রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে তাকে কটূক্তিকারীদের পরিণতি :
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় যুগের নাস্তিক আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কটূক্তিকারী কা‘ব ইবনে আশরাফকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো একদিন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কে ইয়াহূদী সরদার কা‘ব ইবনু আশরাফকে হত্যা করতে পারবে? সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অনেক অনেক কষ্ট দিয়েছে। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু উঠে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি চান আমি তাকে হত্যা করি? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ!’। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুতখন বললেন, তাহলে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইলে আমাকে তা বলার অনুমতি প্রদান করবেন? নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যঁা, বলতে পারো’। এরপর মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুকা‘ব ইবনু আশরাফ ইয়াহূদীর কাছে গিয়ে বললেন, এ লোকটি (রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের কাছে শুধু ছাদাক্বাহ চায় আর আমাদেরকে সে জ্বালাতন করছে, আজ আমি তোমার নিকট কিছু ঋণের জন্য এসেছি। তখন কা‘ব ইবনু আশরাফ তাকে বলল, আরে এখনই জ্বালাতনের কী দেখেছো! পরে সে তোমাদেরকে অত্যাচারে আরও অতিষ্ঠ করে তুলবে! মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুতখন বললেন, সে যাই হোক, আমরা তো তাঁকে মেনে নিয়েছি। শেষ পরিণাম কী দাঁড়ায় তা না দেখে এখনই তাঁকে পরিত্যাগ করা ভালো মনে করি না। আমি এখন তোমার নিকটে এক ওয়াসাক্ব বা দু’ওয়াসাক্ব পরিমাণ খাদ্য ধার চাই। বর্ণনাকারী সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমর ইবনু দীনার আমার কাছে হাদীছটি কয়েকবার বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তিনি এক ওয়াসাক্ব বা দু’ওয়াসাক্ব শর্ত উল্লেখ করেননি। তাই তাঁকে আমি মনে করিয়ে দিলাম, এ হাদীছে তো এক ওয়াসাক্ব বা দু’ওয়াসাক্ব কথাটি আছে। তিনি বললেন, আমি মনে করি তাতে এক ওয়াসাক্ব বা দু’ওয়াসাক্ব কথাটি উল্লেখ আছে। যাহোক, কা‘ব ইবনু আশরাফ তখন বলল, ঋণ তো পেয়ে যাবে, তবে কিছু বন্ধক রাখো। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুতখন বললেন, আচ্ছা! তুমি কী জিনিস বন্ধক চাও? সে বলল, তোমাদের স্ত্রীদেরকে বন্ধক রাখো। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি আরবের সবচেয়ে সুদর্শন ব্যক্তি, তোমার কাছে আমাদের স্ত্রীদের কীভাবে বন্ধক রাখা যেতে পারে? সে তখন বলল, তাহলে তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে বন্ধক রাখো। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমাদের ছেলে-সন্তানদেরকেই বা কীভাবে বন্ধক রাখা যেতে পারে? তাহলে পরবর্তী সময়ে লোকেরা সুযোগ পেয়ে তাদেরকে খোঁটা দিয়ে বলবে, তোমাদেরকে মাত্র এক বা দু’ওয়াসাক্বের বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়েছিল। এটা আমাদের জন্য লাঞ্ছনাকর, অপমানজনক। বরং আমরা আমাদের তলোয়ার (লামা) বন্ধক রাখতে পারি। সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, (লামা) শব্দের অর্থ তলোয়ার। সুতরাং মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুপুনরায় যাওয়ার অঙ্গীকার করে চলে আসেন। দ্বিতীয়বার মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুআবু নায়লাকে (কা‘ব ইবনু আশরাফের দুধ ভাই) সাথে নিয়ে রাতেরবেলা তার কাছে যান। কা‘ব তাদেরকে দুর্গের মধ্যে ডেকে নেয়। রাতেরবেলা তাদের কাছে আসার সময় কা‘বের স্ত্রী তাকে বলল, এখন তুমি কোথায় যাচ্ছো? সে বলল, ভয়ের কোনো কারণ নেই। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুও আমার দুধ ভাই আবু নায়লা এসেছে, তাদের কাছে যাচ্ছি। বর্ণনাকারী সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমর ইবনু দীনার রাযিয়াল্লাহু আনহুব্যতীত এ হাদীছের অন্য বর্ণনাকারীগণ এতটুকু কথা বেশি সংযোগ করে বর্ণনা করেছেন, কা‘ব ইবনু আশরাফের স্ত্রী বলল, এ ডাকে রক্তের গন্ধ আছে বলে মনে হচ্ছে। কা‘ব ইবনু আশরাফ বলল, আরে কিছু না। আমার ভাই মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুএবং দুধ ভাই আবু নায়লা ডাকছে। আর বংশগত অভিজাত ব্যক্তিকে রাতেরবেলায় বর্শাবিদ্ধ করার জন্য ডাকলেও তার যাওয়া উচিত। বর্ণনাকারী আমর ইবনু দীনার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুতার সঙ্গে আরও দু’ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছিলেন। বর্ণনাকারী সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমর ইবনু দীনার কি তাদের দু’জনের নাম বলেছিলেন? উত্তরে সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, একজনের নাম বলেছেন। আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুবলেছেন, তিনি তার সাথে দু’জন লোক নিয়ে আসেন। অন্যরা বলেছেন, তিনি আবু আবস ইবনু জাবর, হারিছ ইবনু আঊস ও আববাদ ইবনু বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহুম-কে সাথে করে নিয়ে আসেন। আমর ইবনু দীনার রাযিয়াল্লাহু আনহুবর্ণনা করেন, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুতাঁর সঙ্গী দু’জনকে বলে রেখেছিলেন, যখনই কা‘ব ইবনু আশরাফ আসবে, তার মাথার চুল ধরে আমি শুঁকতে থাকব। যে সময় তোমরা দেখতে পাবে, আমি খুব শক্ত করে তার মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করেছি, অমনি তোমরা তলোয়ার দিয়ে তাকে আঘাত করবে। তিনি আরও বললেন, একবার আমি তোমাদেরকেও শুঁকাব। অতঃপর কা‘ব ইবনু আশরাফ শরীরে চাদর জড়িয়ে যখন তাঁদের কাছে আসে, তার শরীর থেকে তখন সুগন্ধি বের হচ্ছিল। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুতাকে দেখে বললেন, এতো উত্তম সুগন্ধি এর আগে আমি কোনোদিন দেখিনি। এ স্থলে আমর ব্যতীত অন্য বর্ণনাকারীগণ এতটুকু বেশি বর্ণনা করেছেন, তখন কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহুতাকে বলল, বর্তমানে আমার কাছে আরবের সবচেয়ে সুন্দরী ও সর্বাপেক্ষা উত্তম এবং অধিক সুগন্ধি ব্যবহারকারিণী নারী আছে। আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুবর্ণনা করেন, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুতখন কা‘বকে বললেন, আমাকে আপনার মাথা শুঁকতে অনুমতি দিবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ! অবশ্যই দেব। তারপর তিনি (মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ) তার মাথার ঘ্রাণ শুঁকলেন এবং সাথীদেরকেও শুঁকালেন। তারপর আবার বললেন, আমাকে আরেকবার শুঁকার অনুমতি প্রদান করবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ! এবার মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুতার মাথার চুল দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে সঙ্গীদেরকে বললেন, এবার নাও। আর তখনই তাঁরা তাকে হত্যা করেন এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ফিরে এসে এ সংবাদ জানান।[1] অপর একটি হাদীছে এসেছে,
عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ بَعَثَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِلَى أَبِى رَافِعٍ الْيَهُودِىِّ رِجَالاً مِنَ الأَنْصَارِ، فَأَمَّرَ عَلَيْهِمْ عَبْدَ اللهِ بْنَ عَتِيكٍ، وَكَانَ أَبُو رَافِعٍ يُؤْذِى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَيُعِينُ عَلَيْهِ.
বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনু আতীককে আমীর বানিয়ে তার নেতৃত্বে কয়েকজন আনছারী ছাহাবীকে ইয়াহূদী আবু রাফে‘কে (হত্যার) উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। আবু রাফে‘ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কষ্ট দিত এবং এ ব্যাপারে লোকদেরকে সাহায্য করত।[2] তারা রাতেরবেলা তার ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে খুন করে। হাদীছে এসেছে,
عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: بَعَثَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَهْطًا إِلَى أَبِي رَافِعٍ فَدَخَلَ عَلَيْهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَتِيكٍ بَيْتَهُ لَيْلاً وَهْوَ نَائِمٌ فَقَتَلَهُ.
