আপনাদেরকে একবার জামিল সাহেবের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলাম। গত কয়েক বছরে জামিল সাহেবের জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে। ছেলে চাকরিবাকরি করে, নিজে অবসর। বাজারসদাই করেন, বিকেলবেলা একটু হাঁটাচলা। বাকি সময় জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করেন, কখনো বই পড়েন, কখনো আলেমদের বক্তব্য শোনেন। সবার বক্তব্য অবশ্য তিনি শোনেন না। বক্তব্যের ধরন দেখে বক্তাদেরকে মাকাল ফল, ধুতরা, পচা আদা বিভিন্ন নামে শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। সবচেয়ে অপছন্দ করেন পচা আদা শ্রেণি, এদের গুণ নষ্ট কিন্তু ঝাল বেশি।
ছেলে রাফিকে নিয়ে এখনো দুশ্চিন্তা কাটেনি। রাফির সমস্যা হলো, সে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো বুঝে উঠতে পারছে না। পারবে কোত্থেকে— দীর্ঘদিন লিবারেল শ্রেণি দ্বারা প্রভাবিত, আর যেসব ইসলামিক বক্তাদের বক্তব্য মাঝে মাঝে শোনে, তাদেরকে জামিল সাহেবের একদম পছন্দ না। কারও মুখে রাসূলের আদর্শ দাড়ি নেই, কারও পোশাক টাখনুর নিচে, কেউ আবার প্রাচ্যবিদ দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত। এসব নিয়ে তাদের রয়েছে বিভিন্ন যুক্তি, সেসব যুক্তি যতই শোনে জামিল সাহেব, ততই বিরক্ত হন। ওদের কারণে রাফি যা একটু শিখতে চায়, তার মধ্যেও ভুল জ্ঞান অর্জন করে। ওসব নিয়ে বাপ-ছেলের মাঝে চলে তর্কবিতর্ক।
মাস খানেক আগের কথা। জুমআ থেকে এসে সবাই একসাথে খাবার খেতে বসেছে। প্লেটে ভাত নিতে নিতে রাফি বলল, আজকে ফেসবুক ঘুরে বেশ ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে এদেশ শান্তি-শৃঙ্খলার পথে হাঁটছে, যেন সত্যি হতে যাচ্ছে সাম্যবাদ। এবার সত্যি সত্যি বলা যাবে, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। জামিল সাহেব খেতে খেতে বললেন, বেশ ভালো খবর। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা কে না চায়, কিন্তু ফেসবুকে কী এমন দেখে এত আশাবাদী হয়ে উঠলে?
—কী বলো, আব্বু? তুমি দেখনি ফেসবুকে, এবার পুঁজোয় বড় বড় মুসলিম রাজনীতিবিদরা যাচ্ছে, সংবর্ধনা দিচ্ছে, ইসলামী সংগীত হচ্ছে।
—ও আচ্ছা
—বড় বড় ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও যাচ্ছে, সাম্যের কথা বলছে।
—ও আচ্ছা।
—কী ও আচ্ছা আচ্ছা করছ আব্বু। তোমার কী মনে হয় না, দেশ এবার সাম্যের দিকে এগোচ্ছে?
