আমরা মুসলিমরা পাশ্চাত্য মিডিয়ায় এতই বিভোর যে, সত্য উল্টে গিয়ে মিথ্যা হয়ে গেলেও আমরা সেটাকেই সত্য বলি। আজ কেবল একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করব, তা হচ্ছে বর্ণবাদ।
আমাদের অবস্থা হচ্ছে কাহিনী যা-ই হোক, দোষ মুসলিমদের। ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’–এর গল্পের বুধো মুসলিমরাই। আর এর মূল কারিগর পাশ্চাত্য মিডিয়া, আর এর অনুসারী (‘চামচা’ শব্দটা এক্ষেত্রে বেশি মানানসই হতো) এ দেশীয় মিডিয়া। বর্ণবাদের ছিটেফোঁটা না থেকেও মুসলিমরাই কালারড। আর পাশ্চাত্য হচ্ছে প্রগতিবাদী, সভ্য, সুশীল!!!
[ক]
বর্ণবাদ নিয়ে ২০০৫ বা ২০০৬ সালের সেরা কবিতা হিসেবে মনোনীত আফ্রিকার ছোট্ট এক ছেলের রচিত কবিতার কথা মনে পড়ছে। তার মূল বক্তব্য হচ্ছে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সকল সময়ে নানা পরিস্থিতিতেও আফ্রিকানরা কালোই থাকে। অন্যদিকে সাদা দাবিদাররা নানা সময়ে নানারূপ, গোলাপি, নীল, লাল। সবকিছুই। অথচ কালোরাই না-কি কালারড। সকলের সুবিধার্থে কবিতাটি ফুট নোটে দিয়ে রাখলাম।[1]
গোটা কবিতায় ছোট্ট বাচ্চাটির কথাগুলো ছিল আক্ষরিক, কেবল শেষ লাইনটা ছাড়া। খুব সুন্দরভাবেই সে এ পৃথিবীর বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছিল।
[খ]
আফ্রিকানদের পাশাপাশি মুসলিমরাও বর্ণবাদের শিকার। আর যদি তারা আফ্রিকান মুসলিম হয়, তাহলে তো কথাই নেই। বিলেতে কিছুদিন থাকার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ব্রিটিশরা কতটুকু রেইসিস্ট। আমার ধারণায়, ব্রিটেনে সাধারণত তিন ধরনের লোক দেখতে পাওয়া যায়-
(১) প্রকাশ্য রেইসিস্ট। এরা সরাসরিই মুসলিম, এশিয়ান, আফ্রিকান তথা নন-ব্রিটিশ সবাইকে আক্রমণ করে কথা বলে। সরাসরি আঘাত করার চান্স থাকলে তাও করে।
(২) নিতান্তই ভদ্রলোক। এরা কারো বর্ণ বা ধর্ম বিচার করে না। আদতেই এরা ভদ্রলোক। বয়স্ক, আদি ব্রিটিশ ও শিক্ষিত শ্রেণিতে এধরনের লোক দেখতে পাওয়া যায়।
(৩) বাহ্যিক ভদ্রতা দেখালেও, এরা মূলত রেইসিস্ট। সাধারণত চলাফেরায় এরা ব্রিটিশ এটিকেট বজায় রাখলেও মাঝেমধ্যেই এদের স্বরূপ ধরা পড়ে।
প্রথম দুরকমের লোক খুব-বেশি নেই। বিলেতের বেশির ভাগই তৃতীয় শ্রেণির। অবশ্য এদের মধ্যেও মাত্রাগত পার্থক্য আছে। এদের বাহ্যিক মুখোশ কেবল নানা ইস্যুতেই ধরা পড়ে। আশ্চর্য লাগে তখনই, যখন ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই এশিয়ান ব্রিটিশ, আফ্রিকান ব্রিটিশ। সেটা কার্যক্ষেত্রে যেমন, তেমনই আচরণগত দিক থেকেও।
কিছুদিন মানুষের সাথে মিশে আমার নিজেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। দাড়ি-টুপি থাকায় ন্যূনতম ভদ্রতাসূচক ব্যবহার ও সম্বোধনও অনেক সময় পাইনি। আবার এমন অনেকে বেশ আশাতিরিক্ত ভালো ব্যবহার করেছে, যদিও তা নিতান্তই কম।
আমাদের প্রগতিশীলদের বিরাট অংশ এমন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে ইসলাম বা মুসলিমদের নিয়ে এরা মন্দ কথা না বললেও এদের অবস্থান মুসলিমদের পক্ষে কখনোই যায় না। আর বাকী অংশ তো প্রকাশ্যেই ইসলামবিরোধী। মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার কথা বললেও ইসলাম ও মুসলিমদের ইস্যুতে এদের মতো রেইসিস্ট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
[গ]
অন্যদিকে ইসলাম এমন জীবনব্যবস্থা, যার কাছে বর্ণবাদের কোনো স্থানই নেই। যেখানে ব্রিটিশরা, জার্মানরা, ফরাসীরা নিজেদের উন্নত জাতি মনে করে, যেখানে হোয়াইট সুপ্রিমেসীর ধারণা পাশ্চাত্য সভ্যতায় প্রবলতর, সেখানে ইসলাম এসব বৈষম্যের বিপক্ষে প্রথম দিন থেকেই।
আরবদের মাঝেও উন্নত জাতি দাবি করার প্রবণতা ছিল, এখনো আছে। কিন্তু ইসলামে নেই। মনে রাখা উচিত, আরব মানেই ইসলাম নয়। আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই প্রথমেই তাদের এই গৌরবকে নিষিদ্ধ করলেন। ঘোষণা করলেন, আরবের উপর অনারব বা অনারবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার উপর কালোর, কিংবা কালোর উপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এর চাইতে সুস্পষ্ট বিধান আর কি হতে পারে?
