কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

শারঈ দৃষ্টিকোণে পিতামাতার অধিকার ও সদাচরণ

ভূমিকা: আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন জায়গায় একমাত্র তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে আদেশ দিয়ে তা ফরয করেছেন। যেমনটি আল্লাহ নিজের শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতার সাথে পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতাকে একত্রিত করে তা অপরিহার্য করেছেন। এমনকি তারা মুশরিক হলেও তারা সদ্ব্যবহার পাওয়ার হক্বদার। মহান আল্লাহ বলেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا - وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا - رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا فِي نُفُوسِكُمْ إِنْ تَكُونُوا صَالِحِينَ فَإِنَّهُ كَانَ لِلْأَوَّابِينَ غَفُورًا

‘আপনার রব হুকুম জারি করেছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না আর পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের একজন বা তাদের উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ্’ শব্দটিও বলবে না আর তাদেরকে ধমক দিবে না। তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলবে। তাদের জন্য নম্রতার বাহু অবনত করবে আর বলবে, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালনপালন করেছেন। তোমাদের রব খুব ভালো করেই জানেন তোমাদের অন্তরে কী আছে। তোমরা যদি সৎকর্মশীল হও, তবে নিশ্চয়ই তিনি “তাঁর দিকে বারংবার প্রত্যাবর্তনকারীদের” প্রতি পরম ক্ষমাশীল’ (বানু ইসরাঈল, ১৭/২৩-২৫)। মহান আল্লাহ বলেন,وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো ও তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’ (আন-নিসা, ৪/৩৬)

পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা সর্বোত্তম আমল: হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رضي الله عنه سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَىُّ الْعَمَلِ أَفْضَلُ قَال الصَّلاَةُ عَلَى مِيقَاتِهَا قُلْتُ ثُمَّ أَىٌّ قَالَ ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ قُلْتُ ثُمَّ أَىٌّ قَالَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ.

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্ন করলাম, কোন আমল মহান আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়?’ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সময়মতো ছালাত আদায় করা’। আমি বললাম, ‘তারপর কোন কাজ?’ তিনি বলেন, ‘পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা’। আমি বললাম, ‘তারপর?’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা’।[1]

সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি হক্বদার: সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি হক্বদার হলেন, মা। কারণ মাতাই বেশি কষ্ট স্বীকার করেন।

মহান আল্লাহ বলেন,وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا ‘আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি সদয় আচরণের। তার মা তাকে (পেটে) বহন করেছে কষ্টের সাথে আর তাকে প্রসব করেছে কষ্টের সাথে’ (আল-আহক্বাফ, ৪৬/১৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন,وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ ‘আমরা মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করেছেন আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। কাজেই আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আমার কাছেই (তোমাদের) প্রত্যাবর্তনস্থল’ (লুক্বমান, ৩১/১৪)। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা এক লোক রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি হক্বদার কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। তিনি আবার বললেন, ‘তারপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। তিনি বললেন, ‘তারপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। তিনি পুনরায় বললেন, ‘তারপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা’।[2]

মায়ের খেদমত করা জিহাদ সমতুল্য ছওয়াব: একদা মুআবিয়া ইবনু জাহিমা সুলামী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি জিহাদ করব মনস্থ করেছি, তাই আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি’। একথা শুনে তিনি বললেন, ‘তোমার মা আছেন কি?’ তিনি বললেন, ‘জি, হ্যাঁ’। তিনি বললেন, فَالْزَمْهَا، فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا ‘তাহলে তুমি তার খেদমতে অবিচল থাকো। কারণ মায়ের পদতলে তোমার জান্নাত রয়েছে’।[3]

