উপদেশ-১২ : সালাফে ছালেহীনের চরিত্র
পূর্ণতায় পৌঁছার জন্য তোমার হিম্মত উঁচু হওয়া দরকার। কেননা, অনেক মানুষ শুধু দুনিয়াবিমুখতা নিয়ে ব্যস্ত আছে। অনেক মানুষ শুধু জ্ঞান চর্চায় ব্যস্ত আছে। তবে এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই রয়েছে যারা পরিপূর্ণ ইলম ও পরিপূর্ণ আমলের মাঝে সমন্বয় ঘটাতে পেরেছেন।
জেনে রেখো বৎস! আমি তাবেঈ ও তাদের পরবর্তীদের জীবনীর পাতা উল্টিয়ে দেখেছি, কিন্তু তাদের মাঝে চারজনকে পরিপূর্ণতার সবচেয়ে উচ্চ স্তরে পেয়েছি। তারা হলেন— সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব, হাসান আল-বাছরী, সুফিয়ান ছাওরী ও আহমাদ ইবনু হাম্বাল। তারাও তো মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাদের মাঝে এমন হিম্মত ছিল, যা আমাদের মাঝে ক্ষীণ হয়ে গেছে। সালাফে ছালেহীনের মাঝে এমন অনেক লোক ছিলেন, যাদের মাঝে ছিল সুউচ্চ হিম্মত। তাদের জীবনী দেখতে চাইলে তুমি ‘ছিফাতুছ ছফওয়া’ কিতাবটি খুলে দেখো। চাইলে তুমি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব, হাসান আল-বাছরী, সুফিয়ান ছাওরী ও আহমাদ ইবনু হাম্বাল রহিমাহুমুল্লাহ-এর জীবন-বৃত্তান্ত নিয়ে গবেষণা করতে পার। আমি এদের প্রত্যেকের জীবনী নিয়ে একটি করে কিতাব রচনা করেছি।
উপদেশ-১৩ : মূলধন জমিয়ে রাখো,মুনাফা খরচ করো
বাবা! তুমি জানো যে, আমি ১০০টি কিতাব রচনা করেছি। তার মধ্যে কয়েকখানা হলো— (ক) তাফসীরে কাবীর (২০ খণ্ডে)। (খ) তারীখ (২০ খণ্ডে)। (গ) তাহযীবুল মুসনাদ (২০ খণ্ডে)।
এছাড়া অন্য ছোট-বড় কিতাবগুলো কোনোটা পাঁচ খণ্ডে, কোনোটা দুই খণ্ডে, কোনোটা চার খণ্ডে, কোনোটা এর চেয়ে বেশি, কোনোটা বা কম খণ্ড হবে। এই কিতাবগুলোই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। কারো থেকে ধার নেওয়ার প্রয়োজন হবে না কিংবা কিতাব সংগ্রহ করা দরকার হবে না। সুতরাং তোমার কাজ হলো মুখস্থ করা! কেননা, মুখস্থই হলো মূলধন। আর জ্ঞান বিতরণ করাটা হলো মুনাফা। আর উভয় ক্ষেত্রে তুমি আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করো। তাঁর হালাল-হারামের সীমারেখার ব্যাপারে যত্নবান হও। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তাহলে তিনিও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/৭)। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫২)। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমার ওয়াদা পূর্ণ করো, তাহলে আমিও তোমাদের ওয়াদা পূর্ণ করব’ (আল-বাক্বারা, ২/৩০)।
আর তুমি আমলবিহীন ইলম অর্জন করা হতে সাবাধান থাকো। যারা রাজা-বাদশাদের দরবারে যায় এবং দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তারা ইলম অনুযায়ী আমল করা থেকে গাফেল থাকে। ফলে তারা ইলমের বরকত ও এর মাধ্যমে উপকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
উপদেশ-১৪ : ইলম ও আমল পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত
বিনা ইলমে ইবাদতে মশগূল হওয়া থেকে সাবধান থাকো। কেননা, ইলম ছাড়া আমল করতে গিয়ে অনেক ছূফী-সন্ন্যাসী সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তুমি তোমার মনকে মার্জিত বসনে আবৃত রাখো। তার উচ্চমান যেন তোমাকে দুনিয়াদারদের সামনে প্রসিদ্ধ না করে। আবার তার নিম্নমান যেন তোমাকে ছূফী-সাধকদের মাঝে অনুরূপ না করে। আর প্রতিটি পলকে, প্রতিটি শব্দের উচ্চারণে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে নিজের হিসাব মিলাও। কেননা, এই সকল বিষয়ে তুমি জিজ্ঞাসিত হবে।
আর একটি কথা খুব গুরুত্বের সাথে স্মরণ রাখো, তোমার বিদ্যা দিয়ে তুমি যতটুকু উপকার গ্রহণ করবে, তোমার শ্রোতাগণও ঠিক ততটুকুই উপকৃত হবে। বক্তা যদি নিজ বিদ্যা অনুযায়ী আমল না করে, তাহলে তার উপদেশবাণী মানুষের হৃদয় থেকে ছিটকে পড়বে, পানি যেভাবে পাথরের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ে। অতএব সৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত কখনও উপদেশ দিবে না, সৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত কখনও পথ চলবে না। এমনকি সৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত এক গ্রাস খাবারও মুখে উঠাবে না। সালাফে ছালেহীনের জীবনী অধ্যয়ন করো, সবগুলো বিষয় তোমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।
উপদেশ-১৫ : শ্রেষ্ঠ রচনাবলি
(ক) ‘মিনহাজুল মুরীদীন’ বইটি তোমার পড়া জরুরী। এটি তোমাকে আচার-আচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিবে। তাই এ বইটিকে তোমার সঙ্গী ও উস্তায বানিয়ে নাও।
(খ) ‘ছয়দুল খাত্বির’ বইটি অধ্যয়ন করো। এতে তুমি এমন সব ঘটনা সম্পর্কে জানবে, যা তোমার দ্বীন এবং দুনিয়ার বিষয়াবলিকে সংশোধন করে দিবে।
(গ) ‘জুন্নাতুন নাযার’ বইটি মুখস্থ করো। এটি তোমার ফিক্বহ বুঝার দক্ষতা অর্জনে যথেষ্ট হবে।
(ঘ) ‘আল-হাদায়েক’ কিতাবটিতে সময় দিলে অধিকাংশ হাদীছ তোমার অবগতিতে চলে আসবে।
(ঙ) ‘আল-কাশফ’ কিতাবটিতে দৃষ্টি দিলে ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমের হাদীছগুলোর অস্পষ্টতা তোমার কাছে স্পষ্ট হবে।
(চ) অনারবদের লিখিত তাফসীরগুলোতে মনোযোগ দিয়ো না। কারণ ‘আল-মুগনী’ ও ‘যাদুল মাসীর’ গ্রন্থদ্বয়ে তাফসীরের ক্ষেত্রে তোমার প্রয়োজন হবে এমন কোনো বিষয় বাদ পড়েনি।
(ছ) আর আমি তোমার জন্য নছীহতের যে সকল কিতাব রচনা করেছি, সেগুলোর বাইরে তোমার অতিরিক্ত কিতাবের প্রয়োজন হবে না।
উপদেশ-১৬ : কল্যাণকামী বক্তার গুণাবলি
সাধারণ মানুষ থেকে দূরে থাকো, কিন্তু তাদের সাথে সদাচরণ বজায় রাখো। কেননা, অসৎ সঙ্গীর সাথে থাকার চেয়ে একাকী থাকা বেশি প্রশান্তিদায়ক এবং মান-সম্মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক।
বিশেষ করে একজন বক্তাকে যেন অতি নমনীয় না দেখায় কিংবা বাজারে অহেতুক ঘোরাফেরা করা অথবা হাসি-তামাশা করতে না দেখা যায়। তার সম্পর্কে যেন মানুষের সুধারণা সৃষ্টি হয় এবং তার বক্তব্যে মানুষ উপকৃত হয়। যদি বাধ্য হয়ে মানুষের সাথে মিশতে হয়, তাহলে বুদ্ধিমত্তার সাথে মিশবে। কারণ তাদের স্বভাব-চরিত্রের কথা তাদের মুখের উপরে প্রকাশ করে দিলে তাদের সাথে সদাচরণ করা তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
