কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আদ-দাওয়াহ ইলাল্লহ: এসো! আল্লাহর পথে... (পর্ব-৪)

আল্লাহর নাম ও গুণাবলি:

মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতকে স্পষ্টভাবে জানা ও বুঝার জন্য তাঁর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে জ্ঞান রাখা জরুরী। মহান সৃষ্টিকর্তার নাম ও গুণাবলি যেহেতু একটি অদৃশ্য বিষয়, সেহেতু এই বিষয়ক জ্ঞান মহান আল্লাহর প্রেরিত রাসূলগণ ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। যুক্তিতর্ক দিয়েও বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞান দিয়েও কোনো মতামত প্রদান করা সম্ভব নয়। অতএব, মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সংক্রান্ত তথ্য শুধু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে পাওয়া সম্ভব। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হলো।

আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি অনাদি। তিনি অনন্ত (Infinite) ও চিরন্তন (Eternal)। তিনি অমুখাপেক্ষী। তাঁর কোনো সাহায্যকারী লাগে না। তিনি সকল দুর্বলতা থেকে পবিত্র। তিনি সকল প্রয়োজন থেকে পবিত্র। তাঁর সন্তান বা পিতা নাই। তাঁর ঘুম, খাওয়া, বিশ্রাম কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। তিনি কোনো কিছুর সদৃশ নন। তিনি সত্তাগতভাবে আসমানের উপরে আরশে আযীমে সমুন্নত। তবে তাঁর জ্ঞান, তাঁর ক্ষমতা সকল সৃষ্টিজীবকে ঘিরে রেখেছে। আসমান ও যমীনের প্রতি ইঞ্চিতে একমাত্র তাঁরই একচ্ছত্র রাজত্ব ও ক্ষমতা বিদ্যমান। সকল সৃষ্টিজীব ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁর অনুগত, তারা তাঁর তাসবীহ পাঠ করে, তাঁর দিকেই ফিরে যায়। তিনি তাঁর সকল সৃষ্টিজীবের চেয়ে বড়, শক্তিশালী ও মহান। তিনি যা ইচ্ছা, তাই করতে পারেন। সকল কিছুর উপর তিনি ক্ষমতাবান। তিনি সকল কিছু জানেন। এমনকি মানুষের অন্তরের খবরও জানেন। তিনি একই সাথে সকল সৃষ্টিজীবের কথা শুনেন। সকল সৃষ্টিজীবকে দেখেন। অন্ধকার রাতে কালো পাথরের উপর চলা কালো পিঁপড়াকেও তিনি দেখতে পান। তিনি সকল কিছু অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিচালনা করেন। তাঁর নির্দিষ্ট সিস্টেম রয়েছে। যে সিস্টেমগুলোর মূল দায়িত্ব ফেরেশতারা পালন করে থাকেন। ফেরেশতারাই তাঁর সেনাবাহিনী। তিনি সরাসরি ফেরেশতাদের সাথে কথা বলেন, সরাসরি নবীদের সাথেও কথা বলেছেন। তাঁর নূরের প্রভাবেই সমগ্র আসমান-যমীন, সূর্য, মহাবিশ্ব আলোকিত। তাঁর কাজে কোনো ভুলত্রুটি বা কমতি নাই। তাঁর ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তিনি ন্যায়পরায়ণ ও প্রজ্ঞাময়। মহান আল্লাহর সৃষ্টির ক্ষমতা আছে, তাই তিনি সৃষ্টি করেন। সৃষ্টির জন্য তাঁর ইচ্ছা ও আদেশই যথেষ্ট। যেহেতু তাঁর জ্ঞান আছে, হিকমত আছে; সেহেতু তিনি ইচ্ছা করলে নির্ভুলভাবে ও সুচারুরূপে সৃষ্টি করতে পারেন। সৃষ্টিজীব যেহেতু দুর্বল, সেহেতু সে ভুল করতেই পারে। এইজন্য মহান আল্লাহ ক্ষমার ব্যবস্থা রেখেছেন। কেননা তিনি দয়ালু। তাঁর দয়ার কারণেই তিনি ক্ষমাশীল। মহান আল্লাহ অজ্ঞতা বা অক্ষমতার কারণে কাউকে ছেড়ে দেন এমন নয়। তিনি পূর্ণ ক্ষমতা থাকার পরও ক্ষমা করেন, এ জন্যই তিনি মহান। কল্যাণকর কাজ আল্লাহর নিকটে প্রিয়। আবার সেই কল্যাণের উত্তম প্রতিদান দেওয়াও আল্লাহর নিকট প্রিয়। অকল্যাণকর কাজ আল্লাহর নিকট অপ্রিয়, তবে তা ক্ষমা করা আল্লাহর নিকট প্রিয়। ন্যায়ের সাথে, হিকমতের সাথে সেই পাপের শাস্তি বাস্তবায়ন করাও আল্লাহর কাছে প্রিয়। আল্লাহ শাস্তি বাস্তবায়ন করলে তিনি সেক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ ‍ও সত্যবাদী আর শাস্তি বাস্তবায়ন না করলে তিনি দয়ালু ও ক্ষমাশীল।