বারা ইবনে আযেব রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ জনের কম সংখ্যক ব্যক্তির একটি দলকে আবু রাফে‘র উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে। তাঁদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু আতীক আনছারী রাযিয়াল্লাহু আনহুও ছিলেন। রাতের সময় তিনি আবু রাফে‘র ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে হত্যা করেন।[3]
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ أَنَّ أَعْمَى كَانَتْ لَهُ أُمُّ وَلَدٍ تَشْتُمُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم وَتَقَعُ فِيهِ فَيَنْهَاهَا فَلاَ تَنْتَهِى وَيَزْجُرُهَا فَلاَ تَنْزَجِرُ ... قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ أَنَا صَاحِبُهَا كَانَتْ تَشْتِمُكَ وَتَقَعُ فِيكَ فَأَنْهَاهَا فَلاَ تَنْتَهِى وَأَزْجُرُهَا فَلاَ تَنْزَجِرُ وَلِى مِنْهَا ابْنَانِ مِثْلُ اللُّؤْلُؤَتَيْنِ وَكَانَتْ بِى رَفِيقَةً فَلَمَّا كَانَتِ الْبَارِحَةَ جَعَلَتْ تَشْتِمُكَ وَتَقَعُ فِيكَ فَأَخَذْتُ الْمِغْوَلَ فَوَضَعْتُهُ فِى بَطْنِهَا وَاتَّكَأْتُ عَلَيْهَا حَتَّى قَتَلْتُهَا. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَلاَ اشْهَدُوا أَنَّ دَمَهَا هَدَرٌ.
ইবনু আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক অন্ধ ব্যক্তির একটি দাসী ছিল। সে নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে বেয়াদবীসূচক কথাবার্তা বলত। অন্ধ ব্যক্তিটি তাকে এরূপ করতে নিষেধ করতেন, কিন্তু সে তা মানত না। সে ব্যক্তি তাকে ধমকাতো, তবু সে তা থেকে বিরত হত না। এমতাবস্থায় এক রাতে যখন ঐ দাসী নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে অমর্যাদাকর কথাবার্তা বলতে থাকে, তখন ঐ অন্ধ ব্যক্তি একটি ছোরা নিয়ে তার পেটে প্রচ- আঘাত করে, যার ফলে ঐ দাসী মারা যায়। এ সময় তার এক ছেলে তার পায়ের উপর এসে পড়ে, আর সে যেখানে বসে ছিল, সে স্থানটি রক্তাক্ত হয়ে যায়। পরদিন সকালে এ ব্যাপারে যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আলোচনা হয়, তখন তিনি সকলকে একত্রিত করে বললেন, ‘আমি আল্লাহর নামে শপথ করে এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাই এবং এটা তার জন্য আমার হক্বস্বরূপ। অতএব যে ব্যক্তি তাকে হত্যা করেছে, সে যেন দাঁড়িয়ে যায়’। অন্ধ লোকটি তখন লোকদের সারি ভেদ করে প্রকম্পিত অবস্থায় নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে গিয়ে বসে পড়ে এবং বলে, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি তার হত্যাকারী। সে আপনার সম্পর্কে কটূক্তি ও গালি-গালাজ করত। আমি তাকে এরূপ করতে নিষেধ করতাম ও ধমকাতাম। কিন্তু সে তার প্রতি কর্ণপাত করত না। ঐ দাসী থেকে আমার দু’টি সন্তান আছে, যারা মনি-মুক্তা সদৃশ এবং সেও আমার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু গত রাতে সে যখন পুনরায় আপনার সম্পর্কে কটূক্তি ও গালমন্দ করতে থাকে, তখন আমি আমার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি এবং ছোরা দিয়ে তার পেটে প্রচ- আঘাত করে তাকে হত্যা করি। তখন নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা সাক্ষী থাকো যে, ঐ দাসীর রক্ত ক্ষতিপূরণের অযোগ্য বা মূল্যহীন’।[4]
বুলূগুল মারাম গ্রন্থে আল্লামা ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ লিখেন, অন্ধ ছাহাবীর এ হাদীছটি প্রমাণ করে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মন্দ মন্তব্যকারীকে হত্যা করা হবে। আর মুসলিম হলে সে মুরতাদ হয়ে যায়। আর তার থেকে তওবা করার আবেদন করার দরকার নেই।[5]
নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে ব্যঙ্গ বা কটূক্তিকারীর শাস্তি হলো মৃত্যুদ-। এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে, আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
فَلَمَّا قَدِمَ عَلَيْهِ (أبو موسى) مُعَاذٌ قَالَ انْزِلْ. وَأَلْقَى لَهُ وِسَادَةً فَإِذَا رَجُلٌ عِنْدَهُ مُوثَقٌ قَالَ مَا هَذَا قَالَ هَذَا كَانَ يَهُودِيًّا فَأَسْلَمَ ثُمَّ رَاجَعَ دِينَهُ دِينَ السُّوءِ. قَالَ لاَ أَجْلِسُ حَتَّى يُقْتَلَ قَضَاءُ اللهِ وَرَسُولِهِ. قَالَ اجْلِسْ نَعَمْ. قَالَ لاَ أَجْلِسُ حَتَّى يُقْتَلَ قَضَاءُ اللهِ وَرَسُولِهِ. ثَلاَثَ مَرَّاتٍ فَأَمَرَ بِهِ فَقُتِلَ ثُمَّ تَذَاكَرَا قِيَامَ اللَّيْلِ فَقَالَ أَحَدُهُمَا مُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ أَمَّا أَنَا فَأَنَامُ وَأَقُومُ أَوْ أَقُومُ وَأَنَامُ وَأَرْجُو فِى نَوْمَتِى مَا أَرْجُو فِى قَوْمَتِى.
