কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতি

post title will place here

জাহেলী যুগের মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতি। তারা এ রোগে চরমভাবে আক্রান্ত ছিল। গোত্রের একজন কোনো অন্যায় কাজ করলে গোত্রের সকলে ওই কাজে চোখ বন্ধ করে ধাবিত হতো। যেমন- একটি উদাহরণ দেই, বাসুস যুদ্ধে ৭০ হাজার মানুষ হতাহত হয়। এই যুদ্ধটি ৪০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ঠুনকো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বানূ বকর গোত্রের কালেব নামক এক ব্যক্তি তার চারণভূমিতে কারও পশুচারণের অনুমতি নেই বলে ঘোষণা দেয়। ঘটনাক্রমে বানূ তাগলীবের হাসসাম উক্ত ঘোষণা সম্পর্কে অবগত ছিল না। সে তার উট উক্ত চারণভূমিতে ছেড়ে দেয়। এক মহিলা এই চারণভূমিটা দেখাশোনা করত। মহিলাটি উটের স্তন কেটে দেয়। দিন শেষে উটটি যখন মনিব হাসসামের কাছে পৌঁছে, তখন সে উটের এই অবস্থা দেখে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হয়। ফলে হাসসাম ও কালেবের গোত্র বানূ বকর ও বানূ তাগলীব নিজ নিজ গোত্রের লোকের সাহায্যে অগ্রসর হয় এবং উভয় গোত্রের মধ্যে এক ভীষণ যুদ্ধ বেঁধে যায়। ক্রমান্বয়ে আরবের অন্যান্য গোত্রও একে অন্যের সমর্থনে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উভয় পক্ষ পরস্পর লুটতরাজ, মারামারি, কাটাকাটি ইত্যাদি করতে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ ৪০ বছর পর্যন্ত বংশানুক্রমে প্রায় ৭০ হাজার লোক হতাহতের পর ৫২৫ খ্রিষ্টাব্দে হীরার সর্দার তৃতীয় মুনযিরের প্রচেষ্টায় উভয় পক্ষ এই যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়।[1]

