মুমিনের সকল কাজ হতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেখানো পদ্ধতিতে। খাদ্য গ্রহণ করা সকল প্রাণির জন্য অত্যাবশ্যক। আমাদের জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই খাদ্য। ইসলামে খাদ্য গ্রহণ করার একটি পুরোপুরি ধারণা পাওয়া যায়। অতএব, একজন মুমিনকে অবশ্যই ইসলামের দেখানো পথ অনুযায়ী আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত এই খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। সুপ্রিয় পাঠক! বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা খাদ্য গ্রহণের ইসলামী নীতিমালা সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করব ইনশা-আল্লাহ।
(১) আল্লাহর নাম নিয়ে খাবার খাওয়া: আমাদেরকে সবসময় আল্লাহর নাম নিয়ে (বিসমিল্লাহ বলে) খাবার গ্রহণ করতে হবে। কারণ যে খাবারে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় না, তাতে শয়তান অংশগ্রহণ করে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ الشَّيْطَانَ يَسْتَحِلُّ الطَّعَامَ أَنْ لاَ يُذْكَرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ ‘শয়তান সে খাদ্যকে নিজের জন্য হালাল করে নেয়, যে খাদ্যে বিসমিল্লাহ বলা হয় না’।[1]
শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে যখনই মনে পড়বে তখনই পড়তে হবে, ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহূ ওয়া আখিরাহূ’। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোনো খাবার খাবে, তখন সে যেন ‘বিসমিল্লাহ’ বলে। প্রথমে কেউ তা বলতে ভুলে গেলে সে যেন (মনে পড়লে) বলে,بِسْمِ اللَّهِ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহূ ওয়া আখেরাহূ’।[2]
(২) ডান হাতে খাদ্য গ্রহণ করা: আমাদেরকে ডান হাতে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। কারণ বাম হাতে শয়তান খাবার গ্রহণ করে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ يَأْكُلَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ بِشِمَالِهِ وَلاَ يَشْرَبَنَّ بِهَا فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَأْكُلُ بِشِمَالِهِ وَيَشْرَبُ بِهَا ‘অবশ্যই তোমাদের কেউ যেন বাম হাতে পানাহার না করে। কারণ শয়তান বাম হাতে পানাহার করে’।[3]
(৩) নিজের কাছের দিক থেকে খাদ্য গ্রহণ করা: খাবারের প্লেট সামনে নেওয়ার পর কোলের দিক থেকে তথা নিজের কাছের দিক থেকে খাদ্য গ্রহণ করা ইসলামের সৌন্দর্য। উমার ইবনু আবী সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় আমি একজন ছোট বালক ছিলাম। সেসময় খাদ্য গ্রহণের সময় আমার হাত খাদ্যের পাত্রের এদিক-সেদিক যেত। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন, ‘হে বৎস! তুমি আল্লাহর নামে খাও, ডান হাতে খাও এবং তোমার নিকট থেকে খাবার গ্রহণ করো’।[4]
(৪) মাঝখান থেকে না খাওয়া: থালার মাঝখান থেকে খাদ্য গ্রহণ না করার ব্যাপারে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ আছে। কারণ খাবারের মধ্যখানে বরকত নাযিল হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,البَرَكَةُ تَنْزِلُ وَسَطَ الطعَامِ فَكُلُوا مِنْ حَافَتَيْهِ وَلاَ تَأكُلُوا مِنْ وَسَطِهِ ‘খাদ্যের মধ্যস্থলে বরকত নাযিল হয়। সুতরাং তোমরা পার্শ্ব থেকে খাবে; মধ্যস্থল থেকে খাবে না’।[5]
(৫) তিন আঙুলের সাহায্যে খাওয়া: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশিরভাগ সময় রুটি খেতেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন আঙুলে (বৃদ্ধাঙুল, তর্জনী ও মধ্যমা) খেতেন। ইবনু কা‘ব ইবনে মালেক তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন আঙুল দ্বারা খেতেন।[6]
