রামাযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো শেষ দশ রাত। মহিমান্বিত একটি রজনি লায়লাতুল ক্বদর। মহান আল্লাহর ভাষায় লায়লাতুল ক্বদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এই রাত্রিটি উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। একটি রাতের ইবাদত এক হাজার মাস বা প্রায় ৮৪ বছর ইবাদতের চেয়েও উত্তম। তাছাড়া এ রাতে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য নাযিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। তিনি বলেছেন,
﴿إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ - وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ - لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ - تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ - سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ﴾
‘নিশ্চয় আমি এটা (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনিতে। আর মহিমান্বিত রজনি সম্বন্ধে আপনি কী জানেন? মহিমান্বিত রজনি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ঐ রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরীল) অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজের জন্য তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময়, এই রাত ফজরের উদয় পর্যন্ত’ (আল-ক্বদর, ৯৭/১-৫)।
বিখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা ইবনু আবী হাতিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, আলী ইবনু উরওয়া রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু ইসরাঈলের চার জন সাধকের কথা বললেন যে, তাঁরা সুদীর্ঘ ৮০ বছর ধরে এমনভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করেছেন যে, ঐ সময় চোখের পলক ফেলার মতো সময়ও তাঁরা মহান আল্লাহর নাফরমানী করেননি। তাঁরা হলেন আইয়ূব, যাকারিয়া, হিযকীল ইবনুল আজূয ও ইউশা‘ ইবনু নূন। কথাগুলো শুনে ছাহাবায়ে কেরাম খুবই আশ্চর্যান্বিত হলেন। ফলে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জিবরীল আলাইহিস সালাম এলেন এবং বললেন, আপনার উম্মত ঐ সাধকদের ৮০ বছরের ইবাদতের কথা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হচ্ছে? তাই আল্লাহ তাআলা এর চেয়েও ভালো জিনিস আপনাদের জন্য নাযিল করেছেন। অতঃপর তিনি সূরা আল-ক্বদর তেলাওয়াত করলেন। যাতে বলা হয়েছে যে, লায়লাতুল ক্বদরে মাত্র একটি রাতের ইবাদত এক হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। আপনি এবং আপনার উম্মত যে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছিলেন, তার চেয়ে এটি অনেক উত্তম। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর এ সংবাদ শুনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ছাহাবায়ে কেরাম খুবই খুশী হন।[1]
লায়লাতুল ক্বদরের যে রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে :
রামাযানের ক্বদর রজনিতে আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ﴾ ‘নিশ্চয়ই আমি ক্বদর রজনিতে কুরআন অবতীর্ণ করেছি’ (আল-ক্বদর, ৯৭/১)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেছেন,﴿إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ﴾ ‘আমি এ (কিতাব) অবতীর্ণ করেছি বরকতপূর্ণ রজনিতে, বস্তুত আমি সতর্ককারী’ (আদ-দুখান, ৪৪/৩)।
কুরআনুল কারীম দ্বারাই এটা প্রমাণিত যে, এ রাত রামাযানুল মুবারাক মাসে রয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন,﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ﴾ ‘রামাযান মাস, যে মাসে বিশ্বমানবের জন্য পথপ্রদর্শন এবং সুপথের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং হক্ব ও বাতিলের প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)।
ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমাসহ প্রমুখ ছাহাবী থেকে বর্ণিত আছে যে, লায়লাতুল ক্বদরে সমগ্র কুরআন লাওহে মাহফূয থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর ঘটনা অনুযায়ী দীর্ঘ ২৩ বছরে ধীরে ধীরে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে।
এখানে লায়লাতুল মুবারাকা বা বরকতময় রজনি বলতে লায়লাতুল ক্বদরকে বুঝানো হয়েছে।
লায়লাতুল ক্বদরের ফযীলত :
লায়লাতুল ক্বদরের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ العَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ وَأَحْيَا لَيْلَهُ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ ‘যখন রামাযানের শেষ দশক আসত, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্রি জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন’।[2]
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِىْ رَمَضَانَ مَا لَا يَجْتَهِدُ فِىْ غَيْرِهِ وَفِىْ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْهُ مَا لَا يَجْتَهِدُ فِىْ غَيْرِهِ ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর ইবাদতের জন্য যত পরিশ্রম করতেন, অন্য কোনো মাসে তেমন পরিশ্রম করতেন না। অনুরূপভাবে রামাযানের শেষ দশকে যত পরিশ্রম করতেন, অন্য দিনগুলোতে তত পরিশ্রম করতেন না’।[3]
লায়লাতুল ক্বদর কবে?
