ভূমিকা:
‘মুরদান’ কারা? তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাবে কিনা? তাদের সাথে সম্পর্কিত আরও কোনো বিধিবিধান আছে কিনা? এ ব্যাপারগুলো আমার ততটা জানা ছিল না। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষেরই এ বিষয়টি অজানা। যাহোক, সম্প্রতি ‘যে পাপ পশুও করে না’ শিরোনামে একটি খুৎবা প্রস্তুত করতে যেয়ে পড়াশুনা শুরু করলাম এবং এই বিষয়টি নজরে আসল। তারপর থেকে এ ব্যাপারে লেখা ও বলার খুব প্রয়োজনবোধ করছিলাম। কারণ আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সার্বিক জীবনে এ বিষয়টি জানা খুবই দরকার। অন্যথা নিজের অজান্তেই গোনাহ হয়ে যাওয়ার মারাত্মক ঝুঁকি আছে বৈকি। বরং মহাপাপ সমকামিতা পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। আল্লাহ আমাদেরকে হিফাযতে রাখুন।
সব যুগে ও সব সমাজে এই বিষয়টি সম্পর্কে জানা ও ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক চলা সকলের উপর অপরিহার্য। কারণ সর্বযুগে ও সব সমাজে মুরদান তথা কিশোর-তরুণেরা ছিল, আছে এবং থাকবে। বিশেষ করে স্কুল-মাদরাসাসহ যেখানে যেখানে কিশোর, তরুণ ও যুবকদের আনাগোনা বেশি থাকে এবং তাদের সাথে মিশতে হয়, ওঠাবসা করতে হয়, সেসব জায়গায় কর্মরত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরী।
এ লেখায় আমি মুরদান বা দাড়িবিহীন কিশোর-যুবক সম্পর্কে ইসলামের বিধিবিধান কী হতে পারে, তা তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশা-আল্লাহ। মহান আল্লাহ একক তাওফীক্বদাতা।
মুরদান কারা?
‘মুরদান’ (مُرْدَانٌ) শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে, ‘আমরাদ’ (أَمْرَدُ)।[1] ‘আমরাদ’ এমন তরুণ, যার দাড়ি বের হওয়ার বয়স হয়ে গেছে, গোঁফ গজাতে শুরু করেছে, কিন্তু এখনও দাড়ি বের হয়নি।[2]
বুজাইরিমী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,الْمُرَادُ بِالْأَمْرَدِ مَنْ لَمْ تَنْبُتْ لِحْيَتُهُ وَلَمْ يَصِلْ إلَى أَوَانِ إنْبَاتِهَا غَالِبًا ‘আমরাদ দ্বারা এমন মানুষ উদ্দেশ্য, যার এখনও দাড়ি গজায়নি এবং বেশির ক্ষেত্রে দাড়ি উঠার বয়সও হয়নি’।[3]
অতএব, দাড়িবিহীন শিশু, কিশোর, তরুণ ও যুবকরা মুরদানের আওতাভুক্ত হবে। তবে যেসব তরুণের দাড়ি-গোঁফ এখনও গজায়নি; কিন্তু গজানোর উপক্রম হয়েছে, তারা এই তালিকার শীর্ষে থাকবে।
উল্লেখ্য, আমি এই লেখায় ‘আমরাদ’ বা ‘মুরদান’ শব্দের ভাবার্থ হিসেবে ‘দাড়িবিহীন কিশোর-যুবক’ শব্দ ব্যবহার করেছি।
আরও একটি বিষয় বলে রাখি, এখানে দাড়িবিহীন কিশোর-যুবকরা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলেও উদ্দেশ্য কেবল তারাই নয়। বরং তাদের ক্ষেত্রে যা যা ঘটতে পারে, তা যদি অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটে, তাহলে তারাও এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। তবে, এ ধরনের দাড়িবিহীন সুশ্রী কিশোর-তরুণ-যুবকদের প্রতি নারী-পুরুষ যে কারোরই ভিন্ন আকর্ষণ হতে পারে এবং হওয়া সহজ বলে তাদের বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
দাড়ি বিহীন কিশোর-যুবকের দিকে তাকানোর বিধান:
প্রথমত: আমরা জানি, যা কিছু ফেতনা সৃষ্টি করতে পারে বা কামভাবের উদ্রেক ঘটাতে পারে অথবা হারাম বিষয়ে নিমজ্জিত করতে পারে, তার সবকিছুর দিকে দৃষ্টি দিতে মহান আল্লাহ আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ. وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ
‘মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে’ (আন-নূর, ২৪/৩০-৩১)।
ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন,
الْبَصَرُ هُوَ الْبَابُ الْأَكْبَرُ إِلَى الْقَلْبِ، وَأَعْمَرُ طُرُقِ الْحَوَاسِّ إِلَيْهِ، وَبِحَسَبِ ذَلِكَ كَثُرَ السُّقُوطُ مِنْ جِهَتِهِ. وَوَجَبَ التَّحْذِيرُ مِنْهُ، وَغَضُّهُ وَاجِبٌ عَنْ جَمِيعِ الْمُحَرَّمَاتِ، وَكُلِّ مَا يُخْشَى الْفِتْنَةُ مِنْ أَجْلِه.