পিতামাতার খেদমত করা সন্তানের আয়ু বৃদ্ধি ও জান্নাতে প্রবেশের কারণ: আবুদ দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,الوَالِدُ أَوْسَطُ أَبْوَابِ الجَنَّةِ فَإِنْ شِئْتَ فَأَضِعْ ذَلِكَ البَابَ أَوْ احْفَظْهُ ‘পিতামাতা হলেন জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্যবর্তী দরজা। যদি তুমি চাও, তবে দরজাটিকে নষ্ট করো অথবা সেটাকে হেফাযত করো’।[4] আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,رَغِمَ أَنْفُ، ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ، ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ، قِيلَ: مَنْ؟ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: مَنْ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ، أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَيْهِمَا فَلَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ ‘তার নাক ধূলিধূসরিত হোক, অতঃপর তার নাক ধূলিধূসরিত হোক, অতঃপর তার নাক ধূলিধূসরিত হোক’। বলা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে কে?’ তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতামাতার দুইজনকে অথবা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেল, অথচ সে (তাদের খেদমত করে) জান্নাতে যেতে পারল না’।[5]

পিতামাতার অবাধ্য হওয়া আল্লাহর অসন্তুষ্টিও জাহান্নামে যাওয়ার কারণ: আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,رِضَى الرَّبِّ فِي رِضَى الوَالِدِ، وَسَخَطُ الرَّبِّ فِي سَخَطِ الْوَالِدِ ‘পিতামাতার সন্তুষ্টির মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে আর পিতামাতার অসন্তুষ্টির মধ্যে আল্লাহর অসন্তুষ্টি রয়েছে’।[6] ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ثَلَاثَةٌ لَا يَنْظُرُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ، وَالْمَرْأَةُ الْمُتَرَجِّلَةُ، وَالدَّيُّوثُ، وَثَلَاثَةٌ لَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ: الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ، وَالْمُدْمِنُ عَلَى الْخَمْرِ، وَالْمَنَّانُ بِمَا أَعْطَى ‘তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তাআলা ক্বিয়ামতের দিন তাকিয়ে দেখবেন না— পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিণী মহিলা এবং দাইয়ূস পুরুষ (যে তার স্ত্রী, কন্যা ও বোনের চরিত্রহীনতা ও নোংরামিতে চুপ থাকে এবং বাধা দেয় না)। আর তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না— পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপ এবং দান করে খোঁটাদানকারী ব্যক্তি’।[7]

পিতামাতার অবাধ্য হওয়া কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, فِي الْكَبَائِرِ: عُقُوقُ الوَالِدَيْنِ ‘বড় গুরুতর পাপের মধ্যে রয়েছে পিতামাতার অবাধ্য হওয়া’।[8] নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,كُلُّ ذُنُوبٍ يُؤَخِّرُ اللَّهُ مِنْهَا مَا شَاءَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ إِلَّا الْبَغْيَ وَعُقُوقَ الْوَالِدَيْنِ، أَوْ قَطِيعَةَ الرَّحِمِ، يُعَجِّلُ لِصَاحِبِهَا فِي الدُّنْيَا قَبْلَ الْمَوْتِ ‘পাপসমূহের মধ্যে কিছু পাপ, যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন, সেগুলোর শাস্তি তিনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিলম্বিত করেন। তবে বিদ্রোহ বা যুলম, পিতামাতার অবাধ্যাচরণ বা রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করা ব্যতীত। এসব গুনাহের শাস্তি অপরাধীর মৃত্যুর পূর্বেই এই দুনিয়াতে দ্রুত দিয়ে থাকেন’।[9]

