কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

গাদীরে খুম ও আশূরায়ে মুহাররম

post title will place here

হিজরী বা ইসলামী বর্ষপঞ্জির শেষ মাস যিলহজ্জ, এই মাসের ৯ তারিখ আরাফার দিন, ১০ তারিখ ঈদুল আযহা। অনেকেই বিশেষত শীআ সম্প্রদায় এই যিলহজ্জ মাসে ঈদুল আযহার এক সপ্তাহ পরেই ১৮ যিলহজ্জ তারিখে ঈদে গাদীরে খুম (عيد غدير خم) ঈদুল বেলায়াত (عيد ولاية علي) নামে উদযাপন করে। বাংলাদেশের অনেকেই একে ‘মাওলার অভিষেক দিবস’ নামে অভিহিত করেন। এর ১২ দিন পরেই হিজরী এক বছর শেষ হয় ও নতুন আরেক বছর শুরু হয়, যার প্রথম মাস হলো মুহাররম। এই মাসের ১০ তারিখ পবিত্র আশূরা। এই আশূরায় কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী মুসলিমরা ছিয়াম রাখে, অপরদিকে শীআ সম্প্রদায় আশূরাসহ মুহাররম মাসে কারবালায় হুসাইন রযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদাতের শোক পালন করে। তাই এ বিষয়ে প্রবন্ধটি লেখা হলো। 

প্রথমত গাদীরে খুমের ঘটনার প্রসঙ্গে আসা যাক। মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেওয়ার আগে জীবনের শেষদিকের ঘটনাগুলো ইসলামের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মধ্যে বিদায় হজ্জ ও গাদীরে খুমের ঘটনা অন্যতম। বাংলাদেশের ও বাংলাভাষী অনেক মুসলিমই হয়তো গাদীরে খুম বিষয়ে তেমন কিছুই জানেন না অথবা এ বিষয়ে অজ্ঞ। 

বিদায় হজ্জ ছিল রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদীনার জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিদায় হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা হতে মদীনার দিকে যাত্রা করেন এবং ১৮ যিলহজ্জ তারিখে ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছেন ও সেখানে যাত্রাবিরতি করেন। এটি ছিল মক্কা হতে তিন মাইল দূরে ‘জোহফা’ নামক স্থান, যা মক্কা ও মদীনার মাঝে অবস্থিত। এখানে পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি খুৎবা প্রদান করেন। এটিকে বলা হয় ‘গাদীরে খুম’-এর খুৎবা। এ বিষয়ে সঠিক তথ্য এই যে, ‘খুম্ম’ কুয়ার নিকট পৌঁছে বুরাইদা আসলামী রযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে ইয়ামান যুদ্ধের সফরে আলী রযিয়াল্লাহু আনহু-এর রুক্ষ ব্যবহার সম্পর্কে অভিযোগ পেশ করেন। এতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। গাদীরে খুম-এ যখন খুৎবা প্রদান করেন তখন আলী রযিয়াল্লাহু আনহুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেই দিন নবীজি মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাহাবায়ে কেরাম ও আহলে বায়তের সদস্যরা সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন। যোহরের ছালাতের পরে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাদীরে খুমের সেই খুৎবা প্রদান করেন। যাতে তিনি তার মৃত্যু সন্নিকটে হওয়ার ইশারা করেন এবং কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার তাগিদ দেন। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىٌّ مَوْلاَهُ ‘আমি যার বন্ধু, আলী তার বন্ধু’।[1]

কিন্তু শীআরা উপরিউক্ত হাদীছের আলোকে আলী রযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রথম খলীফা হিসেবে বিশ্বাস করে, একই ধরনের কথা সদর উদ্দীন চিশতীর ‘মাওলার অভিষেক ও ইসলামে মতভেদের কারণ’ বইয়েও রয়েছে। ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, শীআরা এর অর্থ করেছে, আলী রযিয়াল্লাহু আনহু শাসন ক্ষমতাসহ সকল কাজে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্থলাভিষিক্ত। অথচ এর অর্থ কেবল আলী রযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা।[2] শায়খ আলবানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, শীআরা এখানে হাদীছ তৈরি করেছে إنَّهُ خَلِيْفَتِي مِنْ بَعْدِي ‘সে আমার পরে খলীফা’ যা কোনো সূত্রেই বিশুদ্ধ নয়। বরং এটি তাদের রচিত অগণিত মিথ্যাসমূহের অন্যতম।[3] এভাবে শীআরা রাজনৈতিক কারণে আলী রযিয়াল্লাহু আনহু-এর মর্যাদা বর্ণনায় ৩ লাখ জাল হাদীছ বানিয়ে নিয়েছে।[4] 