‘চোখ হচ্ছে হৃদয়ে প্রবেশের সবচেয়ে বড় দরজা এবং ইন্দ্রিয়সমূহে ঢোকার সবচেয়ে উর্বর পথ। এই চোখের কারণেই পদস্খলন ঘটে। ফলে সে ব্যাপারে সতর্ক করা জরুরী। চোখের কারণে যত হারাম কাজ হতে পারে এবং যত ধরনের ফেতনায় নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তার সবগুলো থেকে চোখতে অবনমিত রাখা অপরিহার্য’।[4]
আল্লামা সা‘দী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
أَرْشِدِ الْمُؤْمِنِيْنَ، وَقُلْ لَهُمْ: الَّذِيْنَ مَعَهُمْ إِيْمَانٌ، يَمْنَعُهُمْ مِنْ وُقُوْعِ مَا يُخِلُّ بِالْإِيْمَانِ: {يَغُضُّوْا مِنْ أَبْصَارِهِمْ} عَنِ النَّظَرِ إِلَى العَوْرَاتِ وَإِلَى النِّسَاءِ الأَجْنَبِيَّاتِ، وَإِلَى المُرْدَانِ الَّذِيْنَ يُخَافُ بِالنَّظَرِ إِلَيْهِمُ الْفِتْنَةُ، وَإِلَى زِيْنَةِ الدُّنْيَا الَّتِيْ تَفْتِنُ، وَتُوْقِعُ فِي الْمَحْذُوْرِ.
‘আপনি মুমিনদেরকে নির্দেশনা দিন এবং তাদেরকে বলুন, যাদের সাথে ঈমান আছে, সেই ঈমানের বিচ্যুতি ঘটাতে পারে এমন বিষয় থেকে তাদেরকে তাদের ঈমানই বাধা প্রদান করবে: তারা তাদের দৃষ্টি অবনত রাখবে গোপন বিষয়সমূহ থেকে, বেগানা নারীদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া থেকে এবং এমন কিশোর-যুবকের দিকে দৃষ্টি দেওয়া থেকে, যাদের দিকে তাকালে ফেতনার আশঙ্কা রয়েছে। অনুরূপভাবে তারা দুনিয়াবী এমন সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া থেকে তাদের চোখকে অবনমিত রাখবে, যেসব সৌন্দর্য ফেতনায় ফেলতে পারে এবং নিষিদ্ধ বিষয়ে নিপতিত করতে পারে’।[5]
অতএব, নারী-পুরুষ কারো জন্যই এমন জিনিসের দিকে তাকানো সমীচীন হবে না, যেদিকে তাকালে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে বা তাকে ফেতনায় ফেলতে পারে অথবা হারাম বিষয়ে প্রবেশ করাতে পারে।
দ্বিতীয়ত: দাড়িবিহীন কিশোর-যুবকদের দিকে কামভাবের[6] সাথে তাকালে নিষিদ্ধ হবে নাকি স্বাভাবিকভাবেও তাকানো যাবে না? নাকি ফেতনার ঝুঁকি থাকলেও তাকানো যাবে না? তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই মতভেদকে চারভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে—
(১) কেউ কেউ বলেছেন, দাড়িবিহীন কিশোর-যুবক তো বটেই, এমনকি কামভাব নিয়ে কারো দিকেই তাকানো যাবে না। বরং কামভাব নেই, কিন্তু ফেতনার ঝুঁকি আছে, এমতাবস্থায়ও তাকানো যাবে না। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