‘যখন মু‘আয তার কাছে উপস্থিত হন, তখন তিনি তাকে বসার জন্য অনুরোধ করেন এবং তার জন্য একটি বালিশ রেখে দেন। এ সময় মু‘আয রাযিয়াল্লাহু আনহুতার নিকট বাঁধা অবস্থায় এক ব্যক্তিকে দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এই ব্যক্তি কে? তখন আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এই ব্যক্তি আগে ইয়াহূদী ছিল, পরে ইসলাম কবুল করে, এরপর সে ঐ অভিশপ্ত (ইয়াহূদী) ধর্মে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করেছে। তখন মু‘আয রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি ততক্ষণ বসব না, যতক্ষণ না এই ব্যক্তিকে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মতো হত্যা করা হবে। তখন আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হ্যাঁ, এরূপই হবে, আপনি বসুন। তখন মু‘আয রাযিয়াল্লাহু আনহুতিনবার এরূপ বললেন, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত বসব না, যতক্ষণ না এই ব্যক্তিকে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মতো হত্যা করা হবে। এরপর আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু হত্যার নির্দেশ দেন এবং তা কার্যকর করা হয়। পরে তারা রাত্রি জাগরণ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন। তখন তাদের একজন সম্ভবত মু‘আয ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাতে ঘুমাই ও উঠে ছালাতও আদায় করি; অথবা আমি রাতে উঠে ছালাত আদায় করি এবং ঘুমাইও। আর আমি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করার জন্য যেরূপ ছওয়াবের আশা করি, ঐরূপ ছওয়াব আমি ঘুমিয়ে থাকাবস্থায়ও আশা করি।[6] আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قَدِمَ عَلَىَّ مُعَاذٌ وَأَنَا بِالْيَمَنِ وَرَجُلٌ كَانَ يَهُوْدِيًّا فَأَسْلَمَ فَارْتَدَّ عَنِ الإِسْلاَمِ فَلَمَّا قَدِمَ مُعَاذٌ قَالَ لاَ أَنْزِلُ عَنْ دَابَّتِى حَتَّى يُقْتَلَ. فَقُتِلَ. قَالَ أَحَدُهُمَا وَكَانَ قَدِ اسُْتِيْبَ قَبْلَ ذَلِكَ.
‘আমি যখন ইয়ামানের শাসনকর্তা, তখন মু‘আয রাযিয়াল্লাহু আনহুআমার নিকট আসেন। এ সময় একজন ইয়াহূদী মুসলিম হয়, পরে ইসলাম পরিত্যাগ করে। সে সময় মু‘আয রাযিয়াল্লাহু আনহুসেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন, যতক্ষণ না এ ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে, ততক্ষণ আমি আমার বাহন থেকে অবতরণ করব না। এরপর তাকে হত্যা করা হয়’।[7]
হাদীছদ্বয় থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ধর্মত্যাগী তথা মুরতাদদের শাস্তি হলো মৃত্যুদ-। যা রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর করা হবে। যদি রাষ্ট্রের সরকার তার মৃত্যুদ- কার্যকর করতে বিলম্ব করে তাহলে মুসলিম জনগণ ন্যায়সঙ্গতভাবে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা বিজয়ের বছর মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ। তিনি মাথা থেকে তা খুললেন। সেসময় একজন এসে বলল যে, ইবনে খাতাল কা‘বার গিলাফ ধরে বসে আছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাকে হত্যা করো’।[8]
ইবনে খাতালকে কেন কা‘বার গিলাফ ধরা অবস্থায়ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যার নির্দেশ দিলেন? আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করে বলেন যে, লোকটি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালাগালি করত।[9]
সা‘দ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে নিরাপত্তা দান করেন। কিন্তু তিনি চারজন পুরুষ এবং দু’জন নারী সম্পর্কে বলেন, তাদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা করবে; যদিও তারা কা‘বার গিলাফ ধরে থাকে। তারা হলো ইকরিমা ইবনে আবু জাহ্ল, আব্দুল্লাহ ইবনে খাতাল, মিকইয়াস ইবনে সুবাবা, আব্দুল্লাহ ইবনে সা‘দ ইবনে আবু সারাহ। আব্দুল্লাহ ইবনে খাতালকে কা‘বার গিলাফের সাথে লাগা অবস্থায় পাওয়া গেল এবং তাকে হত্যা করার জন্য দু’ব্যক্তি ছুটে গেল। একজন হলো, সাঈদ ইবনু হুরাইছ, অন্যজন হলেন, আম্মার ইবনে ইয়াসির রাযিয়াল্লাহু আনহুমা। সাঈদ রাযিয়াল্লাহু আনহুছিলেন যুবক, তিনি আগে গিয়ে তাকে হত্যা করলেন। আর মিকইয়াস ইবনে সুবাবাকে লোকেরা বাজারে পেল এবং তাকে হত্যা করল। ইকরিমা ইবনে আবু জাহ্ল জাহাজে আরোহণ করে সুমদ্র পার হতে গেলে জাহাজ তুফানের কবলে পড়ল। জাহাজের লোক বলল, এখন তোমার একনিষ্ঠ ভাই আব্দুল্লাহকে ডাকো। কেননা তোমরা যে মূর্তির পূজা করো তারা তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবে না। ইকরিমা বলল, আল্লাহর কসম! যদি সুমদ্রে তিনি ব্যতীত আমাকে আর কেউ রক্ষা করতে না পারেন, তাহলে স্থলভাগেও তিনি ছাড়া আমাকে আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ওয়াদা করছি, যদি তুমি আমাকে এই মুছীবত হতে নাজাত দাও তবে আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হব