আল্লাহর প্রতিটি আদেশ কল্যাণকর। কেননা তিনি প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর প্রতিটি প্রতিদান হয় তাঁর ন্যায়পরায়ণতা অথবা তাঁর দয়ার মাধ্যমে। মানুষ জাহান্নামে গেলে আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার কারণে জাহান্নামে যাবে আর জান্নাতে গেলে আল্লাহর দয়ার কারণে জান্নাত যাবে।

তিনি শাস্তি প্রদান করতে পারেন, তবে শাস্তি প্রদানকারী তাঁর নাম নয়। যেমন- আল্লাহর নাম দয়ালু। কেননা তিনি সবসময় দয়া করতে থাকেন, কিন্তু শাস্তির ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতা থাকলেও তিনি সবসময় এটি করেন না। একমাত্র যখন তাঁর হিকমত তাঁর ন্যায়পরায়ণতাকে আহ্বান করে, তখন ন্যায় প্রতিষ্ঠার খাতিরে তিনি শাস্তি প্রয়োগ করেন। আর এজন্যই তিনি হাকীম। কখন কী করতে হবে, তা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন। আর তিনি শাস্তি প্রয়োগ করলেও হুট করে প্রয়োগ করেন না; বরং প্রয়োগের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন, তারপর প্রেক্ষাপট স্বাভাবিক গতিতে সেই শাস্তির দিকে পরিবেশকে নিয়ে যায়। এজন্যই তিনি লাতীফ তথা সবকিছুই অতি সূক্ষ্মভাবে করেন।

আল্লাহর ইচ্ছার গুণ হচ্ছে তিনি কল্যাণের ইচ্ছা করেন, সহজতার ইচ্ছা করেন, তওবা কবুলের ইচ্ছা করেন। আল্লাহর কথার গুণ হচ্ছে তিনি সত্য বলেন। তাঁর কাজের গুণ হচ্ছে তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ভালোবাসার গুণ হচ্ছে তিনি স্বাভাবিকতা ভালোবাসেন; প্রেম করেন না, ঝুঁকে পড়েন না।

আল্লাহর সকল গুণ প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহর আদেশ কখনো অযৌক্তিক হবে না, অসামাজিক হবে না, মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে না। তাঁর প্রতিটি আদেশ মানুষের জন্য কল্যাণকর আর তাঁর প্রতিটি নিষেধ মানুষের জন্য অকল্যাণকর।

