কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আল্লাহর দিকে দাওয়াত : দলীয় মোড়কে নাকি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে? (পর্ব-৯)

post title will place here

দলবাজদের আরেকটি স্পষ্ট বিধিনিষেধ হচ্ছে, ‘গোপনীয়তা’

‘অতএব, স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আহলুস সুন্নাহগণ অনুসরণকারী আর বিদ‘আতীরা নিত্য-নতুন বিষয় প্রকাশকারী, যেসব ব্যাপারে কোনো দলীল নেই। সেকারণে তারা তাদের বিদ‘আত লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আহলুস সুন্নাহগণ তাদের মাযহাব লুকিয়ে রাখেন না। তাদের বক্তব্য খোলাখুলি, তাদের মাযহাব প্রসিদ্ধ এবং শেষ পরিণতি তাদেরই’।[1]

ইমাম আহমাদ ‘আয-যুহদ’ কিতাবে (পৃ. ৪৮) এবং দারেমী তার ‘সুনানে’ (১/৯১) উমার ইবনে আব্দুল আযীয রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন,إِذَا رَأَيْتَ الْقَوْمَ يَتَنَاجَوْنَ فِي دِينِهِمْ دُونَ الْعَامَّةِ فَاعْلَمْ أَنَّهُمْ عَلَى تَأْسِيسِ ضَلَالَةٍ ‘যখন কোনো সম্প্রদায়কে দ্বীনী বিষয়ে জনগণকে বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতে দেখবেন, তখন জানবেন যে, তারা কোনো ভ্রষ্টতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছে’।

ইবনুল জাওযী তার ‘তালবীসু ইবলীস’ কিতাবে এই কথাটি উল্লেখ করেছেন। এর টীকাগ্রন্থ ‘আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস’-এর ৮৯ পৃষ্ঠায় আমি লিখেছি, ‘আল-হামদুলিল্লাহ আমাদের দ্বীন স্পষ্ট ও প্রকাশ্য, যেখানে কোনো গোপনীয়তা, অস্পষ্টতা নেই; নেই কোনো ষড়যন্ত্র বা গোপন ভেদ। সুতরাং দলবাজরা এগুলোর মধ্যে যা যা করছে, তার সবই কেবলই ভ্রষ্টতা। আমরা মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই’।

আপনি খুবই আশ্চর্য হয়ে যাবেন, যখন দেখবেন— তারা কুরআন বা সুন্নাহ থেকে তাদের গোপনীয়তার পক্ষে দলীল গ্রহণের অপচেষ্টা করছে। অথচ চূড়ান্ত গবেষণায় সেগুলো একটাও তাদের পক্ষে যায় না। যেমন— সূরা আল-আম্বিয়ার ৬২-৬৩ নম্বর আয়াতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক মূর্তি ভাঙার বিষয়টি গোপন রাখার কথা এসেছে। সূরা গাফেরের ২৮-২৯ নম্বর আয়াতে ফেরাউনের বংশের মুমিন ব্যক্তিদের ঈমান গোপন রাখার কথা এসেছে।

কুরআনে বর্ণিত এজাতীয় অন্যান্য ঘটনাও তারা দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। অনুরূপভাবে তারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাক্কী জীবনে দাওয়াতী কাজের গোপন পর্বকেও দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বাণীটিও দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে:اسْتَعِينُوا عَلَى إنْجَاحِ الْحَوَائِجِ بِالْكِتْمَانِ ‘তোমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফল করতে তোমাদের গোপনীয়তার সাহায্য নাও’।[2]

এসব দলীলের জবাবে বলা যেতে পারে, শেষেরটি ছাড়া বাকী সবগুলোই মুসলিমদের দুর্বল অবস্থা এবং ইসলামের কথা প্রকাশ্যে বলতে ভয়ের অবস্থার সাথে নির্দিষ্ট। তাছাড়া ‘সেগুলোর বেশিরভাগই বিশেষ অবস্থা মেনে চলার উপর নির্ভরশীল ছিল, যেগুলো তারা অহির মাধ্যমে পেয়েছিলেন’।[3] অথবা সেগুলো এমন অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যখন একজন দাঈর নিজেকে মুসলিম পরিচয় দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না।