১৮ যিলহজ্জের গাদীরের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শীআ সম্প্রদায় একে ঈদে গাদীর বা ঈদুল বেলায়াত হিসেবে এবং আমাদের এই দেশে সদর উদ্দীন চিশতী নামে এক পীর লেখক ও বাউল বয়াতীদের অনুসারীরা একে মাওলার অভিষেক দিবস হিসেবে পালন করে। ইদানীং আমাদের বাংলাদেশে আবসার তৈয়বীসহ সুন্নী নামধারী একদল তাফযীলী ও শীআ প্রভাবিত বিদআতীও এই দিনকে ঈদ হিসেবে পালন শুরু করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এই দিনে জশনে জুলুস র‍্যালীরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শীআ সম্প্রদায় শাসিত রাষ্ট্র ইরানে এই ১৮ যিলহজ্জকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেখানে শীআরা ধুমধামে এই দিন পালন করে, সেখানে আনন্দ-ফূর্তি করে, সেদেশের অধিকাংশ রেডিও ও টিভি চ্যানেলে দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালাও সম্প্রচার করে থাকে। ইদানীং ইয়ামানের অনেক যায়েদী শীআও ১২ ইমামী শীআদের সাথে মিল রেখে প্রতি বছর এই কথিত ঈদে গাদীর দিবস উদযাপন করছে। বিশেষত ইয়ামানের ইরান ও লেবাননের হিযবুল্লাহ সমর্থিত সশস্ত্র দল হূছি কট্টর শীআ বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও তাদের অনুসারী সুপ্রিম পলিটিকাল কাউন্সিল বা মাজলিসু সিয়াসিল আ‘লা প্রতি বছর এই ঈদে গাদীর বা ঈদুল বেলায়াত উদযাপন করছে। জেনে রাখা উচিত, এই হূছিরা পুরোপুরি যায়েদী নয়; বরং তারা যায়েদীদের উপশাখা জারুদিয়া নামক সম্প্রদায় থেকে আগত। এই জারুদিয়া শীআরা রাফেযী ও ১২ ইমামী সম্প্রদায়ের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করে। 

৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ ৩৫ হিজরীর ১৮ যিলহজ্জে ইসলামের তৃতীয় খলীফা উছমান ইবনে আফফান রযিয়াল্লাহু আনহু খারেজীদের হাতে শহীদ হন। যা ছিল একটা মর্মান্তিক ঘটনা। তাই একারণে ১৮ যিলহজ্জকে ঈদ হিসেবে পালন করাকে বিদআত বলে মনে করেন আহলুস সুন্নাহর অনুসারী অধিকাংশ মুসলিম। হাদীছে গাদীর এর নাম দিয়ে বিভিন্ন ছবিযুক্ত পোস্টার বা চিত্রাঙ্কন প্রচার করা এগুলো স্পষ্ট গোমরাহি। বিশেষত যা দেখা যায়, গাদীরে খুম এর প্রতীক হিসেবে দুই জন জুব্বা পরিহিত লোকের ছবি দেওয়া হয়, যার একজন অন্যের ডান হাত উঁচু করে আছেন, সামনে অনেক মানুষ। যেন একবিংশ শতাব্দীর সাথে তাল মিলিয়ে গাদীর উদযাপন। কিন্তু এটা করা জায়েয নয়। 

ইতিহাসের আলোকে ৩৫৬ হিজরী অর্থাৎ ৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের আগে কেউ এই ১৮ যিলহজ্জকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করত না। এমনকি খোদ আলী ইবনু আবী তালেব রযিয়াল্লাহু আনহু-সহ অন্য ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এমনকি ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহও এই ১৮ যিলহজ্জকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করেননি। 

দ্বাদশ শতাব্দীর মনীষী ইমাম শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী রহিমাহুল্লাহ উনার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘তুহফায়ে ইছনা আশারিয়্যা’-তে লিখেছেন, (রাফেযী শীআরা) ‘ইহদাছে ঈদে গাদীর’ অর্থাৎ ঈদে গাদীর নামে একটি নতুন ঈদ আবিষ্কার করেছে, যা ১৮ যিলহজ্জ পালন করে। আর (তাদের আবিষ্কৃত) ঐ ঈদকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার চেয়েও বেশি মর্যাদা দেওয়া এবং এটাকে ঈদে আকবর নামে অভিহিত করা সরাসরি শরীআতবিরোধী।[5] 