এবং তাঁর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করব। আমার ধারণা তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন এবং রহম করবেন। পরে তিনি এসে মুসলিম হয়ে যান। আব্দুল্লাহ ইবনে আবু সারাহ ওছমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট গিয়ে লুকিয়ে থাকলেন। যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের বায়‘আতের জন্য আহবান করলেন, তখন ওছমান রাযিয়াল্লাহু আনহুতাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাযির করে দিলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আব্দুল্লাহর বায়‘আত গ্রহণ করুন। তিনি মাথা উঠিয়ে তিনবার আব্দুল্লাহর দিকে তাকালেন। তিনবারের পর তার বায়‘আত গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি ছাহাবায়ে কেরামের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কোনো বুদ্ধিমান লোক ছিল না যে, যখন আমি তার বায়‘আত গ্রহণ করছিলাম না, তখন এসে তাকে হত্যা করত? ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার মনের কথা আমরা কি করে জানব? আপনি চক্ষু দ্বারা কেন ইশারা করলেন না? তিনি বললেন, ‘নবীর মর্যাদার অনুকূল নয় যে, বাহ্যত চুপ থেকে চোখে ইঙ্গিত করবে’।[10]
আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ইয়াহূদী মহিলা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে গালাগাল করত, মন্দ কথা বলত। তখন এক ব্যক্তি তার গলা চেপে ধরে, ফলে সে মারা যায়। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হত্যার বদলে হত্যাকে অগ্রহণীয় সাব্যস্ত করেছেন।[11]
মদীনায় আবু ইফক নামে এক কুলাঙ্গার ছিল। সে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কুৎসামূলক কবিতা রচনা করে, তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিলে সালেম আমের রাযিয়াল্লাহু আনহুনামে একজন ছাহাবী তাকে হত্যা করেন।[12]
বনু উমাইয়ার এক মহিলা কবি ছিল। যার নাম আসমা বিনতে মারওয়ান। সে আবু ইফকের হত্যা দেখে ইসলামকে ঠাট্টা করে কবিতা রচনা করে। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হত্যার নির্দেশ দিলে উমায়ের ইবনে আদল আল খাতামী রাযিয়াল্লাহু আনহুতার ঘরে গিয়ে তাকে হত্যা করে আসেন। এ সংবাদ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানালে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হয়ে বলেন, ‘হে উমায়ের! তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করেছো’।[13]
আলেমদের দৃষ্টিতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কটূক্তিকারী :
হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে শামী’তে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কটাক্ষ বা গালমন্দ করে, তাদের হত্যা করার ব্যাপারে সমস্ত ফক্বীহ একমত। ইমাম মালেক, লাইছ, আহমাদ, ইসহাক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুমুল্লাহ ও তার শিষ্যবর্গ এবং ইমাম ছাওরী ও আওযাঈ রাহিমাহুমুল্লাহসহ সকলেই এ মত পোষণ করেন।[14]
প্রখ্যাত ফক্বীহ ক্বাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ (১০৮৩-১১৪৯ খ্রি.) বলেন, ‘উম্মতের ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি দেওয়া বা তাকে অসম্মান করার শাস্তি হচ্ছে হত্যা করা। এ ব্যাপারে ইমামগণের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি দেবে বা তাকে অবমাননা করবে সে কাফের এবং তার শাস্তি মৃত্যুদ-।[15]
মালেকী মাযহাবের অন্য একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আয-যাখীরাহ ফী ফিক্বহিল মালেকী’-তে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহকে অথবা আল্লাহর রাসূলকে অথবা অন্য কোনো নবী-রাসূলকে গালি দেয় তাকে ইসলামের নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী হত্যা করা হবে। সে যদি তওবা করে, তা সত্ত্বেও তার এই শাস্তি রহিত হবে না।[16]
মালেকী মাযহাবেও এ কথা বলা হয়েছে, ‘কোনো মুসলিম যদি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কটাক্ষ বা গালমন্দ করে, তাহলে তাকে অবশ্যই হত্যা করা হবে, তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে না। আর যদি কোনো কাফের ঐ একই অপরাধ করে এবং পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করতে চায় সেক্ষেত্রে দু’টি মত রয়েছে। একটি হলো, সে ইসলাম কবুল করলে ক্ষমা করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো, যদি সে নিজে স্বেচ্ছায় ধরা দেয় বা তওবা করে। আরেকটি হলো, না! তাকেও ক্ষমা করা হবে না; বরং হত্যা করা হবে।[17]
শাফেঈ মাযহাবের প্রসিদ্ধ আলেম ইবনুল মুনযির রাহিমাহুল্লাহ (৮৫৬-৯৩১ খ্রি.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সরাসরি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালমন্দ করবে, তাকে হত্যা করা ওয়াজিব এবং এ ব্যাপারে সকলেই একমত।[18]