শেষের হাদীছটির ব্যাপারে বলব, এটি এ স্থানের সাথে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ হাদীছটির শেষে একটি বাক্য রয়েছে, যা দলীল গ্রহণকারী বিলুপ্ত করে দিয়েছে। বাক্যটি হচ্ছে, فَإِنَّ كُلَّ ذِي نِعْمَةٍ مَحْسُودٌ ‘নেয়ামতপ্রাপ্ত প্রত্যেকটি ব্যক্তিই হিংসার শিকার’। বিলুপ্ত অংশটি দলীলের সঠিক দিকটি স্পষ্ট করে। অর্থাৎ এখানে গোপনীয়তা রক্ষা করা বলতে হিংসুকের হিংসার ভয়ে নেয়ামত গোপন করা এবং তদ্বিষয়ে আলোচনা না করার কথা বলা হয়েছে।

গোপনীয়তা আজ দুইভাবে উম্মতকে টুকরো টুকরো করে ছাড়ছে:

(১) বিভ্রান্ত আইন-কানুনের ধ্বজাধারী ভ্রষ্ট সরকার, যারা নিজেদের ক্ষমতার চেয়ার হারানোর ভয় পায়, তারা সেসব ব্যক্তিকে শক্ত হাতে দমন করে, যাদের ব্যাপারে তারা গোপনীয়তার আভাস পায়। আর যারা গোপনীয়তা চর্চা করে এবং বাস্তবায়ন করে, তাদেরকে তো দমন করেই। এভাবে সরকারের সাথে ফাটল তৈরি হয়।

(২) তারা মুসলিমদের মধ্যে গভীর গর্ত তৈরি করে, তাদের কাছ থেকে এমন কিছু লুকায়, যা লুকানো জায়েয নেই; এমন কিছু গোপন করে, যা গোপন করা জায়েয নেই। ফলে অন্তরগুলো অন্ধকার হয়ে যায়; হৃদয়গুলো হয়ে যায় কালো। এভাবে জনগণের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয়।

এই দুটি বিষয়ই দাঈদের এড়িয়ে চলা উচিত। কেননা ‘দাওয়াতের মূলনীতি কুরআন, সুন্নাহ ও মানুষের হস্তলিখিত অন্যান্য ইসলামী গ্রন্থে ঘোষিত ও প্রচারিত হয়েছে। ফলে প্রকাশ্য সেই দাওয়াতী কার্যক্রমকে প্রথম যুগের দাওয়াতী কার্যক্রমের গোপন স্তর হিসেবে উপস্থাপন করে ইসলামী আন্দোলনগুলোর গোপনীয়তা অবলম্বনের পেছনে কোনো কৈফিয়ত আছে বলে আমি মনে করি না। বরং বলা যায়, অনন্তকালের জন্য দাওয়াতের গোপন স্তর শেষ হয়ে গেছে। কারণ এই দ্বীন প্রকাশ্যরূপ লাভ করেছে, পূর্ণতা পেয়েছে এবং এর গোপনীয়তা শেষ হয়ে গেছে’।[4]

বর্তমান যুগের ইতিহাস তো বটেই, এমনকি অতীত ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলেও দেখা যায়, যেখানেই অস্পষ্টতা ও গোপনীয়তা আছে, সেখানেই শরী‘আতের নানান ধরনের বিরোধিতা রয়েছে। আর যেখানেই লুকিয়ে থাকা ও গোপনীয়তা অবলম্বনের ব্যাপার রয়েছে, সেখানেই ভীতি ভর করে এবং নিরাপত্তা চলে যায়।

ইসলাম তার স্পষ্টতা, স্বচ্ছতা ও নির্মলতা নিয়ে এসবকিছুর ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। ফলে কোনো বাস্তবতাকে লুকানোর, কোনো পথকে গোপন করার এবং কোনো কর্মপন্থাকে অস্পষ্ট করার সুযোগ এখানে নেই।