দ্বিতীয়ত মুহাররম মাস। হিজরী বা ইসলামী বছরের প্রথম মাস। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা চারটি মাসকে হারাম মাস বা সম্মানিত ও নিষিদ্ধ মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই চার মাস হলো মুহাররম, রজব, যিলক্বদ ও যিলহজ্জ। তাই মুহাররম মাস একটি সম্মানিত ও পবিত্র মাস। এই মুহাররম মাসের ১০ তারিখ তথা আশূরা ইসলামের একটি সম্মানিত ও পবিত্র দিবস। এই মাস আল্লাহর একটা সম্মানিত মাস। এই মাসে সকল গুনাহ, শিরক-বিদআত ও খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা উচিত। 

আশূরার দিনটি একটা ফযীলতপূর্ণ দিবস। এই আশূরায় মূসা আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহ তাআলা ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন এবং আল্লাহ তাআলা ফেরাউনকে সাগরে ডুবিয়ে মারেন। আশূরার দিনের অন্যতম আমল হলো আশূরার ছিয়াম। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাররম মাসের ৯ ও ১০ তারিখের ছিয়ামকে সুন্নাত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইয়াহূদীরা আশূরায় এক দিন ছিয়াম রাখত, তাই ইয়াহূদীদের বিপরীতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশূরায় দুই দিন ছিয়াম রাখতে বলেছেন। এই ছিয়াম মূলত মূসা আলাইহিস সালাম-এর বিজয়ের শুকরিয়াস্বরূপ। এই ছিয়ামের সাথে কারবালার ঘটনার কোনো সম্পর্ক নাই।

আমাদের বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে অনেক মুসলিমের মধ্যে এই ধারণা প্রসিদ্ধ যে, ১০ মুহাররম আশূরার দিনে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, এই দিনে নবী আদম আলাইহিস সালাম-এর জন্ম হয় ও এই দিনেই তার ইন্তেকাল হয়, এই দিনে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর জন্ম হয়, এই দিনে নবী ইউনুস আলাইহিস সালাম মাছের পেট থেকে ফিরে আসেন, এই দিনে নবী ঈসা ইবনু মারইয়াম আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। আল্লাহই ভালো জানেন।

এটা সত্য যে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর অনেক বছর পরে ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে (৬১ হিজরীতে) এই ১০ মুহাররম আশূরার দিনেই বর্তমান ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালায় হুসাইন ইবনু আলী রযিয়াল্লাহু আনহু সুন্নাতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদ হন, কিন্তু অনেকেই হুসাইন রযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদাতের কারণে আশূরাকে শোক দিবস বা শহীদ দিবস এবং মুহাররম মাসকে শোকের মাস মনে করেন। এটা সঠিক নয়। কেননা ইসলামে তিন দিনের বেশি শোক দিবস জায়েয নেই। তাই যারা মুহাররম মাসকে শোকের মাস মনে করে, তারা পথভ্রষ্ট। বিশেষ করে আমরা মুসলিম বিশ্বে দেখি মুহাররম মাস আসলেই শীআরা লাল ও কালো রঙের পতাকা-ব্যানার টানায়। তারা আশূরার দিনে শোক মিছিল, তা‘যিয়া, মাতম, বুক ও মাথা চাপড়ানো, ঢাকঢোল, বাঁশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো, শরীর রক্তাক্তকরণ বা তাতবীর, শোকগাথা ও নাওহা গাওয়া, মোমবাতি জ্বালানো ইত্যাদি কাজকর্ম করে, যা শতভাগ বিদআত ও হারাম। যারা এসব কর্মকাণ্ড করে তারা মূলত ১২ ইমামী শীআ, রাফেযী শীআ, ফাতেমী বা বোহরা শীআ এবং ইয়ামানের হূছি শীআ। 

বাংলাদেশে ঢাকার বকশিবাজারে হোসেনী দালান ইমামবাড়া, ফরাশগঞ্জে বিবি কা রওযা ইমামবাড়া ও তার আশপাশের এলাকা, পল্টন, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর ও রাজশাহীসহ অনেক জেলায় এসব হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, লেবানন, বাহরাইন, ইয়ামান, তুরস্ক, আজারবাইজান, নাইজেরিয়া, তানজানিয়া, কেনিয়া ও ঘানায় শীআরা তাজিয়া মিছিল করে থাকে। বর্তমানে জাপান, পশ্চিমা বিশ্ব তথা ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশে (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা) ও অস্ট্রেলিয়াতেও শীআরা এসব করে থাকে।

