সমস্ত প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নেতা আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি। ‘অতঃপর নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম পথ হচ্ছে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ। আর সর্বনিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে যা দ্বীনের ভেতর নতুন সৃষ্টি করা হয় এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদআত বা গোমরাহী’।[1]
ফেতনা শব্দের অর্থ : ‘ফেতনা’ আরবী শব্দ। এর অর্থ: বিপদ, বিপর্যয়, পরীক্ষা ইত্যাদি। এখানে ব্যক্তির দ্বীনদারীর পরীক্ষাই উদ্দেশ্য।
পরীক্ষা ব্যতীত কোনো ব্যক্তির মর্যাদার দ্বার উন্মোচন হয় না। মহান আল্লাহ বলেন,﴿أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ - وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ - أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ أَنْ يَسْبِقُونَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ﴾ ‘মানুষেরা কি মনে করে যে, “আমরা ঈমান এনেছি” বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হবে, অথচ তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? তাদের পূর্বে যারা ছিল আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম; অতঃপর আল্লাহ অবশ্যই অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যেবাদী। যারা মন্দ কাজ করে তারা কি ভেবে নিয়েছে যে, তারা আমার আগে বেড়ে যাবে? তাদের ফয়সালা বড়ই খারাপ’ (আল-আনকাবূত, ২৯/২-৪)। দিন দিন ফেতনা বাড়বে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,يَتَقَارَبُ الزَّمَانُ وَيُقْبَضُ الْعِلْمُ وَتَظْهَرُ الْفِتَنُ وَيُلْقَى الشُّحُّ وَيَكْثُرُ الْهَرْجُ قَالُوا وَمَا الْهَرْجُ قَالَ الْقَتْلُ ‘সময় নিকটতর হতে থাকবে, আর আমল কমে যেতে থাকবে, ফেতনা প্রকাশ পাবে, কৃপণতা ছড়িয়ে দেওয়া হবে এবং ‘হারজ’ ব্যাপকতর হবে’। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হারজ কী?’ নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হত্যা’।[2]
দ্বীনের মধ্যে মতভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করার কোনোই অনুমতি নেই : আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ﴾ ‘দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’ (আশ-শূরা, ৪২/১৩)। আর ঐক্যের মূল ভিত্তি হলো— ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’ সরল পথ। আর তা হলো একটিই পথ। একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত দিয়ে একটি লম্বা রেখা টানলেন এবং বললেন, এটা হলো আল্লাহর সরল পথ। তার ডানে ও বামে আরও কিছু রেখা টানলেন এবং বললেন, এগুলো হলো অন্য কিছু পথ, যার প্রত্যেকটির মাথায় শয়তান বসে আছে এবং সে এপথগুলোর দিকে মানুষকে আহ্বান করে। তারপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াত পাঠ করলেন,وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ‘আর নিশ্চয়ই এই পথই আমার সরল পথ; এই পথই তোমরা অনুসরণ করে চলবে। এই পথ ছাড়া অন্য কোনো পথের অনুসরণ করবে না, তাহলে তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরিয়ে নিবে’।[3]
প্রকৃত আহলুল কুরআন বা কুরআনের ধারক কারা?