—আমার তো তা মনে হচ্ছে না।
—তুমি হলে নিরাশাবাদী মানুষ, নেগেটিভ চিন্তা-চেতনা।
পিতা-পুত্র একথা থেকে ওকথা, ওকথা থেকে একথার যুক্তি তর্ক তেলাপোকার মতো কিলবিল কিলবিল করে চলছে। রাবেয়া বেগম এসবে অভ্যস্ত। কখনো মনোযোগে শোনেন, কখনো শোনেন না, কখনো বুঝেন আবার বুঝেন না। আজকে রাবেয়া বেগমের দৃষ্টি যুক্তির তেলাপোকার দিকে। তরকারিতে লবণ কম হয়েছে, তেলাপোকা যত দৌড়াবে পিতা-পুত্রের মনোযোগ তত সেদিকে থাকবে, খাবারের দোষ-ত্রুটি খেয়াল করবে না।
জামিল সাহেবের খাওয়া শেষ। তোয়ালে ভেজা হাত মুছে বুকশেল্ফ থেকে একটি ডায়েরি নিতে নিতে নিম্নস্বরে বললেন, ‘কইগো চা টা একটু দিও, আজ আর তোমার ছেলে ঘুমাতে দেবে না বুঝলাম’ বলে মুচকি হাসতে হাসতে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। রাফি বলল, যেভাবে চায়ের কথা বলছ, যেন ভয় পাচ্ছ আব্বু? জামিল সাহেব ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, ‘আজ্ঞে বাবাজি বিয়ে-শাদি করো, সময়ে না হয় উত্তর পাবে। খাইবার যুদ্ধ শেষ হলে আসো এদিকে’। একটু পর রাফিও এসে সোফায় বসল। জামিল সাহেব রাফির দিকে না তাকিয়ে বললেন,
—তারপর... কী জানি একটা বলেছিলে, গাহি সাম্যের গান... কার লেখা জানো তো?
—সে তো সবাই জানে, তুমিও জানো, কবি নজরুলের ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।
—হ্যাঁ, সেদিকেই যাচ্ছি। তার আগে বলো ইসলামে ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ একটা টার্ম আছে জানো?
—এমন কিছু শুনেছি মনে হচ্ছে না, জানি না।
—আচ্ছা অসুবিধে নেই। সামান্য ধারণা এখন আমি দিচ্ছি, তবে বিস্তারিত জানতে হলে বই পড়তে হবে সাথে ভালো আলেমের লেকচার শুনতে হবে, আমি তোমাকে হেল্প করব। এখন বিষয়টা একটু বলি, ইসলামে সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে একদম ক্লিয়ার। এখানে ধোঁয়াশা কিছু নেই। তা তো জানো?
—শিউর। এটা আমি জানি।
—মাশাআল্লাহ ভালো। মুসলিম তার অমুসলিম প্রতিবেশীর সাথে কেমন আচরণ করবে, সম্পর্ক কেমন হতে হবে, তাদের সাথে কতটুকু চলাফেরা করা যাবে, লেনদেন কেমন হবে সবকিছুর দিকনির্দেশনা ইসলামে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
—আচ্ছা।
—বুঝো ব্যাপারটা, এটা কিন্তু হালকা টপিক নয়। মানে শুধু ব্যক্তি নয়; একেবারে রাষ্ট্রীয় কাঠামোসহ মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্কের নীতিমালা ইসলামে ক্লিয়ার নির্দেশনা আছে। সম্পূর্ণ বিষয়টাকে একটা টার্মে বলা হচ্ছে, ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’।
—হুম... জটিলতা আছে দেখছি।
—তা তো আছেই, কিন্তু আজকে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি কবি নজরুলের কাছে। কবি নজরুল কী করেছে, ইসলামের সব রুলস-রেগুলেশন টপকে সাম্যবাদের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি, তার আগে দেখে আসো চা টা আসার কোনো লক্ষণ আছে কিনা!
—আরে চা আসবে, আমি দেখলাম আম্মু কিচেনের দিকে গেলেন। তুমি বলো কবি নজরুল করলেনটা কী?
—আচ্ছা। তুমি তো দুটো লাইন বললেই। সে কিন্তু ভালো কথা বটে, এবার দেখো কবি বলছেন,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃ মুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
—আমি এখানে খারাপ দেখি না, আব্বু। যেমন ধরো, ভারতীয় আগ্রাসন আমাদের হিন্দু-মুসলিম দেখে দেখে ক্ষতি করছে না, সমগ্র দেশের ক্ষতি করছে। এখন হিন্দু-মুসলিম সবাই সবার অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করতে হবে এটাই তো মাতৃ মুক্তিপণ।
—আমার বিবেচনায়ও একথা দূষণীয় হয়নি, তারপরও ‘অন্ধের দেশে কানা হয় রাজা’ বলে একটা কথা আছে। আমরা তো অন্ধের দেশে রাজা সেজে আছি, দোষ-ত্রুটি থাকলে আলেমরা ঠিকই ধরতে পারবে। বিষয়টা নিয়ে কোনো আলেমের সাথে কথা বলতে হবে। যাহোক, এইটুক না হয় ঠিক আছে, কিন্তু কবি আরও কী বলছে দেখো—
আমার শ্যামা মায়ের কোলে চ’ড়ে জপি আমি শ্যামের নাম
মা হলেন মোর মন্ত্র-গুরু, ঠাকুর হলেন রাধা-শ্যাম।
কবি একদিকে নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যেমন গুণগান গাইলেন, আরেকদিকে রাধা শ্যামের গুণগান গাইলেন। আরও বললেন,
সখী, সে হরি কেমন বল্।
নাম শুনে যার এত প্রেম জাগে চোখে আনে এত জল॥
—বুঝলে কিছু?
