কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মুমিনের পরিচয় ও তার গুণাবলি (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

(৭) মুমিনরা তাদের ছালাতসমূহের হেফাযত করে: মুমিনের আরেকটি গুণ হলো তাদের ছালাতসমূহের ব্যাপারে তারা যত্নবান হয়। ঈমান আনার পর সর্বপ্রথম ফরয ইবাদত হলো ছালাত। তাই তো যারা মুমিন, তারা ছালাতের হেফাযতকারী। মহান আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ ‘আর যারা নিজদের ছালাতসমূহ হেফাযত করে’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৯)। এমনকি ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার প্রথম হিসাব ছালাত সম্পর্কেই নেওয়া হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার ছালাতের হিসাব নেওয়া হবে। যদি ছালাত সঠিক হয়, তবে সে সফল হবে ও মুক্তি পাবে। আর যদি ছালাত বিনষ্ট হয়, তবে সে অকৃতকার্য ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।[1] ‘ছালাতসমূহের হেফাযত করা’ মানে যথাযথভাবে, সঠিক সময়ে নিয়মিত ছালাত আদায় করা (আন-নিসা, ৪/১০৩)[2] ছালাত ছাড়া ক্বিয়ামতের দিন মুক্তি পাওয়ার বিকল্প কোনো পথ নেই। তাই যথাযথভাবে ছালাতের হেফাযত করা মুমিনের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য; অন্যথা ক্বিয়ামতের দিন ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

(৮) মুমিনরা জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে: মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হলো তারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের জানমাল দিয়ে তাঁরই পথে সংগ্রাম করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন কেবল তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি। আর নিজেদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে, এরাই সত্যবাদী’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১৫)। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ ‘তোমরা জিহাদ করো মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের জানমাল ও যবান দ্বারা’।[3] কুরআনের প্রায় সর্বত্র জিহাদের বর্ণনায় আল্লাহ প্রথমে মালের কথা এনেছেন। কারণ জিহাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো মাল।

(৯) মুমিনরা প্রিয়নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে: মুমিনের আরেকটি গুণ হলো তারা দুনিয়ার সকল প্রিয় জিনিসের চেয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বেশি ভালোবাসে, এমনকি নিজেদের জীবনের চেয়েও। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় হব’।[4] এমনকি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবেসে তাঁর অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করা যায় (আলে ইমরান, ৩/৩১)

(১০) মুমিনরা একে অপরকে বিপদে সাহায্য করে, যুলম করে না: তারা পরস্পরে ভাই ভাই। তারা কাউকে কষ্ট দেয় না, কারও ক্ষতি করে না, কারও প্রতি যুলম-অত্যাচার করে না; বরং তারা পরস্পর পরস্পরকে বিপদ-মুছীবতে সাহায্য করে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে’।[5] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার উপর যুলম করে না এবং তাকে (যালিমের হাতে) সোপর্দ করে না। যে কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে নিয়োজিত থাকবে, আল্লাহ তার অভাব পূরণে নিয়োজিত থাকবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তাআলা ক্বিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন’।[6] এমনকি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম ভাইকে সাহায্য করতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে যালেম হোক অথবা মাযলূম’।[7] যালেম ভাইকে যুলম থেকে বিরত রাখতে এবং মাযলূম ভাইকে যালেমের হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে হবে। কেননা ক্বিয়ামতের দিন যুলম হবে অন্ধকার।[8] তাই যুলম নামক মারাত্মক ও ভয়াবহ অপরাধ থেকে মুমিনরা বেঁচে থাকে।

(১১) মুমিনরা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজে নিষেধ করে: সৎ ও কল্যাণকর কাজে আদেশ করা এবং অসৎ ও অকল্যাণকর কাজে বাধা দেওয়া মুমিনের একটি অনন্য গুণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুমিন পুরুষ ও নারীগণ পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে। তারা ছালাত ক্বায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এসব লোকদের প্রতি অচিরেই আল্লাহ অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আত-তাওবা, ৯/৭১)। এই আয়াতে মুমিন পুরুষ ও নারীর প্রধানতম গুণটি বর্ণনা করা হয়েছে আর তা হলো ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ’। এ কারণেই এই জাতির উদ্ভব হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি, তোমাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দিবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে’ (আলে ইমরান, ৩/১১০)

