اَلْكَعْبَةُ কা‘বা আরবী শব্দ ك-ع-ب ধাতুমূল থেকে উৎপত্তি, অর্থ- উঁচু হওয়া। কা‘বাগৃহ সমস্ত গৃহের তুলনায় স্থানগত ও মর্যাদাগত বিবেচনায় সুউচ্চ বলেই তাকে কা‘বা বলা হয়। কা‘বা সঊদী আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত। কা‘বা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র স্থান। দুনিয়ার সর্বপ্রথম ইবাদত গৃহ। মুসলিমদের কিবলা, পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে সেদিকে মুখ করে ছালাত আদায় করতে হয় (আল-বাক্বারা, ২/১৫০)। ছালাতের সময় বান্দার থাকে দুটি অভিমুখী সত্তা- একটি হলো আত্মা এবং অপরটি হলো দেহ। তার আত্মা অভিমুখী থাকে আল্লাহর প্রতি আর দেহ ও মুখমণ্ডল অভিমুখী হয় আল্লাহর এক বিশেষ নিদর্শন কা‘বাগৃহের প্রতি। যে গৃহের সম্মান করতে ও যার প্রতি অভিমুখী হতে বান্দা আদিষ্ট। এটি সারা বিশ্বের মুসলিম জাতির ঐক্য ও সংহতির বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম এবং সকল বিষয়ে একাত্মতা অবলম্বনের নিদর্শন। ত্বাওয়াফ করা কা‘বার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।*
জেনে রাখা প্রয়োজন যে, হিজায তথা মক্কা ও মদীনা অঞ্চল ১৩৪৪ হিজরী সনে সঊদী আরবের শাসনাধীন হয়। এর পূর্ব পর্যন্ত উক্ত অঞ্চল উছমানীয় শাসনের অধীনে ছিল।
কা‘বার নামসমূহ : আল-কা‘বাতুল মুশাররফা, আল-বায়তুল মুহাররম (ইবরাহীম, ১৪/৩৭)। আল-বায়তুল আতীক (আল-হজ্জ, ২২/৩৩), আল-বায়তুল হারাম (আল-মায়েদা, ৫/২, ৯৭)। আল-মাসজিদুল হারাম (আল-বাক্বারা, ২/১৪৪, ১৪৯, ১৯১; আল-মায়েদা, ৫/২; আল-আনফাল, ৮/৩৪; আত-তওবা, ৯/৭, ১৯, ২৮; আল-ইসরা, ১৭/১; আল-হজ্জ, ২২/২৫; আল-ফাতহ, ৪৮/২৫, ২৭)।
আল-মাসজিদুল হারামের অর্থ : আল-মাসজিদুল হারামের প্রয়োগিক অর্থ চারটি। যথা- (১) মাসজিদুল হারাম ঐ মাসজিদকে বলা হয়, যা বায়তুল্লাহর চতুষ্পার্শ্বে নির্মিত হয়েছে। (২) আল-কা‘বাতুল মুশাররাফা (আল-বাক্বারা, ২/১৪৪, ছফওয়াতুত তাফসীর)। (৩) মক্কা মুকারারামা (আল-ইসরা, ১৭/১)। (৪) আবার কোনো কোনো সময় ইহা দ্বারা মক্কার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এলাকাকেও বোঝানো হয় (আত-তওবা, ৯/২৮)।
মক্কার ভৌগোলিক অবস্থান : মক্কা পৃথিবীর মধ্যস্থিত। চারপাশে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় অবস্থিত মক্কা নগরী। পূর্ব আবূ কুবাইস পাহাড় এবং পশ্চিমে কু‘আয়কা‘আন পাহাড় নতুন চাঁদের মতো মক্কাকে বেষ্টন করে রেখেছে। সমুদ্রতল থেকে ২৭৭ মিটার (৯০৯ ফুট) ওপরে একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় শহরটি অবস্থিত, যা জেদ্দা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার (৪৩ মাইল) এবং মদীনা শহর থেকে দক্ষিণ দিকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী এখানে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করেন। বিশ্বের চতুর্থ উচ্চতম ভবন ‘মক্কা রয়েল ক্লক টাওয়ার’ এই শহরেই অবস্থিত। প্রতি বছর ১৫ মিলিয়ন মুসলিম মক্কা শহর ভ্রমণ করে। ফলে শহরটি সারা বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিশ্বজনীন শহরে পরিণত হয়েছে।
কা‘বাঘর নির্মাণের ইতিহাস : ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম কা‘বাগৃহ নির্মাণ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ ‘আর স্মরণ করুন, যখন আমরা ইবরাহীমের জন্য নির্ধারণ করে (দেখিয়ে) দিয়েছিলাম (কা‘বা) ঘরের স্থান (তৈরির জন্য) (আল-হজ্জ, ২২/২৬)। আল্লাহ অন্যত্রে বলেন,