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,يَا أَهْلَ اْلقُرْآنِ أَوْتِروُا فَإِنَّ اللهَ وِتْرٌ يُحبُّ اْلوِتْرَ ‘হে কুরআনের ধারকেরা বিতর পড়ো! কেননা আল্লাহ বেজোড়, তিনি বেজোড়কে ভালোবাসেন’।[4] এখানে আহলুল কুরআন দ্বারা উদ্দেশ্য, ক্বারী ও হাফেযগণ। যারা কুরআনকে জীবনের ও চরিত্র গঠনের সিলেবাস বানিয়েছে এবং সম্মান ও প্রশান্তির উৎস করেছে, তারাই কুরআনের ধারক। এরাই তারা, যারা কুরআন তেলাওয়াতে, মুখস্থতে, চিন্তা-গবেষণাতে এবং আনুগত্যে ও আমলে কুরআনের হক্ব আদায় করেছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ للهِ أَهْلِينَ مِنَ النَّاسِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ هُمْ قَالَ هُمْ أَهْلُ الْقُرْآنِ أَهْلُ اللهِ وَخَاصَّتُهُ ‘মানুষের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ ব্যক্তিবর্গ বা অনুসারী রয়েছে’। ছাহাবীগণ বললেন, ‘তারা কারা, হে আল্লাহর রাসূল?’ তখন তিনি বললেন, ‘তারা হলো কুরআনের ধারক, আল্লাহর অনুসারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠ লোক’।[5]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,يَأْتِى الْقُرْآنُ وَأَهْلُهُ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ بِهِ فِى الدُّنْيَا تَقْدُمُهُ سُورَةُ الْبَقَرَةِ وَآلُ عِمْرَانَ ‘ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত করা হবে কুরআন ও তার পাঠকদের, যারা কুরআনের আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী আমল করেছে। তাদের সামনে থাকবে সূরা আল-বাক্বারা ও আলে ইমরান’।[6] এই হাদীছ প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি কুরআন অনুযায়ী আমল করবে না, সে কুরআনের ধারক নয়। আর কুরআন তাদের জন্য সুপারিশকারী হবে না; বরং কুরআন তাদের বিপক্ষে দলীল হবে।
‘আহলে কুরআন’ হওয়ার মিথ্যাদাবিদার হলো ‘হাদীছ অস্বীকারকারীরা’: যাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাড়ে ১৪০০ বছর পূর্বে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,أَلاَ يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ عَلَيْكُمْ بِهَذَا الْقُرْآنِ فَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَلاَلٍ فَأَحِلُّوهُ وَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ ‘জেনে রেখো! অচিরেই এমন পরিতৃপ্ত লোক পাওয়া যাবে, যে বালিশে হেলান দিয়ে বসে বলবে, তোমরা এই কুরআন আঁকড়ে ধরো! এর মধ্যে যা হালাল হিসেবে পাবে, তা হালাল গণ্য করবে। আর যা হারাম হিসেবে পাবে, তা হারাম গণ্য করবে’।[7] অনুরূপ আরেকটি হাদীছ আবূ রাফে‘ রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কাউকে যেন এরূপ না দেখি যে, সে তার গদিতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে, আর তার নিকট আমার আদেশাবলির কোনো একটি আদেশ পৌঁছবে যাতে আমি কোন বিষয় আদেশ করেছি অথবা কোন বিষয় নিষেধ করেছি’। তখন সে বলবে, আমি এসব কিছু জানি না; আল্লাহর কিতাবে যা পাব তারই অনুসরণ করব। অথচ আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারাম করেন, যেমন আল্লাহ হারাম করেন।[8]
উক্ত হাদীছদ্বয়ে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল পরিত্যাগ করাকে নিন্দা করা হয়েছে। ইমাম খাত্ত্বাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, এই হাদীছ দ্বারা সতর্ক করা হয়েছে ঐ সমস্ত সুন্নাহর বিরোধিতা করাকে, যা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবর্তন বা চালু করে গেছেন এবং যার উল্লেখ কুরআনে নেই। অথচ কুরআনের ন্যায় হাদীছও অহী। উক্ত হাদীছ থেকে আরও বুঝা গেল যে, কিছু লোক থাকবে যারা হাদীছকে অস্বীকার করবে।
কুরআনকে হাদীছও বলা হয় : আল্লাহ তাআলা কুরআনকেও হাদীছ বলেছেন। অপরপক্ষে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, কর্ম ও সমর্থনকেও হাদীছ বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ﴿اللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ﴾ ‘আল্লাহ উত্তম হাদীছ অবতীর্ণ করেছেন’ (আয-যুমার, ৩৯/২৩)। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,فَذَرْنِي وَمَنْ يُكَذِّبُ بِهَذَا الْحَدِيثِ سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ - وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ﴾ ‘কাজেই যারা আমাকে এবং এই বাণীকে প্রত্যাখ্যান বা অস্বীকার করে তাদেরকে ছেড়ে দাও; আমি তাদেরকে এমনভাবে ক্রমে ক্রমে ধরব যে, তারা জানতে পারবে না। আমি তাদেরকে সময় দিই; আমার কৌশল বড়ই শক্তিশালী’ (আল-ক্বলাম, ৬৮/৪৪)।