মহান আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মানার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নাই, বরং মানুষেরই প্রয়োজন রয়েছে। মানুষের অধীন কর্মচারীকে মানুষ তার আদেশ-নিষেধ মানতে বাধ্য করে, কেননা তার আদেশ ও নিষেধের সাথে তার প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড, সুনাম, সুখ্যাতি ও ইনকামের সম্পর্ক রয়েছে তথা স্বার্থ রয়েছে। অন্যদিকে মহান আল্লাহর কোনো আদেশ ও নিষেধে মহান আল্লাহর কোনো স্বার্থ নাই, স্বার্থ রয়েছে শুধু মানুষেরই তথা মানুষেরই কল্যাণ ও মানুষেরই অকল্যাণ যুক্ত রয়েছে।

আর মানুষের জায়গা থেকে চিন্তা করলে সৃষ্টিকর্তার মহৎ গুণ স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে তাঁর দিকে আকর্ষণ করে। যেমন- মানুষ দুনিয়াতে কোনো ভালো খেলোয়াড়, ভালো গায়ক, ভালো লেখক, ভালো আলেম অথবা ‍সুন্দর চেহারার কোনো মানুষকে ভালোবাসে, তার কথা শুনতে চায়, মানতে চায়। এটিই মানুষের সহজাত স্বভাব। সেই জায়গায় কোনো মানুষ যদি মহাসৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর মহৎ গুণগুলো সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানও অর্জন করে, মহান আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে ন্যূনতমও চিন্তা করে; তাহলে স্বাভাবিকভাবে তার মাথা নত হয়ে আসবে, সে আল্লাহকে ভালোবেসে ফেলবে, আল্লাহর দিকে তার ফিরে যেতে মন চাইবে।

মানুষের জায়গা থেকে চিন্তা করলে আরও একটি বিষয় মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানার দিকে উদ্বুদ্ধ করবে আর সেটি হচ্ছে আল্লাহর দয়া ও রহমত। কীভাবে প্রতি মূহূর্তে মহান আল্লাহর দয়া মানুষকে ঘিরে আছে সেটি যদি ন্যূনতমও মানুষের অনুভূতিতে কাজ করে, তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই মহান আল্লাহর ইবাদত করবে।

মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলি বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি:

১. আল্লাহর নামগুলো শুধু নাম নয়, বরং গভীর অর্থপূর্ণ। নামগুলো যেমন আল্লাহর সত্তার প্রমাণ বহন করে, তেমনি সেগুলোর অর্থ আল্লাহর গুণেরও প্রমাণ বহন করে।

২. আল্লাহর গুণগুলো সর্বোচ্চ ও সুন্দর। আল্লাহ তাঁর নামের ক্ষেত্রে ‘হুসনা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। হুসনা অর্থ শুধু সুন্দর নয়, বরং সর্বোচ্চ সুন্দর তথা প্রত্যেকটা নাম যে অর্থ প্রমাণ বহন করে সেই অর্থের সর্বোচ্চ স্তরে মহান আল্লাহর গুণ। মানুষের গুণের সাথে তাঁর গুণের কোনো তুলনা হয় না। মানুষের গুণ তার কাজ থেকে নির্গত আর আল্লাহর সকল কাজ তাঁর গুণ থেকে নির্গত। এজন্য আল্লাহর কাজগুলো পূর্ণ, সূক্ষ্ম ও নির্ভুল। কেননা তাঁর গুণগুলো মহৎ ও উঁচুমানের। কল্যাণের যে গুণগুলো মহান আল্লাহর জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে, সেগুলো অন্যান্য এই জাতীয় গুণের চেয়ে অনেক উঁচু। যেমন- আলীম (عليم) ও খবীর (خبير), এই দুটি গুণ ফক্বীহ (فقيه) ও আলেম (عالم) হওয়ার চেয়ে উঁচু। কারীম (كريم) ও জাওয়াদ (جواد), এই দুটি গুণ সাখী (سخي) ও মুতাছাদ্দিক্ব (متصدق) হওয়ার চেয়ে উঁচু। খালেক (خالق), বারী (باري) ও মুছাব্বির (مصور) এই গুণগুলো ফায়েল (فاعل)ও ছানি‘ (صانع) হওয়ার চেয়ে উঁচু।

