আমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা তথা মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রধান দু’টি উৎসব রয়েছে, ঈদুল ফিত্বর ও ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিত্বর রামাযানের এক মাস ছিয়াম সাধনা শেষে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে উদযাপিত হয়। আর ঈদুল আযহা যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে হয়। মূলত পশু কুরবানীর পটভূমিতেই এই ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়। এই পশু কুরবানীর জন্য ইসলামে গরু, ছাগল, খাসি, পাঁঠা, ভেড়া, দুম্বা, উট, মহিষ ইত্যাদি জন্তু দিয়ে যবেহ ও কুরবানীর বিধান রয়েছে। তাই এই কুরবানীর পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশে এবং অমুসলিম দেশে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় কুরবানীর পশুর হাট আমরা দেখতে পাই। বাংলায় একে কুরবানীর হাট, উর্দূ ও হিন্দিতে কুরবানী মান্ডী, আরবীতে সূক্ব আল-আযাহী বলে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কুরবানীর পশুর হাট দেখা যায়। ঢাকায় কুরবানীর পশুর হাটের ইতিহাস অনেক পুরনো। মোঘল ও ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকায় রহমতগঞ্জ, গাবতলীসহ পাঁচটি এলাকায় কুরবানীর পশুর হাট বসত। তখন লোকসংখ্যা কম ছিল। পরে ১৯৪৭ এর পরে পাকিস্তান আমলে ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আস্তে আস্তে কুরবানীর পশুর হাটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এখন বর্তমানে ঢাকায় কুরবানীর পশুর হাটের সংখ্যা শতাধিক। ১৯৪৭ এর আগে পুরান ঢাকায় গেন্ডারিয়া, ধোলাইখাল, নয়াবাজার এসব এলাকায় কুরবানীর পশুর হাট ছিল না। পরে এসব এলাকায় কুরবানীর পশুর হাট বসেছে। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর ইত্যাদি জেলায় কুরবানীর পশুর হাটের অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একেক কুরবানীর হাটের কার্যক্রম ভিন্ন ভিন্ন দিনে শুরু হয়। অনেক হাট যিলহজ্জ মাসের চাঁদ উঠার দুই-তিন সপ্তাহ আগেই শুরু হয়, আবার অনেক হাট যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার দুই-তিন দিন আগেই শুরু হয়। আবার অনেক হাট যিলহজ্জ মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়। মধ্যরাতে বিভিন্ন জাতের দেশী, বিদেশী কুরবানীর পশু হাটে আসতে থাকে।
তবে কুরবানীর হাটের ক্রেতাদের উপস্থিতিটা যিলহজ্জ মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়। যারা কুরবানীর হাটে গরু-ছাগল সরবরাহ করে বিক্রি করেন, তাদেরকে ব্যাপারী বলে। হাটে ক্রেতা সমাগম দেখা যায় ঈদুল আযহার চার/পাঁচ দিন আগে থেকে। কুরবানীর হাটের প্রচারণার জন্য ঈদের ১৫ দিন আগে থেকে মাইকিং ও পোস্টারিং শুরু হয়। ‘হাট হাট হাট, এক বিরাট কুরবানীর হাট’ এই বাক্যে প্রচারণা চলে। পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, ইরান, ইরাক, সঊদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, লেবানন, ইয়ামান, জর্ডান, তুরস্ক, ফিলিস্তীন, সিরিয়া, মিশর, আলজেরিয়া, মরক্কো, আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম দেশে কুরবানীর হাট দেখা যায়। বাংলাদেশের ঢাকায় গেন্ডারিয়া-ধোলাইখাল হাট, নয়াবাজার-রহমতগঞ্জ হাট, মতিঝিলের আরামবাগে উটের হাট, রাজারবাগে সুন্নতী জামে মসজিদ সংলগ্ন এলাকার হাট, মেরাদিয়া হাট, গাবতলী হাট, কেরানিগঞ্জ, হাজারীবাগ, ঠাটারিবাজার হাট ইত্যাদি হলো ঢাকার জনপ্রিয় কুরবানীর হাট।
প্রতিটি কুরবানীর পশুর হাটে বেচাকেনা জমজমাট হয়ে উঠে। গত ৬-৭ বছর আগে ই-কমার্স এর মাধ্যমে অনলাইনে কুরবানীর পশু ক্রয়েরও ব্যবস্থা হয়েছে। তবে কুরবানীর হাট সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগেরও শেষ নেই। কয়েকবছর আগে অনেক হাটে মাইকে লাউডস্পিকারে গানবাজনা ও মিউজিকসহ বিজ্ঞাপন বাজানোর অভিযোগ এসেছে। এগুলো খুবই দুঃখজনক। গত ২০১৬ সালে গেন্ডারিয়ার কুরবানীর হাটসহ কয়েকটা হাটে এভাবে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য মাইকে মিউজিকসহ গান বাজানোর অভিযোগ এসেছিল।[1] এখন প্রতি বছর প্রায় হাটে তা পরিলক্ষিত হয়। পাশাপাশি ঈদের আগে দিন যত ঘনিয়ে আসে ততই পশুর দাম বাড়তে থাকে। যা খুবই দুঃখজনক। উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে কুরবানীর হাটে মিউজিকসহ গান-বাজনা ও অসাধু পন্থা অবলম্বন করা অন্যায় এবং পবিত্রতা নষ্টের শামিল।
কুরবানীর হাটে করণীয়, বর্জনীয় ও পরামর্শ :
(১) কুরবানীর হাটে ছালাতের স্থান রাখা উচিত।
(২) দেশের সকল কুরবানীর পশুর হাটে ক্রেতা আকর্ষণ বা এ জাতীয় অজুহাতে মাইকে বিজ্ঞাপন প্রচারের আড়ালে গান-বাজনা থেকেও বিরত থাকা উচিত।
(৩) তাক্বওয়ার জন্য মহিলাদের কুরবানীর পশুর হাটে যাওয়া থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
(৪) চোর, ডাকাত, চাঁদাবাজ, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টির প্রতিহত করার জন্য কুরবানীর পশুর হাটের সকল ইজারাদার ও বিক্রেতাদের সজাগ হওয়া উচিত।
(৫) অনলাইনে ওয়েবসাইটে কুরবানীর পশু ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং এদের কর্মকর্তাদের নযরদারি রাখা উচিত।
(৬) কুরবানীর পশুর হাটে তাক্বওয়া রক্ষার্থে অযথা ছবি তোলা, ভিডিও রেকর্ড করা থেকে বিরত থাকা।
(৭) কুরবানীর পশুর হাট ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে হাত ধোয়ার কলের ব্যবস্থা ও এটিএম বুথ বসানো।
(৮) প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া তথা সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, নিউজপোর্টাল, ওয়েবসাইট ও ব্লগসাইটগুলোতে নযরদারি রাখা উচিত যেন কুরবানীর হাট, ঈদুল আযহা ও কুরবানী নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি বন্ধ হয়।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
শেখ আহসান উদ্দীন
সূত্রাপুর, ঢাকা।
[1]. বাংলা ট্রিবিউন।