কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আদ-দাওয়া ইলাল্লহ: এসো! আল্লাহর পথে...

ভূমিকা: আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর মনোনীত ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সহজ-সরল পথ ইসলাম। ইসলামের অপর নাম জ্ঞান। জ্ঞানার্জন ছাড়া আল্লাহর পথ সম্পর্কে জানা অসম্ভব। ইসলামের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে বহু ভাষায় গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যেমন ফাযায়েলে আমলের উপর অসংখ্য বই রয়েছে। মানুষ যখন শুধু ফাযায়েলে আমল পড়ে, তখন সে ইসলামের নির্দিষ্ট একটি অংশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে; ইসলামের জিহাদ বা রাজনীতি সম্পর্কে সে অজ্ঞ থাকে। ঠিক তেমনি মাদরাসাগুলোতে ফিক্বহী মাসআলা-মাসায়েলের আলোচনা বলতে পবিত্রতা ও ছালাত-কেন্দ্রিক আলোচনাতেই বেশি হয়। আবার যারা সঊদী আরব বা মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন, তাদের আলোচনা ও লেখনীতে আক্বীদার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়। আবার যারা ইসলামী রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাদের মুখে সবসময় ইসলামের রাজনৈতিক বিষয়টি প্রাধান্য পায়। আবার কেউ শুধু জিহাদের আয়াত ও হাদীছ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।

ফলত ইসলামের পূর্ণাঙ্গ চিত্র ধারণ করতে মানুষ ব্যর্থ হয়। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমাদের সামনে না থাকার কারণেই মূলত আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফেতনার ফাঁদে পা দিয়ে দিই। আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতভেদ তৈরি হয়। কেননা আমরা প্রত্যেকেই ইসলামকে নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজ নিজ জ্ঞান অনুযায়ী দেখার চেষ্টা করি। কেউই ইসলামকে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্রে দেখার চেষ্টা করি না।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের এমন একটি লেখনীর খুব প্রয়োজন, যেখানে সমগ্র ইসলামের সারমর্ম থাকবে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সার নির্যাস থাকবে। মানুষকে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা শিখিয়েছেন, সেই শিক্ষার মূল সারাংশ থাকবে। যাতে করে মানুষ ইসলামের পরিপূর্ণ চিত্রটা একবারে জানতে পারে। যা অতি বিস্তারিত হবে না আবার অতি সংক্ষিপ্ত হবে না। আল-হামদুলিল্লাহ দেরিতে হলেও আমরা আদ-দাওয়া ইলাল্লহ বা আল্লাহর পথে আহ্বান নামে সেই লেখা মাসিক আল-ইতিছামের পাঠকদের জন্য আরম্ভ করতে যাচ্ছি। আমরা দু‘আ করি মহান আল্লাহ যেন আমাদের এই ধারাবাহিক লেখনীতে বরকত দান করেন- আমীন!

ইসলাম কী?

سلم ‘সিলমুন’ শব্দমূল থেকে ইসলাম শব্দটি নির্গত, তার শাব্দিক অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা। আর ইসলাম শব্দের শাব্দিক অর্থ আত্মসমর্পণ করা। আত্মসমর্পণ দ্বারা উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করা। আর শান্তি-নিরাপত্তা দ্বারা উদ্দেশ্য দুনিয়াবী ও পরকালীন উভয় জগতে শান্তি ও নিরাপত্তা। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত হচ্ছে শান্তি ও নিরাপত্তা। জীবনে যদি শান্তিই না থাকে এবং জান ও মালের নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে অর্থসম্পদ সবকিছু মূল্যহীন হয়ে পড়ে। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় চাহিদা হচ্ছে জানমালের শান্তি ও নিরাপত্তা। আর সেই শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব— যদি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকল কিছুই মহান আল্লাহর দরবারে একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণ করে। ইসলামের সকল বিধিবিধানের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর সামনে একান্ত অনুগত করার মাধ্যমে মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইহকালে ও পরকালে নিরঙ্কুশ শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা।