উপদেশ-১৭ : হক্বদারের কাছে হক্ব পৌঁছিয়ে দাও
স্ত্রী, সন্তান, নিকটাত্মীয়সহ প্রত্যেক হক্বদারের কাছে হক্ব পৌঁছিয়ে দাও। তোমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কী নিয়ে সে বিদায় হচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য রাখো। যথাসম্ভব সর্বোত্তম জিনিস ছাড়া তাকে বিদায় দিও না। মনের ব্যাপারে অবহেলা করো না। সর্বোত্তম ও সুন্দরতম আমলের প্রতি তাকে অভ্যস্ত করে তোলো। কবর নামক সিন্দুকে এমন কিছু পাঠাও, সেখানে পৌঁছলে যা দেখে তুমি আনন্দিত হবে। যেমন বলা হয়—
ওহে যারা দুনিয়া নিয়ে আছো ব্যস্ত
উচ্চাকাঙ্ক্ষা যাকে করেছে ধোঁকাগ্রস্ত
মৃত্যু কবে হঠাৎ করে আসবে চলে
আর কবর তো হলো সিন্দুক আমলের।
কাজের শেষ ফলাফলের কথা মাথায় রাখো, তাহলে পছন্দনীয় কিংবা অপছন্দনীয় সকল ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করা তোমার পক্ষে সহজ হবে। যদি কখনও মনের মাঝে গাফলতি অনুভব কর, তাহলে মনকে কবরস্থানে ঘুরিয়ে নিয়ে আসো, তাহলে পরকালের পথে আসন্ন যাত্রার কথা স্মরণ হবে।
আল্লাহই সবকিছুর পরিচালক। তথাপি তোমার কার্য পরিচালনা করো— কোনো অপচয়-অপব্যয় না করে, যেন তোমাকে মানুষের দ্বারস্থ না হতে হয়। কেননা, সম্পদ রক্ষা করা দ্বীনেরই অংশ। এটা এজন্য যে, মানুষের দ্বারস্থ হওয়ার চেয়ে ওয়ারিছদের জন্য কিছু রেখে যাওয়া উত্তম।
উপদেশ-১৮ : শুভ সমাপ্তি
জেনে রাখো বাবা, আমরা আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রযিয়াল্লাহু আনহু-এর বংশধর। আমাদের পিতা হলেন ক্বাসেম ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু আবূ বকর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবূ বকর রযিয়াল্লাহু আনহু। তার জীবন-বৃত্তান্ত ‘ছিফাতুছ ছফওয়া’ গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর আমাদের উত্তরসূরীরা ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীদের মাঝে আমি ছাড়া এমন কেউ নেই, যাদেরকে জ্ঞানান্বেষনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেওয়া হয়েছিল। এখন জ্ঞানার্জনের বিষয়টি তোমার উপর বর্তিয়েছে। তুমি জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও, যেন তোমার সম্পর্কে আমার আশা ভঙ্গ না হয়। আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলাম। তারই কাছে দু‘আ করি, যেন তিনি তোমাকে ইলম এবং আমলের তাওফীক্ব দান করেন।
তোমাকে সদুপদেশ দেওয়ার জন্য আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম। সুউচ্চ সুমহান আল্লাহর হুকুম ছাড়া পাপ কাজ থেকে বাঁচার এবং আনুগত্য করার ক্ষমতা কারোই নেই। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি প্রশংসাকারীদের নিয়ামত বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তার পরিবারবর্গ ও ছাহাবীদের উপর রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন।
মূল : আবুল ফারজ ইবনুল জাওযী রহিমাহুল্লাহ
অনুবাদ : আব্দুল কাদের বিন রইসুদ্দীন
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।