(৬) পড়ে যাওয়া লোকমা বা খাবার তুলে খাওয়া: পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খাওয়া সুন্নাত। এতে দোষের কিছু নেই। বরং তা মুছে বা পরিষ্কার করে খেতে হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ الشَّيْطَانَ يَحْضُرُ أَحَدَكُمْ عِنْدَ كُلِّ شَىْءٍ مِنْ شَأْنِهِ حَتَّى يَحْضُرَهُ عِنْدَ طَعَامِهِ فَإِذَا سَقَطَتْ مِنْ أَحَدِكُمُ اللُّقْمَةُ فَلْيُمِطْ مَا كَانَ بِهَا مِنْ أَذًى ثُمَّ لْيَأْكُلْهَا وَلاَ يَدَعْهَا لِلشَّيْطَانِ فَإِذَا فَرَغَ فَلْيَلْعَقْ أَصَابِعَهُ فَإِنَّهُ لاَ يَدْرِى فِى أَىِّ طَعَامِهِ تَكُونُ الْبَرَكَةُ ‘শয়তান তোমাদের প্রতিটি কাজের সময় তোমাদের পাশে উপস্থিত হয়, এমনকি তার খাবার খাওয়ার সময়ও তার পাশে উপস্থিত হয়। সুতরাং যদি তোমাদের কারো লোকমা মাটিতে পড়ে যায়, সে যেন তাতে লেগে যাওয়া ময়লা অপসারণ করে তা খেয়ে নেয় এবং এটা শয়তানের জন্য যেন ফেলে না রাখে। অতঃপর যখন খাবার গ্রহণ শেষ করবে, তখন সে যেন তার আঙুলগুলো চেটে খায়। কেননা সে জানে না, তার খাদ্যের কোন অংশে বরকত আছে’।[7]
অনুরূপভাবে যদি পানীয়তে মাছি পড়ে যায়, তাহলে সেটিকে সরাসরি না তুলে পূর্ণরূপে তাতে ডুবিয়ে, অতঃপর তা তুলে ফেলে পান করা কর্তব্য। কেননা তার এক পাখায় আছে রোগজীবাণু আর অন্য পাখায় আছে তার প্রতিষেধক। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا وَقَعَ الذُّبَابُ فِى إِنَاءِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْمِسْهُ كُلَّهُ ثُمَّ لْيَطْرَحْهُ فَإِنَّ فِى أَحَدِ جَنَاحَيْهِ شِفَاءً وَفِى الآخَرِ دَاءً ‘যখন তোমাদের কারো পানীয় দ্রব্যে মাছি পড়ে যায়, তখন তাকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেবে। তারপর সেটা ফেলে দিবে। কারণ তার দুটি ডানার মধ্যে একটিতে রোগজীবাণু আছে আর অপরটিতে আছে রোগমুক্তি’।[8] (পানীয় বস্তুতে পড়ে যাওয়া অবস্থায়) মাছি যে ডানাতে রোগজীবাণু আছে সেটিকে ডুবিয়ে দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। অতএব, তা সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেওয়ার পর নিক্ষেপ করা উচিত।
(৭) খাদ্য ও পানীয়তে ফুঁ না দেওয়া: খাবার ও পানীয়তে ফুঁ দেওয়া যাবে না। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য নাক ও মুখ দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। নিঃশ্বাসে থাকে দেহের দূষিত বাষ্প ও রোগজীবাণুবাহী অপেক্ষাকৃত ভারী বায়বীয় পদার্থ কার্বন ডাই-অক্সাইড, যা খাবার কিংবা পানির সঙ্গে মিশে আবার মানুষের দেহের ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে শরীরে বিভিন্ন রোগজীবাণুর আস্তানা গড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِذَا شَرِبَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَتَنَفَّسْ فِي الإِنَاء ‘তোমাদের কেউ যখন কিছু পান করে, তখন সে যেন পানপাত্রে নিঃশ্বাস না ছাড়ে অথবা ফুঁ না দেয়’।[9]
(৮) হেলান দিয়ে না খাওয়া:হেলান দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করা অহংকারের লক্ষণ। সেজন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলান দিয়ে খাবার গ্রহণ করা পছন্দ করতেন না। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ آكُلُ مُتَّكِئًا ‘আমি হেলান দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করি না’।[10] তাই হেলান দিয়ে খাবার খাওয়া বর্জন করা কর্তব্য।
(৯) উপুড় হয়ে খাওয়া যাবে না: উপুড় হয়ে বা পেটের উপর ভর করে খানাপিনা করাও নিষিদ্ধ। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন কোনো ব্যক্তি যেন উপুড় হয়ে না খায়।[11]