আত্মসমর্পণ বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝার জন্য কুরআনে কারীমে যেখানে ইসলাম শব্দটি ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তার একটি উদাহরণ দেখি। মহান আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ - وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَاإِبْرَاهِيمُ - قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ

‘আর যখন তারা উভয়েই আত্মসমর্পণ করলেন এবং ইবরাহীম তার সন্তানকে যবেহ করার জন্য শুইয়ে দিলেন, তখন আমি আল্লাহ ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম! আপনার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন। আমরা এভাবেই ইহসানকারীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০৩-১০৫)

পিতা সন্তানকে কুরবানী করবেন। পিতা-পুত্র উভয়েই রাজী। কারও কোনো প্রশ্ন নেই। যবেহ করার জন্য পিতা প্রস্তুত। যবেহ হওয়ার জন্য সন্তান প্রস্তুত। পিতা-পুত্র উভয়ে এত বড় একটি অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য কোনো প্রশ্ন ছাড়াই রাজী হওয়ার একমাত্র কারণ তারা উভয়েই বিশ্বাস করেন এটি আল্লাহর আদেশ। আল্লাহর আদেশের সামনে এই ধরনের আত্মসমর্পণকে ইসলাম বলা হয়।

যাহোক, আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণের জন্য তাওহীদের বিশ্বাস জরুরী। যার মধ্যে তাওহীদের বিশ্বাস নেই, সে যতই বাহ্যিক অর্থে নিজেকে আল্লাহর আনুগত্যকারী হিসেবে প্রদর্শন করুক, সে আসলে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে পারেনি। সুতরাং আমাদের আলোচনায় সর্বাগ্রে স্থান পাবে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ব। তারপর আল্লাহর প্রেরিত রাসূলগণ ও তাদের আনীত কিতাবসমূহ, ফেরেশতাগণ, মৃত্যু ও পরকাল, ভাগ্যের লিখন ইত্যাদি বিষয় স্থান পাবে।

তাওহীদ কী ও কেন?

তাওহীদ শব্দের শাব্দিক অর্থ একত্ব। অর্থাৎ মহান আল্লাহর একত্ব। ইংরেজিতে বলা হয় Monotheism.

মহান আল্লাহর একত্ব দ্বারা উদ্দেশ্য সকল ক্ষেত্রে সকল অবস্থায় চিরন্তন ও চিরস্থায়ী একত্ব। যেমন মহান আল্লাহ রব বা প্রতিপালক হিসেবে একক। তিনি একাই সমগ্র পৃথিবী পরিচালনা করছেন। মহান আল্লাহ ইলাহ হিসেবে একক। তথা তিনিই একমাত্র ইবাদতের যোগ্য সত্তা; আর কেউ নয়। মহান আল্লাহ তাঁর নাম ও গুণাবলিতে একক। তথা তাঁর গুণের মতো কারও গুণ নেই। তাঁর নামের মতো কারও নাম হতে পারে না। এই তাওহীদই ইসলামের মূল বিশ্বাস। কেননা আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ একত্বে পরিপূর্ণ বিশ্বাস ছাড়া তাঁর সামনে পূর্ণ আত্মসমর্পণ কখনোই সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর তাওহীদে যত বেশি মযবূত বিশ্বাসী, সে নিজেকে আল্লাহর সিদ্ধান্তের সামনে তত বেশি আত্মসমর্পণ করতে পারবে। আর যত বেশি আল্লাহর সিদ্ধান্তের সামনে আত্মসমর্পণ করতে পারবে, সে তত বেশি মানসিকভাবে শক্তিশালী হতাশামুক্ত শান্তিময় জীবনযাপন করতে পারবে। পাশাপাশি সে পৃথিবীতে শক্তিশালী ও প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে আবির্ভূত হবে। যেমনটা ছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, দাঊদ ও সুলায়মান আলাইহিমাস সালাম এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অতএব, তাওহীদ হচ্ছে পৃথিবীর এমন এক মহাসত্য, যার মধ্যে মানবজাতির সকল সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। নিম্নে আমরা তাওহীদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করছি।

প্রতিপালক কে?