শীআদের পাশাপাশি বাংলাদেশের ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, জেনেভা ক্যাম্প কলোনীসহ এরকম অনেক অঞ্চলে, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামের হালিশহর ও তার আশপাশের কিছু অঞ্চলে, খুলনা এবং নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবাঙালি উর্দূভাষী বিহারী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোকজন এই আশূরায় তাজিয়া ও পাইক মিছিল বা তাজিয়াদারী করে ঢাকঢোল বাজায় ও বিভিন্ন মরসিয়া গীতি গায়। যদিও এরা নিজেদেরকে সুন্নী বলে দাবি করে কিন্তু তাদের মধ্যে ছহীহ আক্বীদা-মানহাজের দাওয়াহ ও তাবলীগের অভাবে তারা এসব বিদআতে আক্রান্ত। মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফেনী, রংপুর, কুমিল্লা ও চাঁদপুরসহ এরকম অনেক জেলায় কতিপয় ছূফী পীর দরবার ও তাদের অনুসারী লোকজনেরাও বিশেষত মানিকগঞ্জে গড়পাড়া ইমামবাড়ী পীর, রাজবাড়ীতে আঞ্জুমানে কাদেরিয়াসহ এজাতীয় কতিপয় পীর ও তাদের অনুসারীরাও আশূরায় তাজিয়া মিছিল করে, লাল কালো সবুজ পতাকা নিশান উড়ায় ও মোমবাতি আগরবাতি জ্বালানোর মতো বিদআতী কর্মকাণ্ড করে। অজ্ঞতা, বিভ্রান্তি ও কৌতূহল থেকে এসব মিছিলে লোক সমাগম একটি বড় কারণ। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনেক অঞ্চলে অনেকে বিশেষ করে কতিপয় বিদআতীরা এদিন জারি গান গায়, যা শতভাগ নাজায়েয ও হারাম।

অপরদিকে নাছেবীসহ অনেকে এইদিনে এমন কিছু আমল বা কর্মকাণ্ড করে যার ভিত্তি কুরআন, সুন্নাহ ও খায়রুল কুরূন এর যুগে বা তিন যুগে এর ভিত্তি পাওয়া যায় না। যেমন ১০ মুহাররমে চোখে সুরমা লাগানো, একে ফযীলত বা ছওয়াবের কাজ মনে করা, আশূরার দিনে উত্তম পোশাক পরিধান করাকে ছওয়াবের কাজ মনে করা ও এদিন আনন্দ-ফূর্তি করা, এদিনকে ঈদ হিসেবে গণ্য করা, বাদ্য-বাজনাসহ গান গাওয়া ও নাচানাচি করা, আতশবাজি পটকা ফুটানো, একে অপরের গায়ে পানি ছিটানো/স্প্রে করা, মেহেদি লাগানো ইত্যাদি। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশে বিশেষত মরক্কো, আলজেরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, কমোরোস এসব দেশের অনেক এলাকায় এসব লক্ষ করা যায়। এসব দেশে শীআদের সংখ্যা খুবই কম বা নগণ্য, এসব দেশে সুন্নী বা আহলুস সুন্নাহর অনুসারী মুসলিমদের সংখ্যা ৯০-৯৯ ভাগ। এসব দেশে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শীআ মতবাদকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। বিশেষত ১২ ইমামী ও রাফেযী শীআদের আক্বীদা মতাদর্শকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে মরক্কোতে অনেক জায়গায় নারী-পুরুষ একত্রে নাচ-গান, ঢোল-তবলা বাজিয়ে মিছিল শোভাযাত্রা করে ও অনেক পুরুষ বড় বড় দালানে জড়ো হয়ে হাততালি দিয়ে দুর্বোধ্য সব কর্মকাণ্ড করে থাকে, সেখানে অনেক ছূফীরাও এসব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে।[6]

তবে আলজেরিয়াতে এগুলো খুবই কম হয়। আলজেরিয়াতে অনেক লোক আশূরার দিনে যাকাত দিয়ে থাকে। সেদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একদল লোক এই দিনে নাচ-গান, বাদ্যের আয়োজন করে থাকে, যাকে তারা ‘সেবিবা’ বলে।[7]