৩. আল্লাহর নামগুলো দুই ধরনের হয়ে থাকে। কিছু নাম মহান আল্লাহর সত্তা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, আবার কিছু নাম সৃষ্টি পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে। যা মহান আল্লাহর সত্তা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ তা দুটি বিষয়ের প্রমাণ বহন করে— নামটি আল্লাহর জন্য প্রমাণিত হয় এবং নামটির অর্থপূর্ণ গুণটিও আল্লাহর জন্য প্রমাণিত হয়। যেমন- আল্লাহর নাম ‘আল-হাইয়্যূ’ তথা চিরঞ্জীব। এই নামটির অর্থ আল্লাহর সত্তা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। নামটি যেমন আল্লাহর জন্য প্রমাণিত, তেমনি নামের অর্থপূর্ণ গুণটিও আল্লাহর জন্য প্রমাণিত তথা মহান আল্লাহ কখনো মৃত্যুবরণ করেন না।

আর যদি নামের অর্থের প্রভাব সৃষ্টি পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে, তাহলে তিনটি বিষয় প্রমাণিত হয়— নামটি আল্লাহর জন্য প্রমাণিত হয়, নামটির অর্থপূর্ণ গুণটিও আল্লাহর জন্য প্রমাণিত হয় এবং সেই গুণের প্রভাব বা ফলাফল সৃষ্টি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যেমন- ‘আর-রহীম’ (পরম দয়ালু), এটি আল্লাহর একটি প্রমাণিত নাম। ‘আর-রহীম’ নামের মাধ্যমে বুঝা যায়, আল্লাহর মধ্যে রহমতের গুণ রয়েছে। আর রহমতের ফলস্বরূপ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর দয়া করেন, মাফ করেন, রহমত বর্ষণ করেন ইত্যাদি।

৪. আল্লাহর নামগুলো তাঁর গুণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থেরও প্রমাণ বহন করে। যেমন- আল্লাহর নাম আল-খালেক তথা মহান আল্লাহ সৃষ্টি করতে পারেন। এই নামটি আরও কয়েকটি অর্থের প্রমাণ বহন করে। যেমন- জ্ঞান ছাড়া যেমন সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, ক্ষমতা ছাড়াও তেমনি সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। সুতরাং আল্লাহর ‘সৃষ্টিকর্তা’ নাম তাঁর জ্ঞানী ও শক্তিশালী হওয়ারও প্রমাণ বহন করে।

৫. আল্লাহর নামগুলো শুধু অহী দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে। এখানে চিন্তাভাবনা ও গবেষণার কোনো সুযোগ নাই। ‍এটা যুক্তিতর্ক দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব নয় তথা আল্লাহর নাম হতে হলে কুরআনে ও ছহীহ হাদীছে তা থাকতে হবে। যা কুরআনে ও ছহীহ হাদীছে নাই, তা আল্লাহর নাম নয়।

৬. আল্লাহর নাম অগণিত ও অসংখ্য। শুধু ৯৯টি নয়। ৯৯টি মূলত আমাদের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।

৭. আল্লাহর এমনও গুণাবলি রয়েছে, যে গুণাবলি দিয়ে আল্লাহর কোনো নাম নাই। যেমন- মহান আল্লাহ হাসেন, রাগ করেন, নেমে আসেন এগুলো মহান আল্লাহর প্রমাণিত গুণ। তবে এগুলো দিয়ে শরীআতে আল্লাহকে নামকরণ করা হয়নি। যেমন- আল্লাহ রাগকারী বা আগমনকারী এই ধরনের কোনো নাম আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়।