الصَّبِيُّ الْأَمْرَدُ الْمَلِيحُ بِمَنْزِلَةِ الْمَرْأَةِ الْأَجْنَبِيَّةِ فِي كَثِيرٍ مِنْ الْأُمُورِ...وَلَا يَجُوزُ النَّظَرُ إلَيْهِ عَلَى هَذَا الْوَجْهِ بِاتِّفَاقِ النَّاسِ؛ بَلْ يَحْرُمُ عِنْدَ جُمْهُورِهِمْ النَّظَرُ إلَيْهِ عِنْدَ خَوْفِ ذَلِكَ؛ وَإِنَّمَا يُنْظَرُ إلَيْهِ لِحَاجَةِ بِلَا رِيبَةٍ مِثْلَ مُعَامَلَتِهِ وَالشَّهَادَةِ عَلَيْهِ؛ وَنَحْوِ ذَلِكَ كَمَا يُنْظَرُ إلَى الْمَرْأَةِ لِلْحَاجَةِ.
‘সুশ্রী শিশু-কিশোর অনেক ক্ষেত্রে বেগানা নারীর মতো।…এই কারণে সকল মানুষের ঐকমত্যে ফেতনার ঝুঁকিসহ তাদের দিকে তাকানো জায়েয নেই। বরং অধিকাংশ আলেমের নিকট ফেতনার আশঙ্কা থাকলে তাদের দিকে তাকানো হারাম। সেজন্য, শুধু দরকার হলে তাদের দিকে তাকানো যাবে; সন্দেহের চোখে তাকানো যাবে না। যেমনটি প্রয়োজনের সময় নারীর দিকেও তাকানো যায়। যেমন- কোনো কিছু লেনদেনের সময়, সাক্ষ্য প্রদান বা গ্রহণের সময়’।[7]
উল্লেখ্য, এখানে সুশ্রী কথাটা দর্শকের প্রকৃতি ও রুচি অনুযায়ী ধর্তব্য হবে। কারণ সবার চোখে সুন্দরের সংজ্ঞা একরকম নয়। সেজন্য, একজন কালো মানুষও কারো চোখে সুন্দর হতে পারে। আরেকটা কথা হচ্ছে, এখানে সুশ্রী আর বিশ্রী মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে, কামভাবের সাথে দৃষ্টি দেওয়া।
ইবনু মুফলিহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, وَيَجُوزُ النَّظَرُ إِلَى الْغُلَامِ لِغَيْرِ شَهْوَةٍ ‘কামভাব ছাড়া কিশোর-বালকের দিকে তাকানো জায়েয’।[8]
তিনি আরো বলেন,وَلَا يَجُوزُ النَّظَرُ إِلَى أَحَدٍ مِمَّنْ ذَكَرْنَا لِشَهْوَةٍ، لِمَا فِيهِ مِنَ الْفِتْنَةِ، وَمَعْنَى الشَّهْوَةِ: أَنْ يَتَلَذَّذَ بِالنَّظَرِ إِلَيْهِ ‘যাদের কথা উল্লেখ করলাম[9], তাদের কারো দিকে কামভাবসহ তাকানো জায়েয নেই। কারণ এতে ফেতনা রয়েছে। এখানে কামভাবের অর্থ হচ্ছে, চোখের স্বাদ গ্রহণ’।[10]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন,
وَالنَّظَرُ إلَى وَجْهِ الْأَمْرَدِ لِشَهْوَةٍ كَالنَّظَرِ إلَى وَجْهِ ذَوَاتِ الْمَحَارِمِ، وَالْمَرْأَةِ الْأَجْنَبِيَّةِ بِالشَّهْوَةِ، سَوَاءٌ كَانَتْ الشَّهْوَةُ شَهْوَةَ الْوَطْءِ، أَوْ شَهْوَةَ التَّلَذُّذِ بِالنَّظَرِ، فَلَوْ نَظَرَ إلَى أُمِّهِ، وَأُخْتِهِ، وَابْنَتِهِ يَتَلَذَّذُ بِالنَّظَرِ إلَيْهَا كَمَا يَتَلَذَّذُ بِالنَّظَرِ إلَى وَجْهِ الْمَرْأَةِ الْأَجْنَبِيَّةِ كَانَ مَعْلُومًا لِكُلِّ أَحَدٍ أَنَّ هَذَا حَرَامٌ، فَكَذَلِكَ النَّظَرُ إلَى وَجْهِ الْأَمْرَدِ بِاتِّفَاقِ الْأَئِمَّةِ.