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা করেও দেখিয়েছেন। কালো হাবশী বেলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু কে অনেক উপরে উঠিয়েছেন। এমনকি পরবর্তীতেও এ প্রচলন ছিল। আমি বিস্তারিত লিখতে চাচ্ছি না, অনেক পাঠক আমার চাইতেও ভালো জানেন। এমনকি বর্তমানে আমাদের এই ঈমানী দুর্দশার সময়েও বর্ণবৈষম্য মুসলিমদের মধ্যেই সবচেয়ে কম। কালো আফ্রিকানদের যেমন আমরা জড়িয়ে ধরতে পারি, তেমনই পারি একজন গরীবকে বুকে টেনে নিতে।
সহজ একটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। সবাই জানেন, তাও লিখছি। ছালাতের কাতারে কৃষ্ণাঙ্গ ফকীর দাঁড়ালেও তার যেমন অধিকার, তেমনই ল্যাম্বরগিনি চড়ে আসা বিলিওনিয়ারেরও সমান অধিকার। যতটুকু বৈষম্য আমরা নানা ক্ষেত্রে করছি, তা কেবলই দুনিয়ার স্বার্থসিদ্ধির জন্য। নতুবা বর্ণবৈষ্যমের বিরুদ্ধে এত ইফেক্টিভ নীতিমালা আর কেউই দিতে পারেনি।
[ঘ]
কেবল এক জায়গায় ইসলাম পার্থক্য করে। সেটা ধর্ম ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ইসলাম ও মুসলিম একদিকে, অন্যদিকে সব অমুসলিম। আচরণগতভাবেও এই পার্থক্য ইসলামে নির্ধারিত। ফলে মুসলিমদের সাথে যে আচরণ, তা সবার ক্ষেত্রেই সব সময় করা যাবে না। সেখানে বিভিন্নতা আছে।
পাঠক খেয়াল করবেন, আমি বলছি, পার্থক্য করে; বৈষম্য করে আমি স্বজ্ঞানেই বলছি না। এর মূল কারণ হচ্ছে, ধর্মীয় কারণে পার্থক্যকরণ কোনো জাতিগত বিষয় না। বরং যে যখনই ইসলাম গ্রহণ করবে, মুসলিম হিসেবে সুবিধা তখন থেকেই যে প্রাপ্ত হবে।
অন্যান্য বর্ণের ক্ষেত্রে এ সুবিধা নেই। আপনি চাইলেও সাদা হয়ে যেতে পারবেন না, এটা তো অসম্ভব। কিংবা ব্রিটিশ হতে পারবেন না। যদি অনেক ঝামেলা মাথায় নিয়ে নাগরিকত্ব নিয়েও ফেলেন, তবুও আপনি এশিয়ান ব্রিটিশ; মূল ব্রিটিশ কখনোই নয়। অতএব, ওদেরটাকে বর্ণবৈষম্য বললেও ইসলামের বিভিন্নতাকে পার্থক্য বলাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
আরো একটা বিষয় এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখা উচিত, ইসলাম মুসলিম-অমুসলিমের আচরণগত ক্ষেত্রে অনেক জায়গাতে পার্থক্য করলেও, একটা ক্ষেত্রে ইসলাম সুদৃঢ়, তা হচ্ছে, কারো প্রতি যুলম করা যাবে না। এমনকি কাউকে ধর্মের কারণে উপহাস করা যাবে না, কটু কথাও বলা যাবে না, অন্যের ধর্মের প্রতি আঘাত করা যাবে না ইত্যাদি। এমনকি অন্য ধর্মের মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। ফলে অন্যরা রেসিজমে যতটা যুক্ত, ইসলাম ঠিক ততটাই তা থেকে মুক্ত।
[ঙ]
এত কিছুর পরও ইসলামই বর্ণবাদী। কারণ মাইক ওদের হাতে। আমরা দোষ না করেও দোষী।
প্রিয় ভাই! আমার দুঃখ সেখানে না। দুঃখ আমরা ভালো মুসলিমরা, যারা তথাকথিত প্রগতিশীল নই, এ সত্যটা বুঝতে চাই না। চাইলেও উচ্চকণ্ঠে এ সত্যটা তুলে ধরতে চাই না বা পারি না। আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে, মানছি। কিন্তু সীমাবদ্ধতাকে কখন পাশ কাটানো যায়, কখন উপড়ে ফেলা যায়, এটা আমরা বুঝতে চাচ্ছি না। কেবল চুপ থেকে দায় নিয়েই মনে মনে আফসোস করছি। অনেকে তো ইসলামকেই ভুল বুঝছি পাশ্চাত্যের প্ররোচণায়।
যাহোক, আমাদের মাঝে ইসলামের পরিপূর্ণ জ্ঞান আসুক; নিদেনপক্ষে পাশ্চাত্যের মুখোশ খুলে যাক, উন্মোচিত হোক দেশীয় সুশীলদের মায়াবী প্রতারণা, মুসলিমরা আবারো ফিরিয়ে আনুক তাদের বজ্রধ্বনি, যাতে পাশ্চাত্যের অসভ্যতা বালির বাঁধের মতো ধ্বসে যাবে— এ কামনায়।
আল্লাহু আ‘লাম। ওয়ামা তাওফীক্বী ইল্লা বিল্লাহ।
মুস্তফা মনজুর
[1]. COLOUR: When I born, I black; When I grow up I black; When I go in sun I black; When I scared, I black; When I sick, I black! And when I die, I still black!! And U white fellow? When U born, U pink; When u grow up, U white; When U go in sun, you red; When U cold, U blue; When U scared, U yellow; When U sick, U green; When U die, U grey; And U call me coloured!!!