রাফি কিছু না বলে চুপ করে ভাবছে। জামিল সাহেব ফের বলতে লাগলেন, দেখো এবার দুটো লাইন দিচ্ছি তুমি সমস্যা পাও কিনা দেখি, কবি বলছেন,
কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।
তার রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব, যার হাতে মরণ বাঁচন॥
বলো, কী সমস্যা এখানে? রাফি মাথা নাড়ল, ধরতে পারছে না। জামিল সাহেব চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ভালো করে খেয়াল করো, ‘তার রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব, যার হাতে মরণ-বাঁচন’। শিবের হাতে মরণ-বাঁচন একজন মুসলিম বলতে পারে? রাফি বলল, তা তো না! আমার কাছে মনে হচ্ছে লাইনটাতে শিরক হয়েছে। জামিল সাহেব বললেন, ভেরি গুড! আমি আশা করছিলাম এবার ধরতে পারবে। কবি আরও বলছেন কী, শোনো—
কবিতায় যাওয়ার আগে রাবেয়া বেগমের আগমন। টি-টেবিলে দু’কাপ চা নামিয়ে রেখে বললেন, ছেলের সাথে যে ভাব ধরছ, যেন আমি তোমার সেবা-যত্ন করি না?
—তা করো বৈ কী। তারপরও আবহাওয়া কখন কোনদিকে যায়, মাঝে মাঝে পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া শ্রেয়। তা দু’কাপ কেন? তুমি খাবে না?
—জি না, খান আপনে চা। এবেলা-ওবেলা চা, আর খাওয়া শেষে হিসেব, দুধের প্যাকেটের যা দাম বাড়ল, চা খাওয়া বন্ধ করতে হবে দেখছি, দুধ-চা স্বাস্থ্য হানিকর। বলতে বলতে রাবেয়া বেগম ভেতরের দিকে গেলেন। জামিল সাহেব বুঝলেন, তুমি থেকে আপনি সম্বোধনে যাওয়া আবহাওয়ার ভালো লক্ষণ নয়। তিনি চায়ে পরপর দু’চুমুক দিয়ে কবিতায় ফিরলেন। খেয়াল করো কবি বলছেন—
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
একে তো হৃদয়কে কা‘বার চেয়ে বড় করে দেখা, সাথে মন্দির আর কা‘বাকে সমান করে তুললেন। বিষয়টা কেমন হলো?
—একজন মুসলিমের জন্য এই বিষয়গুলো আসলেই সমস্যা, একটা বিষয় আমার বুঝে আসছে না, উনার কথাগুলো অবশ্যই ইসলাম সাপোর্ট করে না ঠিক আছে কিন্তু সাম্যবাদের সাথে কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না।
জামিল সাহেব চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বললেন, এধরনের ভূরিভূরি উদাহরণ দেওয়া যায় ‘লেকিন সমঝদারকে লিয়ে ইশারা কাফি’, এটুকুই তোমার জন্য এনাফ ডোজ মনে করি। এবার আসি আসল পয়েন্টে, কবি নজরুল মুসলিম কিন্তু তিনি এমন সাম্যের স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে হিন্দু-মুসলিম বা কোনো ধর্মের ভেদাভেদ দেখতে চাননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমসহ লেখকরা যখন মুসলিমদেরকে অসভ্য, বর্বর, মূর্খ জাতি বলে হেয় করেছেন, তখনো কবি সবাইকে এক করে বলেছেন,
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।
মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান॥
এর চাইতে বড় সাম্যের কথা তো হতে পারে না, তাই না? কিন্তু তাতে কী হলো... কবি নজরুল এত খাটাখাটি করে তেলে-জলে মিশিয়েও নিজে যথার্থ মূল্যায়ন পান নাই। কথা বুঝতেছ?