(১২) মুমিনরা একে অপরের দুঃখ-কষ্ট দূর করে, দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে: এক মুমিন আরেক মুমিনের জন্য ইমারত তুল্য, যার এক অংশ আরেক অংশকে সুদৃঢ় করে।[9] তাই তারা কেউ কাউকে দুঃখ-কষ্ট দেয় না আর কারও কাছে দোষ-ত্রুটি বলে বেড়ায় না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিন ব্যক্তির পার্থিব দুঃখ-কষ্টসমূহের মধ্যে একটি কষ্ট দূর করে দেবে, আল্লাহ সেই ব্যক্তি হতে তার ক্বিয়ামতের দুঃখ-কষ্টসমূহ হতে একটি কষ্ট দূরীভূত করবেন। যে ব্যক্তি কোনো নিঃস্ব ঋণগ্রস্তকে অবকাশ দিবে, আল্লাহ তার জন্য ইহকাল ও পরকালে সবকিছু সহজ করে দিবেন। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটিকে দুনিয়া ও আখেরাতে গোপন করবেন। আর আল্লাহ তাঁর বান্দার সহায় থাকেন যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে’।[10]

(১৩) মুমিনরা নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অপর ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করে: তারা নিজের জন্য ভালো জিনিস আর অন্যের জন্য খারাপ জিনিস পছন্দ করে না; বরং তারা নিজের জন্য যেটা, অপরের জন্যও সেটা পছন্দ করে। তারা পরস্পরের মাঝে ব্যবধান তৈরি করে না। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে’।[11]

(১৪) মুমিনরা আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করে: তারা শুধু আল্লাহকে ভয় করে। কোনো পীর-ফকির, ওলী-আউলিয়া বা মানুষের আনুগত্য করে না; বরং তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করে। কেননা আল্লাহ বলেন,فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং পরস্পরের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো’ (আল-আনফাল, ৮/১)। আনুগত্য সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো’ (আন-নিসা, ৪/৫৯)

(১৫) আল্লাহর নাম শুনলে মুমিনদের অন্তর ভয়ে কেঁপে উঠে, কুরআনের আয়াত শুনলে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং মুমিনরা আল্লাহর উপর ভরসা করে: তাদের সামনে যখন আল্লাহর আলোচনা করা হয়, তখন তাদের অন্তর আঁতকে উঠে; তাদের সামনে যখন আল্লাহ তাআলার আয়াত পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে। কেননা মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে’ (আল-আনফাল, ৮/২)

(১৬) মুমিনদের কাছে প্রতিবেশী মুমিন নিরাপদ থাকে: নিজ প্রতিবেশীকে যেকোনোভাবে কষ্ট দেওয়া কাবীরা গুনাহ। তাই তাদের অনিষ্ট থেকে সর্বদা প্রতিবেশী মুমিন নিরাপদ থাকে। কেননা যে ব্যক্তি নিজ প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়, সে সত্যিকারের মুমিন নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মুমিন নয়’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, ‘যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়’।[12] প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়ে জান্নাতে যাওয়া যাবে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لَا يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ مَنْ لَا يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ ‘সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়’।[13] নিজ প্রতিবেশীর প্রতি দয়াশীল হওয়া সত্যিকারের ঈমানের পরিচায়ক।

(১৭) মুমিনদের সকল কাজ ইখলাছে ভরপুর তথা আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে: তারা কাউকে ভালোবাসবে শুধু আল্লাহর জন্য এবং কাউকে ঘৃণা করবে তাও শুধু আল্লাহর জন্য। কাউকে দান করবে আল্লাহর জন্য এবং দান করা থেকে বিরত থাকবে আল্লাহরই জন্য। অর্থাৎ সকল কাজ হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য, এটা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتكْمل الْإِيمَان ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসল, আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করল, আল্লাহর জন্য কাউকে দান করল এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকল, সে ব্যক্তি নিজ ঈমানকে পূর্ণতা দান করল’।[14] এমনকি আল্লাহর জন্য পরস্পর ভালোবাসা ও শত্রুতা পোষণকারী দুজন ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন আরশের নিচে ছায়া পাবে।[15]

(১৮) মুমিনরা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবে: তারা মানুষের সাথে কথা-কাজ, আচার-ব্যবহারে উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করে। তারা কখনো নিন্দনীয় চরিত্রের অধিকারী হয় না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا ‘মুমিনদের মাঝে ঈমানে পরিপূর্ণ সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সর্বোত্তম’।[16] উত্তম চরিত্রের বিষয়টি মহান আল্লাহর প্রতি সঠিক ঈমানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সুতরাং যে মুসলিম ব্যক্তির হৃদয়ে ঈমান যত ভালো থাকবে, তার চরিত্র ও আচরণ ততই ভালো হবে এবং যে মুসলিম ব্যক্তির হৃদয়ে ঈমান যত খারাপ থাকবে, তার চরিত্র ও আচরণ ততই খারাপ হবে।

