যা বর্জনীয় :
(১) যমযমের পানি দিয়ে গোসল করা।
(২) যমযমের পানি দিয়ে শরীরের কোনো অংশ ধুয়ে ফেলা।
(৩) বরকতের নিয়্যতে যমযমের পানি দিয়ে কাপড় ধৌত করা।
(৪) যমযমের পানি অপচয় করা।
ছাফা-মারওয়া সাঈ করা : যমযমের পানি পান করার পর ছাফা-মারওয়া সাত চক্কর সাঈ করতে হবে। তামাত্তু হজ্জের সময় এটা উমরার সাঈ হবে। ক্বেরান ও ইফরাদ হজ্জের ক্ষেত্রে এ সময় সাঈ করলে ১০ তারিখে করতে হবে না। তবে এ সময় না করে ১০ তারিখে করা যায়। অবশ্য ত্বাওয়াফের সাথেই করা উত্তম। কারণ, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জে ক্বেরান করেছিলেন। ঐ সময় তিনি ত্বাওয়াফের সাথে সাঈ করেছিলেন। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, رَمَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الْحَجَرِ إِلَى الْحَجَرِ ثَلَاثًا وَمَشَى أَرْبَعًا وَكَانَ يَسْعَى بِبَطْنِ الْمَسِيلِ إِذَا طَافَ بَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালো পাথর থেকে কালো পাথর পর্যন্ত তিন বার রামাল (দ্রুত হাটা) করলেন। আর চার বার স্বাভাবিক চললেন। আর যখন তিনি ছাফা-মারওয়া সাঈ করছিলেন, তখন তিনি ‘বাত্বনে মাসীল’ হতে দৌড়ে যাচ্ছিলেন’।[1] এই হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ত্বাওয়াফের সাথে সাঈ করেছিলেন।
হায়েয অবস্থায় মহিলারা সাঈ করতে পারে। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, فَاقْضِى مَا يَقْضِى الْحَاجُّ غَيْرَ أَنْ لاَ تَطُوفِى بِالْبَيْتِ ‘হাজীগণ যেভাবে হজ্জ পালন করেন তুমি সেভাবে সব বিধান পালন করো। তবে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত ত্বাওয়াফ করো না’।[2] এই হাদীছে প্রমাণিত হয়, মহিলারা হায়েয অবস্থায় সাঈ করতে পারে। সাঈ হজ্জ বা উমরার সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ। এটা ভিন্ন কোনো ইবাদত নয়। অতএব, হজ্জ-উমরা ছাড়া সাঈ করা যাবে না। সাঈ শুরু হবে ছাফা হতে। উপরে উঠে কেবলামুখী হয়ে হাত তুলে দু‘আ করবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ أَقْبَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَدَخَلَ مَكَّةَ فَأَقْبَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْحَجَرِ فَاسْتَلَمَهُ ثُمَّ طَافَ بِالْبَيْتِ ثُمَّ أَتَى الصَّفَا فَعَلاَهُ حَيْثُ يَنْظُرُ إِلَى الْبَيْتِ فَرَفَعَ يَدَيْهِ فَجَعَلَ يَذْكُرُ اللَّهَ مَا شَاءَ أَنْ يَذْكُرَهُ وَيَدْعُوهُ.
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মদীনা থেকে) এসে মক্কায় প্রবেশ করলেন। অতঃপর তিনি হাজরে আসওয়াদের দিকে অগ্রসর হলেন এবং সেটিকে চুমা দিলেন। তারপর বায়তুল্লাহ ত্বাওয়াফ করলেন। অতঃপর ছাফা পাহাড়ে আসলেন এবং তার উপর এমনভাবে চড়লেন যাতে তিনি কা‘বাঘর দেখতে পাচ্ছিলেন। তারপর তিনি দুই হাত তুললেন এবং ইচ্ছামতো আল্লাহর যিকির করতে থাকলেন ও দু‘আ করলেন।[3]
ছাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হয়ে প্রথমে পাঠ করবে,
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ ... أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللَّهُ بِهِ.
