কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

তাবীয ব্যবহার শিরক

ভারতীয় উপমহাদেশে তাবীয একটি পরিচিত শব্দ। সকল ধর্মাবলম্বীরাই তাবীয ব্যবহার করে। কিন্তু ইসলামে তাবীয ব্যবহার করা হারাম ও শিরক। আজ আমরা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জানার চেষ্টা করব— তাবীয কীভাবে একজন ঈমানদার ব্যক্তিকে শিরক করিয়ে মুশরিকে পরিণত করে। সেইসাথে বর্তমান যুগে তাবীযের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে।

তাবীয কী?

সোজাকথায় তাবীয হচ্ছে এমন বস্তু যার ভালো-মন্দ করার ক্ষমতা আছে মনে করে মানুষ তা শরীরে, বাহুতে, গলায় বা অন্য কোথাও ঝুলিয়ে রাখে।

তাবীযের মূল উদ্দেশ্য :

আমাদের উপমহাদেশে তাবীয দেওয়া এবং নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, এই তাবীয তাকে গায়েবী খারাপ কোনো কিছু থেকে রক্ষা করবে। বিশেষ করে জিন-ভূতের আছর কিংবা কারো উপকার বা অপকার করার উদ্দেশ্যে তাবীয পরিধান করে।

তাবীয নিষিদ্ধের দলীল :

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি শক্তিশালী হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, তাবীয ব্যবহার করা সরাসরি হারাম এবং শিরক। আবূ বাসীর আনছারী আব্বাদ ইবনু তামীম থেকে থেকে বর্ণিত, তিনি (আবূ বাসীর) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কোনো একা সফরে ছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে কাজে পাঠালেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ বাকর রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার বিশ্বাস যে, তখন সমস্ত লোক ঘুমিয়েছিল। কাজটি ছিল কোনো উটের গলায় কোনো হার, তাবীয কিংবা ঘণ্টা যেন না থাকে। থাকলে কেটে ফেলতে বলেন।[1] জাহেলী যুগে কুসংস্কারের কারণে উটের গলায় মালা লটকানো হতো যাতে উট বদনযর থেকে রক্ষা পায়। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ভ্রান্ত ধারণা ও রসম উৎখাতের ব্যবস্থা করেন। উক্ববা ইবনু আমির রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাবীয ব্যবহার করবে আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দিবেন না। আর যে কড়ি ব্যবহার করবে আল্লাহ তাকে মঙ্গল দান করবেন না’।[2]

কোনো কিছুর দ্বারা তাবীয বা কড়ি ঝুলানো একই ধরনের অপরাধ। উক্ববা ইবনু আমির রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে একদল লোক উপস্থিত হলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দলটির নয়জনকে বায়আত করালেন এবং একজনকে বায়আত করালেন না। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নয়জনকে বায়আত করালেন আর একজনকে ছেড়ে দিলেন? রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তার সাথে একটি তাবীয রয়েছে। তখন লোকটি হাত ভেতরে ঢুকিয়ে তাবীয ছিড়ে ফেললেন। অতঃপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও বায়আত করালেন এবং বললেন, ‘যে ব্যক্তি তাবীয ব্যবহার করল সে শিরক করল’।[3]

উক্ত হাদীছ থেকে বুঝা যায়, তাবীয ব্যবহার করা জঘন্য অপরাধ। এরূপ ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়আত করানো থেকে বিরত থেকেছেন। সেটা যে প্রকারের তাবীয হোক না কেন। তাহলে তাবীযের অপরাধ কত ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়।