শাফেঈ মাযহাবের প্রসিদ্ধ আলেম আবুবকর আল-ফারিসী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৯১৭ খ্রি.) তার ‘আল-ইজমা’ নামক কিতাবে বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এমন কোনো গালি দেয়, যাতে অপবাদের বিষয় রয়েছে, তবে সে স্পষ্ট কুফরী করল। সে তওবা করা সত্ত্বেও তার হত্যার বিধান রহিত হবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অপবাদ দেওয়ার শাস্তি হলো মৃত্যুদ-, যা তওবা করা সত্তেবও রহিত হয় না।[19]
ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ-এর ‘উছূলুস সুন্নাহ’ নামক আক্বীদার গ্রন্থে বলা হয়েছে, সঠিক সিদ্ধান্ত হলো এই যে, যিন্দীক, মুনাফিক্ব এবং যারা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অথবা ছাহাবীদেরকে গালি দেয় অথবা আল্লাহ, আল্লাহর কিতাব অথবা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আর যারা যাদুকর এবং যাদের মুরতাদ হওয়া বারংবার প্রমাণিত এদের সকলের ব্যাপারে ইসলামের বিধান হলো, কোনো প্রকার তওবা করার সুযোগ দেওয়া ছাড়াই তাদের হত্যা করতে হবে, যাতে তাদের অন্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং অন্যরা এ ধরনের অন্যায় করতে সাহস না পায়।[20]
আল্লামা ক্বাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কুরআন, হাদীছ ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে কী কী হক্ব রয়েছে তা প্রমাণিত এবং তাকে কতটুকু সম্মান-ইযযত দিতে হবে তাও সুনির্দিষ্ট। এ হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কষ্ট দেওয়াকে হারাম করেছেন। আর উম্মত এ কথার উপর ইজমা‘ তথা ঐকমত্য হয়েছেন যে, মুসলিমদের মাঝে যে তাঁর কুৎসা বলবে, কিংবা গালি দিবে তাকে হত্যা করা হবে।[21]
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সুহনুন রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ওলামায়ে কেরাম রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালাগালিকারী ও তার কুৎসাকারীদের কাফের হওয়ার উপর ইজমা‘ তথা ঐকমত্য হয়েছেন। আর এমন ব্যক্তির উপর আল্লাহর শাস্তি ও ধমক রয়েছে। আর যে ব্যক্তি এমন ব্যক্তির কাফের হওয়া ও শাস্তির অধিকারী হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করবে সেও কাফের।
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহিমাহুল্লাহ সূরা তওবার ১১-১৩ নাম্বার আয়াত দ্বারা দলীল দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি ইসলাম বা কুরআনের বিরুদ্ধে খারাপ মন্তব্য করে অথবা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর ব্যাপারে মন্দ কথা বলে ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে।[22]
ইমাম আল-খাত্ত্বাবী রাহিমাহুল্লাহ (৯৩১-৯৯৮ খ্রি.) বলেন, ‘যারা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে কটাক্ষ বা গালমন্দ করে তাদের হত্যা করা ওয়াজিব। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত আছে বলে আমার জানা নেই।[23]
আল-কাফী ফী ফিক্বহি আহলিল মাদীনাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালিগালাজ করবে, সে মুসলিম হোক বা যিম্মী (অমুসলিম নাগরিক) হোক, তাকে সর্বাবস্থায় হত্যা করা হবে। এ দু’টি মতই ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ থেকে ইমাম ইবনুল হাকাম রাহিমাহুল্লাহ ও অন্যরা বর্ণনা করেছেন।[24]
ইমাম ইবনু কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ (১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেন, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি দেয় তাকে সর্বাবস্থায় হত্যা করতে হবে।[25]
ইমাম ইবনু তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ (১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেন, ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ একাধিক স্থানে বলেছেন, যে সকল লোক রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালিগালাজ করে অথবা কটাক্ষ করে তারা মুসলিম হোক বা কাফের তাদেরকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। আমি মনে করি তাদেরকে তওবার সুযোগ না দিয়ে হত্যা করা হোক।[26]
‘আদ-দুরারুস সানিয়্যাহ’ নামক কিতাবে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ-এর বর্ণিত ‘ঈমান ভঙ্গের কারণসমূহ’-এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনের কোনো বিষয় নিয়ে অথবা ছওয়াব বা শাস্তির বিষয় নিয়ে উপহাস ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, সে কাফের হয়ে যায়।[27]