৮. কিছু গুণ বিপরীতার্থক জবাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো দ্বারা মহান আল্লাহর নাম উদ্দেশ্য নয়। যেমন- কেউ যদি ঠাট্টা করে, তাহলে আল্লাহও ঠাট্টা করতে পারেন। কেউ যদি ষড়যন্ত্র করে, তাহলে আল্লাহও ষড়যন্ত্র করতে পারেন। এগুলোর অর্থ এই নয় যে, মহান আল্লাহর নাম হবে ষড়যন্ত্রকারী বা ঠাট্টাকারী। বরং এই কাজগুলো বিভিন্ন কথার উত্তরে শত্রুদের বিপরীতে মহান আল্লাহরও করার সক্ষমতা আছে সেটি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

৯. আল্লাহর নাম ও গুণাবলি দুই ধরনের হয়ে থাকে। ভালো গুণ সাব্যস্ত করার নাম এবং দুর্বলতার গুণ থেকে পবিত্রকারী নাম। ভালো গুণ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ নিজের জন্য জীবিত থাকা, কথা বলা এগুলো সাব্যস্ত করেছেন। আবার দুর্বলতার গুণ থেকে পবিত্র করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ নিজেকে সন্তান গ্রহণ, তন্দ্রা, ক্লান্তি, মৃত্যু ইত্যাদি থেকে পবিত্র করেছেন। আর দুর্বলতার গুণগুলোর ক্ষেত্রে অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে শুধু দুর্বলতা থেকে আল্লাহকে পবিত্র করলেই হবে না, বরং তার বিপরীত ভালো গুণকে মহান আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করতে হবে। যেমন- মহান আল্লাহকে তন্দ্রা স্পর্শ করে না, এর বিপরীত ভালো গুণ হচ্ছে মহান আল্লাহ সবসময় সজাগ থাকেন। আল্লাহ কারও উপর যুলম করেন না, এর বিপরীত গুণ হচ্ছে তিনি সর্বোচ্চ ন্যায়পরায়ণ।

১০. ভালো গুণ সাব্যস্তকরণের গুণাবলি সংখ্যায় বেশি আর দুর্বলতা থেকে পবিত্রকারী গুণাবলি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আর এই ধরনের দুর্বলতা থেকে পবিত্র করার গুণগুলো বিশেষ কিছু কারণে বর্ণিত হয়েছে, যেমন- আল্লাহর পরিপূর্ণতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি বলেন,لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ‘তাঁর মতো কিছুই নেই’ (আশ-শূরা, ৪২/১১)। তিনি আরও বলেন, وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ ‘তাঁর সমকক্ষ কেউই নেই’ (আল-ইখলাছ, ১১২/৪)। আল্লাহর পরিপূর্ণতা বুঝানোর জন্য এই পবিত্রকরণের প্রয়োজন ছিল।

কখনো মিথ্যুকদের ভুল দাবিকে প্রত্যাখ্যান করতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- কিছু মানুষ মনে করে আল্লাহর সন্তান রয়েছে, তাই পবিত্রকরণের লক্ষ্যে মহান আল্লাহর গুণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘আল্লাহর কোনো সন্তান নেই’। কারো মনে হতে পারে যে, আল্লাহর কাজে কোনো ঘাটতি আছে কি-না সেই ভুল ধারণা দূর করতে বলা হয়েছে, وَمَا مَسَّنَا مِنْ لُغُوبٍ ‘আমাদেরকে কোনো ক্লান্তি স্পর্শ করেনি’ (ক্বাফ, ৫০/৩৮)

১১. আল্লাহর কিছু গুণ তাঁর সত্তার সাথে সম্পর্কিত আর কিছু গুণ তাঁর কর্মের সাথে সম্পর্কিত। যেগুলো মহান আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পর্কিত, সেগুলো তাঁর চিরন্তন ও চিরস্থায়ী গুণ আর যেগুলো তাঁর কর্মের সাথে সম্পর্কিত, সেগুলো তিনি সবসময় করেন এমন নয়; বরং তাঁর হিকমত, ন্যায়পরায়ণতা, জ্ঞান যখন যে কাজটিকে উপযুক্ত মনে করে, তখন তিনি সে কাজটি করেন।