(১০) জগ বা কলসীর মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান না করা: জগ বা কলসীর মুখে সরাসরি মুখ লাগিয়ে পানি পান করা যাবে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন করে পান করতে নিষেধ করেছেন।[12] এতে করে অন্যের সেই জগ বা কলসী থেকে পানি পান করতে রুচিতে বাধতে পারে অথবা ভিতরের কোনো ময়লা বা পোকামাকড় সরাসরি সে খেয়ে ফেলতে পারে।
(১১) তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা: পানি তিন নিঃশ্বাসে পান করতে হবে, এক নিঃশ্বাসে তাড়াহুড়া করে পান করা যাবে না। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করতেন এবং বলতেন, إِنَّهُ أَرْوَى وَأَبْرَأُ وَأَمْرَأُ ‘নিশ্চয়ই এটি অধিক তৃপ্তিদায়ক, স্বাস্থকর ও উপকারী’।[13]
(১২) খাবার শেষে আঙুল ও প্লেট চেঁটে খাওয়া: খাবার শেষে আঙুল ও প্লেট চেটে খেতে হবে। কোনো কিছু অবশিষ্ট রাখা যাবে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ فَلْيَلْعَقْ أَصَابِعَهُ فَإِنَّهُ لاَ يَدْرِى فِى أَيَّتِهِنَّ الْبَرَكَةُ ‘যখন তোমাদের কেউ খাবার খাবে, তখন সে যেন তার আঙুল চেঁটে খায়। কেননা তোমরা জানো না যে, কোন খাবারে বরকত আছে’।[14] খাওয়ার শেষে আঙুল চেঁটে খাওয়ার গুরুত্ব বিজ্ঞানও স্বীকার করেছে। কারণ আঙুলের মাথা হতে এক প্রকার পদার্থ নির্গত হয়, যা খাদ্য হজম হওয়াতে সাহায্য করে। আর এজন্যই তরকারিতে আঙুল ডুবালে তরকারি খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
(১৩) দাঁড়িয়ে খাবার ও পানীয় গ্রহণ না করা: দাঁড়িয়ে পানাহার করা যাবে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে পানাহার করতে নিষেধ করেছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لاَ يَشْرَبَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ قَائِمًا فَمَنْ نَسِىَ فَلْيَسْتَقِئْ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। কেউ ভুলে গিয়ে পান করে থাকলে, সে যেন তা বমি করে ফেলে’।[15] কিন্তু কোনো অসুবিধা বা প্রয়োজনে অথবা বসার মতো উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে দাঁড়িয়ে পানাহার করা যায়।[16]
(১৪) পেট পূর্ণ করে না খাওয়া: একজন মুমিনের ভরপেট খাওয়া উচিত নয়। বরং পেটের কিছু অংশ ফাঁকা রেখে তার খাওয়া উচিত এবং পরিমাণে কম খাওয়া উচিত। যতটুকু খাবার তার না খেলেই নয়, ততটুকুই শুধু খাবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মানুষ পেট থেকে বেশি নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলির এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে’।[17]
(১৫) খাবারের সমালোচনা না করা: খাবারের দোষ ধরা যাবে না, এটা সুন্নাতের খেলাফ। মানুষ বুঝতে চায় না, যে বা যারা খাবার প্রস্তুত করেছে, সে কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে তা খারাপ করেনি; বরং মনের অজান্তেই তা হয়ে যায়। তাই খাবারের সমালোচনা করা যাবে না, তা খারাপ হলেও। যতটুকু রুচি হবে ততটুকু খেতে হবে, বাকিটা রেখে দিতে হবে। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোনো খাদ্যের দোষ প্রকাশ করেননি। রুচি হলে তিনি খেতেন আর অপছন্দ হলে তা পরিত্যাগ করতেন।[18] অর্থাৎ তিনি মন্দ বলতেন না। রুচি হলে খেতেন, না হলে বাদ দিতেন।