প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ইমাম নাছিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ (১৩৩২-১৪২০হি.) বলেন, শায়খ ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ১৪২০হি.) বলেছেন, মানুষ কখনো মুখে অস্বীকার না করেও বিভিন্ন কারণে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে কাফের হয়ে যায়, যার বিস্তারিত বিবরণ আলেমগণ নিজ নিজ কিতাবের ‘মুরতাদের বিধান’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। এ জাতীয় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, ইসলাম নিয়ে অথবা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে কটাক্ষ করা অথবা আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল অথবা আল্লাহর কিতাব অথবা আল্লাহ প্রদত্ত শরী‘আতের কোনো বিষয় নিয়ে উপহাস করা। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘বলো! তোমরা আর কোনো কৈফিয়ত পেশ করো না। নিশ্চয়ই তোমরা ঈমান আনার পরে কুফরী করছো।[28]
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কটূক্তিকারীর তাওবা :
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে কটূক্তিকারী ও নাস্তিক-মুরতাদদের শাস্তি হলো মৃত্যুদ-। তাদের এ শাস্তি মওকূফের কোনো সুযোগ নেই। তারা মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি চাইলে তাদেরকে ক্ষমা করতে পারেন। এতে করে তাদের পরকালীন শাস্তি আল্লাহ মওকূফ করবেন। তবে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে দুনিয়াবী শাস্তি তথা মৃত্যুদ- বহাল থাকবে। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, ইকরিমা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে,
أَنَّ عَلِيًّا عَلَيْهِ السَّلاَمُ أَحْرَقَ نَاسًا ارْتَدُّوْا عَنِ الإِسْلاَمِ فَبَلَغَ ذَلِكَ ابْنَ عَبَّاسٍ فَقَالَ لَمْ أَكُنْ لأَحْرِقَهُمْ بِالنَّارِ إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تُعَذِّبُوْا بِعَذَابِ اللهِ. وَكُنْتُ قَاتِلَهُمْ بِقَوْلِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَإِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ بَدَّلَ دِيْنَهُ فَاقْتُلُوْهُ.
‘আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুঐসব লোকদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন, যারা মুরতাদ হয়েছিল। এ সংবাদ ইবনু আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট পৌঁছলে তিনি বলেন, যদি আমি সেখানে উপস্থিত থাকতাম, তবে তাদের আগুনে পুড়াতে দিতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তি দ্বারা কাউকে শাস্তি দিয়ো না’। অবশ্য আমি তাদেরকে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ মতো হত্যা করতাম। কেননা তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দ্বীন পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়, তোমরা তাকে হত্যা করবে’।[29]
এ হাদীছ থেকে বুঝা যায়, আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমুরতাদদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন। অবশ্য ইবনু আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহুআগুনে পুড়িয়ে হত্যা করাকে পসন্দ করেননি। তবে তিনিও মৃত্যুদ--র পক্ষেই রায় দেন। দুনিয়াতে তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
কেউ কেউ বলেছেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননাকারী মুসলিম হোক বা অমুসলিম তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে না। তাকে হত্যা করা হবে। তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে না।[30]
ইমাম ইবনে তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ একাধিক জায়গায় বলেছেন, যে সকল লোক রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালিগালাজ করে অথবা কটাক্ষ করে তারা মুসলিম হোক বা কাফের তাদেরকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। আমি মনে করি, তাদেরকে তওবার সুযোগ না দিয়ে হত্যা করা হোক।[31]
ক্বাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ (১০৮৩-১১৪৯ খ্রি.) বলেন, যে সকল লোক রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালিগালাজ করে অথবা কটাক্ষ করে তারা মুসলিম হোক বা কাফের তাদেরকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে, তাদের তওবা কবুল হবে না। কেননা এটি শুধু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়।[32]
ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর মতে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননাকারী যদি মুসলিম হয় তবে তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে, তাকে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে। ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ-এর মতে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননাকারী যদি মুসলিম হয় তবে তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে।[33]
মহান আল্লাহ আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বোচ্চ সম্মান নিশ্চিত করার তাওফীক দিন। আমীন!
