ইমাম নববী আলাইহিস সালাম বলেছেন, ‘এই হাদীছটি আরাফার দিনের ফযীলতের একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ। ইবনু আব্দিল বার আলাইহিস সালাম বলেছেন, ‘এ দিনে মুমিন বান্দারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। কেননা, আল্লাহ রব্বুল আলামীন গুনাহগারদের নিয়ে ফেরেশতাগণের সামনে গর্ব করেন না। কিন্তু তওবা করার মাধ্যমে ক্ষমাপ্রাপ্তির পরই তা সম্ভব’।
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,اِنَّ اللهَ يُبَاهِىْ بِاَهْلِ عَرَفَاتٍ اَهْلَ السَّمَاءِ فَيَقُوْلُ لَهُمْ : اُنْظُرُوْا اِلٰى عِبَادِىْ جَاءُوْنِىْ شُعْثًا غُبْرًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রব্বুল আলামীন আরাফায় অবস্থানরতদের নিয়ে আসমানবাসীদের সামনে গর্ব করেন। আল্লাহ তাদের বলেন, ‘আমার এ সকল বান্দাগণের দিকে চেয়ে দেখো! তারা এলোমেলো কেশ ও ধুলোয় ধূসরিত হয়ে আমার কাছে এসেছে’।
শেষকথা, আমাদের মুসলিম হিসাবে আরাফার গুরুত্ব বুঝে আরাফাকেন্দ্রিক আমলসমূহ সম্পাদনের মাধ্যেমে বিশেষ ফযীলত অর্জনে সচেষ্ট হওয়া উচিত। আল্লাহ যেন সেই তাওফীক্ব দান করেন- আমীন!

Magazine