‘মাহরাম নারী ও বেগানা নারীর দিকে কামভাবসহ তাকানো যেমন, দাড়িবিহীন তরুণ-যুবকের দিকে কামভাবসহ তাকানোও তেমন। এই কামভাব যৌন কামভাব হোক বা দৃষ্টির স্বাদ গ্রহণের কামভাব হোক- যেটাই হোক-না কেনো। অতএব, কেউ যদি তার মা, বোন ও মেয়ের দিকে চোখের স্বাদ নেওয়ার জন্য তাকায়, ঠিক যেমনটা বেগানা নারীর চেহারার দিকে চোখের স্বাদ নেওয়ার জন্য তাকায়, তাহলে সবার জানা যে, এই ধরনের তাকানো হারাম। অনুরূপভাবে দাড়িবিহীন তরুণ-যুবকদের দিকে তাকানোও ইমামদের সর্বসম্মতিক্রমে হারাম’।[11]
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ-এর এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, এখানে কামভাব দ্বারা দুই ধরনের কামভাব উদ্দেশ্য: যৌন কামভাব ও দৃষ্টির স্বাদ গ্রহণের কামভাব। সেজন্য, ইবনুল কত্ত্বান বলেছেন,أَجْمَعُوا عَلَى أَنَّهُ يَحْرُمُ النَّظَرُ إلَى غَيْرِ الْمُلْتَحِي بِقَصْدِ التَّلَذُّذِ بِالنَّظَرِ وَتَمَتُّعِ الْبَصَرِ بِمَحَاسِنِهِ ‘সৌন্দর্য দেখে চোখের স্বাদ নেওয়ার উদ্দেশ্যে দাড়িবিহীন ব্যক্তির দিকে তাকানো হারাম হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম ইজমা পোষণ করেছেন’।[12]
(২) দাড়িবিহীন কিশোর-যুবকের দিকে দৃষ্টি দিলে কামভাব হবে কিনা এমন সন্দেহ হলেও তাদের দিকে তাকানো ঠিক হবে না। ইবনু আবিদীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন,فَإِنَّهُ يَحْرُمُ النَّظَرُ إلَى وَجْهِهَا وَوَجْهِ الْأَمْرَدِ إذَا شَكَّ فِي الشَّهْوَةِ ‘মেয়েদের চেহারা দেখা হারাম এবং কামভাব হতে পারে মর্মে সন্দেহ হলে দাড়িবিহীন কিশোর-যুবকের চেহারা দেখাও হারাম’।[13]
(৩) কারো কারো মতে, দাড়িবিহীন সুশ্রী কিশোর, তরুণ, যুবকের দিকে কোনোভাবেই তাকানো ঠিক হবে না। ইমাম ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,كَانَ السَّلَفُ يَقُولُونَ فِي الْأَمْرَدِ هُوَ أَشَدُّ فِتْنَة مِنْ الْعَذَارَى فَإِطْلَاقُ الْبَصَرِ مِنْ أَعْظَمِ الْفِتَنِ ‘দাড়িবিহীন কিশোর-যুবকের ব্যাপারে সালাফগণ বলতেন, কুমারী মেয়েদের চেয়ে দাড়িবিহীন কিশোর-যুবক বেশি ফেতনাময়। সুতরাং (তাদের দিকে) চোখ তুলে তাকানো বড় ফেতনার অন্তর্ভুক্ত’।[14]
ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَكَذَلِكَ يَحْرُمُ عَلَى الرَّجُلِ النَّظَرُ إِلَى وَجْهِ الْأَمْرَدِ إِذَا كَانَ حَسَنَ الصُّورَةِ سَوَاءٌ كَانَ نَظَرُهُ بِشَهْوَةٍ أَمْ لَا سَوَاءٌ أَمِنَ الْفِتْنَةَ أَمْ خَافَهَا هَذَا هُوَ الْمَذْهَبُ الصَّحِيحُ الْمُخْتَارُ عِنْدَ الْعُلَمَاءِ الْمُحَقِّقِينَ نَصَّ عَلَيْهِ الشَّافِعِيُّ وَحُذَّاقُ أَصْحَابِهِ رَحِمَهُمُ اللَّهُ تَعَالَى وَدَلِيلُهُ أَنَّهُ فِي مَعْنَى الْمَرْأَةِ فَإِنَّهُ يُشْتَهَى كَمَا تُشْتَهَى وَصُورَتُهُ فِي الْجَمَالِ كَصُورَةِ الْمَرْأَةِ بَلْ رُبَّمَا كَانَ كَثِيرٌ مِنْهُمْ أحْسَنَ صُورَةً مِنْ كَثِيرٍ مِنَ النِّسَاءِ بَلْ هُمْ فِي التَّحْرِيمِ أَوْلَى لِمَعْنًى آخَرَ وَهُوَ أَنَّهُ يَتَمَكَّنُ فِي حَقِّهِمْ مِنْ طُرُقِ الشَّرِّ مالا يَتَمَكَّنُ مِنْ مِثْلِهِ فِي حَقِّ الْمَرْأَةِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ وَهَذَا الَّذِي ذَكَرْنَاهُ فِي جَمِيعِ هَذِهِ الْمَسَائِلِ مِنْ تَحْرِيمِ النَّظَرِ هُوَ فِيمَا إِذَا لَمْ تَكُنْ حَاجَةٌ أَمَّا إِذَا كَانَتْ حَاجَةٌ شرعية فيجوز النظر كما فِي حَالَةِ الْبَيْعِ وَالشِّرَاءِ وَالتَّطَبُّبِ وَالشَّهَادَةِ وَنَحْوِ ذَلِكَ وَلَكِنْ يَحْرُمُ النَّظَرُ فِي هَذِهِ الْحَالِ بِشَهْوَةٍ فَإِنَّ الْحَاجَةَ تُبِيحُ النَّظَرَ لِلْحَاجَةِ إِلَيْهِ وَأَمَّا الشَّهْوَةُ فَلَا حَاجَةَ إِلَيْهَا قَالَ أَصْحَابُنَا النَّظَرُ بِالشَّهْوَةِ حَرَامٌ عَلَى كُلِّ أَحَدٍ غَيْرَ الزَّوْجِ وَالسَّيِّدِ حَتَّى يَحْرُمَ عَلَى الْإِنْسَانِ النَّظَرُ إِلَى أُمِّهِ وَبِنْتِهِ بِالشَّهْوَةِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ.