হাদীছ ও সুন্নাহ অর্থ : হাদীছের আভিধানিক অর্থ- নতুন, যা পুরাতনের বিপরীত। আভিধানিক অর্থ- সংবাদ, উপদেশ, স্বপ্ন, কাহিনী ও সব ধরনের কথা বা বাণীকে হাদীছ বলে।
পারিভাষিক অর্থ : হাদীছ হলো, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে সম্বন্ধিত কথা, কর্ম, অনুমোদন এবং সৃষ্টিগত বা চারিত্রিক গুণ চাই তা নবুঅতের পূর্ববর্তী হোক কিংবা পরবর্তী।
সুন্নাহ অর্থ : সুন্নাহ-এর আভিধানিক অর্থ- পথ, পদ্ধতি, রীতি, নিয়ম, স্বভাব। আবার সুন্নাহকে হাদীছও বলা হয়। ইমাম শাওকানী রহিমাহুল্লাহ সুন্নাহর সংজ্ঞায় বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, কাজ ও সমর্থনকে সুন্নাহ বলা হয়।
কুরআন ও হাদীছের মধ্যে পার্থক্য : কুরআন ও হাদীছের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও উৎসগত দিক থেকে উভয়ই এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ উভয়ই অহী। কুরআন প্রত্যক্ষ অহী আর হাদীছ পরোক্ষ অহী। কুরআন ‘অহীয়ে মাতলূ’ তথা পঠিত অহী, যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে অবতীর্ণ হয়েছে। এর ভাষা ও অর্থ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। পক্ষান্তরে, হাদীছ হলো ‘অহীয়ে গায়রে মাতলূ’ তথা অপঠিত অহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তরে প্রতিভাত হয়েছে এবং তিনি স্বীয় ভাষা ও ভাব-ভঙ্গিমায় ছাহাবীদের কাছে তা উপস্থাপন করেছেন। কুরআন সর্বতোভাবে অকাট্য আর হাদীছ ছহীহ-যঈফ হওয়ার সম্ভাবনা রাখে এবং বিশুদ্ধতার নিরিখে তা গ্রহণযোগ্য হয়।
হাদীছের গুরুত্ব : হাদীছের গুরুত্বের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ মূলত একমত। হাদীছ বাদ দিলে কুরআনের পরিচয় লাভ ও ইসলামী বিধিবিধান পূর্ণভাবে পালন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কুরআনুল কারীমে সকল কিছুর বর্ণনা শুধু মূলনীতিরূপে এসেছে। যেমন— ছালাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ছলাতের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। প্রত্যহ কয় বার ছালাত আদায় করতে হবে, ছালাতের সময় কখন থেকে শুরু হবে আর তা কখন শেষ হবে, কত রাকআত পড়তে হবে এবং রুকূ-সিজদা কখন করতে হবে ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যা হাদীছ ছাড়া জানা সম্ভব নয়। এভাবে অন্যান্য বিধান হাদীছের ব্যাখ্যা ছাড়া পালন করা সম্ভব নয়। মূলত এজন্যই ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান, কাদিয়ানী, বাহাঈ, শীআ, রাফেযী, খারেজী এবং আহলুল কুরআন দাবিদাররা হাদীছের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া। তারাও জানে যে, হাদীছের সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই কুরআন মানা যায় না। শুধু সরলপ্রাণ মুসলিমদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যই তারা মূলত কুরআনের নাম নেয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং কুরআন সম্পর্কে বলেন, ﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى - إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى﴾ ‘আর সে (রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মনগড়া কথাও বলেন না। তা তো অহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়’ (আন-নাজম, ৫৩/৩-৪)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে বলেছেন,تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা সে দুটি জিনিস আঁকড়ে ধরে থাকবে পথভ্রষ্ট হবে না, তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ’।[9] হুযায়ফা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দুটি হাদীছ বর্ণনা করেন যার একটি হলো,الأَمَانَةَ نَزَلَتْ فِى جَذْرِ قُلُوبِ الرِّجَالِ ثُمَّ عَلِمُوا مِنَ الْقُرْآنِ ثُمَّ عَلِمُوا مِنَ السُّنَّةِ ‘আমানত মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর তারা কুরআন হতে শিক্ষা গ্রহণ করেন, তারপর সুন্নাহ হতে শিক্ষা গ্রহণ করেন’।[10] এই হাদীছ কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষার প্রতি সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যেন কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ বুঝার পর অন্য কোনো মত ও পথের অনুসারী না হয়।