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ - رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কা‘বাঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং তারা বলেছিলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের আপনার অনুগত করুন, আমাদের বংশে একদল মানুষ সৃষ্টি করুন, যারা আপনার আজ্ঞাবহ হয় আর আমাদের ইবাদতের নিয়ম-ক্বানূন শিক্ষা দিন এবং আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! এদের নিকট এদের মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি এদের আপনার আয়াতগুলো পড়ে শুনাবে এবং এদের কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেবে আর এদের বিশুদ্ধ করবে, নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (আল-বাক্বারা, ২/১২৭-১২৯)। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দু‘আ কবুল করেন এবং কুরাইশ বংশের মধ্য থেকে শেষ নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করেন।
কা‘বাগৃহের প্রথম নির্মাতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম: কা‘বাগৃহ সর্বপ্রথম কে নির্মাণ করেন এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কেউ বলেন, সর্বপ্রথম ফেরেশতাগণ কা‘বাগৃহ নির্মাণ করেন। কেউ বলেন, আদম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম কা‘বাগৃহ নির্মাণ করেন। তবে সবচেয়ে প্রামাণ্য ও সঠিক মত হলো, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম কা‘বাঘর নির্মাণ করেন। কারণ আবূ যার রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মাসজিদ কোনটি? তিনি উত্তরে বলেন, মাসজিদুল হারাম। আবার প্রশ্ন করেন, এরপর কোনটি? তিনি উত্তর দেন, মাসজিদে বায়তুল মুক্বাদ্দাস। আবার জিজ্ঞেস করেন, এই দুটি মাসজিদ নির্মাণের মধ্যে কত দিনের ব্যবধান ছিল? তিনি উত্তর দেন, ৪০ বছর।[1] এ হাদীছে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণের ব্যবধান বর্ণনা করা হয়েছে ।
কেননা বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের প্রথম নির্মাণও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর হাতে কা‘বাগৃহ নির্মাণের ৪০ বছর পর সম্পন্ন হয়। এরপর সুলায়মান আলাইহিস সালাম বায়তুল মুক্বাদ্দাস পুনঃনির্মাণ করেন। তাই আমরা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কেই কা‘বাগৃহের প্রথম নির্মাতা বলতে পারি।[2]
উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম ফেরেশতাগণ অতঃপর আদম আলাইহিস সালাম কা‘বাগৃহ নির্মাণ করেন মর্মে বর্ণিত সকল বর্ণনা দুর্বল।
কা‘বাগৃহ সংস্কারের ইতিহাস : প্রথম সংস্কার করেন জুরহাম গোত্রের লোকেরা। এরপর আমালেকা সম্প্রদায়। তারপর কুরাইশগণ। অতঃপর কুরাইশদের দ্বিতীয়বার নির্মাণ কাজে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অংশগ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৫ বছর। তিনিই ‘হাজারে আসওয়াদ’ তথা কা‘বাগৃহের কালো পাথর সকল গোত্রকে একসাথে নিয়ে স্থাপন করেছিলেন। তবে কুরাইশদের এ নির্মাণে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর ভিত্তির সামান্য পরিবর্তন ঘটে। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর যুগ থেকেই কা‘বাঘরের উচ্চতা ছিল নয় হাত। কা‘বাগৃহের চতুর্দিক দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত ছিল। তবে উপরে কোনো ছাদ ছিল না। ফলে কিছু চোর প্রবেশ করে এর মূল্যবান সম্পদগুলো চুরি করে নিয়ে যায়। অন্য দিকে বহু পুরাতন হওয়ায় প্রাচীরে ফাটল দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া সেই বছর মক্কা নগরীতে বন্যার কারণে কা‘বামুখী জলধারা সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে সংস্কারের একান্ত প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ওয়ালিদ ইবনু মুগীরা মাখযুমী সর্বপ্রথম ভাঙার কাজ আরম্ভ করেন, এরপর অন্যন্যরাও অংশগ্রহণ করেন।
কুরাইশদের সংস্কারের ফলে কা‘বাগৃহের কিছু পরিবর্তন : কুরাইশদের সংস্কারের ফলে কা‘বাগৃহের কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। যেমন- (ক) কা‘বার উত্তরের একটি অংশ ছয় হাত কমিয়ে কা‘বা থেকে আলাদা করা হয়, যাকে ‘হাতীম’ বলা হয়। এর কারণ হলো, তারা অর্থ সংকটের মধ্যে পড়েছিল। (খ) কুরাইশরা কা‘বাগৃহের শুধু একটা দরজা রাখে। (গ) কুরাইশরা দরজাটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় চার মিটার উঁচুতে নির্মাণ করে। এর কারণ হলো, যে কেউ ইচ্ছা করলেই যেন সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। বরং যাকে তারা অনুমতি দেবে, সেই কেবল প্রবেশ করতে পারবে। (ঘ) কা‘বাগৃহের ভেতর ছয়টি পিলার ও তার উপর ছাদ দেওয়া হয়। বর্তমান কা‘বাগৃহের উচ্চতা ১৫ মিটার। দক্ষিণ-উত্তর ১০ মিটার। পূর্ব-পশ্চিম ১২ মিটার। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর নির্মাণের সময় কা‘বাগৃহের দুটি দরজা ছিল, একটি প্রবেশের জন্য এবং অপরটি বাহির হওয়ার জন্য। তাই পরবর্তীতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রী আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে বলেছিলেন, ‘আমার ইচ্ছে হয় যে, কা‘বাঘরের বর্তমান নির্মাণ ভেঙে দিয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালামকর্তৃক নির্মীত ভিত্তির অনুরূপ করে দিই। কিন্তু অল্প জ্ঞানসম্পন্ন নব মুসলিমদের ভুল বুঝাবুঝির আশঙ্কার কথা বিবেচনা করে আগের অবস্থায় বহাল রাখছি’।[3]
আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কা‘বাগৃহ সংস্কার : খলীফার যুগ শেষ হওয়ার পর যখন মক্কার উপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইচ্ছানুযায়ী কা‘বাগৃহ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর অনুরূপ করার কাজে হাত দেন। ফলে তিনি কা‘বাগৃহের মাটির সাথে লাগিয়ে পূর্ব-পশ্চিম দুটি দরজা স্থাপন করেন। তবে মক্কার উপর তার কর্তৃত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
হাজ্জাজ ইবনু ইউসুফ-এর কা‘বাগৃহ সংস্কার : আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যুর পর হাজ্জাজ ইবনু ইউসুফ আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ানের নির্দেশে কা‘বাগৃহ পুনরায় ভেঙে কুরাইশরা যেভাবে নির্মাণ করেছিল, সেভাবেই নির্মাণ করেন। তার ক্ষমতার পর কোনো কোনো বাদশাহ হাদীছ অনুযায়ী কা‘বাগৃহ নির্মাণের ইচ্ছা করেন এবং তৎকালীন বড় মুফতী ইমাম মালেক ইবনু আনাস রাহিমাহুল্লাহ-এর কাছে এ বিষয়ে ফৎওয়া চান। তিনি ফৎওয়া প্রদান করেন যে, এভাবে কা‘বাঘরের ভাঙা-গড়া অব্যাহত থাকলে পরবর্তী শাসকদের জন্য এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং কা‘বাগৃহ খেলনার পাত্রে পরিণত হয়ে যাবে। কাজেই বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় থাকতে দেওয়া উচিত। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব তার এ ফৎওয়া গ্রহণ করেন। ফলে আজ পর্যন্ত হাজ্জাজ ইবনু ইউসুফের নির্মাণই বহাল রয়েছে। তবে কা‘বাগৃহের সংস্কার অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ১৪১৭ হিজরীতে বাদশাহ ফাহাদ ইবনু আব্দুল আযীয ব্যাপক সংস্কার করেন।