‘দাড়িবিহীন তরুণ-যুবকের দিকে তাকানো যেকোনো ব্যক্তির জন্য হারাম, যদি সে সুদর্শন হয়। এক্ষেত্রে কামভাবসহ তাকাক বা কামভাব ছাড়া তাকাক; অনুরূপভাবে ফেতনামুক্ত থাক বা ফেতনার ঝুঁকি থাক— কোনো পার্থক্য নেই। বিশ্লেষক আলেম-উলামার নিকট এটাই বিশুদ্ধ মত। শাফেঈ ও তার বিচক্ষণ অনুসারীগণ এমতের পক্ষেই কথা বলেছেন। শাফেঈর দলীল হচ্ছে, দাড়িবিহীন তরুণ-যুবকেরা মেয়েদের মতোই। কারণ মেয়েদের প্রতি যেমন কামভাব তৈরি হয়, তেমনি দাড়িবিহীন তরুণ-যুবকের প্রতিও কামভাব তৈরি হতে পারে। সৌন্দর্যের দিক থেকে নারীদের চেহারা যেমন, এদের চেহারাও তেমন; বরং অনেক নারীর চেহারার চেয়ে অনেক তরুণ-যুবকের চেহারা বেশি সুন্দর। তাছাড়া আরেকটি দিক বিবেচনায় দাড়িবিহীন তরুণ-যুবকের ক্ষেত্রে হারাম হওয়ার বিষয়টি আরো যৌক্তিক। সেটি হচ্ছে, এ শ্রেণির তরুণ-যুবকের দিকে খারাপ পথ পাড়ি দেওয়া যতটা সহজ, নারীদের ক্ষেত্রে ঐ রাস্তায় হাঁটা ততটা সহজ নয়। আল্লাহই ভালো জানেন।
তাকানো হারাম হওয়ার এই বিষয়টি সেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যেখানে তাকানোর দরকার নেই। কিন্তু যদি আসলেই তাকানোর দরকার হয়, তাহলে তাকানো জায়েয। যেমন: ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে, সাক্ষ্য প্রদান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে ইত্যাদি। কিন্তু এসব অবস্থাতেও কামভাবসহ তাকানো হারাম। কারণ প্রয়োজন তাকানোর বৈধতা দিয়েছে প্রয়োজনের তাগিদেই। কিন্তু কামভাবের তো আর কোনো প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের মতাবলম্বীগণ বলেছেন, স্বামী ও দাসীর মালিক ছাড়া সবার জন্য কামভাব নিয়ে তাকানো হারাম। এমনকি কারো জন্য কামভাব নিয়ে তার মা ও মেয়ের দিকে তাকানোও হারাম। আল্লাহই ভালো জানেন’।[15]
(৪) কামভাব ও ফেতনামুক্তভাবে তাকালে দোষের কিছু নেই। তবে, এক্ষেত্রেও দু’টি দিক খেয়াল রাখতে হবে: কামভাব হবে না মর্মে নিশ্চিন্ত থাকলে তাকানো যাবে। কিন্তু সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত না থাকলে তাকানো যাবে না।[16]
এখানে আরো একটা কথা মনে রাখতে হবে, তা হচ্ছে— কামভাব হবে না মর্মে নিশ্চিন্ত থাকলেও বারবার তাকানো যাবে না। কারণ বারবার দৃষ্টি নিবদ্ধের মধ্যে সাধারণত কোনো-না কোনো গড়বড় থাকে। সেজন্য, ইবনু আক্বীল রাহিমাহুল্লাহ বলেন, تَكْرَارُ النَّظَرِ إلَى الْأَمْرَدِ مُحَرَّمٌ، لِأَنَّهُ لَا يُمْكِنُ بِغَيْرِ شَهْوَةٍ ‘দাড়িবিহীন কিশোর-যুবকের দিকে বারবার তাকানো হারাম। কেননা কামভাব ছাড়া বারবার তাকানো হতে পারে না’।[17]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَمَنْ كَرَّرَ النَّظَرَ إلَى الْأَمْرَدِ وَنَحْوِهِ، أَوْ أَدَامَهُ، وَقَالَ: إنِّي لَا أَنْظُرُ لِشَهْوَةٍ كَذَبَ فِي ذَلِكَ، فَإِنَّهُ إذَا لَمْ يَكُنْ مَعَهُ دَاعٍ يَحْتَاجُ مَعَهُ إلَى النَّظَرِ لَمْ يَكُنْ النَّظَرُ إلَّا لِمَا يَحْصُلُ فِي الْقَلْبِ مِنْ اللَّذَّةِ بِذَلِكَ. وَأَمَّا نَظْرَةُ الْفَجْأَةِ فَهِيَ عَفْوٌ إذَا صَرَفَ بَصَرَهُ.