—হুঁ!
—‘হুঁ’ কী? স্পষ্ট ভাষায় কথা বলবা-
গাছ যেমন ছালে বন্দী, মাছ বন্দী জালে
যুক্তির নৌকা কথায় বন্দী, বাতাস লাগে পালে
কথার সাথে কথা বললে যুক্তির নৌকায় বাতাস পাবে, ‘হুঁ’ ‘হা’ করলে তো পালে বাতাস পায় না। রাফি চমকে গিয়ে বলল,
—বুঝতেছি বুঝতেছি, সবই বুঝতেছি।
—তোমরা চাকরির জন্য কী একটা বই পড়তা না, লাল নীল কী জানি...
—কত রঙের বই তো পড়লাম কোনটা আবার লাল নীল?
—আরে রং না, বইয়ের নাম এরকম।
—ও আচ্ছা। ‘লাল নীল দীপাবলি’ যাকে বাংলা সাহিত্যের জীবনী বলা হয়।
—দেখো কবি নজরুল জীবনভর এত সাম্য সাম্য করেও মুক্তি পেলেন না, তাঁকে কেউ বলছে সেক্যুলার কবি, কেউ বলছে কট্টরপন্থি মুসলিম, কেউ বলছে মুসলিম নামে হিন্দু কবি। এত নাম-বদনামের পরও ‘লাল নীল দীপাবলি’-এর লেখক এই বইয়ে নজরুলের তেমন কোনো আলোচনা আনেননি বললেই চলে, শুধু তিনি মুসলিম ছিলেন বলে।
রাফি একমত হলো যে, সত্যিই বইটিতে কবি নজরুলকে নিয়ে দায় সারা কয়েকটি কথা ছাড়া বাংলা সাহিত্যে তার কৃতিত্বের তেমন কোনো আলোচনা করা হয়নি। জামিল সাহেব বললেন,
—যাকে ছাড়া বাংলা সাহিত্য অসম্পূর্ণ তাঁকে অবহেলা করে এ কেমন সাহিত্য জীবনী হলো? এ তো জীবনীর গলা চেপে ধরল। যাহোক, শুধু তাই নয়; কবিকে ‘জাতীয় কবি’ মৌখিক স্বীকৃতি দিয়েছে শুধু, লিখিত স্বীকৃতি এখনো দেয়নি। কারণ নজরুল একজন মুসলিম কবি।
—লিখিত দিক বা না দিক তাতে কী?
—দেওয়া না দেওয়া বিষয় না; বিষয় হচ্ছে না দেওয়ার কারণ। তাদের সাম্যের কেমন অসাড়তা তা দেখানো। কাউকে যদি সাংবিধানিকভাবে লিখিত ‘জাতির পিতা’ উপাধি দেওয়া জরুরী হয়, একই যুক্তিতে জাতীয় কবিকেও লিখিত স্বীকৃতি দেওয়া জরুরী। বাঙালি সেক্যু কিন্তু বড়ই বিচিত্র। এরা নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি, পরের বেলায় দাঁতকপাটি। মৌখিক অস্বীকৃতিরও সুযোগ সন্ধানে আছে তারা। বুঝতে পারছ তো?