ক্বিয়ামতের অন্যতম মৌলিক আলামত বা নিদর্শন হচ্ছে মানুষ তার পিতামাতাকে ছেড়ে স্ত্রীর কথায় উঠাবসা করবে: আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,وَأَطَاعَ الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ، وَعَقَّ أُمَّهُ، وَأَدْنَى صَدِيقَهُ، وَأَقْصَى أَبَاهُ ‘পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে এবং মায়ের অবাধ্যতা করবে। আর বন্ধুকে খুব কাছে স্থান দেবে এবং আপন পিতাকে দূরে সরিয়ে রাখবে’।[10] অর্থাৎ স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মায়ের অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে যাবে। প্রতিটি মুসলিম পরিবার বর্তমানে এ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। অধিকাংশ সময় মা তার ছোট্ট কুটিরে পড়ে থাকে, ছেলে পাশের রুমে থাকা সত্ত্বেও মাকে একনজর দেখার সময় তার হয় না। অথচ স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সে মহাফূর্তিতে দিন কাটাচ্ছে। পিতামাতা যদি চুপ থাকেন, তবে সেই অবাধ্যতা দিন দিন চরম আকার ধারণ করে। যার নমুনা আমরা প্রতিদিন পেপার-পত্রিকায় পড়ে থাকি। বন্ধুবান্ধবের সাথে সারাদিন বসে গল্প করবে, তাদেরকে কাছে ডাকবে; কিন্তু পিতার সাথে যে দুয়েকটি কথা বলবে, বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করবে, তার মনে প্রশান্তি দিবে, তার কাছ থেকে দু‘আ নেবে— এ যেন মহা বিরক্তিকর বিষয়। বিশেষত পিতা যদি বয়োবৃদ্ধ হন, তবে তো কোনো কথাই নেই। আল্লাহ যেন সকল সন্তানদেরকে পিতামাতার অবাধ্যতা থেকে রক্ষা করেন- আমীন!

পিতামাতার প্রতিদান: আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لَا يَجْزِي وَلَدٌ وَالِدًا، إِلَّا أَنْ يَجِدَهُ مَمْلُوكًا فَيَشْتَرِيَهُ فَيُعْتِقَهُ ‘কোনো সন্তান পিতার ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। কিন্তু সে যদি তার পিতাকে ক্রীতদাসরূপে পায় এবং তাকে মুক্ত করে দেয় (তবে সেটা তার প্রতিদান হতে পারে)’।[11] আবূ বুরদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর সাথে ছিলেন। ইয়ামানের এক ব্যক্তি তার মাকে তার পিঠে বহন করে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করছিলেন আর বলছিলেন, আমি তার জন্য তার অনুগত উটতুল্য এবং যদি তার বাহন ভয় পায়, তবুও আমি ভয় পাই না। অতঃপর তিনি ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে বললেন, আমি কি আমার মায়ের প্রতিদান দিতে পেরেছি বলে আপনি মনে করেন? তিনি বললেন, لَا وَلَا بِزَفْرَةٍ وَاحِدَةٍ ‘না, (কষ্টের সময়ের) তার একটি দীর্ঘশ্বাসের প্রতিদানও হয়নি’।[12]

কাফের ও মুশরিক পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا ‘তোমার (কাফের) পিতামাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করবে না, তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে সৎভাবে’ (লুক্বমান ৩১/১৫)

আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কন্যা আসমা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলাম,قَدِمَتْ عَلَيَّ أُمِّي وَهِيَ رَاغِبَةٌ أَفَأَصِلُ أُمِّي؟ قَالَ: نَعَمْ، صِلِي أُمَّكِ ‘আমার জননী আমার কাছে আগমন করেছেন, তিনি আমার প্রতি খুবই অনুরাগী। আমি তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখব?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার মায়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে’।[13]

পিতামাতার মৃত্যুর পরে সন্তানদের কর্তব্য: পিতামাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য দু‘আ করা, ছাদাক্বা করা এবং তাদের বন্ধুদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা সন্তানদের কর্তব্য। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ ‘কোনো লোকের জন্য সবচেয়ে উত্তম নেক কাজ হলো পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সাথে সদ্ব্যবহার করা’।[14] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, সা‘দ বিন উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মা যখন ইন্তিকাল করেন, তখন তিনি অনুপস্থিত ছিলেন, পরে তিনি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন,يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّي تُوُفِّيَتْ وَأَنَا غَائِبٌ عَنْهَا، أَيَنْفَعُهَا شَيْءٌ إِنْ تَصَدَّقْتُ بِهِ عَنْهَا؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَإِنِّي أُشْهِدُكَ أَنَّ حَائِطِيَ المِخْرَافَ صَدَقَةٌ عَلَيْهَا ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার অনুপস্থিত থাকাকালে আমার মা মারা গেছেন। এখন যদি তার পক্ষ থেকে কিছু ছাদাক্বা বা দান করি, তাহলে কি তিনি উপকৃত হবেন? নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ’। সা‘দ বললেন, ‘তাহলে আমি আপনাকে সাক্ষ্য রেখে বলছি যে, আমার মিখরাফের বাগান তার নামে ছাদাক্বা করলাম’।[15]