১২. আল্লাহর গুণ সাদৃশ্য থেকে পবিত্র। আল্লাহ গুণের ধরন বর্ণনা করা নিষিদ্ধ। কেউ যদি মনে করে আল্লাহর কোনো গুণ যেমন- শ্রবণ, দৃষ্টি ইত্যাদি তাঁর সৃষ্টিজগতের গুণাবলির মতো, তবে এটি একটি মারাত্মক ভুল। কারণ এটি কুরআন ও স্বাভাবিক যুক্তিবিরোধী কথা। স্বাভাবিক যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, সৃষ্টিজগতের একটি জিনিসের সাথে আরেকটির কোনো মিল নাই। যেমন- হাতির সাথে পিঁপড়ার কোনো মিল নাই, আকাশের সাথে যমীনের কোনো মিল নাই, সেখানে কীভাবে সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যে সাদৃশ্য থাকতে পারে? আমরা সকলেই জানি, প্রতিটি সৃষ্টির বিভিন্ন দুর্বলতা আছে। হাতির হাত দিয়ে হাতি মানুষের মতো কাজ করতে পারে না, আবার মানুষ তার হাত দিয়ে নিজের পিঠটাই ভালোভাবে চুলকাতে পারে না। সেখানে কীভাবে মহান সৃষ্টিকর্তার হাতকে তাঁর দুর্বল সৃষ্টির সাথে মিলানো হবে?

আল্লাহর গুণাবলিকে যেমন সৃষ্টিজীবের সাথে সাদৃশ্য দেওয়া যায় না, ঠিক তেমনি সেগুলোর ধরন সম্পর্কে মস্তিষ্কপ্রসূত কোনো কথাও বলা যাবে না। যেমন- ‘আল্লাহ আরশে এইভাবে এইভাবে আছেন’ অথবা ‘আল্লাহর শোনা বা দেখা মানে এমন এমন...’ এভাবে আল্লাহর গুণের ধরন নির্ধারণ করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا ‘তারা আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান দ্বারা পরিবেষ্টন করতে পারবে না’ (ত্ব-হা, ২০/১১০)। আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ‘যার ব্যাপারে তোমার জ্ঞান নেই, তার পেছনে যেয়ো না’ (আল-ইসরা, ১৭/৩৬)

আর যুক্তির বিচারে যেহেতু আমরা আল্লাহর সত্তা কেমন সেটাই জানি না, তাহলে তো তাঁর গুণাবলি কেমন হবে তা জানার প্রশ্নই আসে না। যেহেতু আল্লাহর সত্তা অদৃশ্য, সেহেতু তাঁর নাম ‍ও গুণ সম্পর্কে ততটুকুই জানা সম্ভব, যতটুকু মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহীর মাধ্যমে জানাবেন।

ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ-কে একবার আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, ٱلِاسْتِوَاءُ مَعْلُومٌ، وَٱلْكَيْفُ غَيْرُ مَعْقُولٍ، وَٱلإِيمَانُ بِهِ وَاجِبٌ، وَٱلسُّؤَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ অর্থাৎ আরশে আরোহণ (استواء) বুঝা যায়, এটি অজানা নয়; কিন্তু কীভাবে তা হয়েছে তা বুঝা যায় না। এ ব্যাপারে ঈমান আনা ফরয আর এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা বিদআত।[1]