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪০৩৭।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৪০৩৯।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৪০৩৮।
[4]. সুনানে আবুদাঊদ, হা/৪৩৬৩, সুনানে দারাকুৎনী, হা/১০৩; আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১১৯৮৪; বুলূগুল মারাম, হা/১২০৪।
[5]. বুলূগুল মারাম ফী আহাদীছিল আহকাম, হা/১৩৩।
[6]. আবুদাঊদ, হা/৪৩৫৪, সনদ ছহীহ ।
[7]. আবুদাঊদ, হা/৪৩৫৫, সনদ ছহীহ ।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৪৯।
[9]. ফাতহুল বারী, ২/২৪৮; আস-সারেমুল মাসলূল, পৃঃ ১৩৫।
[10]. নাসাঈ, হা/৪০৬৭; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৭২৩, সনদ ছহীহ ।
[11]. সুনানে আবুদাঊদ, হা/৪৩৬৪; সুনানে বায়হাক্বী কুবরা, হা/১৩১৫৪।
[12]. সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪/২৮৫।
[13]. সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪/২৮৬।
[14]. ইবনু আবিদীন, প্রাগুক্ত, ১৬/ ২৮৫।
[15]. ইমাম ইবনে তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ, আস-সারিমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল, ১/৯।
[16]. শিহাবুদ্দীন আহমাদ ইবনে ইদরীস, আয-যাখীরাহ ফী ফিক্বহিল মালিকী, বৈরূত, ১৯৯৪, ১১/ ৩০২।
[17]. আবদুল ওয়াহহাব আছ-ছা‘লাবী, আত-তালকীন ফিল ফিক্বহিল মালিকী, বৈরূত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৪২৫হিঃ/২০০৪খ্রি., ২/১৯৯।
[18]. ইবনুল মুনযির, কিতাবুল ইজমা‘, তাবি, ১/৩৫।
[19]. আন-নাবাভী, আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহায্যাব, বৈরূত, দারুল ফিকর, তা.বি., ১৯/ ৩২৬।
[20]. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ, উছূলুল সুন্নাহ, সঊদী আরব, দারুল মানার, ১৪১১, ১/৪৯২।
[21]. সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১২/২১; আশ-শিফা, ২/২১১।
[22]. মাহাসিনুত তাওয়ীল, ৫/১৪২।
[23]. ইমাম ইবনে তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ, আস-সারিমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল, ১/৯।
[24]. ইবনু আবদিল বার্র রাহিমাহুল্লাহ, আল-কাফী ফী ফিক্বহি আহলিল মাদীনাহ, ২/১০৯১।
[25]. ইবনে কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ, আশ-শারহুল কাবীর, বৈরূত, দারল কিতাবুল আরাবী, তা.বি., ১০/৬৩৫।
[26]. ইমাম ইবনে তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ, আস-সারিমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল, ১/১০।
[27]. আব্দুর রহমান ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ক্বাসিম রাহিমাহুল্লাহ, আদ-দুরারুস ছানিয়্যাহ মিন আজভীবাতিন নাজদিয়্যাহ, ২/২৬৬।
[28]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আল-আলবানী রাহিমাহুল্লাহ, হাকীকাতুল ঈমান, মিসর, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, তা.বি., ১/৩২।
[29]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০১৭; আবুদাঊদ, হা/৪৩৫১; ইবনু মাজাহ, হা/২৫৩৫; তিরমিযী, হা/১৪৫৮; নাসাঈ, হা/৪০৬০; মিশকাত, হা/৩৫৩৩।
[30]. আবদুল ওয়াহহাব আছ-ছা‘লাবী, আত-তালকীন ফিল ফিক্বহিল মালিকী, ২/১৯৯।
[31]. ইমাম ইবনে তায়মিয়া রাহিমাহুল্লাহ, আস-সারিমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল, ১/১০।
[32]. প্রাগুক্ত।
[33]. প্রাগুক্ত।