রুওয়াইফা ইবনু ছাবেত রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘হে রুওয়াইফা! হয়তো তুমি আমার পরও অনেক দিন বেঁচে থাকবে। সুতরাং তুমি লোকদেরকে এ কথা বলে দিয়ো যে, যে ব্যক্তি দাড়িতে গিট দিল (জট পাকাল) অথবা তাবীয জাতীয় বেল্ট বা সূতা (ছেলে-মেয়ের বা প্রাণীর গলায়) পরাল কিংবা চতুষ্পদ জন্তুর গোবর অথবা হাড় দিয়ে ইসতেঞ্জা করল, নিশ্চয়ই তার সাথে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সম্পর্ক নেই’।[4] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ঝাড়ফুঁক, তাবীয এবং ভালোবাসা সৃষ্টি করার জন্য কোনো কৌশল অবলম্বন করা শিরক’।[5] এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তাবীয ব্যবহার করা, বাচ্চাদের গলায় বা কোমরে কালো, সাদা, লাল যেকোনো কিছুই বাঁধা হোক না কেন তা শিরক।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্ত্রী যায়নাব রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, একদা (আমার স্বামী) আব্দুল্লাহ আমার গলায় একখানা তাগা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘(তোমার গলায়) এটা কী? বললাম, এটা একটি তাগা, এতে আমার জন্য মন্ত্র পড়া হয়েছে। যায়নাব রযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, তা শুনে তিনি তাগাটি ধরে ছিঁড়ে ফেললেন, অতঃপর বললেন, তোমরা আব্দুল্লাহর পরিবারবর্গ। তোমরা শিরকের মুখাপেক্ষী নও। আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ঝাড়ফুঁক, তাবীয ও জাদুটোনা শিরকী কাজ’।[6]

উপরিউক্ত হাদীছসমূহ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সকল প্রকার তাবীয ব্যবহার হারাম এবং শিরক। 

ঝাড়ফুঁক জায়েয :

ইসলামে শরী‘আতসম্মত ঝাড়ফুঁকের অনুমোদন অনুমোদন রয়েছে। আওফ ইবনু মালেক আশজাঈ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা জাহিলী যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম। অতঃপর আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী? তিনি বলেন, তোমাদের ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থাগুলো আমার সামনে পেশ করো। যেসব ঝাড়ফুঁকে শিরক নেই, তাতে কোনো দোষ নেই’।[7] 

উম্মে সালামা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার (উম্মে সালমার) ঘরে একটি মেয়েকে দেখতে পেলেন, তার চেহারায় (বদনযরের) চিহ্ন ছিল। অর্থাৎ চেহারাটি হলুদ বর্ণ ধারণ করেছিল। তখন তিনি বললেন, ‘এর জন্য ঝাড়ফুঁক করো, কেননা তার উপর নযর লেগেছে’।[8] সুতরাং বদনযর লাগলে তাকে ঝাড়ফুঁক করা যাবে। 

আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কারো উপর বদনযর লাগলে, কোনো বিষাক্ত প্রাণী দংশন করলে এবং পাঁজরে খুজলি (পিঁপড়ার মতো ছোট ছোট জিনিস শরীরে বের হওয়া) উঠলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝাড়ফুঁক করতে অনুমতি দিয়েছেন’।[9] আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনছারদের এক পরিবারের লোকদের বিষাক্ত দংশন ও কান ব্যথার কারণে ঝাড়ফুঁক গ্রহণ করার অনুমতি দেন’।[10]

সুতরাং এছাড়াও অসংখ্য ছহীহ দলীল দ্বারা প্রমাণিত যে, যেকোনো অসুস্থতা এবং বদনযর লাগা ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঝাড়ফুঁককে জায়েয করা হয়েছে।

ভরসা আল্লাহর উপর :

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবীয এজন্যই নিষিদ্ধ করেছেন, যাতে মানুষ আল্লাহর উপর ভরসা ভুলে তাবীযের উপর ভরসা না করে। কেননা যেকোনো বিপদ আপদ, দুঃখ-দুর্দশা সর্বাবস্থায় আমাদের আল্লাহর উপরই ভরসা রাখতে হবে এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ বলেন,وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘যদি আল্লাহ তোমাকে কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউ নেই। পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার কল্যাণ দান করেন, তবে তিনিই তো সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান’ (আল-আনআম, ৬/১৭)। 

সুতরাং একমাত্র আল্লাহই মানুষকে কষ্ট দেন এবং তিনিই একমাত্র উদ্ধারকারী। যেসব কারণে তাবীয ব্যবহার হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে জিনের আছর এবং বদনযর। আর এই দুই রোগের চিকিৎসা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন ঝাড়ফুঁক ও নিয়মিত দু‘আ-কালাম পড়ার মাধ্যমে। সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ঝাড়ফুঁক করাই হচ্ছে সঠিক ত্বরীক্বা।