হাদীছে ক্বদর রজনি নির্ধারিত করে দেওয়া হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট হাদীছগুলো থেকে বুঝা যায়, লায়লাতুল ক্বদর লাভের জন্য পুরো রামাযান, বিশেষ করে রামাযানের শেষ দশক, আরো বিশেষ করে বললে শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই শেষ দশকে লায়লাতুল ক্বদরের অন্বেষণে পূর্ণ মনোযোগী এবং প্রস্তুত থাকা চাই।
আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُجَاوِرُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ وَيَقُولُ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ‘আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রামাযানের শেষ দশকে লায়লাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করো’।[4] অপর এক হাদীছে এসেছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা রামাযানের শেষ ১০ রাত্রিতে লায়লাতুল ক্বদর সন্ধান করবে। যদি কেউ একান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে অন্তত শেষ সাত রাতের ব্যাপারে যেন কোনোভাবেই দুর্বলতা প্রকাশ না করে’।[5] অন্য এক হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমাকে লায়লাতুল ক্বদর দেখানো হয়েছে। অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব, তোমরা শেষ ১০ রাতের বিজোড় রাতগুলোতে তা খোঁজ করো’।[6] আবূ যার গিফারী রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২৩ রামাযানের রাত্রিতে আমাদের নিয়ে ক্বিয়ামুল লায়ল করলেন রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। এরপর বললেন, তোমরা যা খুঁজছ তা মনে হয় সামনে। এরপর ২৫ রামাযানের রাতে মধ্যরাত পর্যন্ত ক্বিয়ামুল লায়ল করলেন। এরপর বললেন, তোমরা যা খুঁজছ তা বোধহয় সামনে। এরপর ২৭ রামাযানের রাতে তিনি নিজের স্ত্রীগণ এবং পরিবারের অন্য সদস্যগণ সবাইকে ডেকে আমাদেরকে নিয়ে প্রভাত পর্যন্ত জামাআতের সাথে ক্বিয়ামুল লায়ল করলেন, এমনকি আমরা ভয় পেয়ে গেলাম যে, সাহরী খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে না।[7]
শেষ দশকের আমল :
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে ইবাদত বাড়িয়ে দিতেন । আয়েশা ছিদ্দীক্বা রযিয়াল্লাহু আনহা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেষ দশকের আমলের বিবরণ দিয়ে বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، مَا لَا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য দিনগুলোর তুলনায় রামাযানের শেষ দশকে বেশি ইবাদত করতেন’।[8] অন্য আরেকটি হাদীছে এসেছে, আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ وَأَحْيَا لَيْلَهُ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ ‘যখন রামাযানের শেষ দশক আসত, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোমর কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্রি জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন’।[9]
লায়লাতুল ক্বদরে গুনাহ মাফ হয় :
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি রামাযানে ঈমানের সাথে ও ছওয়াব লাভের আশায় ছওম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াব লাভের আশায় লায়লাতুল ক্বদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[10]
