আমাদের জীবন শিক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে এ পথে ছুটে চলেছে অগণিত মানব সন্তান। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি পৃথিবীর বুকে উন্নতি করতে পারে না। শিক্ষা চোখ খুলে দিয়ে মনুষ্যত্ব বিকাশে সহায়তা করে। শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর অন্যতম। আত্মোপলব্ধি, আত্মগঠন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি, ব্যক্তির আচরণিক ও আবেগিক পরিবর্তন, দেশ ও জাতির সভ্যতা সংস্কৃতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রয়োজনে শিক্ষাগ্রহণ একান্ত আবশ্যক।
শিক্ষার প্রয়োজন শুধু মানুষের জন্য। মানুষের সঙ্গে শিক্ষার যে ঘনিষ্ঠতা এমন আর কোনো প্রাণীর বেলায় নেই। সৃষ্টির শুরু থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করে আসছে। পৃথিবীর বয়স যতই বাড়ছে মানুষের চিন্তা, চেতনা ও চাহিদা ততই প্রসারিত হচ্ছে। হাজার বছর আগের শিক্ষাব্যবস্থা আর আজকের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অনেক তফাত।
শিক্ষা কী?
আল্লাহ কুরআনুল কারীমে বলেছেন,إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ ‘যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন’ (আলে ইমরান, ৩/১৬৪)।
এখানে আল্লাহর আয়াত পড়ে শোনানোর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কুরআনের আয়াত বা তাঁর কুদরতের নিদর্শন যাতে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো সন্দেহ না থাকে, কিতাবের জ্ঞানের অর্থ হচ্ছে ভালোমন্দ চেনার জ্ঞান, হিকমত অর্থ হচ্ছে জীবনযাপনের কৌশল। এই হিকমতের মধ্যে রয়েছে সমাজবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাসহ সকল ধরনের জ্ঞান। আর অন্তঃকরণ পবিত্র করার অর্থ হচ্ছে আত্মা বা রূহকে এতটা উন্নত করা যাতে তা যে কোনো খারাপ বা অকল্যাণ কাজের দিকে ধাবিত না হয়। শিক্ষার এতটা পরিচ্ছন্ন ও পরিপূর্ণ সংজ্ঞা আর কেউ দিতে পারেনি।
মন এবং আত্মার উন্নতি সাধন যদি শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে ধর্মের সাথে শিক্ষার যোগাযোগ অপরিহার্য। কারণ মন ও আত্মার উন্নয়ন, বিশ্বমানবতার কল্যাণ কামনায় তার বাস্তব প্রয়োগ ধর্ম ছাড়া সম্ভব নয়।
শিক্ষাব্যবস্থার ইতিকথা : গোলাম জাতির শিক্ষাব্যবস্থা আর স্বাধীন জাতির শিক্ষাব্যবস্থা এক হতে পারে না। আমরা পরপর দুইবার স্বাধীনতা লাভ করলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চুলচেরা পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এদেশ দখল করার পর প্রথমদিকে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছ থেকেই প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়।
ইংরেজরা এসব স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা তাদের ভাষায় বিদ্রোহের কারণ খুঁজতে গিয়ে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই এর বীজ আবিষ্কার করে। তাই তারা নযর দেয় শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের। কারণ কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পারলেই যথেষ্ট।
ইংরেজরা তাদের অনেক শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ এবং ঝানু ঝানু আমলাদের দ্বারা গঠিত বিভিন্ন কমিশন তৈরি করে শিক্ষাব্যবস্থার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এদেশের মানুষের মধ্য থেকে স্বাধীনতার চেতনা শেষ করে দিয়ে স্থায়ী গোলামির মানসিকতা তৈরির সিদ্ধান্ত নিল। অবশেষে লর্ড ম্যাকেলের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন ইংরেজ সরকারের ইচ্ছা পূরণের মতো শিক্ষাব্যবস্থা কাঠামো তৈরি করে দিল। শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে তার ভূমিকা লিখতে গিয়ে লর্ড ম্যাকেলে পরিষ্কার ভাষায়ই লিখলেন, আমরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা এখানে ক্বায়েম করতে চাই, সে ব্যবস্থায় যারা লেখাপড়া করবে তারা রঙে, ভাষায় এবং চেহারায় হবে ভারতীয়; কিন্তু চিন্তা-চেতনা, ভাবনা ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হবে ব্রিটিশেরই মানস সন্তান।