‘যে ব্যক্তি দাড়িবিহীন তরুণ-যুবক বা এরকম কারো দিকে বারবার তাকায় অথবা অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে আর বলে যে, আমি কামভাব নিয়ে তাকাই না, সে আসলে ঐ ব্যাপারে মিথ্যা বলছে। কারণ তার প্রয়োজন না পড়লে সে এভাবে তাকাত না। বরং তাকানোর মাধ্যমে মনের স্বাদ পাওয়ার কারণেই সে তাকায়। তবে হঠাৎ চোখ পড়লে যদি দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তা ক্ষমাযোগ্য’।[18]
আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
সঊদী আরব; অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. দোযী, তাকমিলাতুল মা‘আজিম আল-আরাবিয়্যাহ, (ইরাক: সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম মন্ত্রণালয়, ১ম মুদ্রণ: ১৯৭৯-২০০০ খৃ.), ১০/৩৯।
[2]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরাব, (বৈরূত: দারু ছদির, ৩য় মুদ্রণ: ১৪১৪ হি.), ৩/৪০০১।
[3]. সুলায়মান আল-বুজাইরিমী, হাশিয়াতুল বুজাইরিমী আলাল খত্বীব, (দারুল ফিকর: ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খৃ.), ৩/৩৮৩।
[4]. কুরতুবী, আল-জামে‘ লিআহকামিল কুরআন –তাফসীর কুরতুবী- (কায়রো: দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যাহ, ২য় মুদ্রণ: ১৩৮৪ হি./১৯৬৪ খৃ.), ১২/২২৩।
[5]. আব্দুর রহমান নাছের আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম মুদ্রণ: ১৪২০ হি./২০০০ খৃ.), পৃ. ৫৬৬।
[6]. এখানে কামভাব বলতে যৌন কামভাবও হতে পারে আবার চোখের মজা নেওয়াও হতে পারে, যেমনটা আমরা এ্রই লেখার বিভিন্ন জায়গায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্যে দেখতে পাব ইনশা-আল্লাহ।
[7]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ, ২১/২৪৫।
[8]. ইবনু মুফলিহ, আল-মুবদি‘ ফী শারহিল মুক্বনি‘ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম মুদ্রণ: ১৪১৮ হি./১৯৯৭ খৃ.), ৬/৮৯।
[9]. যাদের কথা ইবনু মুফলিহ উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে দাড়িবিহীন কিশোর, তরুণ, যুবকও আছে।
[10]. আল-মুবদি‘ ফী শারহিল মুক্বনি‘, ৬/৮৯।
[11]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ, ২১/২৪৫।
[12]. ইবনু আবিদীন, রদ্দুল মুহতার আলাদ-দুর্রিল মুখতার, (বৈরূত: দারুল ফিকর, ২য় মুদ্রণ: ১৪১২ হি./১৯৯২ খৃ.), ১/৪০৭।
[13]. প্রাগুক্ত।
[14]. আল-বুহূতী, কাশশাফুল ক্বিনা‘ আন মাতনিল ইক্বনা‘ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, তা. বি.), ৫/১৬।
[15]. নববী, আল-মিনহাজ শারহু ছহীহি মুসলিম ইবনিল হাজ্জাজ (বৈরূত: দারু এহইয়াইত তুরাছ আল-আরাবী, ২য় মুদ্রণ: ১৩৯২ হি.), ৪/৩১।
[16]. দ্রষ্টব্য: আল-মারদাবী, আল-ইনছাফ ফির রজিহ মিনাল খিলাফ (বৈরূত: দারু এহইয়াইত তুরাছ আল-আরাবী, ২য় মুদ্রণ, তা. বি.), ৮/২৮-২৯।
[17]. প্রাগুক্ত।
[18]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ, (মদীনা: বাদশা ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স: ১৪১৬ হি./১৯৯৫ খৃ.), ১/২৮৭।