এই রাত্রি হলো ইবাদতের রাত্রি। এ রাত্রি ধুমধাম করে খাওয়া-দাওয়া, আমোদ-প্রমোদের রাত্রি নয়। আসলে যে ব্যক্তি এ রাত্রের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, সেই সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।
লায়লাতুল ক্বদর থেকে বঞ্চিত হবেন না :
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে এত বড় খুশির খবর পাওয়ার পর এ রাতের ক্ষমা ও রহমত লাভের চেষ্টা না করা অনেক বড় বঞ্চনার বিষয়। আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রামাযান আসলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,إِنّ هَذَا الشّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلّهُ، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلّا مَحْرُومٌ ‘এই মহিমান্বিত মাস উপস্থিত। তাতে একটি রজনি রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হলো, সে যেন সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে’।[11]
যেভাবে লাভ করতে পারা যায় লায়লাতুল ক্বদরের ন্যূনতম ফযীলত :
মুমিনমাত্রই কর্তব্য হলো ক্বদর রজনির পূর্ণ কদর করা। অন্তত এ রাতে কোনোভাবে অমনোযোগী না থাকা। রামাযান মাসের ফরয ছালাতগুলো জামাআতের সাথে আদায় করার মাধ্যমে ক্বদর রজনির ন্যূনতম কদর হতে পারে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ صَلّى الْعِشَاءَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنّمَا قَامَ نِصْفَ اللَيْلِ، وَمَنْ صَلّى الصُبْحَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنّمَا صَلّى اللّيْلَ كُلّهُ ‘যে ব্যক্তি এশার ছালাত জামাআতে আদায় করল, সে যেন অর্ধ রজনি ক্বিয়াম করল। আর যে ব্যক্তি ফজরের ছালাতও জামাআতে আদায় করল, সে যেন পূর্ণ রাত ছালাত পড়ল’।[12]
তাই এ মাসে জামাআতে ছালাতের প্রতি সবিশেষ যত্নবান হওয়া জরুরী। তাহলে আশা করা যায় লায়লাতুল ক্বদরের ন্যূনতম ফযীলত থেকে মাহরূম হব না।
লায়লাতুল ক্বদরের দু‘আ :
লায়লাতুল ক্বদর যেহেতু বিশেষ রজনি, তাই এ রাতে বেশি বেশি দু‘আ করা উচিত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে দু‘আ করতে হবে। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি যদি ক্বদরের রাত পেয়ে যাই, তাহলে কী দু‘আ পাঠ করব? উত্তরে তিনি বললেন, এই দু‘আটি পাঠ করবে: اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعَفُ عَنِّي।[13]
লায়লাতুল ক্বদরের কিছু আলামত :
আবূ সাঈদ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
اعْتَكَفْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ مِنْ رَمَضَانَ فَخَرَجَ صَبِيحَةَ عِشْرِينَ فَخَطَبَنَا وَقَالَ إِنِّي أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أُنْسِيتُهَا أَوْ نُسِّيتُهَا فَالْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فِي الْوَتْرِ وَإِنِّي رَأَيْتُ أَنِّي أَسْجُدُ فِي مَاءٍ وَطِينٍ فَمَنْ كَانَ اعْتَكَفَ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلْيَرْجِعْ فَرَجَعْنَا وَمَا نَرَى فِي السَّمَاءِ قَزَعَةً فَجَاءَتْ سَحَابَةٌ فَمَطَرَتْ حَتَّى سَالَ سَقْفُ الْمَسْجِدِ وَكَانَ مِنْ جَرِيدِ النَّخْلِ وَأُقِيمَتْ الصَّلاَةُ فَرَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْجُدُ فِي الْمَاءِ وَالطِّينِ حَتَّى رَأَيْتُ أَثَرَ الطِّينِ فِي جَبْهَتِهِ.
আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে রামাযানের মধ্যম দশকে ই‘তিকাফ করি। তিনি ২০ তারিখের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, আমাকে লায়লাতুল ক্বদর (এর সঠিক তারিখ) দেখানো হয়েছিল, পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে তার সন্ধান করো। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ঐ রাতে) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ই‘তিকাফ করেছে সে যেন ফিরে আসে (মসজিদ হতে বের হয়ে না যায়)। আমরা সকলে ফিরে আসলাম (থেকে গেলাম)। আমরা আকাশে হালকা মেঘখণ্ডও দেখতে পাইনি। পরে মেঘ দেখা দিল ও এমন জোরে বৃষ্টি হলো যে, খেজুরের শাখায় তৈরি মসজিদের ছাদ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। ছালাত শুরু করা হলে আমি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কাদা-পানিতে সিজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই।[14]
এছাড়াও অন্যান্য হাদীছে লায়লাতুল ক্বদরে আলামত পাওয়া যায়। যেমন আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘...ঐ রাতের আলামত বা লক্ষণ হলো, রাত শেষে সকালে সূর্য উদিত হবে, তা উজ্জ্বল হবে। কিন্তু সে সময় (উদয়ের সময়) তার কোনো তীব্র আলোকরশ্মি থাকবে না (অর্থাৎ দিনের তুলনায় কিছুটা নিষ্প্রভ হবে)’।[15] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘লায়লাতুল ক্বদরের আলামত হচ্ছে, স্বচ্ছ রাত, যে রাতে চাঁদ উজ্জ্বল হবে, আবহাওয়ায় প্রশান্তি (সাকিনা) থাকবে। না ঠাণ্ডা, না গরম। সকাল পর্যন্ত (আকাশে) কোনো উল্কাপিণ্ড দেখা যাবে না। সে রাতের চাঁদের মতোই সূর্য উঠবে (তীব্র) আলোকরশ্মি ছাড়া। শয়তান সেই সময় বের হয় না’।[16] আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘লায়লাতুল ক্বদরের রাতটি হবে প্রফুল্লময়; না গরম, না ঠাণ্ডা। সেদিন সূর্য উঠবে লাল বর্ণে, তবে দুর্বল থাকবে’।[17] অন্য একটি হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘লায়লাতুল ক্বদর উজ্জ্বল একটি রাত; না গরম, না ঠাণ্ডা। সে রাতে কোনো উল্কাপিণ্ড দেখা যাবে না’।[18] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘লায়লাতুল ক্বদর রয়েছে সপ্তম অথবা নবম অথবা বিংশ, যে রাতে (পৃথিবীর) নুড়ি পাথরের চেয়ে বেশি সংখ্যক ফেরেশতাগণ জমিনে নেমে আসে’।[19]
রামাযান মাসে লায়লাতুল ক্বদরের রাতগুলো সকল মুসলিমের খুব যত্ন সহকারে পালন করা উচিত। কারণ রামাযানের শেষ দশকের রাতগুলো খুবই ফযীলতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। আর এই লায়লাতুল ক্বদরের রাতগুলো বছরে একবার করে আসে। এই রাতের মাধ্যমে হাজার মাসের চেয়েও বেশি ইবাদতের ছওয়াব পাওয়া যায়। তাই আমরা সবাই লায়লাতুল ক্বদরের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে জেনে তার উপর আমল করার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ।
মুহাম্মাদ গিয়াসুদ্দীন
শিবগঞ্জ, বগুড়া।
[1]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৪/৫৩১; তাফসীর দুররে মানছূর, ৬/৩৭১।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২৪; মিশকাত, হা/২০৯০।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৫২৯।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২০।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯১৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৫।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[7]. তিরমিযী, হা/৮০৬, হাদীছ ছহীহ; আবূ দাঊদ, হা/১৩৭৫; ইবনু খুযায়মা, হা/২২০৬।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭৫।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২৪; মিশকাত, হা/২০৯০।
[10]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৬০।
[11]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪৪, হাদীছ হাসান ছহীহ; নাসাঈ, হা/২১০৬।
[12]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫৬; মিশকাত, হা/৬৩০।
[13]. ইবনু মাজাহ, ৩৮৫০, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২০৯১।
[14]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১৬।
[15]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৬২।
[16]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮১৭।
[17]. ইবনু খুযায়মা, হা/২১৯৩।
[18]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮১৭।
[19]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৭৪৫; সিলসিলা ছহীহা, হা/২২০৫।