কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরবানীর ইতিহাস

আরবী কুরব বা কুরবান (قرب বা قربان) শব্দটি উর্দূ ও ফার্সীতে (قربانى) কুরবানী নামে রূপান্তরিত। কুরবানীর অর্থ হলো— নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভ করা, নিকটবর্তী হওয়া, উৎসর্গ করা, উপঢৌকন, সান্নিধ্য লাভের উপায়, ত্যাগ করা, পশুত্বকে বিসর্জন দেওয়া ইত্যাদি। মূলত কুরবানী শব্দটি বাংলায় ব্যবহৃত আরবী ভাষার একটি প্রতিশব্দ। কুরআনুল কারীমে কুরবানীর একাধিক সমার্থক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: (১) নাহর (نحر), এ অর্থে আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘(হে নবী!) আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য ছালাত এবং কুরবানী করুন’ (আল-কাওছার, ১০৮/২)। এ কারণে কুরবানীর দিনকে (يوم النحر) বলা হয়। (২) নুসুক (نسك), এ অর্থে আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু; সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য’ (আল-আনআম, ৬/১৬২)। (৩) মানসাক (منسك), এ অর্থে আল্লাহ বলেন, لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর বিধান রেখেছি’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩৪)। আবার (৪) (الأضحى) অর্থে হাদীছের ভাষায় কুরবানীর ঈদকে (عيد الأضحى) ‘ঈদুল আযহা’ বলা হয়।

কুরবানীর ইতিহাস :

কুরবানীর ইতিহাস অতি প্রাচীন। পৃথিবী নামক ভূখণ্ডে মানব সৃষ্টির শুরুর দিকেই পৃথিবীর প্রথম মানব এবং প্রথম নবী আদম আলাইহিস সালাম-এর সময় থেকেই কুরবানীর প্রচলন শুরু হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَاناً فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنْ الآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنْ الْمُتَّقِينَ ‘আদম আলাইহিস সালাম-এর দুই পুত্রের (হাবীল ও কাবীলের) বৃত্তান্ত আপনি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনান। যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল। তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হলো না। (যার কুরবানী কবুল হয়নি সে) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। (অপরজন) বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন’ (আল-মায়েদা, ৫/২৭)

পৃথিবীর ইতিহাসে আদম আলাইহিস সালাম-এর পুত্রদ্বয় হাবীল ও ক্বাবীলের কুরবানীই প্রথম, যাতে হাবীলের কুরবানী গৃহীত হয় আর ক্বাবীলেরটা হয় প্রত্যাখ্যাত। সে যুগে কুরবানী কবুল হওয়ার নিদর্শন ছিল এই যে, আসমান থেকে একটি আগুন এসে কুরবানী নিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কুরবানীকে উক্ত অগ্নি গ্রহণ করত না, সে কুরবানীকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হতো।

ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেক যুগেই কুরবানীর এ বিধান সব শরীআতেই বিদ্যমান ছিল। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে যুগে যুগে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রিয়বস্তু উৎসর্গই আজকের প্রচলিত কুরবানী। এ কথার প্রমাণে মহান আল্লাহ বলেন,وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الأَنْعَامِ فَإِلٰهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرْ الْمُخْبِتِينَ ‘আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য (কুরবানীর) নিয়ম করে দিয়েছি। তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিযিক্ব দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর উপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (এই বিভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতির মূল লক্ষ্য কিন্তু এক আল্লাহর নির্দেশ পালন)। কারণ তোমাদের মা‘বূদই একমাত্র উপাস্য। কাজেই তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ করো আর সুসংবাদ দাও সেই বিনীতদেরকে’ (আল-হজ্জ, ২২/৩৪)

আমাদের জন্য প্রণীত কুরবানীর ইতিহাস :

মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর ১০ যিলহজ্জ যে কুরবানী দিয়ে থাকেন, এর প্রচলন এসেছে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম থেকে। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সে হুকুম পালন করে সফল হয়েছিলেন। মুসলিম মিল্লাতের পিতা নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর কুরবানীর পর থেকে মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে তাঁর এ নির্দেশ কুরবানীর বিধান পালন করে আসছেন।

ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, স্বপ্নে আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর নিজ পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর সম্মতিতে কুরবানী করার মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে মিনার একটি নির্জন স্থানে যান। অতঃপর কুরবানী করার জন্য পুত্রকে শোয়ান। কিন্তু আল্লাহ তার নির্দেশ পালনের প্রতি পিতা এবং পুত্রের অপরিসীম ত্যাগ স্বীকারে খুশি হন এবং শিশু ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-কে রক্ষা করেন। আর আল্লাহর তরফ থেকে পাঠানো একটি মেষকে (ভিন্ন মত দুম্বা) শিশু ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর পরিবর্তে কুরবানী করা হয়। কুরবানীর এ নির্দেশের বর্ণনায় কুরআনে আল্লাহ বলেন,فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ ‘অতঃপর যখন সে (শিশু ইসমাঈল) তার (পিতা ইবরাহীম) এর সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে (পিতা ইবরাহীম) বলল, হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, অতএব এ ব্যাপারে তোমার কী অভিমত? সে (শিশু ইসমাঈল) বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশা-আল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০২)। আল্লাহ আরও বলেন, فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ ‘অতঃপর বাবা-ছেলে উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাকে যবেহ করার জন্য তাকে (শিশু ইসমাঈলকে) কাত করে শুইয়ে দিলেন’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০৩)। আল্লাহ আরও বলেন,وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ - قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ ‘তখন আমি (আল্লাহ) ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। নিশ্চয়ই আমি এভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০৪-১০৫)। আল্লাহ আরও বলেন,إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ - وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ ‘নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি (আল্লাহ) তার (ইবরাহীমের) সন্তান কুরবানীর পরিবর্তে যবেহযোগ্য এক মহান জন্তু দিয়ে কুরবানী করিয়ে তাকে (ইবরাহীমের সন্তানকে) মুক্ত করে নিলাম’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০৬-১০৭)। আল্লাহ আরও বলেন, وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ ‘আর এ (কুরবানীর) বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০৮)

সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তাআলা কতই না মহান! যিনি তাঁর বন্ধু নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে প্রিয় সন্তান কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনিও তার নির্দেশ পালনে নিজ সন্তানকে যবেহ করার জন্য শুইয়ে দিয়েছেন। আর তিনি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তারপর থেকেই মুসলিম উম্মাহ কুরবানীর এ বিধান পালন করে আসছেন।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে :

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বন্ধুত্ব মহান আল্লাহর প্রতি কত গভীর ছিল তা একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম যখন চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলেন, তখন প্রায় ১০০ বছরের বৃদ্ধ নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। তখন তিনি আল্লাহ তাআলার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সে সময় মিনা প্রান্তরে প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে কুরবানীর নির্দেশ পালন করেছিলেন। আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে তার মানসিকতা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে গিয়েছিল। যা আজও মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর যিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১৩ তারিখ এই চার দিনের যেকোনো একদিন পশু কুরবানীর মাধ্যমে পালন করে থাকেন।

প্রথম মানব নবী আদম আলাইহিস সালাম থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর উম্মতের জন্যই কুরবানীর বিধান বলবৎ ছিল। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণে আজও সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা প্রতি বছর ওই বিধান যথাযথ ধর্মীয় অনুশাসন মেনেই পালন করছেন। আর এর মাধ্যমেই মুসলিম সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে, সাদা চোখে কুরবানীর মাধ্যমে নিরীহ পশুকে যবেহ করার বিষয়টি দৃশ্যমান হলেও বাস্তবিক পক্ষে ওই পশু কুরবানীর মধ্যেই মানুষের জন্য রয়েছে প্রভূত কল্যাণ ও সমৃদ্ধি। কুরবানীর অন্তর্নিহিত শিক্ষাকে যদি মুসলিমরা উপলব্ধি ও ধারণ করতে পারে, তবে তখনই কেবল কুরবানী অর্থ শুধু পশু যবেহ নয়, বরং এর সুদূর প্রসারী মানব কল্যাণ।

অধ্যাপক ওবায়দুল বারী বিন সিরাজউদ্দীন

পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Magazine