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজও সেই শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন হয়নি। ইংরেজরা আমাদের দেশ দখল করার পূর্বে এখানে একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। একই প্রতিষ্ঠান থেকে আলেম, সমাজতত্ত্ববিদ, সামাজিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসনিক কর্মকর্তা তথা জাতির প্রয়োজন পূরণের জন্য সকল ধরনের জনশক্তিই সরবরাহ করত ওই শিক্ষাব্যবস্থা। এদেশের সকল ধর্ম ও গোত্রের লোকদের জন্যই সে শিক্ষাব্যবস্থা উপযোগী ছিল। আদর্শিক দিক থেকে সেই শিক্ষাব্যবস্থার খোঁজখবর আজকে আবার নেওয়ার প্রয়োজন।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় অশুভ চিন্তা : ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা সর্বযুগে উত্তম এবং গ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ইসলামী শিক্ষা আতঙ্কে ভোগে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম ঢুকলে তো আর সংস্কৃতির নামে অজস্র দুষ্কৃতির খেলা করা যাবে না, সহশিক্ষার নামে জ্ঞানচর্চার বদলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের অলিন্দে বৃন্দাবনলীলা চলবে না, নারী স্বাধীনতার নামে হাটে-ঘাটে নারীপণ্যের পসরা বসিয়ে বিনা পুঁজিতে জমজমাট ব্যবস্থা করার মওকা পাওয়া যাবে না। পার্কে ও নাইট ক্লাবে বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা আর খেমটা নাচের মহড়া চলবে না। নারীর বহর আর শাড়ির ঝলক দেখিয়ে তরুণদের মাথা নষ্ট করে প্রগতি আন্দোলনের ঝাণ্ডা বুলন্দ করার উপায় থাকবে না।
শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং তাতে সফল হওয়ার উপায় : শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ কিছু অর্জন করতে চায় সেটা দৈহিক, মানসিক, বৈষয়িক কিংবা আত্মিকও হতে পারে। এ লক্ষ্য নির্ধারিত হয় একটা জাতি বা জনগোষ্ঠীর মৌলিক জীবনদর্শন দ্বারা। এজন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য কেবল বৈষয়িক প্রগতি কিংবা কেবল আত্মিক মুক্তিই হতে পারে না; দৈহিক, মানসিক, বৈষয়িক, আত্মিক সবদিক দিয়ে জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলাই হবে এর মূল লক্ষ্য। ইসলামী শিক্ষা ধর্মীয় মূল্যবোধের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতিই উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতা অর্জনের সর্বোত্তম মাধ্যম। কুরআনুল কারীমে এসেছে, إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ‘তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে মর্যাদাশীল, যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১৩)।
কাজেই কুরআনুল কারীমের আলোকে আমাদেরকে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করবে; শিক্ষার্থীদেরকে প্রদান করবে জীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র ও অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গি। তাই বর্তমানে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং তড়িৎ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা সৃষ্টির জন্য শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত এবং পাঠ্যক্রমেও পরিবর্তন অপরিহার্য। বিশ্বের সমস্ত মুসলিমকে সেইভাবে তৎপর হতে হবে, যেভাবে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদীন সমস্ত মুসলিম নর-নারীকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ইসলামী শিক্ষার যে প্রগতি আমরা অনুধাবন করতে পারি, তা যদি আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সংযোজিত হয় তবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব।
সুশিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা : মানুষের মনের সম্ভাবনাকে বিকশিত করা ও সচল করাই শিক্ষা। তবে হ্যাঁ, ইতিবাচক শিক্ষাই হচ্ছে সুশিক্ষা। সুশিক্ষা একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। সুশিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে এবং বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহায্য করে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য : শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, অতি প্রাচীনকাল থেকেই মন ও মগজের সৌন্দর্য বৃদ্ধিই ছিল শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য। দার্শনিক প্লেটো বলেন, শিক্ষাই মানুষকে ভ্রান্ত অভিজ্ঞতার বন্ধন থেকে মুক্তি ও জ্ঞান অন্বেষণে সাহায্য করতে পারে। গাযালী বলেন, কর্মহীন জ্ঞান উন্মাদনা মাত্র, জ্ঞানহীন কর্ম কোনো ধর্ম নয়।
সুশিক্ষার স্বরূপ : সুশিক্ষার মাধ্যমেই মানব জীবনের সামগ্রিক উৎকর্ষতা অর্জন করা সম্ভব। সুশিক্ষার মাধ্যমেই জীবনকে খুঁজে পাওয়া যায়। শিক্ষাহীন জীবন অর্থহীন। সুশিক্ষা মানুষকে আশাবাদী, আত্মপ্রত্যয়ী, উন্নত, আলোকিত ও বিকশিত করতে পারে। নিজেকে বুঝতে, জানতে ও আবিষ্কার করতে মানুষকে অবশ্যই প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। মানুষের মধ্যে যে অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে এর আশানুরূপ ও যথার্থ বিকাশ ঘটানো সুশিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। জীবনকে দক্ষ, গতিশীল, আকর্ষণীয়, গ্রহণযোগ্য ও কল্যাণকামী করতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। একটি জাতির অতীত-ঐতিহ্য, ইতিহাস-গৌরব, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জাতি গঠন, রাজনৈতিক দর্শন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে পারে সুশিক্ষা। মানব কল্যাণের পরিপন্থী সব ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিক স্বার্থে নিয়োজিত হতে প্রকৃত শিক্ষাই উদ্বুদ্ধ করে। সার্বিক অর্থে একটি সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম হতে পারে সুশিক্ষা। প্রকৃতপক্ষে সুশিক্ষা বলতে যে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ, মানবিক উন্নয়ন, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রয়োগযোগ্য অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, তাকেই সুশিক্ষা বা উন্নত শিক্ষা বলা হয়।
অন্যদিকে সুশিক্ষার লক্ষ্য হলো সৃষ্টিশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের উৎকর্ষতা। আধুনিক ধারণা মতে, সময় ও অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাই হলো সুশিক্ষা।
সুশিক্ষার জন্য শিক্ষকের ভূমিকা : একজন শিক্ষার্থীকে পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষক তার উপর অর্পিত গুরুদায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে জ্ঞানপ্রদীপ নিভে যাবে। এ পর্যায়ে দেশের সচেতন দায়িত্বশীলগণ এমন সব শিক্ষক পেতে চায়, যাদের শিক্ষকসুলভ আচরণ ও সংস্পর্শে শিক্ষাঙ্গনে সৃষ্টি হবে প্রকৃত শিক্ষার জন্য অনুকূল পরিবেশ, রচিত হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক। ফলে সুগম হবে সুশিক্ষা অর্জনের পথ।
মানুষকে জ্ঞানী করে তোলারউপায় : দেশের সকল মানুষকে জ্ঞানী করে তোলার উপায়, জাতির জীবনের মেরুদণ্ড মনুষ্যত্ব ও জ্ঞান। এ দুটি চাপা রেখে জাতিকে জাগতে বললে তারা জাগবে না। বুদ্ধির দোষে হোক বা অবস্থার চক্রে হোক, কোনো দেশ যদি বহু মানুষের অশিক্ষা, অল্প শিক্ষাবশত অমার্জিত চিত্ত এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সে জাতির জীবন টেকসই হবে না। এসব লক্ষ্য মৌন আত্মার স্পন্দন আনার উপায় আছে, কোটিবদ্ধ মুখে ভাষা তুলে দেবার এক পন্থা আছে, সকল দেশের সকল সময়ে সেই পন্থা কার্যকরী হয়ে থাকে। সেই পন্থা না থাকলে কোনো জাতি বাঁচত না, উন্নত হতো না, স্বপ্ন দেখাও অসম্ভব হতো। এজন্য সুশিক্ষায় শিক্ষিত জাতি দরকার। দেশের বা জাতীয় সাহিত্যের পুষ্টিসাধন তন্মধ্যে অন্যতম পথ বা পন্থা। জাতিকে শক্তিশালী করতে প্রত্যেক সময়ে মানুষ এই পন্থা অবলম্বন করেছে।