‘গোপনীয়তার দিকে আহ্বান কেবল দাওয়াতী কার্যক্রমের শত্রুদের মোকাবিলা করে ক্ষান্ত থাকে না এবং থেমে থাকে না ইসলামী দাওয়াতের দরজার নিকটে; বরং তা স্বার্থরক্ষার নামে বহু পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। ফলে গোপনীয়তার দিকে আহ্বান এখন বিশেষ সম্প্রীতি স্থাপনের এবং যোগ্য লোকদের নেতৃত্বের জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রবেশদ্বারে পরিণত হয়েছে। ইসলামী কার্যক্রমের শত্রুরা নয়; বরং ইসলামী কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্টরাই গোপনীয়তার দিকে আহ্বানের প্রথম বলির পাঠায় পরিণত হয়েছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, গোপন ও বাতেনী দাওয়াতী কার্যক্রমগুলো ইসলামের সাথে কত ষড়যন্ত্র যুক্ত করেছে এবং এসব দাওয়াতী কার্যক্রমের চিন্তাচেতনা ও আক্বীদার সাথে কত বিভ্রান্তি ও পদস্খলন যুক্ত হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, এসব গোপন দাওয়াতী কার্যক্রম নিজেদের অস্তিত্ব, গোপনীয়তা[5] ও নিরাপত্তা রক্ষার নামে অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ ধরে চলে, যার দরুন সেখানে সংশোধন, আলোচনা-পর্যালোচনা ও ফলাফল সংগ্রহের কোনো রাস্তা থাকে না’।[6]

আপনারা আমার সাথে আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একথাটি চিন্তা করুন:

قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا، ‌لَا ‌يَزِيغُ ‌عَنْهَا بَعْدِي إِلَّا هَالِكٌ

‘আমি তোমাদেরকে আলোকিত দ্বীনের উপর রেখে যাচ্ছি, যার রাত তার দিনের মতোই উজ্জ্বল। নিজেকে ধ্বংসকারীই কেবল এ দ্বীন ছেড়ে বিপথগামী হবে’।[7]

এটাই গন্তব্য, এটাই দলীলের মাধ্যম।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : বিভক্তি (اَلْاِفْتِرَاقُ) ও দলাদলি (اَلْحِزْبِيَّةُ)-এর মধ্যে সম্পর্ক

আলেমশ্রেণি ও ইলম অন্বেষণকারী ছাত্রবৃন্দের নিকট একথা অস্পষ্ট নয় যে, বিভক্তি ও দলাদলির মধ্যে ঘনিষ্ট ও মজবুত সম্পর্ক রয়েছে। সেজন্য যেখানেই দলাদলি আছে, সেখানেই বিভক্তি আছে। আর যেখানেই বিভক্তি ভর করেছে, সেখানেই দলাদলি গড়ে উঠেছে।

বিভক্তির জড় বহু পুরোনো। যখনই এর সামান্য আভাস নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেয়েছিলেন, তখনই তিনি এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ছহীহ বুখারীর ৩৫১৮, ৪৯০৫ ও ৪৯০৭ নম্বর হাদীছে জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ যুদ্ধে বহু সংখ্যক মুহাজির ছাহাবী অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুহাজিরগণের মধ্যে একজন অত্যন্ত আমুদে ছিলেন। তিনি কৌতুকচ্ছলে একজন আনছারীর কোমরে আঘাত করলেন। তাতে আনছারী ছাহাবী ভীষণ রেগে গেলেন এবং উভয়ে গোত্রীয় সহযোগিতার জন্য নিজ নিজ লোকদের ডাকলেন। আনছারী ছাহাবী বললেন, হে আনছারীগণ! মুহাজির ছাহাবী বললেন, হে মুহাজিরগণ! সাহায্যে এগিয়ে এসো। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথা শুনে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন, জাহেলী যুগের হাঁকডাক কেন?! তারপর বললেন, তাদের কী হয়েছে? অতঃপর মুহাজির কর্তৃক আনছারীর কোমরে আঘাতের কথা তাকে জানানো হলো।

রাবী বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, دَعُوهَا فَإِنَّهَا خَبِيثَةٌ ‘এ জাতীয় হাঁকডাক ত্যাগ করো, এ অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ’।

ইমাম মুসলিমও উল্লিখিত বর্ণনাকারী থেকে এমনটা বর্ণনা করেছেন (হা/২৫৮৪)

