কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ফিলিস্তীন সংকটে মুসলিম উম্মাহর করণীয়

post title will place here

ফিলিস্তীনের চিত্র আজও পৃথিবীর প্রতিটি মানবিক হৃদয়ে গভীর যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। পিতা তার সন্তানের ছিন্নভিন্ন দেহের অংশ দুটো টুকরো কাপড়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, মা চিৎকার করে কাঁদছেন, কারণ সন্তানের দেহের বাকি অংশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিশুদের লাশ পড়ে আছে, খুলি ফেটে চৌচির, কান দিয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত আর মগজ। ফিলিস্তীন, যেটি অতীতে অসংখ্য নবী-রাসূলের স্মৃতিতে পূর্ণ ছিল, আজ অবৈধ ইয়াহূদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের হাতে তছনছ হয়ে গেছে।

যারা এক সময় অনাহারী অবস্থায় ফিলিস্তীনে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের দেওয়া আশ্রয়ে এখন রক্ত ঝরছে। এত অত্যাচারের পরও মুসলিমরা মাসজিদুল আক্বছা এবং ফিলিস্তীন ত্যাগ করেনি। কারণ—

(১) ফিলিস্তীন হলো সেই পবিত্র স্থান, যেখানে অসংখ্য নবী-রাসূলের আগমন হয়েছিল।

(২) আল-আক্বছা ছিল কা‘বার পূর্বে আমাদের প্রথম কিবলা এবং আল্লাহ তা কা‘বার দিকে পরিবর্তন করেছিলেন।[1]

(৩) আল- আক্বছা হলো সেই মসজিদ, যার সম্পর্কে মহান আল্লাহ আয়াত নাযিল করেছেন এবং যার আশপাশের স্থানকে পবিত্র ও বরকতময় ঘোষণা করেছেন। আর এখান থেকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিস্ময়কর যাত্রা মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল (আল-ইসরা, ১৭/১)

(৪) শাম অঞ্চলের উপর ফেরেশতাগণ তাদের ডানা বিছিয়ে রেখেছেন, যেখানে ফিলিস্তীন অন্তর্ভুক্ত।[2]

(৫) শাম হবে হাশরের ময়দান।[3]

(৬) ফিলিস্তীনের লুদ এলাকায় দাজ্জালকে হত্যা করা হবে।[4]

ফিলিস্তীন সংকট ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে করণীয়:

ফিলিস্তিন সংকট একটি দীর্ঘকালীন মানবিক ও রাজনৈতিক সমস্যা, যা শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তীনের জনগণ বছরের পর বছর ধরে অত্যাচার ও ভূমি দখলের শিকার এবং এই সংকট সমাধানে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য অপরিহার্য। মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো, আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ করে ফিলিস্তীনের জনগণের প্রতি সমর্থন জানানো এবং তাদের মুক্তির জন্য কাজ করা। এক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে করণীয় হলো—

(১) দু'আ ও আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া: ফিলিস্তীনের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে অধিক প্রার্থনা করা আবশ্যক। অন্তর থেকে প্রার্থনা আমাদের ঈমানকে দৃঢ় করে এবং আল্লাহর সাহায্য এনে দেয়।

(২)ইসরাঈলি পণ্য বয়কট: ইসরাঈল পৃথিবীর একমাত্র ইয়াহূদী রাষ্ট্র, যা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং বিশ্বের নানা দেশে তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে। মুসলিম হিসেবে আমাদের ঈমানী দায়িত্ব ইসরাঈলি পণ্য বয়কট করা। যখন আমরা তাদের পণ্য বর্জন করব, তখন তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা তাদের ফিলিস্তীনিদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে বাধ্য করবে। আলেম-উলামা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

(৩)নিজেকে উত্তম মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা: নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা এবং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনীর শিক্ষা অনুসরণ করা। এভাবে একজন মুসলিম হিসাবে নিজের জীবনকে উন্নত করতে হবে।

(৪)জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন: মুসলিম উম্মাহ বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। কুরআনে কারীমের প্রথম নির্দেশ ‘ইক্বরা’ (পড়ুন) মুসলিমদের জন্য নির্দেশ। সঠিক জ্ঞান অর্জনই মুসলিম উম্মাহর উন্নতির পথ।

(৫)মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠা: কুরআন-হাদীছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠার বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১০)। মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধভাবে একত্রিত করতে হবে, যাতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মুসলিমদের দুঃখ-দুর্দশায় আমরা একসাথে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি।