(১৬) শুকরিয়া আদায় করা: খাবার শেষ হলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। কারণ খাবারের প্রতিটি দানাই আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামতস্বরূপ। সেই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ اللَّهَ لَيَرْضَى عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَأْكُلَ الأَكْلَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا أَوْ يَشْرَبَ الشَّرْبَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا ‘আল্লাহ তাঁর সেই বান্দার উপর সন্তুষ্ট হন, যে এক গ্রাস খাদ্য খেয়ে তার প্রশংসা করে অথবা এক ঢোক পানি পান করে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে’।[19]
(১৭) একসাথে বসে খাওয়া সুন্নাত: বড় প্লেটে একসঙ্গে খাওয়া সুন্নাত। আরব দেশে এখনো বড় প্লেটে খাবার গ্রহণের সংস্কৃতি আছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ أَحَبَّ الطَّعَامِ إِلَى الله مَا كَثُرَتْ عَلَيْهِ الأَيْدِي ‘আল্লাহর কাছে প্রিয় খাদ্য হলো যাতে অনেক হাত অংশগ্রহণ করে’।[20] অর্থাৎ যে খাদ্য অনেকে একসঙ্গে খায়। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,طَعَامُ الْوَاحِدِ يَكْفِى الاِثْنَيْنِ وَطَعَامُ الاِثْنَيْنِ يَكْفِى الأَرْبَعَةَ وَطَعَامُ الأَرْبَعَةِ يَكْفِى الثَّمَانِيَةَ ‘একজনের খাবার দুইজনের জন্য, দুইজনের খাবার চার জনের জন্য এবং চার জনের খাবার আট জনের জন্য যথেষ্ট’।[21]
তবে পৃথকভাবে একাকী খাওয়াও বৈধ। এতে কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَأْكُلُوا جَمِيعًا أَوْ أَشْتَاتًا ‘তোমরা একত্রে আহার করো অথবা পৃথক পৃথকভাবে আহার করো, তাতে তোমাদের জন্য কোনো অপরাধ নেই’ (আন-নূর, ২৪/৬১)।
(১৮) স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্রে পানাহার করা যাবে না: স্বর্ণ-রূপার পাত্রে পানাহার করা নিষেধ। তা কাফেরদের পাত্র আর তাতে অহংকার প্রকাশ পায়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لَا تَشْرَبُوْا فِيْ آنِيَةِ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَلَا تَلْبَسُوا الْحَرِيْرَ وَالدِّيبَاجَ فَإِنَّهَا لَهُمْ فِي الدُّنْيَا وَلَكُمْ فِي الْآخِرَةِ ‘তোমরা সোনা ও রূপার পাত্রে পানাহার করবে না আর তোমরা রেশমী পোশাক পরিধান করবে না। কারণ তা দুনিয়াতে কাফেরদের জন্য এবং আখেরাতে তোমাদের জন্য’।[22] তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি রূপার পাত্রে পানাহার করে, সে ব্যক্তি নিজ পেটে জাহান্নামের আগুন ঢকঢক করে পূর্ণ করে’।[23]
(১৯) খাবার পরিবেশনকারীর সবার শেষে খাবে: যে ব্যক্তি খাবার পরিবেশন করবে, সে সবার শেষে খাবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ নিজে করেছেন এবং বলেছেন, ‘যে লোকদেরকে পানি পান করায়, সে সবার শেষে পান করবে’।[24]
(২০) খাদ্য প্রস্তুতকারীকে খাবারে শরীক করা: যে ব্যক্তি খাদ্য প্রস্তুত করে বা খাবার পরিবেশন করে, তার মনের মধ্যে খাদ্যের প্রতি আসক্তি তৈরি হতে পারে, সেজন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও খাবারে শরীক করতে বলেছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إِذَا أَتَى أَحَدَكُمْ خَادِمُهُ بِطَعَامِهِ ، فَإِنْ لَمْ يُجْلِسْهُ مَعَهُ فَلْيُنَاوِلْهُ لُقْمَةً أَوْ لُقْمَتَيْنِ أَوْ أُكْلَةً أَوْ أُكْلَتَيْنِ فَإِنَّهُ وَلِىَ عِلاَجَهُ ‘যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তির খাদেম তার নিকট খাবার নিয়ে আসে, তখন যদি তাকে নিজের সঙ্গে (খেতে) না বসায়, তাহলে সে যেন তাকে (কমপক্ষে তার হাতে) এক লোকমা বা দুই লোকমা অথবা এক গ্রাস বা দুই গ্রাস (ঐ খাবার থেকে) তুলে দেয়। কেননা সে (খাদেম) তা রান্না (করার যাবতীয় কষ্ট বরণ) করেছে’।[25]