(১৯) মুমিনরা নিজেদেরকে সংশোধনের পাশাপাশি অপরকে সংশোধনকারী: তারা কেবল নিজেদের সংশোধনকেই যথেষ্ট মনে করে না, বরং আল্লাহ তাদেরকে যে শক্তি ও সামর্থ্য দিয়েছেন তা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে অন্যকেও সংশোধনে সচেষ্ট থাকে। প্রথমে তারা ভালো আচরণের মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা করে, অন্যথা কঠোরতা অবলম্বন করে। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ ‘তোমাদের মধ্যে যে অন্যায় দেখবে, সে যেন তা তার হাত দিয়ে বাধা দেয়। যদি হাত দিয়ে বাধা না দিতে পারে, তবে যেন মুখ দিয়ে বাধা দেয়। আর যদি মুখ দিয়ে বাধা না দিতে পারে, তবে যেন অন্তর দিয়ে বাধা দেয় আর এটি হলো দুর্বল ঈমানের পরিচয়’।[17] আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে আর তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো’ (আত-তাহরীম, ৬৬/৬)। যদি কারও অন্যায় প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি ও সামর্থ্য থাকে, তাহলে তা ব্যবহার করে অন্যায় থেকে বিরত রেখে সংশোধন করতে হবে আর এটি হলো মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

(২০) মুমিনরা সল বিপদে ধৈর্যধারণ করে: মুমিনের অন্যতম গুণ হলো তারা অনেক ধৈর্যশীল। এই দুনিয়া মুমিনদের সুখ ও শান্তির জায়গা নয়, তাদের চিরস্থায়ী শান্তির জায়গা জান্নাত। সেজন্য তাদেরকে এই পৃথিবীতে বিভিন্ন দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা এবং কাফেরের জন্য জান্নাত’।[18]

শুধু প্রকৃত মুমিনরাই এই ধৈর্য নামক পরীক্ষায় মহান আল্লাহর কাছে উত্তীর্ণ হয়। ধৈর্য তিন ধরনের হয়। যথা— (ক) ইবাদত বা আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্যধারণ, (খ) আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপাচার থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ এবং (গ) বিপদাপদের সময় ধৈর্যধারণ। ধৈর্যধারণের মাধ্যমে মুমিনরা আল্লাহর সাহায্য লাভ করে। আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৩)

এগুলো ছাড়াও মুমিনের আরও অনেক গুণাবলি রয়েছে, যা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনুল কারীম ও হাদীছের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন।

আপনি মুমিন কি-না, এটা বুঝবেন কীভাবে?

যদি কোনো নেক (সৎ) কাজ আপনাকে আনন্দ দেয় এবং খারাপ (অসৎ) কাজ পীড়া দেয়, তখন বুঝবেন আপনি মুমিন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, إِذَا سَرَّتْكَ حَسَنَتُكَ وَسَاءَتْكَ سَيِّئَتُكَ فَأَنْتَ مُؤْمِنٌ ‘যখন তোমাকে নেক (সৎ) কাজ আনন্দ দিবে ও খারাপ (অসৎ) কাজ পীড়া দিবে, তখন তুমি মুমিন’।[19]

উপসংহার:

প্রকৃতপক্ষে মুমিনরাই সফলকাম। মুমিন ছাড়া পরকালে কেউ মুক্তি পাবে না। দুনিয়াতে শান্তি ও পরকালে মুক্তি পেতে মুমিন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই পরিপূর্ণ মুমিন হতে হলে উপরিউক্ত গুণাবলি প্রত্যেক মুমিন দাবিদার ব্যক্তির মাঝে থাকা জরুরী। মহান আল্লাহ উক্ত গুণাবলি নিজেদের মাঝে ধারণ করার তাওফীক্ব দান করুন এবং মুমিন হিসেবে আমাদের মৃত্যু দান করুন- আমীন!

আবূ মাহদী মামুন বিন আব্দুল্লাহ

 অধ্যয়নরত, আক্বীদা ও দাওয়াহ বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. ইবনু মাজাহ, হা/১৪২৫।

[2]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৯৯।

[3]. আবূ দাঊদ, হা/২৫০৪, হাদীছ ছহীহ।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৯।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭০২৮; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৮।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/২২৮০।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২২৮১।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/২২৮৫।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/২২৮৪।

[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭০২৮; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৮।

[11]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৫।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০১৬।

[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৬।

[14]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬৮১; ছহীহুল জামে‘, হা/৫৯৬৫।

[15]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪২১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪২৭।

[16]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬৮২, হাসান ছহীহ।

[17]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৯।

[18]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৫৬; মিশকাত, হা/৫১৫৮।

[19]. সিলসিলা ছহীহা, হা/৫৫০; মিশকাত, হা/৪৫; আহমাদ, হা/২১৬৬২; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৩৯।

Magazine