ইসলামবিরোধী শিক্ষার কুফল : ইসলামী শিক্ষার বিপরীতে যে বস্তুবাদী, পুঁজিবাদী, সমাজবাদী ও নাস্তিক্যবাদী শিক্ষার মহড়া বিভিন্ন সমাজ ও দেশে চলছে, সে শিক্ষায় মা-বাবাকে পরম শ্রদ্ধার পাত্র না ভেবে তাদেরকে উৎপাদনের মন্ত্র ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। শিক্ষককে গুরুজন মনে না করে মাসিক মাইনে পাওয়া খাদেম ব্যতীত অধিক কিছু ভাবতে শিখে না। নারীর ইযযত হেফাযত না করে ভোগের সামগ্রী ছাড়া অন্য কিছু ধারণা করতে পারে না। অংকের নামে দুধে পানি মেশানো এবং চক্রবৃদ্ধি সূদের হিসাব শিখায়, সাহিত্যের নামে পরকীয়া প্রেম আর নারকীয় যৌনলীলার ইন্ধন যোগায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামে মুনাফেক্বী ও মানবীয় প্রভুত্বের মহত্ত্ব শিখানো হয়, অর্থনীতির নামে ব্যক্তিগত শোষণ (পুঁজিবাদ) বা দলীয় শোষণ (সমাজবাদ) শিক্ষা দেয়। সমাজবিজ্ঞানের নামে সৃষ্টির সেরা মানবজাতিকে বানরের বংশধর বলে সবক দেয়। আল্লাহর বাণীর চাইতে তারা ডারউইনের বাণীকে অধিক গুরুত্ব দেয়। খুলাফায়ে রাশেদীনের নেতৃত্বের বদলে তারা মাও সে তুং, লেলিন, স্টালিনের নেতৃত্বকে আদর্শ মনে করে। এমন কুধারণা সম্পন্ন শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? প্রশ্ন রেখে গেলাম।
ইসলামবিরোধী শিক্ষা অর্জনের ফলে ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে কাঁচকলা দেখায়, শিক্ষককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়, অস্ত্র হাতে নিয়ে পরীক্ষা দেয়, নকলবাজি আর অসদুপায় অবলম্বন করে পরীক্ষার বৈতরণি পার হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অলিগলি, করিডোরে কপোত-কপোতীর ন্যায় জোড়ায় জোড়ায় মেলা বসায়, টেডিবাদের জয়গান গায়।
ইসলামের আলোকে আমাদের একটি শিক্ষাব্যবস্থা থাকা খুবই দরকার। যাতে জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখার মধ্যে একটি সমন্বয় থাকবে। শিক্ষার্থীদের প্রদান করবে একটি অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গি, একটি অবিভাজ্য জীবন। সুতরাং অজ্ঞতা, মূর্খতা, কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, নকল প্রবণতা ও সন্ত্রাস নিরসনে নৈতিকতা, সততা, নির্ভেজাল জ্ঞান ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় ইসলামী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
ইসলামী শিক্ষার রূপরেখা : যে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামকে একটা পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ হিসেবে শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত থাকে, তাই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা। এ শিক্ষা লাভের ফলে শিক্ষার্থীদের মন, মগজ, চরিত্র এমনভাবে গড়ে উঠবে, যাতে ইসলামের আদর্শে একটা রাষ্ট্র পরিচালনা করার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। মুসলিম বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, শাসক, বিচারক, অর্থনীতিবিদ, সেনাপতি, রাষ্ট্রদূত ইত্যাদি সৃষ্টি করবে।
ইসলামী শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :
(১) একই সাথে দ্বীন ও দুনিয়ার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হতে হবে।
(৪) শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চস্তরে মুসলিম বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, শাসক, বিচারক, অর্থনীতিবিদ, সেনাপতি, রাষ্ট্রদূতসহ উন্নতমানের মুফাসসির, মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ ও মুজতাহিদ সৃষ্টির উপযোগী বিশেষ কোর্স থাকবে।
(৯) শিক্ষাগ্রহণ, শিক্ষাদান এবং শিক্ষাকে সার্বজনীন করার জন্য পুরোপুরি চেষ্টা থাকবে, যাতে কেউ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে না যায়।
(১০) প্রয়োজনীয় শিক্ষা অবৈতনিক হবে। অসমর্থক ও কপর্দকহীন ছাত্রদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের যিম্মাদারী নেওয়া হবে। প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি এ ব্যাপারে সাহায্য করাকে কল্যাণজনক এবং ছাদাক্বার অর্থ এই খাতে ব্যয় করাকে উৎকৃষ্টতর ব্যয়ের খাত হিসেবে মনে করবেন।
মহান আল্লাহ ইসলামী শিক্ষার সমন্বয়ে একটি উন্নত শিক্ষাক্রম তৈরির তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
মহিউদ্দিন বিন জুবায়েদ
মুহিমনগর, চৈতনখিলা, শেরপুর।