হাদীছ অস্বীকারকারীদের উপস্থাপিত দলীল ও তার জবাব :
প্রথম দলীল : কুরআনের দুটি আয়াত দ্বারা তারা দাবি করে যে, কুরআনেই সব কিছুর বর্ণনা আছে। কাজেই হাদীছের প্রয়োজন নেই।
উত্তর : প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলেন,﴿مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ﴾ ‘আমি কিতাবে কোনো কিছুই বাদ দেইনি’ (আল-আনআম, ৬/৩৮)। এখানে কিতাব দ্বারা লাওহে মাহফূয উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ছোট-বড় সকল জিনিস লাওহে মাহফূযে আসল অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে।[11]
দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ﴾ ‘আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি’ (আন-নাহল, ১৬/৮৯)। অর্থাৎ কুরআন মাজীদে সব বিষয়েরই মূলনীতি বিদ্যমান রয়েছে। ইমাম আওযাঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, সুন্নাতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মিলিয়ে এই কিতাবে সমস্ত কিছুর বর্ণনা রয়েছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বলেছেন, জেনে রেখো! আমাকে কুরআন দেওয়া হয়েছে এবং কুরআনের ন্যায় অনুরূপ কিছু (হাদীছ) দেওয়া হয়েছে।[12]
দ্বিতীয় দলীল : হাদীছের মধ্যে অনেক জাল-বানোয়াট প্রবেশ করেছে, ফলে হাদীছের উপর ভরসা করা যায় না।
উত্তর : মুসলিম উম্মাহ মূলত একমত যে, হাদীছের নামে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিরোধে মুহাদ্দিছগণ যে চেষ্টা ও দক্ষতা প্রদর্শন করে গেছেন, দুনিয়াতে তার দৃষ্টান্ত নেই। অর্থাৎ ছহীহ ও যঈফ এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় হয়ে গেছে। অন্যদিকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীছ বর্ণনা করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যা বলবে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়’।[13]
তৃতীয় দলীল : কিছু হাদীছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও যুক্তিবিরোধী কথাবার্তা রয়েছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা।
উত্তর : মূলত হাদীছ জ্ঞান-বিজ্ঞানবিরোধী নয়। বরং জ্ঞানের কমতির কারণে তাদের নিকট এমন মনে হয়েছে। আলী রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,لَوْ كَانَ الدِّينُ بِالرَّأْىِ لَكَانَ أَسْفَلُ الْخُفِّ أَوْلَى بِالْمَسْحِ مِنْ أَعْلاَهُ وَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَمْسَحُ عَلَى ظَاهِرِ خُفَّيْهِ ‘দ্বীনের মধ্যে যদি রায়, যুক্তি ও বিবেকের স্থান থাকত, তাহলে মোজার উপরের অংশ অপেক্ষা নিচের অংশই অধিক মাসাহযোগ্য হতো। কিন্তু আমি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁর মোজার উপরের অংশে মাসাহ করতে দেখেছি’।[14]
চতুর্থ দলীল : কিছু হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদেরকে কুরআন অবতীর্ণের সময় হাদীছ লিখতে নিষেধ করেছেন।
উত্তর : প্রাথমিক দিকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছ লিখতে এই জন্য নিষেধ করেছিলেন যে, যাতে কুরআনের সাথে হাদীছ মিশে না যায়’।[15] পরবতীর্তে ছাহাবীগণ হাদীছ মুখস্থ ও লেখার কাজ করেছেন। উম্মাতে মুহাম্মাদী প্রথম প্রকার অহীর সংরক্ষণের জন্য যে সকল ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন, এই দ্বিতীয় প্রকার অহীর সংরক্ষণের জন্যও ঠিক সে সকল ব্যবস্থাই করেছেন। অর্থাৎ হাদীছ মুখস্থকরণ, অন্যদের তা শিক্ষাদান, কিতাবে লিপিবদ্ধকরণ যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
দ্বীন মানার ক্ষেত্রে কুরআনই কি আমাদের জন্য যথেষ্ট, না হাদীছও মানতে হবে?