তাওহীদ ভালোভাবে বুঝতে হলে সবার আগে আমাদেরকে মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত বা প্রতিপালকত্ব বুঝতে হবে। প্রতিপালক শব্দের অর্থ হচ্ছে যিনি লালনপালন করেন। আর লালনপালন দ্বারা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কিছুই উদ্দেশ্য।

এই পৃথিবীতে আমাদের আগমন থেকে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই অমোঘ নিয়মের বাঁধনে আবদ্ধ। আমরা নিজ সিদ্ধান্তে কেউ এই পৃথিবীতে আসিনি। আমাদের কখন কোথায় কোন পরিবারে কীভাবে জন্ম হবে তার পুরোটাই আমাদের এবং আমাদের পিতা-মাতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পৃথিবীতে আগমনের পর অন্তত আড়াই তিন বছর পর্যন্ত আমরা পরিপূর্ণরূপে অন্যের করুণার উপর প্রতিপালিত হই। যখন থেকে আমরা বড় হই এবং নিজেরা খাওয়া ও চলা শিখি, তখনও আমরা এক অদৃশ্য শক্তির অমোঘ নিয়ন্ত্রণে থাকি। আমরা পৃথিবীতে যা কিছু খাই না কেন, তার সবকিছুই মাটি, পানি ও সূর্য থেকে শক্তি সঞ্চার করে থাকে। আমরা যদি গরু বা মুরগির গোশত খেয়ে শক্তি সঞ্চার করি, তাহলে গরু বা মুরগি সেই শক্তি সঞ্চার করেছে ঘাস-পাতাসহ অন্যান্য উদ্ভিদ ও খাদ্য গ্রহণ করে। আর সেই উদ্ভিদ ও খাদ্যদ্রব্যগুলো মাটি, পানি ও সূর্যের শক্তি থেকে শক্তি গ্রহণ করেছে। যেকোনো গাছকে যদি দীর্ঘদিন সূর্যের তাপ থেকে দূরে রাখা হয়, কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, তাহলে গাছটি একসময় মারা যাবে। ঠিক তেমনি যদি গাছটিতে দীর্ঘদিন পানি দেওয়া না হয় অথবা গাছের গোড়া থেকে মাটি সরিয়ে নেওয়া হয়, কিছুদিনের মধ্যে গাছটি মারা যাবে। তথা পৃথিবীতে শুধু আমাদের নয়; পৃথিবীর সকল প্রাণী ও জীবজন্তুর এমনকি সকল উদ্ভিদের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা সূর্যের আলো, পানি ও মাটির উপর। এই তিনটিই আমরা সরাসরি প্রাকৃতিক উৎস থেকে গ্রহণ করে থাকি। যার উপর পৃথিবীর কোনো শক্তির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শুধু তাই নয়, আমরা বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন গ্রহণ করি, সেটিও সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমনকি আমাদের শরীর যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজ করে থাকি, সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাজ করে থাকে। যেমন আমরা যদি প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করি, আমাদের রক্তে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ বা চিনির পরিমাণ বেড়ে যাবে। আমরা দৈনিক শরীরে যে পরিমাণ ক্যালরি পাঠাই, সে পরিমাণ ক্যালরি যদি খরচ না করি, তাহলে সেগুলো ফ্যাট হিসেবে আমাদের শরীরে জমা হয়। ধীরে ধীরে ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার ইত্যাদি রোগ বাসা বাঁধে। লিভারের রক্ত শোধন কাজ, কিডনির পানি শোধন কাজ এবং ফুসফুসের শ্বাসগ্রহণ ও প্রদানের কাজের নিয়মাবলি সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা কখনোই এই অঙ্গগুলোকে নিজের ইচ্ছামতো কাজে লাগাতে পারব না। যেমন কার্ব বা শর্করা খেয়ে রক্তকে বলতে পারব না—তুমি এটিকে পরিপূর্ণ প্রোটিন হিসেবে গ্রহণ করো। প্রোটিন খেয়ে বলতে পারব না—তুমি এটিকে শর্করা হিসেবে গ্রহণ করো। সারাদিন শুয়েবসে থেকে লিভারকে বলতে পারব না—তুমি তোমার ফ্যাট গলিয়ে ফেলো। এক কথায় আমাদের স্বাধীনতা শুধু খাবার গ্রহণ পর্যন্ত। কোন খাবারটি গ্রহণ করব আর কোন খাবারটি গ্রহণ করব না এতটুকু। কিন্তু খাবার তৈরি হওয়া থেকে শুরু করে আমাদের পেটে যাওয়ার পর তার পাচন প্রক্রিয়া ও আমাদের সুস্থ ও বেঁচে থাকা পুরোটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এক অমোঘ অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় নিয়মে পরিচালিত হতে থাকে।