সন্তানরা মুসলিম পিতামাতার জন্য যে দু‘আ করবে:

১. رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا ‘হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করুন, যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালনপালন করেছেন’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/২৪)

২. رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ ‘হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব অনুষ্ঠিত হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং মুমিনগণকে ক্ষমা করে দিয়েন’ (ইবরাহীম, ১৪/৪১)

৩. رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ‘হে আমার রব! আপনি আমাকে আর আমার পিতামাতাকে যে নেয়ামত দান করেছেন, তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শক্তি দান করুন আর আমাকে এমন সৎকর্ম করার সামর্থ্য দিন যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন; আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ করে দিন। আমি আপনার দিকে ফিরে এসেছি আর নিশ্চয়ই আমি আত্মসমর্পণকারী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত’ (আল-আহক্বাফ, ৪৬/১৫)

৪. আবূ তালেবের কন্যা উম্মু হানী রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর মুক্তদাস আবূ মুররা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, তিনি আকীক নামক স্থানে অবস্থিত আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে তার খামারবাড়িতে একই বাহনে চড়ে গমন করেন। তিনি তার বাড়িতে পৌঁছে উচ্চৈঃস্বরে বলেন, عَلَيْكِ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ ‘হে আমার মা! আপনার প্রতি আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক’। তার মা বললেন, وَعَلَيْكَ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ ‘তোমার প্রতিও আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক’। তিনি পুনরায় বললেন, رَحِمَكِ اللَّهُ رَبَّيْتِنِي صَغِيرًا ‘আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন, আপনি আমার শৈশবকালে আমাকে লালনপালন করেছেন’। তার মা বললেন,يَا بُنَيَّ وَأَنْتَ فَجَزَاكَ اللَّهُ خَيْرًا وَرَضِيَ عَنْكَ كَمَا بَرَرْتَنِي كَبِيرًا ‘হে পুত্র! আল্লাহ তোমাকেও উত্তম প্রতিদান দিন এবং তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হোন, যেরূপ আমার বার্ধক্যে তুমি আমার প্রতি সদ্ব্যবহার করেছ’।[16]

মুশরিক পিতামাতার জন্য মাগফেরাতের দু‘আ করা নিষেধ। তবে তাদের সুস্বাস্থ্য ও হেদায়েতের জন্য দু‘আ করা যায়। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁদের পিতামাতার জন্য দু‘আ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে (আত-তাওবা, ৯/১১৩)

উপসংহার: পরিশেষে আল্লাহর কাছে দু‘আ করি, মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

 শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭৮২; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৭১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৪৮।

[3]. নাসাঈ, হা/৩১০৪, হাদীছ ছহীহ।

[4]. তিরমিযী, হা/১৯০০, হাদীছ ছহীহ।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫১।

[6]. তিরমিযী, হা/১৮৯৯, হাদীছ ছহীহ।

[7]. নাসাঈ, হা/২৫৬২; আহমাদ ৬১৮০।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯।

[9]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৯১।

[10]. তিরমিযী, হা/২২১১; মিশকাত, হা/৫৩৫০।

[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫১০।

[12]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/১১; শুআবুল ঈমান, হা/৭৫৫০।

[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০০৩।

[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫২; মিশকাত, হা/৪৯১৭।

[15]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭৫৬।

[16]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/১৪।

Magazine