কুরআনুল কারীমের অনেক নির্দেশ, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অগণিত নির্দেশ ও বাণী এবং ছাহাবীগণের কর্ম-পদ্ধতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলামী শরীআহর (আল-কুরআন হলো প্রথম উৎস) দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে হাদীছ। দ্বীন মানার ক্ষেত্রে শুধু কুরআনই যথেষ্ট নয়; বরং হাদীছ মানাও ফরয। কেননা হাদীছ ও সুন্নাহ হচ্ছে পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাদানকারী। কুরআন ও হাদীছের সমন্বয়েই ইসলামী বিধিবিধানের পূর্ণরূপ লাভ করেছে। কুরআনে বর্ণিত ইসলামী শরীআহর অনেক কিছুই সংক্ষিপ্ত, যা হাদীছে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। যেমন— কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, আল্লাহ বলেন,﴿وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾ ‘আমি তো তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি যারা এ বিষয়ে মতভেদ করে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য’ (আন-নাহল, ১৬/৬৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ ‘(অতীতে রাসূলগণকে পাঠিয়েছিলাম) স্পষ্ট প্রমাণাদি ও কিতাব দিয়ে; আর এখন আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে করে আপনি মানুষকে তাদের উপর অবতীর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা করে দেন, যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (আন-নাহল, ১৬/৪৪)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, أَلَا إِنِّي أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘জেনে রেখো! আমাকে কিতাব তথা কুরআন দেওয়া হয়েছে এবং তার সাথে অনুরূপ আরেকটি বিষয় (সুন্নাহ) দেওয়া হয়েছে’।[16]
আল-কুরআনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করতে ও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন : মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ﴾ ‘তোমরা যদি তার আনুগত্য করো, তবে সঠিক পথ পাবে, রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে স্পষ্টভাবে (আল্লাহর বাণী) পৌঁছে দেওয়া’ (আন-নূর, ২৪/৫৪)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করা মানেই আল্লাহর আনুগত্য করা। আল্লাহ বলেন,﴿مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا﴾ ‘যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল; কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে (জোরপূর্বক তাকে সৎপথে আনার জন্য) আমি আপনাকে তাদের প্রতি পাহারাদার করে পাঠাইনি’ (আন-নিসা, ৪/৮)। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا﴾ ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকো’ (আল-হাশর, ৫৯/৭)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ - قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ﴾ ‘বলে দাও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার অনুসরণ করো। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসকল ক্ষমা করবেন। বস্তুত আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। বলো, তোমরা আল্লাহর ও রাসূলের আনুগত্য করো। অতঃপর যদি তারা না মানে, তবে আল্লাহ কাফেরদেরকে ভালোবাসেন না’ (আল-ইমরান, ৩/৩১-৩২)।
যারা আল্লাহ তাআলা ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসে, এ আয়াত তাদের জন্য মাপকাঠি বা পরীক্ষা। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসার অর্থ হলো, একচ্ছত্রভাবে তাঁর অনুসরণ করা।
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রকৃত আনুগত্য কাকে বলে?