‘মুহাজির ও আনছার এই দু’টি নামই শারঈ নাম, কুরআন ও সুন্নাহ যে নাম দু’টি উল্লেখ করেছে। মহান আল্লাহ যেমন আগে ও এই কুরআনে আমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন, তেমনি এই নাম দু’টিও তিনিই রেখেছেন। মুহাজির ও আনছার নাম দু’টির দিকে কোনো ব্যক্তির সম্বন্ধিত হওয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর নিকটে উত্তম ও প্রশংসনীয়। পরিচয়দানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গোত্র ও অঞ্চলের দিকে সম্বন্ধিত হওয়ার মতো বৈধ বিষয় এটি নয়; অনুরূপভাবে কোনো বিদ‘আত বা পাপের দিকে সম্বন্ধিত হওয়ার মতো মাকরূহ বা হারামও এটি নয়।[8] এতদসত্ত্বেও উভয় দল যখন এটাকে পুঁজি করে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাপারটা অপছন্দ করেছেন এবং সেটাকে জাহেলী হাঁকডাক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন’।[9]

তারপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে সঠিক দিকটি তুলে ধরেন ‘এবং তাদেরকে মুসলিম, মুমিন ও আল্লাহর বান্দা হিসেবে একে অপরকে আহ্বানের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। বিভক্তি সৃষ্টিকারী শব্দ অমুক-তমুকের বিপরীতে এটাই মূলত সংযোগ স্থাপনকারী আহ্বান। আল্লাহই সাহায্যস্থল।’[10]

জাহেলী ডাকের সারসংক্ষেপ হচ্ছে, ‘যেমন কোনো গোত্রের দিকে আহ্বান, কোনো ব্যক্তির অন্ধভক্তির দিকে আহ্বান। কোনো মাযহাব, দল বা শায়খের প্রতি অন্ধভক্তিও অনুরূপই। স্রেফ খেয়ালখুশি ও অন্ধভক্তির কারণে কাউকে কারো উপর প্রাধান্য দেওয়াও অনুরূপ। এভাবে নিজে কোনো দিকে সম্বন্ধিত হয়ে সেদিকে (মানুষকে) ডাকা, এর উপর মিত্রতা বা শত্রুতা স্থাপন করা এবং এর উপর মানুষকে মাপা ইত্যাদি সবই জাহেলী ডাকের অন্তর্ভুক্ত’।[11]

সবগুলো আলোচনা থেকে স্পষ্ট হলো, ‘বিভেদ যে রকমেরই হোক না কেন, মতভেদ যার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠুক না কেন তা ইসলামের প্রকৃতির সাথে মিলে না এবং তা উপকার ও কল্যাণ বয়ে আনার চেয়ে মুসলিমদের জন্য ক্ষতি ও অকল্যাণই বেশি বয়ে আনে।﴿وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا﴾ “এতদুভয়ের উপকারের চেয়ে পাপই বড়” (আল-বাক্বারা, ২/২১৯)। এর মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই বেশি’।[12]

অতএব, ‘দ্বীনের মধ্যে বিভেদ ও বিভক্তি বলতে যেমন আক্বীদা ও শরী‘আতের ভেতরকার মতভেদ বুঝায়, তেমনি একই ধর্মাবলম্বীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিভিন্ন জামা‘আত ও দলের বিভক্তিও বুঝায়— এই বিভক্তি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তি যা-ই হোক না কেন। কুরআন-হাদীছের অনেক বক্তব্যের দাবিও কিন্তু তাই। মহান আল্লাহ বিবাদ ও মতভেদ করতে উন্মুক্তভাবে নিষেধ করেছেন এবং এটিকে মুসলিমদের দুর্বলতা তৈরি ও শক্তি খর্ব হওয়ার কারণ হিসেবে গণ্য করেছেন। তিনি বলেন, ﴿وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ﴾ ‘আর তোমরা পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করো না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে’ (আল-আনফাল, ৮/৪৬)। সকল প্রকার ঝগড়া বুঝানোর জন্য আল্লাহ এখানে ঝগড়া-বিবাদ কথাটিকে কোনো ধরনের লাগাম ছাড়াই উল্লেখ করেছেন।

তারপর মহান আল্লাহ কেবল ঝগড়া-বিবাদ করতে নিষেধ করেই ক্ষান্ত হননি; বরং মুসলিমদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য ঘটে গেলে ভুল শোধরানোর ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা ব্যয় করা আবশ্যক করেছেন। আবশ্যক করেছেন বিভেদ উঠাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বজায় রাখতে এবং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে একটি বিষয়ের উপর একমত হতে। তিনি তাদেরকে সুযোগ দেননি মতভেদের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দল গঠন করতে এবং পরস্পরবিরোধী মতামত পেশ করতে। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,

﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ ‌تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا﴾ 

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও আনুগত্য করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ করো, তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও— যদি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনে থাক। এটাই উত্তম এবং সুন্দরতম মর্মকথা’ (আন-নিসা, ৪/৫৯)

এখানে মহান আল্লাহ বিবাদ-বিসম্বাদ থেকে নিষেধ করে কোনো একটি দিক ছেড়ে কোনো একটি দিকের প্রতি একমত হওয়ার বিশেষ নির্দেশ দেননি; বরং আদেশ-নিষেধ উভয়কে উন্মুক্ত রেখেছেন। ফলে তা রাজনৈতিক, সামাজিক সবক্ষেত্রেই আবশ্যক, যেমনিভাবে আক্বীদা ও ইবাদতের ক্ষেত্রে আবশ্যক’।[13]

তাহলে বুঝা গেলো, বিভেদ ও দলাদলিকে মানুষের দৃষ্টিতে যতই ঠুনকো মনে হোক না কেন এবং চিন্তাবিদদের চোখে যতই তুচ্ছ মনে হোক না কেন এ দু’টি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

(চলবে)

মূল : আলী ইবনে হাসান আল-হালাবী আল-আছারী

অনুবাদ : আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
 বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
সঊদী আরব; অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।

[1]. আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস মিন তালবীসি ইবলীস, পৃ. ৪০।

[2]. ছহীহুল জামে‘, হা/৯৪৩।

[3]. মুহাম্মাদ আবু রহীম, ‘আস-সির্রিয়্যাহ ওয়া আছারুহা ফী আদাইল মাহাম আল-আসকারিয়্যাহ’, পৃ. ২৬।

[4]. গযবান, আল-মানহাজ আল-হারাকী লিস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ১/৩৩। যুহাইর সালেম রচিত ‘আছারাত ওয়া সাক্বাতাত’ বইয়ের ৩৩ পৃষ্ঠার সাথে তুলনা করে দেখতে পারেন।

[5]. যে কোনো কর্ম, যা গোপনীয়তা ও মাটির নিচে কাজ করার স্বভাবে ভূষিত, তা যদি নিজের মধ্যে যোগ্যতা ও বিচক্ষণতা আছে বলে মনে করে এবং তার প্রতিপক্ষ কখনই সেখানে সুঁই ঢুকাতে পারবে না বলে বিশ্বাস করে, তাহলে বুঝতে হবে— তা উদাসীনতায় বিভোর রয়েছে। অন্ধকার গোপন মাধ্যমগুলোই অদ্ভুত সব বীজ বপন করে থাকে এবং মাটির নিচে অন্ধকার কাজ করে থাকে, যেগুলোর প্রকৃতি অজ্ঞাত… (দ্র. খালেছ হালাবী, ফিন নাক্বদিয যাতি, পৃ. ৪১)

[6]. নাযারাত ফী মাসীরাতিল আমাল আল-ইসলামী, পৃ. ৩৮-৩৯।

[7]. হাদীছটি হাসান, ‘আল-আরবাঊনা হাদীছান ফিদ-দাওয়াতি ওয়াদ-দু‘আত’ বইয়ে আমি হাদীছটির তাখরীজ করেছি, হা/৬, দারু ইবনিল ক্বাইয়িম, দাম্মাম।

[8]. একথার মাধ্যমে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, যার বিস্তারিত বিবরণের জায়গা এটি নয়।

[9]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইয়িমাহ, ইক্বতিযাউছ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম, ১/২১১।

[10]. মাদারিজুস সালেকীন, ২/৩৭০।

[11]. ইবনুল ক্বাইয়িম-এর বক্তব্য থেকে, যা ‘তাইসীরুল আযীযিল হামীদ’ গ্রন্থকার ইবনুল ক্বাইয়িম থেকে উল্লেখ করেছেন, পৃ. ৫১৫।

[12]. আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ, পৃ. ৩৪।

[13]. আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ, পৃ. ৩৫-৩৬।

Magazine