(৬)আখেরাতমুখী দুনিয়া: ইসলামের সোনালি যুগের মানুষ দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখেরাতের জন্য কাজ করতেন। মুসলিম উম্মাহর দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ হলো দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা ও মৃত্যুভীতি। ছাওবান রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা একদিন এভাবে দুনিয়ার স্বার্থের মোহে পড়ে মুসলিমদের উপর বিজাতিরা আক্রমণ করবে’।[5] আমাদের উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়াবি লাভের সাথে আখেরাতের উদ্দেশ্যকে সমন্বয় করা।

(৭)ইসলামী শিক্ষা ও ছাহাবীদের আদর্শ: শৈশব থেকেই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা অর্জন করা উচিত। ছাহাবীদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের আদর্শকে জীবনে প্রয়োগ করতে হবে।

(৮)শাসনব্যবস্থার জ্ঞান অর্জন: গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরী।

(৯)ফিলিস্তীন সচেতনতা বৃদ্ধি: ফিলিস্তীন সম্পর্কে বই, প্রবন্ধ, তথ্য, ছবি সংগ্রহ করে তা পরিবার ও সমাজে প্রচার করতে হবে, যাতে আমরা সবাই সচেতন হতে পারি।

(১০)ইখতেলাফি মাসআলায় ঐক্য বজায় রাখা: ইখতেলাফি মাসআলা নিয়ে পারস্পরিক বিভেদের বদলে এক আল্লাহর গোলাম ও নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হিসেবে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

(১১)অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া: মুসলিমদের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করা জরুরী। ব্যবসা ও আয়-উপার্জন করতে গিয়ে যেন ইসলামী শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয় এবং সেটি নেক আমল হিসেবে পরিণত হয়।

(১২)জ্ঞানগত দৈন্যতা কাটানো: মুসলিম উম্মাহকে জ্ঞানবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে হবে। কুরআন মাজীদ ও ছহীহ হাদীছে এর গুরুত্ব রয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

(১৩)ঔপনিবেশিক মন-মানসিকতা থেকে মুক্তি: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতা আমাদের মাঝে যেসব বীজ বপন করেছে, তা থেকে মুক্তি পেতে হবে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো নিজের জাতি ও দেশের কল্যাণে কাজ করা।

(১৪)ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় নষ্ট না করা: মুসলিম যুবক-যুবতিদের উচিত নিজেদের মূল্যবান সময় সঠিকভাবে ব্যবহার করা এবং পড়াশোনা ও উন্নতিতে মনোযোগী হওয়া।

(১৫)ফিলিস্তীনি ভাইদের জন্য আর্থিক সহায়তা: ফিলিস্তীন ও অন্যান্য অত্যাচারিত মুসলিমদের জন্য আর্থিক সহায়তা পাঠানো ও সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

(১৬)আইটি সেক্টরে শক্তি বৃদ্ধি: মুসলিমদের জন্য আইটি সেক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে দক্ষতা অর্জন করা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ লাভ করার জন্য এ সেক্টরে সময় ব্যয় করতে হবে।

(১৭)সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সহায়তা: সামাজিক মাধ্যম দ্বারা মুসলিমদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইসলামের পক্ষে কথা বলা।

(১৮)নারীদের ভূমিকা: নারী সমাজের উন্নতির জন্য তাদের যথাযথ শিক্ষা ও আদর্শ প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নারীরা মানবসভ্যতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

(১৯)পরিবারের দ্বীনের পথে চালনা: পরিবারের সদস্যদের দ্বীনের পথে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা চালানো উচিত, যাতে পুরো পরিবার আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে পারে।

(২০)নারী ছাহাবীদের আদর্শ: নারীদের জীবন গঠন করতে হবে ছাহাবী নারীদের মতো, যেমন খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা, আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা ও ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা। তাদের আদর্শ অনুসরণ করলে একজন মুসলিম নারীও মহান চরিত্র অর্জন করতে পারেন।

উল্লেখিত এসব দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা ফিলিস্তীনসহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!

মেহেদী হাসান সাকিফ

দত্তপাড়া, টংগী, গাজীপুর।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪০।

[2]. তিরমিযী, হা/৩৯৫৪, হাদীছ ছহীহ।

[3]. আহমাদ, হা/২০০১১।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৭।

[5]. আবূ দাঊদ, হা/৪২৯৭, হাদীছ ছহীহ।

Magazine