অদৃশ্যে থেকে যিনি এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনিই মূলত প্রকৃতপক্ষে প্রতিপালক। মহান আল্লাহ এই বিষয়গুলোকেই কুরআন মাজীদে বিভিন্ন সহজ উদাহরণ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। আসমান ও জমিন সৃষ্টির কথা বলেছেন। আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণের কথা বলেছেন। পাহাড়-পর্বত স্থাপন, নদীনালা প্রবাহিত করা ও গাছপালাকে অঙ্কুরোদগম ঘটানো এবং বাগানে পরিণত করা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের কথা বলেছেন।

উল্লিখিত বিষয়গুলো অতি সহজেই স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই অনুমেয় যে, এগুলো মানুষের পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। মানুষ খুব ভালোভাবেই জানে বিজ্ঞান যতই উন্নত হোক না কেন, তাদের পক্ষে পাহাড়-পর্বত স্থাপন করা, নদীনালা প্রবাহিত করা, আসমান ও যমীন সৃষ্টি করা, গাছপালা অঙ্কুরোদগম করানো সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। সৃষ্টি করা তো বহু দূরের কথা— এগুলোর অনেক কিছুর রহস্য ভেদ করাও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন মহাকাশ। মহাকাশ এত বিশাল যে, বিজ্ঞানীরা নিজেরাও জানে না তারা মহাকাশের কতটুকু অংশ আবিষ্কার করতে পেরেছে। একটি বিশাল দেয়ালের সাথে চোখ লাগিয়ে দেয়ালের যতটুকু অংশ দেখা যায়, তারা মহাকাশের ততটুকু অংশও আবিষ্কার করতে পেরেছে কিনা তা তারা জানে না। কিছুদিন পূর্বে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ যে ছবি পাঠিয়েছে, নাসার দাবি অনুযায়ী একটি বালুকণা আকাশের দিকে তুলে ধরলে আকাশের তুলনায় সেই বালুকণা যত ছোট দেখা যায়, বিশাল মহাকাশের ততটুকু অংশের ছবি হতে পারে এই ছবি।

বিজ্ঞানীরা মহাকাশ সম্পর্কে যতটুকু আবিষ্কার করেছেন, তার সারমর্ম হলো— আমরা একটি গ্রহে বসবাস করছি, যার নাম পৃথিবী। এই গ্রহটি শূন্যে ভাসমান, আর পৃথিবী থেকে যেদিকেই যাওয়া হোক না কেন, তা মহাশূন্যেরই অংশ। আমাদের এই পৃথিবীর আশপাশে রয়েছে আরও কিছু গ্রহ, যেমন- সূর্য, বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ইত্যাদি। এই গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান বিধায় একে সৌরজগৎ (Solছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামr Sysহাফিযাহুল্লাহআলাইহিস সালামm) বলা হয়। এই সৌরজগৎ ছাড়িয়ে গেলে আমরা আরও অনেক সৌরজগৎ দেখতে পাই, যেগুলো মিলিয়ে একটি গ্যালাক্সি তৈরি করে—যার নাম ‘মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি’।