—হ্যাঁ পারছি।
—ফিনিশিং টেনে দিচ্ছি। দেখো, তোমাকে আমাকে কেউ চেনে না, আর ওসব টুটাফাটা রাজনীতিবিদদের দুদিন পর কেউ মনে রাখে না। তো যাদেরকে সারা বিশ্ব চিনে, তাদের এত সাম্যের ডাকডাকির পরও কিছুই আসে যায়নি এমনকি অবমূল্যায়নও করা হয়েছে ধর্ম পরিচয়ের কারণে। আর এখন রাজনৈতিক নেতা কয়েক গিয়ে মন্দিরে গড়াগড়ি আর মুখরোচক কথা বললে সুন্দর সাম্যবাদ এসে যাবে, তুমি কীভাবে মনে করো?
—কথা অযৌক্তিক নয় আব্বু, কিন্তু অমুসলিম বলো আর নাস্তিক সেক্যুলার যাই বলো, তারাও যদি মুসলিমদের প্রতি একই রকম সহনশীল হয়, তাহলে তো হয়ে যায়!
—সমস্যা তো এখানে। কবি নজরুল দিয়ে এটাই তোমাকে বুঝালাম। যতই করো ওরা মুসলিমদের জন্য সহজ হবে না। আল্লাহ কুরআনে বলে দিয়েছেন, ইয়াহূদী ও নাছারারা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১২০)। ‘আর ইয়াহূদী-মুশরিকরা মুমিনদের বিরুদ্ধে সবসময় কঠোর’ (আল-মায়েদা, ৫/৮২)।
অতএব, তুমি নিজের মুসলিম সত্তা বাদ দিয়ে যতই ওদের সাথে মিশে যাও না কেন, ওতে কোনোই লাভ হবে না। দিন শেষে দুনিয়া-আখেরাত দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত। আম-ছালা যাই যাই অবস্থা।
রাফি আড়মোড়া ভেঙে বলল, যত সহজ ভেবেছিলাম তত আসলে সহজ নয় আব্বু।
—বুঝতে পেরেছ তাহলে। তাদের মুখে যতই সাম্যের ডাক থাকুক, অন্তরে সাম্য মানে তুমি ওদের দলে যোগ দাও। এর কিন্তু সমসাময়িক প্রমাণও আছে। রাফি উৎসাহ নিয়ে তাকাল। জামিল সাহেব একটু থেমে বললেন, কবি আল মাহমুদের কথাই ধরো, যতদিন নাস্তিক সেকুলারদের দলের ছিলেন ততদিন তিনি অতি মূল্যবান। যখনি তিনি ইসলামে ফিরলেন তখন তিনি আর কেউ না, একেবারে ‘নো বডি’ হয়ে গেলেন।
—রাফি অবাক হয়ে বলল, জানতাম না তো!
—আধুনিক যুগ, নেটে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করো, অনেক কিছুই জানবে। এবার বলো, পুজোয় গিয়ে গড়াগড়ি থেকে সাম্যের আশা কতটুকু? রাফি আশাহত স্বরে বলল, নিরাশাবাদীর দলে যোগ দিলাম আব্বু। জামিল সাহেব হেসে উঠে বললেন, আচ্ছা যাও তাহলে এখন, রেস্ট নাও একটু। রাফি উঠতে উঠতে বলল, আর কী জানি ‘ওয়ালা-বারা’ বললে, ওটার বই দিও একটা আমাকে। রাফি রুমের দিকে গেল।
রাবেয়া বেগম একটু বিশ্রাম সেরে গোছগাছে লাগলেন। ফ্রিজে ডালের বাটি রাখতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গেল বাইরে। সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে রুক্ষস্বরে বললেন, ‘এটুক ডাল না খেতে পারলে রাঁধানোর কী দরকার? দেখো কাণ্ড এখন। শুধু আমার কাজ বাড়ানোর ধান্ধা’। সোফা থেকে জামিল সাহেব মাথা উঁচিয়ে বুঝলেন ঘটনা কী ঘটেছে, তবে এতে উনার দোষটা কোথায়? চোখ বন্ধ করে তা বুঝার চেষ্টা করছেন।
মুগনিউর রহমান তাবরীজ
শিক্ষক ও মিডিয়া হেড, হাবরুল উম্মাহ মডেল মাদরাসা, লক্ষ্মীপুর; লেখক, অ্যা লেটার টু অ্যাথেইস্ট।