১৩. ছিফাতের আয়াতগুলোকে তার প্রকাশ্য অর্থের উপরেই রেখে দিতে হবে। প্রকাশ্য অর্থ সেটাই, যেটা আয়াত পড়তে পড়তে একজন আরবীভাষী মানুষের বুঝে আসে। আরবী ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন মানুষ বাক্য শোনামাত্রই ওই বাক্য থেকে যা বুঝেন, সেটিই প্রকাশ্য অর্থ। আল্লাহর গুণের ধরন জানা যায় না তার অর্থ এই নয় যে, অর্থও জানা যায় না। একদল লোক আছে যারা বলে, কুরআনে উল্লেখকৃত আল্লাহর গুণের অর্থও আমরা জানি না, এটি একটি ভ্রান্ত মতবাদ। যদি অর্থই জানা সম্ভব না হয়, তাহলে কুরআনের আয়াতগুলো শুধু শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে। আর এটি কুরআনের জন্য ও মহান আল্লাহর জন্য অবমাননাকর! কুরআনের হাজারো আয়াত অর্থহীন হওয়ার মাধ্যমে তা উদ্দেশ্যহীন হয়ে যাবে আর মহান আল্লাহ উদ্দেশ্যহীন কোনো কথা বলেন না। মহান আল্লাহ কুরআনকে মানুষের জন্য বোধগম্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অতএব, বোধগম্য কুরআনের আয়াত অর্থহীন হতে পারে না। মহান আল্লাহর প্রতিটি গুণের অর্থ রয়েছে। যেহেতু মহান আল্লাহ নিজে সেই অর্থের কোনো ব্যাখ্যা করেননি, তাই আমরাও কোনো ধরন বর্ণনা বা সাদৃশ্য দেওয়া অথবা দূরবর্তী ব্যাখ্যা করা থেকে বিরত থাকব।

পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতের শেষে মহান আল্লাহর গুণাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখকৃত মহান আল্লাহর গুণাবলির সাথে সেই আয়াতের প্রেক্ষাপটের গভীর সম্পর্ক থাকে। মহান আল্লাহ আয়াতে যা বলেন, সেটির দলীল হিসেবে তাঁর গুণের কথা উল্লেখ করে থাকেন। যেমন- শাস্তির কথা বললে ‘আল-আযীয’ বলবেন, যা প্রমাণ করে তিনি শাস্তি দিতে সক্ষম। ক্ষমার কথা বললে ‘আর-রহীম’ বলেন, যা প্রমাণ করে তিনি দয়ালু, তাই অবশ্যই ক্ষমা করবেন। অতএব, কুরআনের প্রেক্ষাপট প্রমাণ করে মহান আল্লাহর গুণগুলো অর্থবহ এবং বাহ্যিক অর্থনির্ভর।

আমরা কি আল্লাহর চেয়ে আল্লাহকে বেশি চিনি? নিশ্চয়ই না। আল্লাহ নিজেকে নিয়ে যেমন বলেছেন, তা কি সত্য নয়? অবশ্যই সত্য। আল্লাহর চেয়ে বেশি সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল কথা কেউ বলতে পারে? না। তাহলে কেন মনে করব, আল্লাহ এমনভাবে কথা বলেছেন, যা মানুষের বোধগম্য নয়? তাও হাজারো আয়াতে। আল্লাহ তো তাঁর গুণাবলি এমন ভাষায় বলেছেন, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। তাহলে তুমি তা বিকৃত করে অন্য অর্থ নির্ধারণ করবে কেন?

তুমি কি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেয়ে বেশি আল্লাহ সম্পর্কে জানো? রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি সত্য বলতেন না? তিনি কি সবচেয়ে প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্টভাষী ছিলেন না? তিনি কি উম্মতের সবচেয়ে বড় কল্যাণকামী ছিলেন না? তাহলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে আল্লাহর গুণাবলি বর্ণনা করেছেন, তা মেনে নেওয়া উচিত আর তা বিকৃত করা অনুচিত।

আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী যদি ঈমানের মূল বিষয় ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মানুষ কীভাবে নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহর নাম ও গুণাবলি নির্ধারণ করবে? তা হবে অত্যন্ত হাস্যকর!

(ইন-শা-আল্লাহ চলবে)

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

* ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বিএ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।


[1]. মিরকাতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতুল মাছাবীহ, ‘কিতাবুল লিবাছ’ ৭/২৭৭৯।

Magazine