‘ওষুধ জায়েয হলে তাবীয নয় কেন?’-এর জবাব :

যেসব ছূফীবাদীরা তাবীযকে জায়েয করতে চায়, তাদের দাবি হলো, অসুস্থ হলে যেমন ওষুধ নিতে হয় ঠিক তেমনি জিন বা বদনযরসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও হলো তাবীয। ওষুধ নেওয়া যদি জায়েয হয়, তাহলে তাবীয নেওয়াও জায়েয হবে!

তাদের দাবি চমৎকার হলেও ভিত্তি নেই। কারণ অসুস্থ হলে আল্লাহর উপর ভরসা করে ওষুধ খেতে বলেছেন খোদ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হাদীছে এসেছে, জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হারূন ইবনু মা‘রূফ এবং আবূ তাহির ও আহমাদ ইবনু ঈসা রহিমাহুল্লাহ ...জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু-এর সনদে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, প্রতিটি ব্যাধির প্রতিকার রয়েছে। অতএব, রোগে যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ করা হলে আল্লাহর ইচ্ছায় আরোগ্য লাভ হয়।[11]

সুতরাং যেকোনো রোগের কারণে হালাল ওষুধ নেওয়া জায়েয। কিন্তু তাবীয কোনো ওষুধ নয়। 

সেইসাথে ওষুধ নেওয়া এবং ঝাড়ফুঁক করা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা। কিন্তু তাবীয নেওয়া এবং দেওয়া কোনোটাই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা নয়। অতএব, ওষুধের সাথে তাবীযের মিল খোঁজাটা সম্পূর্ণ বোকামি। 

কুফরী কাজে তাবীয :

তাবীয জায়েয মনে করার কারণে অনেক মুসলিম দুনিয়াবী স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজে তাবীযের সাহায্য নেয়। যেমন- জোর করে কাউকে বিয়ে করা, স্বামীকে বশ করা, মা সন্তানের সম্পর্ক নষ্ট করা, সম্পত্তি অর্জন, শত্রুর ক্ষতি করা ইত্যাদি।

এটা অনস্বীকার্য যে, জাদুটোনা সত্য। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরও জাদু করা হয়েছিল। কিন্তু জাদুর পরিবর্তে জাদু করার শিক্ষা ইসলামে নেই। এটা আল্লাহর একটা পরীক্ষা।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই তাবীয ক্ববয করেননি এবং করতে নির্দেশও দেননি। বরং যেকোনো ধরনের তাবীযকে নিষিদ্ধ করেছেন। সেইসাথে যেকোনো অসুস্থতায় ঝাড়ফুঁক ও দু‘আ-কালাম পড়তে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।


[1]. মুয়াত্ত্বা মালেক, হা/১৬৮৭; ছহীহ বুখারী, হা/৩০০৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২১১৫।

[2]. আহমাদ, হা/১৭৪৪০।

[3]. আহমাদ, হা/১৭৪৫৮, সনদ ছহীহ।

[4]. আবূ দাঊদ, হা/৩৬; নাসাঈ, হা/৫০৬৭; মিশকাত, হা/৩৫১, সনদ ছহীহ।

[5]. আবূ দাঊদ, হা/৩৮৮৫; ইবনু মাজাহ, হা/৩৫৩০; আহমাদ, হা/৩৬১৫; মিশকাত, হা/৪৫৫২, সনদ ছহীহ।

[6]. আবূ দাঊদ, হা/৩৮৮৫; আহমাদ, হা/৩৬১৫; সনদ ছহীহ, মিশকাত, হা/৪৫৫২।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৮৬২; আবূ দাঊদ, হা/৩৮৮৬; মিশকাত, হা/৪৫৩০।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৩৯; ছহীহ মুসলিম, হা/৫৮৫৪; মিশকাত, হা/৪৫২৮।

[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৮৫৩।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭২০।

[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৬৩৪।

Magazine