(২১) দস্তরখানা, পাটি বা মাদুর বিছিয়ে আহার করা: চেয়ার-টেবিলে না বসে দস্তরখানা, পাটি বা মাদুর বিছিয়ে আহার করা সুন্নাত। ক্বাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে জানি না যে, তিনি কখনো ছোট ছোট পেয়ালাতে খাবার খেয়েছেন, তাঁর জন্য কখনো পাতলা রুটিও তৈরি করা হয়নি এবং তিনি টেবিলের উপরও খাবার খাননি’। ক্বাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করা হলো, তবে তারা কীভাবে খেতেন? তিনি বললেন, সাধারণ দস্তরখানা বিছিয়ে আহার করতেন।[26] তবে চেয়ার-টেবিলে বসে আহার করা নিষিদ্ধ নয়।
(২২) দস্তরখানা উঠানোর সময় দু‘আ পড়া:পানাহার শেষে প্লেট বা দস্তরখানা উঠানোর সময় দু‘আ পড়তে হবে। তখন বলতে হবে,الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ غَيْرَ مَكْفِىٍّ وَلاَ مُوَدَّعٍ وَلاَ مُسْتَغْنًى عَنْهُ رَبَّنَا ‘আল্লাহ তাআলার প্রশংসা, বহু প্রশংসা, পবিত্র প্রশংসা, রবকতময় প্রশংসা। হে আমাদের রব! তোমার নেয়ামত হতে মুখ ফিরানো যায় না, তার অন্বেষণ ত্যাগ করা যায় না এবং তার প্রয়োজন হতে মুক্ত থাকা যায় না’।[27]
(২৩) দাওয়াতে গেলে মেজবানের জন্য দু‘আ করা: কারো বাসায় দাওয়াতে গেলে মেজবানের জন্য দু‘আ করতে হবে। মেজবানের জন্য দু‘আ,اللهُمَّ أَطْعِمْ مَنْ أَطْعَمَنِي وَأَسْقِ مَنْ أَسْقَانِي ‘হে আল্লাহ! যে আমাকে খাওয়ায়েছে, তাকে তুমি খাওয়াও। আর যে আমাকে পান করিয়েছে, তাকে তুমি পান করাও’।[28]
উপরিউক্ত আলোচনায় আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খানা খাওয়ার তরীকা সম্পর্কে অবগত হলাম। খাওয়া-দাওয়া মানুষের জীবন ধারণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যেন নববী তরীকায় খাবার গ্রহণ করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-আমিন
সহকারী শিক্ষক (ধর্ম), মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়, তানোর, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০১৭।
[2]. আবূ দাঊদ, হা/৩৭৬৭, হাদীছ ছহীহ।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০২০।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৭৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২০২২।
[5]. তিরমিযী, হা/১৮০৫, হাদীছ ছহীহ।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৩২।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৩৩।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৮২।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৩০।
[10]. আবূ দাঊদ, হা/৩৭৬৯, হাদীছ ছহীহ।
[11]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৩৭০, হাসান।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬২৯।
[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০২৮।
[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৩৫।
[15]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০২৬।
[16]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০২৭।
[17]. তিরমিযী, হা/২৩৮০, হাদীছ ছহীহ।
[18]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৬৪।
[19]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৩৪।
[20]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২১৩৩।
[21]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৪৮৯।
[22]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৩৩।
[23]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৩৪।
[24]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৮১।
[25]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৫৭।
[26]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪১৫।
[27]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪৫৮।
[28]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৫৫।