সুধী পাঠক! দেখলেন, জাহেলী যুগের মানুষ কতটা গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতির রোগে আক্রান্ত ছিল। অথচ উচিত ছিল বিষয়টা খতিয়ে দেখে এর একটা সুরাহা করা, কিন্তু তা না করে সবাই গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতির মোহে পড়ে অন্ধের ন্যায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের বর্তমান যুগে জাহেলী যুগের মতো গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়ে থাকে। আপনি মনে করছেন, জাহেলী যুগের মানুষের মাঝে এই রোগ বিদ্যমান ছিল। আপনাকে এখন দেখিয়ে দিব কীভাবে আমরা স্বজনপ্রীতির জালে আবদ্ধ। আপনি একা একা আনমনে হাঁটছেন। মনটা ভীষণ ফুরফুরে। হঠাৎ একটা উঁচু আওয়াজ শুনতে পেলেন। স্বরটা খুবই পরিচিত লাগছে। আপনি দেখতে পেলেন আপনার চাচাতো ভাই ও আরেকজন ছেলে মারামারি লেগেছে। এজন্যই আপনার চাচাতো ভাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে ডাকছে। ঘটনাস্থলে আপনি গিয়েই বলা নেই, কওয়া নেই আপনার চাচাতো ভাইয়ের সাথে যে মারামারি লেগেছে তাকে কষে কয়েকটি থাপ্পড় দিয়ে দিলেন। এই যে আপনি জাহেলী যুগের মানুষের মতো কাজ করলেন! আপনি মারামারির কারণ জিজ্ঞেস করেছেন? না জেনে কেন মারলেন? আপনি কোনো এক দলকে সমর্থন করেন। এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আরেকজন আরেক দলকে সমর্থন করে, এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি কেন আপনার দলের সাফাই গাইতে গিয়ে ওই লোককে মারলেন। এটা কি গোত্রপ্রীতি নয়? এটা কি দলপ্রীতি নয়? জাহেলী যুগের মানুষ এমনটাই করত। দেশে কত মানুষ যে এভাবে মৃত্যুবরণ করছে! এর কারণে কত নারী যে বিধবা হচ্ছে! কত শিশু যে ইয়াতীম হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। একেক জন একেক দল করে। আপনি আপনার দলের সাফাই গাইতে গিয়ে কেন কুপিয়ে ওই লোককে হত্যা করলেন? কেন তার বাড়িঘর, দোকান পুড়িয়ে দিলেন? ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলছেন, খেলছেন তো খেলছেন। সহসাই আপনার দলের একজন আপনার বিপক্ষ দলের লোকের সাথে কথা কাটাকাটি লেগেছে। আপনি কিছু না শুনে অথবা না বুঝে কেন পেছন থেকে ওই ছেলেকে ধাক্কা দিলেন? মিছিলে যায়নি বিধায় কেন আটকে রেখে ওই ছেলেকে নির্যাতন করলেন? কেন তাকে রাস্তায় ফেলে রড দিয়ে পিটালেন? কিছুদিন আগে দেখলাম, এক ছেলে আর্জেন্টিনা দলকে সাপোর্ট করে, আরেক ছেলে ব্রাজিল দল সাপোর্ট করে। ঠুনকো একটি বিষয় নিয়ে দুজনের মাঝে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। এখান থেকে ঝগড়া ছড়িয়ে গেছে সারা গ্ৰাম জুড়ে। একজন আরেকজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করছে, কুকুরের মতো লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। এটা কি জাহেলী যুগের রীতি নয়? ছোট ভাই অন্যায় করে একজনকে মেরেছে। বড় ভাই তাকে কিছু না বলে উল্টো ওই ব্যক্তিকে বিশাল বাঁশ দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে। বেচারার মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। বড় ভাইয়ের উচিত ছিল বিষয়টা খতিয়ে দেখে সুন্দর ও সুষ্ঠু বিচার করা। তা না করে কী করেছে আপনি তো দেখলেন। এটা না করার জন্যই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ‘ন্যায়বিচার করতে কারো প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের প্ররোচিত না করে। ন্যায়বিচার করো। এটা তাক্বওয়ার নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তোমরা যা করো, তার খবর রাখেন’ (আল-মায়েদা, ৫/৮)

আমাদের দেশে একদল আরেক দলকে কীভাবে নির্দয়ভাবে মারে তা তো আপনি ভালো করেই জানেন। যে মারছে সেও জানে না কেন মারছে আর যে মার খাচ্ছে সেও জানে না কেন মার খাচ্ছে। যে মারছে সে নেতার কথা শুনে মারছে। এটা কি দলপ্রীতি নয়? আপনি তো জাহেলী যুগের মানুষের মতো কাজ করলেন! একবার কি ভেবেছেন? একবার কি চিন্তা করেছেন?

স্বজনপ্রীতির আরও চিত্র দেখুন- আপনি অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন, আপনার রেজাল্ট ভালো, সবকিছু ঠিকঠাক আছে; তথাপি আপনি চাকরি পাবেন না। কারণ আপনার মামু বা খালু নেই। যার মামু বা খালু আছে, সে পেছনের বেঞ্চের ছাত্র হলেও চাকরি পাবে। আপনি শুধু সার্টিফিকেট নিয়ে দিনভর পরীক্ষাই দিবেন। চাকরি নামের সোনার হরিণ আপনার কাছে ধরা দিবে না। চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে ঠিকই। কিন্তু কে কে চাকরি পাবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত। চাকরি পাবে অমুকের ভাগনে, অমুকের ভাতিজা, অমুকের শ্যালক, অমুকের ছেলে। আপনি যোগ্য হলেও চাকরি পাবেন না। কারণ আমরা যে স্বজনপ্রীতির রোগে আক্রান্ত! সারা দেশে একই অবস্থা! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরেই এই বেহাল অবস্থা। যোগ্য মানুষ চাকরি পাচ্ছে না। কারণ তার মামু বা খালু নেই আর অযোগ্যরা ঠিকই চাকরি পাচ্ছে। কারণ উপরে তার কেউ আছে। এই বিষয়টির কথাই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। এটাই ক্বিয়ামতের আলামত। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‎إِذَا ضُيِّعَتِ الأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ‏ قَالَ كَيْفَ إِضَاعَتُهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ‏ إِذَا أُسْنِدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ ‘যখন আমানত নষ্ট হয়ে যাবে, তখন ক্বিয়ামতের অপেক্ষা করবে। রাবী বলল, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমানত কীভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যখন কোনো দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করা হবে, তখনই ক্বিয়ামতের অপেক্ষা করবে’।[2]