এসব দেখে শীআ সম্প্রদায়ের লোকেরা আহলুস সুন্নাহর অনুসারী মুসলিমদেরকে উদ্দেশ্য করে তারা বলে, সুন্নীরা বা আহলে সুন্নাহর অনুসারীরা নাকি আশূরার দিনে হুসাইন রযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদাতের দিনে আনন্দ উদযাপন করে (নাঊযুবিল্লাহ)। কিন্তু উপরিউক্ত কর্মকাণ্ড অর্থাৎ আশূরায় প্রথম পক্ষ শীআদের শোক মাতম তাজিয়াদারী এবং অপর পক্ষ যারা এই দিনে আনন্দ উদযাপন করে ঈদ হিসেবে গণ্য করে, তাদের থেকে আহলুস সুন্নাহ, কুরআন সুন্নাহর অনুসারী মধ্যমপন্থি মুসলিম সম্পূর্ণ ভিন্ন।

মূলত আশূরায় শীআদের শোক পালন তাজিয়া মিছিল, মাতম আব্বাসীয় খলীফা মুত্বী‘ ইবনু মুক্বতাদিরের সময়ে (৩৩৪-৩৬৩ হি./৯৪৬-৯৭৪ খ্রি.) তাঁর কট্টর শীআ আমীর আহমাদ ইবনু বূইয়া দায়লামী ওরফে মুইযযুদ্দৌলা ৩৫১ হিজরীতে ১৮ যিলহজ্জকে ঈদে গাদীর হিসেবে ঘোষণা করে। ৩৫২ হিজরীর শুরুতে ১০ই মুহাররমকে তিনি ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন ও মহিলাদেরকে শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহর ও গ্রামের সর্বত্র সকলকে শোকমিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শীআরা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। কিন্তু সুন্নীরা চুপ হয়ে যান। পরে সুন্নীদের উপরে এই ফরমান জারী করা হলে ৩৫৩ হিজরীতে উভয় দলের ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। ফলে বাগদাদে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ ও সামাজিক অশান্তির সৃষ্টি হয়।

আল-মুইযযু লিদীনিল্লাহি ফাতিমী (বেদ্বীন কট্টর শীআ) মিশরেও এই হুকুম জারী করে। একথা সত্যান্বেষী ইতিহাসবিদদের কাছে প্রসিদ্ধই আছে। উদাহরণস্বরূপ ইবনুল আসীর রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক রচিত আল-কামেল ফিত তারীখ, ৭/২৭৯; ইবনে কাছীর রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক রচিত আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৫/২৬১ (৩৫২ হিজরীর ঘটনাবলি) ও মাওলানা হাবীবুর রহমান আযমী রহিমাহুল্লাহ-এর ‘ইবতালে আযাদারী’ কিতাবে তার সুস্পষ্ট বিবরণ দেখা যেতে পারে।

শীআ সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশেষত ১২ ইমামী ও রাফেযী শীআরা বলে, আশূরায় ছিয়াম রাখা বিদআত। কিন্তু শীআদের হাদীছ গ্রন্থে দেখা যায়, তাদের অনেক হাদীছ গ্রন্থে এই ছিয়ামের পক্ষে স্বীকৃতি পাওয়া যায়। ওয়াসায়িলুশ শীআ গ্রন্থে বর্ণিত আছে, আলী রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তোমরা ৯ ও ১০ মুহাররমে ছিয়াম রাখো, এতে তোমাদের পূর্বের গুনাহ মাফ হবে। তাদের ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকির বলেছেন, আশূরার দিনে ছিয়াম রাখলে সারা বছরের গুনাহ দূর হয়ে যায়।[8] তাদের পঞ্চম ইমাম মূসা আল-কাযিম বলেছেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশূরার দিনে ছিয়াম রাখতেন।[9] 

আশূরায় উপমহাদেশে শীআদের তাজিয়া মিছিলে কয়েকটা ঘোড়াকে রাজকীয় কারুকার্যখচিত করে সেগুলোকে জুলজিনা আখ্যায়িত করে অনেক শীআ এগুলো নিয়ে আসে। সেই ঘোড়াকে দেখলে দুধভর্তি ছোট-বড় গ্যালন ও বোতল হাতে অনেক লোককে ছুটে আসতে দেখা যায়, এমনকি অনেক শীআ তাকে সিজদাও করে (নাঊযুবিল্লাহ)। এ তো দেখলেই বুঝা যায়, ঘোড়ার পূজা চলছে শীআদের মিছিলে, যা সুস্পষ্টরূপে শিরক।