আবিস ইবনু রাবীআহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি উমার রযিয়াল্লাহু আনহু-কে কালো পথর চুমা দিতে দেখেছি এবং এই কথা বলতে শুনেছি,إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ وَلَوْلاَ أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ ‘আমি নিশ্চিতরূপে জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি কারো ক্ষতি ও উপকার করতে পারো না। যদি আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তোমাকে চুমা দিতে না দেখতাম, তবে আমি কখনো তোমাকে চুমা দিতাম না’।[17] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে যাবে। আর যে আমার অবাধ্য হবে, সে হলো অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী’।[18] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল বা কাজ করল, যে কাজের নির্দেশ আমি দিইনি, তার সে কাজ প্রত্যাখ্যাত’।[19]
ইসলামের অন্যতম রুকন : ইসলামের অন্যতম একটি রুকন হলো— এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মা‘বূদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল। ঈমানের অন্যতম রুকন : ঈমানের রুকনসমূহের চতুর্থ রুকন হলো রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস করা।
‘মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাখ্যা : ‘মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাখ্যা হলো- মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন একজন মানুষ, একজন প্রেরিত রাসূল ও আল্লাহর বান্দা এই ঈমান রাখা, তিনি যে বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন, তা সত্য হিসেবে বিশ্বাস করা, যা আদেশ করেছেন তাঁর আনুগত্য করা, যা থেকে নিষেধ ও সতর্ক করেছেন তা হতে বিরত থাকা, তাঁর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁর কথার উপর কারও কথাকে প্রাধান্য না দেওয়া, সে যে শ্রেণির ব্যক্তিই হন না কেন?[20]
আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾ ‘আমরা আপনাকে বিশ্বের সমগ্র (জাতির) জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না’ (সাবা, ৩৪/২৮)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلَا نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘শপথ সেই সত্তার, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! এই উম্মতের মধ্যে থেকে ইয়াহূদী হোক বা খ্রিষ্টান হোক— কোনো ব্যক্তি যদি আমার সম্পর্কে শোনে অতঃপর আমাকে যে শরীআত দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে তার উপর ঈমান না এনেই মৃত্যুবরণ করে, তবে সে জাহান্নামের অধিবাসী হবে’।[21]
সর্বজনস্বীকৃত চার ইমামের কোনো ইমামই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের বিপরীত করেননি। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করা ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে তাঁরা সুনিশ্চিতভাবে একমত ছিলেন। আর এই ব্যাপারেও তাঁরা ঐকমত্য যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ছাড়া অন্য যে কোনো লোকের বাণী বা উক্তি গ্রহণও করা যেতে পারে আবার প্রত্যাখ্যানও করা যেতে পারে। অর্থাৎ যদি তাঁদের কথা শুদ্ধ হয়, তবে তা গৃহীত হবে। আর যদি ভুল হয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ ও ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হলে ওটাই আমার মাযহাব বা অনুসরণীয় বলে পরিগণিত হবে।[22] ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য যে কোনো লোকের কথা গ্রহণীয় এবং বর্জনীয়।[23] ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের হাদীছ প্রত্যাখ্যান করল সে ধ্বংসের তীরে উপনীত।[24]
পরিশেষে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীছ পরিবেশন করেই শেষ করছি— রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا لَا يَزِيغُ عَنْهَا بَعْدِي إِلَّا هَالِكٌ ‘আমি তোমাদেরকে রেখে যাচ্ছি স্বচ্ছ দ্বীন ও সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর, যার রাতটাও দিনের মতো আলোকিত। উক্ত দ্বীন থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ বিচ্যুত হয় না’।[25]
মাহবূবুর রহমান মাদানী
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৭; মিশকাত, হা/৫৩৮৯।
[3]. সূরা আল-আনআম, ৬/১৫৩; মুসনাদ আহমাদ, হা/৪২২৫।
[4]. আবূ দাঊদ, হা/১৪১৬, হাদীছ ছহীহ।
[5]. ছহীহ জামে‘, হা/২১৬৫।
[6]. তিরমিযী, হা/২৮৮৩, হদীছ ছহীহ।
[7]. তিরমিযী, হা/২৬৬৪, হাদীছ ছহীহ।
[8]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪।
[9]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৩৩৩৮, ৫/১৩২৩।
[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৩; মিশকাত, হা/৫৩৮১।
[11]. তাফসীর সা‘দী, পৃ. ২৫৫।
[12]. মুসনাদে আহমাদ, ৪/১৩০; তাফসীর ইবনু কাসীর, আন-নাহল, ১৬/৮৯-এর আলোচনা।
[13]. ছহীহ বুখারী, হা/১১০; ছহীহ মুসলিম, হা/৪; মিশকাত, হা/১৯৮।
[14]. আবূ দাঊদ, হা/১৬২, হাদীছ ছহীহ।
[15]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩০০৪।
[16]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪; মিশকাত, হা/১৬৩, হাদীছ ছহীহ।
[17]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫৯৭; ছহীহ মুসলিম, হ/১২৭০।
[18]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮০; মিশকাত, হা/১৪৩।
[19]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।
[20]. ফাতহুল মাজীদ, পৃ. ৩৯।