এই গ্যালাক্সির বাইরেও রয়েছে অসংখ্য গ্যালাক্সি; প্রতিটি গ্যালাক্সিতে রয়েছে শত শত সৌরজগৎ, যাদের মাঝে অনেকগুলোতেই হয়তো আমাদের পৃথিবীর মতো গ্রহ রয়েছে। আল্লাহু আকবার! এত বিশাল এই মহাবিশ্ব নিশ্চয়ই কারও দ্বারা সৃষ্ট। সেই সৃষ্টিকর্তাই হলেন একমাত্র রব্বুল আলামীন।

তবে এসবই প্রথম আসমানের নিচের জগৎ। কেবল প্রথম আসমান পর্যন্ত এই বিশালতা যদি হয়, তাহলে সাত আসমান, কুরসী এবং আরশের বিশালতা কীরূপ হবে? রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

هَلْ تَدْرُونَ كَمْ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ؟ قَالُوا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: بَيْنَهُمَا مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ، وَمِنْ كُلِّ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ.

‘তোমরা কি জানো আকাশ ও জমিনের মধ্যবর্তী দূরত্ব কত?’ তারা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন’। তখন তিনি বললেন, ‘তাদের মাঝে দূরত্ব ৫০০ বছরের পথ। আর এক আকাশ থেকে অপর আকাশের দূরত্বও ৫০০ বছরের পথ’।[1]

এখানে ‘৫০০ বছরের পথ’ বলতে বোঝানো হয়েছে— সবচেয়ে দ্রুতগামী কোনো বাহনের গতিতে হাঁটলে তা অতিক্রম করতে সময় লাগবে ৫০০ বছর। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,مَا السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرَضُونَ السَّبْعُ فِي الْكُرْسِيِّ إِلَّا كَحَلْقَةٍ مُلْقَاةٍ بِأَرْضٍ فَلَاةٍ ‘সাত আসমান ও সাত জমিন একত্রিত করলেও তা আল্লাহর কুরসীর সামনে এমন, যেন একটি আংটি মরুভূমিতে পড়ে আছে’।[2] তিনি আরও বলেন,وَمَا الْكُرْسِيُّ فِي الْعَرْشِ إِلَّا كَحَلْقَةٍ مِنْ حَدِيدٍ أُلْقِيَتْ بَيْنَ فَلَاةٍ مِنَ الْأَرْضِ ‘আর কুরসী আল্লাহর আরশের সামনে এমন, যেন একটি লোহার আংটি বিশাল মরুভূমিতে পড়ে আছে’।[3]

তাহলে কল্পনা করুন, মানুষ এখনো শুধু প্রথম আসমানের নিচের মহাশূন্যের সামান্য অংশ আবিষ্কার করতে পেরেছে, যার তুলনায় সব আসমান ও জমিন আল্লাহর কুরসীর সামনে একটি আংটির মতো। আর কুরসীও আল্লাহর আরশের সামনে তেমনই একটি ক্ষুদ্র বস্তু।

সারসংক্ষেপ: সার্বিকভাবে বলা যায়— এই মহাবিশ্ব, মহাশূন্য, জীবজগৎ, উদ্ভিদ, গ্রহ-নক্ষত্র, সবকিছুই নির্দিষ্ট ও অনতিক্রমযোগ্য নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। এ নিয়মগুলো কারও দ্বারা নির্ধারিত—যিনি সর্বশক্তিমান, সবকিছুর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকারী। তাঁকেই বলা হয়, ‘রাব্বুল আলামীন’।

আর এই সত্তাকে তাঁর রুবূবিয়্যাত তথা পালনকারীরূপে একক স্বীকৃতি দেওয়ার নামই হলো, তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ।

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বিএ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।


[1]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭২৩; তিরমিযী, হা/৩৩২০; ছহীহুল জামে‘, হা/২১৯৮।

[2]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১০৯।

[3]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১০৯।

Magazine