‘নিশ্চয় ছাফা-মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমিও তা দিয়ে শুরু করছি’।[4] এরপর বলবে, اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ (তিন বার)। তারপর (তিন বার) বলবে,لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ. آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ، لِرَبِّنَا حَامِدُونَ. صَدَقَ اللَّهُ وَعْدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَهُ অর্থ : ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বূদ নেই। তিনি একক তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তারই। সকল প্রশংসা তাঁর। তিনি সবকিছু করতে সক্ষম। আমরা ফিরে যাই, তওবা করি তাঁর নিকটে। আমরা ইবাদত ও প্রশংসা করি আমাদের রবের। আল্লাহ তাঁর অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেনে। তিনি একাই সম্মিলিত শত্রুদলকে পরাজিত করেছেন’।[5]
উক্ত দু‘আটি এক বার বলার পর নিজের জন্য দু‘আ করবে। এভাবে তিন বার দু‘আ করবে। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ছাফা পাহাড়ে দাঁড়াতেন, তখন তিন বার اللَّهُ أَكْبَرُ বলতেন। তারপর বলতেন,لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ অর্থ : ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মা‘বূদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসা তাঁর। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’। এভাবে তিন বার বলতেন। তারপর দু‘আ করতেন। এভাবে মারওয়া পাহাড়ের উপরও দু‘আ করতেন।[6]
সুলায়মান ইবনু মুগীরা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজারে আসওয়াদের পাশে আসলেন, তাতে চুমু দিলেন। তারপর বায়তুল্লাহ ত্বাওয়াফ করলেন। অতঃপর যখন ত্বাওয়াফ শেষ করলেন, তখন ছাফা পাহাড়ে আসলেন এবং পাহাড়ের উপরে উঠে বায়তুল্লাহর দিকে তাকালেন। অতঃপর দুই হাত উঠালেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর ইচ্ছামতো দু‘আ করতে লাগলেন।[7] জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজারে আসওয়াদের নিকট আসলেন এবং তাতে চুমু দিলেন। তারপর দরজা দিয়ে ছাফা পাহাড়ের দিকে বের হয়ে গেলেন। তারপর যখন তিনি ছাফার নিকটবর্তী হলেন, তখন তিনি তেলাওয়াত করলেন, إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ ‘নিশ্চয় ছাফা এবং মারওয়া পাহাড় আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত’। তারপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি সেই পাহাড় থেকে সাঈ আরম্ভ করছি যে পাহাড় থেকে আল্লাহ আরম্ভ করেছেন। অতঃপর তিনি ছাফা হতে আরম্ভ করলেন এবং ছাফা পাহাড়ের উপর উঠলেন। এমনকি তিনি কা‘বাঘর দেখতে পেলেন এবং কেবলামুখী হলেন এবং আল্লাহ এক বলে ঘোষণা দিলেন। অতঃপর তাকবীর পাঠ করলেন এবং বললেন,
لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ، أَنْجَزَ وَعْدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ.
তারপর কিছু সময় দু‘আ করলেন। অনুরূপ তিন বার করলেন। অতঃপর ছাফা থেকে নামলেন এবং মারওয়ার দিকে হেঁটে চললেন। এমনকি তার দুই পা সমতল যমীনে পৌঁছে গেল। অতঃপর তিনি দৌঁড়ে চললেন, এমনকি সমতল যমীন পার হয়ে গেলেন। আবার যখন উচুঁতে উঠতে লাগলেন, তখন স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চললেন। শেষে মারওয়ায় পৌঁছে গেলেন এবং মারওয়ায় সেভাবেই দু‘আ করলেন, যেভাবে ছাফার উপর করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মারওয়ায় এসে ত্বাওয়াফ শেষ হলো।[8]
উক্ত হাদীছসমূহ দ্বারা বুঝা গেল, ছাফা হতে মারওয়ার দিকে যেতে হবে এবং বর্তমান সবুজ বাতির স্থানে দৌঁড়াবে। তবে মহিলারা দৌঁড়াবে না। মারওয়ার উপরে কা‘বামুখী হয়ে হাত তুলে ছাফার মতোই তাকবীর ও দু‘আ পাঠ করবে। তবে আয়াতটি শুধু ছাফায় পড়বে। ছাফা হতে মারওয়ায় পৌঁছলে এক চক্কর হয়। আবার মারওয়া হতে ছাফায় আসলে দুই চক্কর হয়। এভাবে মারওয়ায় সাত চক্কর শেষ হবে। ছাফা এবং মারওয়ায় যতবার উঠবে একই নিয়মে প্রতিবার তাকবীর বলবে এবং হাত তুলে দু‘আ করবে। ছাফা-মারওয়াতে সাঈর সময় নির্ধারিত কোনো দু‘আ নেই। নিজের ইচ্ছামতো কুরআন এবং ছহীহ হাদীছ হতে প্রমাণিত দু‘আ, তাসবীহ-তাহলীল ও যিকির করবে। কিছু না জানা থাকলে নিজের ভাষায় আল্লাহকে ডাকবে। তবে ছাহাবীগণ হতে নিম্নের দু‘আটি প্রমাণিত। আবূ ইসহাক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি ইবনু উমারকে ছাফা-মারওয়ার মাঝে বলতে শুনেছি, رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَارْحَمْ وَأَنْتَ أَوْ أَنَّكَ الْأَعَزُّ الْأَكْرَمُ অর্থ : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করো এবং আমার উপর দয়া করো। নিশ্চয় তুমি মহাসম্মানিত, মহান দানশীল’।[9]
সাঈ করা অবস্থায় যা নিষিদ্ধ :
(১) সাঈ করা অবস্থায় পুরুষদের ডান কাঁধ খোলা রাখা।
(২) প্রতি চক্করে বিশেষ দু‘আ পড়া।
(৩) সাঈ চলা অবস্থায় ছালাত শুরু হলে একাকী ছালাত আরম্ভ করা এবং জামাআতে শরীক না হওয়া।
(৪) সাঈ শেষে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করা।
(৫) ছাফা-মারওয়ায় পাথর ছোঁয়া এবং মুখে ও গায়ে মাখা।
(৬) নারীরা পুরুষদের সাথে সবুজ চিহ্নিত স্থানে দৌঁড়ানো।
(চলবে)
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২৬১; মিশকাত, হা/২৫৬৫।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৪; নাসাঈ, হা/২৯০।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/১৮৭২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৯৬১, হাদীছ ছহীহ।
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; মিশকাত, হা/২৫৫৫।
[5]. আলবানী, মানাসিকুল হজ্জ ওয়াল উমরা, পৃ. ২৫।
[6]. সুনাদে আহমাদ, হা/১৫২১০; নাসাঈ, হা/২৯৭২, হাদীছ ছহীহ।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৮০।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; মিশকাত, হা/২৫৫৫।
[9]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৯১৩৫ ।