কা‘বার বাস্তব কাঠামো : কা‘বার চারটি কোণ কম্পাসের প্রায় চার বিন্দু বরাবর মুখ করা। কা‘বার দক্ষিণ কোণ হচ্ছে ‘রুকন আল-আসওয়াদ’ (কালো পাথর), এটি একটি জান্নাতী পাথর, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে কথা বলার শক্তি দিবেন, তখন সে কথা বলবে। উত্তর কোণ হলো ‘রুকন আল-ইরাকী’ ইরাকের দিকে তাই তাকে ইরাকী কোণ বলা হয়। পশ্চিমে রয়েছে ‘রুকন আশ-শামী’ ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ‘রুকন আল-ইয়ামানী’।
মাসজিদে হারামের বর্তমান কাঠামো : কা‘বার চারদিকে যে মাসজিদ দেখা যায়, তাকে মাসজিদে হারাম বলা হয়। উক্ত মাসজিদ ভেতরের ও বাইরের ছালাতের স্থান মিলে প্রায় ৩,৫৬,৮০০ বর্গমিটার (৮৮.২ একর) জুড়ে অবস্থিত। ধারণ ক্ষমতা : ৯,০০,০০০ লোক, হজ্জের সময় তা বেড়ে ৪০,০০,০০০ এ উন্নীত হয়। স্তম্ভ বা পিলার সংখ্যা : ৪৯৬টি। দরজা সংখ্যা : ১৯টি। মিনার সংখ্যা : ৯টি, যার উচ্চতা ৮৯ মিটার বা ২৯২ ফুট।[4]
কা‘বাগৃহের বৈশিষ্ট্যসমূহ : কা‘বাগৃহের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِينَ فِيهِ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَقَامُ إِبْرَاهِيمَ وَمَنْ دَخَلَهُ كَانَ آمِنًا وَلِلهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ‘নিশ্চয় মানবজাতির (ইবাদতের) জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ (কা‘বা) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায় (মক্কায়), বরকতময় ও সৃষ্টিজগতের দিশারী হিসাবে। তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, তার মধ্যে একটি মাক্বামে ইবরাহীম। আর যে কেউ তাতে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ। আর মানুষের মধ্যে যার সেথায় যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্জ করা তার জন্য ফরয’ (আলে-ইমরান, ৩/৯৬-৯৭)। কা‘বাগৃহের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো-
(১) এই গৃহ বিশ্ববাসীর সর্বপ্রথম ইবাদত গৃহ।[5] (২) এই গৃহ বরকত ও কল্যাণের প্রাণকেন্দ্র (আল-বাক্বারা, ২/১৯৮)।[6] (৩) এই গৃহ বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক (আল-বাক্বারা, ২/১৪৪)। (৪) তাতে মাক্বামে ইবরাহীম রয়েছে।[7] (৫) যে ব্যক্তি তাতে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ ও বিপদমুক্ত হয়ে যায়, তাকে হত্যা করা বৈধ নয়।[8] (৬) সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য এ গৃহে হজ্জ করা ফরয করা হয়েছে, যদি এ গৃহ পর্যন্ত পৌঁছার কারো শক্তি ও সামর্থ্য থাকে।[9]
আল-হাজারুল আসওয়াদ বা কালো পাথর : কা‘বাঘর নিমার্ণের সময় ইসমাঈল আলাইহিস সালাম পাথরের সন্ধানে নিকটবর্তী একটি উপত্যকায় গেলে জিবরীল আলাইহিস সালাম একটি পাথর নিয়ে অবতরণ করেন। যমীন পানিতে ডুবে গেলে পাথরটি আসমানে উঠে যেত। পাথর দেখে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম বললেন, এটি কোথা থেকে আসল এবং কে একে নিয়ে আসল? তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন, যিনি আমাকে তোমার দিকে ও তোমার পাথরের দিকে ন্যস্ত করেননি, তার তরফ থেকে এসেছে।[10]