আবার এই তাজিয়া মিছিলে অনেকে শরীর রক্তাক্ত করে, খোদ শীআ সম্প্রদায়ের অনেক আলেমও এটাকে নাজায়েয ও বিদআত বলেছেন। বিশেষত ইরানের শীআদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা, ইরাকে শীআদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ সিস্তানী, মুক্তাদা আল-সদর, বাকির আল-সদর, লেবাননের হুসাইন ফাযলুল্লাহ এজাতীয় অনেক শীআ আলেম এই তাতবীর বা শরীর রক্তাক্তকরণকে নাজায়েয বলেছেন। 

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শোকে গাল চাপড়ায়, কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহেলী যুগের মতো বিলাপ করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[10]

শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া রহিমাহুল্লাহ ইরাকের কূফাতে বসবাসরত দু’টি পথভ্রষ্ট দল সম্পর্কে আলোচনা করেন যারা আশূরার দিবসকে তাদের বিদআত বাস্তবায়ন করার জন্য উৎসব হিসেবে গ্রহণ করত। এ দুই দলের একদল হচ্ছে রাফেযী, যারা আহলে বায়তের প্রতি ভালোবাসা দেখায় আর ভিতরে ভিতরে তারা হয়তো ধর্মত্যাগী মুরতাদ, নয়তো কুপ্রবৃত্তির অনুসারী জাহেল। আর অপর দল হচ্ছে নাছেবী যারা ফেতনার সময় যে যুদ্ধ হয়েছে সে কারণে আলী রযিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে।[11] 

উপমহাদেশের বিখ্যাত হানাফী আলেম মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষ্নৌবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, মুহাররমের ১০ দিনে কিংবা অন্য কোনো সময়েও তাযিয়া, ঝাণ্ডা ও দুলদুল প্রভৃতি তৈরি করা বিদআত। এর প্রমাণ নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাবেঈন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এসব জিনিস নিজেদেরই আবিষ্কৃত এবং নির্ধারিত। যার সম্মান করা ‘ঠাকুর পূজা’র মতোই। হানাফী ব্রেলভী আলেম মাওলানা রেজা খান ব্রেলভী (যাকে ব্রেলভী রেজবীরা আলা হযরত বলে) বলেন, শীআদের মজলিসে ও তাদের তাজিয়া মিছিলে অংশগ্রহণ করা হারাম, তাজিয়া তৈরি করা নাজায়েয ও মুহাররমে ঢোল বাজানো হারাম।[12]

খোদ ব্রেলবী সাহেবও এসম্পর্কে ‘রিসালায়ে তাযিয়াদারী’ নামে স্বতন্ত্র একটি পুস্তিকা লিখেছেন। তাদের আলেম মাওলানা আমজাদ আলীর গ্রন্থ ‘বাহারে শরীআত’-এ উল্লেখ আছে, তাজিয়া করা, সেখানে মানত করাও গুনাহ। 

সঊদী আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ বলেছেন, আশূরায় শীআদের কর্মকাণ্ড বিদআত ও গোমরাহি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সকল শিরক-বিদআত, ফেতনা-ফাসাদ থেকে রক্ষা করুন- আমীন!

শেখ আহসান উদ্দীন

সূত্রাপুর, ঢাকা।

[1]. আহমাদ, হা/২২৯৯৫; হাকেম, হা/৪৫৭৮।

[2]. মিরক্বাত, হা/৬০৯১-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[3]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১৭৫০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[4]. ড. মুছত্বফা সাবাঈ, আস-সুন্নাহ ফীত তাশরীঈল ইসলামী (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৪র্থ সংস্করণ : ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ৮১।

[5]. তুহফায়ে ইছনা আশারিয়া (উর্দূ), পৃ. ৫১৪।

[6]. https://youtu.be/RMTiQfAzc1c.

[7]. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ashura_in_Algeria.

[8]. শেখ তূসি, তাযহীবুল আহকাম, শীআ আলেম খোয়েঈ-এর দৃষ্টিতে ছহীহ।

[9]. তাযহীবুল আহকাম।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৯৭।

[11]. মিনহাজুস সুন্নাহ ও ফাতাওয়া কুবরা।

[12]. আহকামে শরীআত ও ফতওয়ায়ে রজভীয়া, ৩য়, ৬ষ্ঠ ও ১০ম খণ্ড।

Magazine