জাহেলী যুগের এই স্বজনপ্রীতি, গোত্রপ্রীতি, দলপ্রীতি ও সংগঠনপ্রীতির রোগটি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে। আপনি চাকরির জন্য যাবেন আপনাকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কোন দল করেন? আপনি যদি তাদের দল না করেন অথবা তারা যেই মতাদর্শে বিশ্বাসী, আপনি সেই মতাদর্শে বিশ্বাসী না হন, তাহলে আপনার চাকরি হবে না। আপনি যত বড় যোগ্য ব্যক্তিই হোন না কেন। পক্ষান্তরে যদি তাদের দল করেন অথবা তাদের মতাদর্শ গ্ৰহণ করেন, তাহলে আপনার চাকরি হবে।

বিচারের ক্ষেত্রে যদি আপনি যান, তাহলে স্বজনপ্রীতি যে কোন পর্যায়ে গেছে তা দেখলে আপনার চোখ চড়কগাছ হবে। বিচারকের কোনো আত্মীয় কেউ অন্যায় করলে অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু বিচার পাওয়া যায় না। এখন তো গরিবরা সুষ্ঠু বিচারই পায় না। সব জায়গায় স্বজনপ্রীতির ছড়াছড়ি। হাদীছে স্বজনপ্রীতি দূর করার জন্য বলা আছে,

‎عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ قُرَيْشًا أَهَمَّتْهُمْ الْمَرْأَةُ الْمَخْزُومِيَّةُ الَّتِي سَرَقَتْ فَقَالُوا مَنْ يُكَلِّمُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَنْ يَجْتَرِئُ عَلَيْهِ إِلاَّ أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ حِبُّ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَلَّمَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَتَشْفَعُ فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللهِ ثُمَّ قَامَ فَخَطَبَ قَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا ضَلَّ مَنْ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ الضَّعِيفُ فِيهِمْ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَرَقَتْ لَقَطَعَ مُحَمَّدٌ يَدَهَا.

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, মাখযূমী গোত্রের এক মহিলার ব্যাপার কুরাইশ বংশের লোকদের খুব দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল, যে চুরি করেছিল। ছাহাবীগণ বললেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কে কথা বলতে পারবে? আর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয়ভাজন উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া এটা কেউ করতে পারবে না। তখন উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কথা বললেন। এতে তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি আল্লাহর শাস্তির বিধানের ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’ এরপর তিনি দাঁড়িয়ে খুৎবা দিলেন এবং বললেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয় তোমাদের আগের লোকেরা গুমরাহ হয়ে গিয়েছে। কারণ কোনো সম্মানী ব্যক্তি যখন চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত, তখন তার উপর শরীআতের শাস্তি ক্বায়েম করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ-এর কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই মুহাম্মাদ তার হাত কেটে দিবে’।[3]

আল্লাহ তাআলা আমাদের স্বজনপ্রীতির রোগ থেকে হেফাযত করুন- আমীন!


-সাঈদুর রহমান

* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. ইসলামের ইতিহাস, পৃ. ১২।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯৬।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৮৮।

Magazine