কালো পাথরটি দৈর্ঘে ২৫ ও প্রস্থে ১৭ সেন্টিমিটার, যা কা‘বার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ তথা ত্বাওয়াফের স্থান থেকে দেড় মিটার বা চারফুট উঁচুতে অবস্থিত।
(১) কালো পাথরটি জান্নাত থেকে এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, نَزَلَ الحَجَرُ الأَسْوَدُ مِنَ الجَنَّةِ، وَهُوَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ فَسَوَّدَتْهُ خَطَايَا بَنِي آدَمَ ‘হাজরে আসওয়াদ যখন জান্নাত হতে অবতীর্ণ হয়, তখন এটি দুধের চেয়ে অধিক সাদা ছিল। পরে আদম সন্তানদের পাপরাশি তাকে কালো করে দেয়’।[11]
(২) ইবনু আব্বাস বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালো পাথর সম্পর্কে বলেছেন, وَاللهِ لَيَبْعَثَنَّهُ اللهُ يَوْمَ القِيَامَةِ لَهُ عَيْنَانِ يُبْصِرُ بِهِمَا، وَلِسَانٌ يَنْطِقُ بِهِ، يَشْهَدُ عَلَى مَنْ اسْتَلَمَهُ بِحَقٍّ ‘আল্লাহর শপথ! কিয়ামতের দিন আল্লাহ এটিকে উঠাবেন, তখন এটির দুটি চক্ষু হবে, যার দ্বারা সে দেখবে, এটির একটি জিহ্বা হবে, যার দ্বারা সে কথা বলবে এবং যে তাকে ঈমানের সহিত চুম্বন করেছে, তার জন্য সাক্ষ্য দেবে’।[12]
(৩) কালো পাথরকে চুম্বন করা এবং রুকনে ইয়ামানীকে স্পর্শ করার কথা হাদীছে এসেছে। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, إِنَّ مَسْحَهُمَا كَفَّارَةٌ لِلْخَطَايَا ‘কালো পাথর ও রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা গোনাহের কাফফরাস্বরূপ’।[13]
(৪) আবিস ইবনু রবী‘আ বলেন, আমি উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে কালো পাথর চুমু দিতে দেখেছি এবং এই কথা বলতে শুনেছি, إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ، لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ، وَلَوْلاَ أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ ‘আমি নিশ্চিতরূপে জানি, তুমি একটি পাথর। তুমি কারও উপকার বা অপকার করতে পারো না। যদি আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তোমাকে চুমা দিতে না দেখতাম তবে আমি কখনো তোমাকে চুমা দিতাম না’।[14] এতে বুঝা গেল যে, মানুষের কোনো ভালো-মন্দ পৌঁছানোর শক্তি পাথরের নেই।
আরও জানা গেল যে, পাথরকে চুম্বন করা সুন্নাত মাত্র।
মাহবূবুর রহমান মাদানী
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৫২০।
[2]. তাফসীর যাকারিয়া, সূরা আলে ইমরান, ৩/৯৬-এর আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৮৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৩৩।
[4]. তারিখু মাক্কা ওয়াল মাদীনা, পৃ. ১৫৫।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৫২০।
[6]. ইবনু মাজাহ, হা/১৪০৬।
[7]. তাফসীর সা‘দী, সূরা আলে ইমরান, ৩/৯৬-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৪৯।
[9]. তাফসীর ইবনু কাসীর, তাফসীর যাকারিয়া, সূরা আল-হজ্জ, ২২/২৭-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য; ফাতহুল বারী, ৬/৪০৯।
[10]. ফাতহুল বারী, ৬/৪০৬।
[11]. তিরমিযী, হা/৮৭৭, হাদীছ ছহীহ।
[12]. তিরমিযী, হা/৯৬১, হাসান; ফাতহুল বারী, ৩/৫৬৩, ‘হজ্জ’ অধ্যায়।
[13]. তিরমিযী, হা/ ৬৫৯, হাদীছ ছহীহ।
[14]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৮।