কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কিতাবুল ঈমান (মিন্নাতুল বারী- ২৮তম পর্ব)

post title will place here

ভূমিকা : দীর্ঘ ২০ পর্ব যাবৎ আমরা ছহীহ বুখারীর ‘কিতাবুল অহী’-এর হাদীছসমূহের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানলাম। এই পর্ব থেকে আমরা ছহীহ বুখারীর দ্বিতীয় অধ্যায় ‘কিতাবুল ঈমান’-এর হাদীছসমূহের ব্যাখ্যা শিখব ইনশা-আল্লাহ। তবে ‘কিতাবুল ঈমান’-এর হাদীছগুলোর সরাসরি ব্যাখ্যায় যাওয়ার পূর্বে কিতাবুল ঈমানে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ সার্বিক যে বিষয়গুলো আলোচনা করবেন, তা বুঝার সুবিধার্থে ভূমিকাস্বরূপ ঈমানসংক্রান্ত কিছু আলোচনা জেনে রাখা জরূরী। উক্ত ভূমিকাস্বরূপ আলোচনায় আমরা যে বিষয়গুলো জানব তা নিম্নরূপ—

(১) অধ্যায়ের ধারাবাহিকতা (২) ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য (৩) অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাসের সীমাবদ্ধতা (৪) মৌলিক আক্বীদাসূহ (৫) ঈমানের ফযীলত (৬) ঈমান না আনার ভয়াবহতা (৭) মৌলিক ছয়টি আক্বীদার সারর্মম ব্যাখ্যা (৮) ইমাম বুখারীর আলোচ্য বিষয় (৯) ঈমানের সংজ্ঞা ও মতভেদ (১০) আক্বীদার বাতিল ফেরক্বাসমূহ (১১) আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বীদা ও মানহাজ (১২) আক্বীদা ও বিশ্বাসের উপর লিখিত সালাফগণের কিতাবসমূহ।

উক্ত ভূমিকা আলোচনার পর আমরা ছহীহ বুখারীর হাদীছসমূহের ব্যাখ্যায় প্রবেশ করব ইনশা-আল্লাহ। ওমা তাওফীক্বী ইল্লা বিল্লাহিল আলিঈল আযীম।

(১) অধ্যায়ের ধারাবাহিকতা : ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ সর্বপ্রথম অহীর আলোচনা করেছেন। কেননা সকল সত্যের উৎস একমাত্র অহী। অকাট্য সত্য একমাত্র আল্লাহর অহী থেকেই পাওয়া সম্ভব। নবীগণের যাত্রাও শুরু হয় অহী দিয়ে। ঠিক তেমনি আমাদের রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল অহী দিয়ে। তার সকল দাওয়াতের মূল ভিত্তি অহী। তাই সর্বপ্রথম অহী নিয়েই তিনি আলোচনা করেছেন। অহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত দিক-নির্দেশনার মধ্যে একজন মুসলিমের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঈমান; ইসলামের চিন্তাধারা ও বিশ্বাস। তাই ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহও অহীর পরে সর্বপ্রথম ঈমানের আলোচনা শুরু করেছেন। আমরা যদি সারর্মম বলি, তাহলে বলতে পারব সকল আমলের ভিত্তি ঈমান। ঈমান না থাকলে আমল কোনো কাজে আসবে না। আর ঈমান ও আমল উভয়ের উৎস অহী। তাই ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ প্রথমে অহীর আলোচনা করেছেন। তারপর ঈমানের আলোচনা এবং এরপর বিভিন্ন আমলের ধারবাহিক আলোচনা শুরু করবেন ইনশা-আল্লাহ।

(২) ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : প্রতিটি আদর্শ ও দ্বীন টিকে থাকে তার বিশ্বাস ও চিন্তাধারার উপর। আজকের বিশ্বেও সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ হচ্ছে চিন্তার যুদ্ধ। যে বিশ্বাস যত বেশি মানুষের অন্তরে প্রভাব ফেলতে পারছে, যত বেশি মন জয় করতে পারছে— সেই বিশ্বাসের অনুসারীরাই দিন দিন বাড়ছে। আজকের বিশ্বায়নের যুগে শয়তানের অনুসারীরা অসংখ্য ইসলামী বিশ্বাস বিরোধী প্রোপাগান্ডা পরিচালনা করে আসছে। যেমন বস্তুবাদ, পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র। বস্তুবাদ থেকেই তৈরি হয়েছে নারীর অবাধ স্বাধীনতার নামে অবৈধ যৌনাচার, সমকামিতা, লিঙ্গ পরিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন শয়তানী এজেন্ডা। যা মানুষের মন ও মস্তিষ্কে প্রবেশ করানোর জন্য সকল প্রকার ব্রেন ওয়াশিং পদ্ধতি শয়তানের পূজারীরা গ্রহণ করছে। বস্তুবাদ আমাদের পরিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধগুলো ভেঙে দিচ্ছে। সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কও আজ মূল্যায়িত হচ্ছে টাকার উপর ভিত্তি করে। বস্তুবাদ সমাজে তৈরি করেছে চাহিদার লাগামহীনতা, যা মানুষকে পশুকে পরিণত করে দিচ্ছে; যা পূরণ করতে প্রয়োজন টাকার অসম প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পুঁজিবাদের বিকল্প নাই। ফলত একটি চক্রের মতো মানুষ বস্তুবাদী চিন্তাধারা পূরণ করতে গিয়ে যেমন বিকৃত চরিত্রের অধিকারী হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি সূদী অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে; যা তাকে গোলাম বানিয়ে দিচ্ছে স্থায়ীভাবে। পাশাপাশি এই ভঙ্গুর পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন নড়বড়ে পরিবর্তনশীল শাসনব্যবস্থা যা একমাত্র গণতন্ত্র দিতে পারে। ফলত বস্তুবাদ, পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র একটি চক্রের মতো পৃথিবী শাসন করছে। তবে যাত্রাটা শুরু হয় মানুষের বস্তুবাদী চিন্তাধারা থেকেই।

সুতরাং বিশ্বাস ও চিন্তাভাবনার গুরুত্ব সীমাহীন ও অপরিসীম। তাইতো মক্কার দীর্ঘ ১৩ বছর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু মানুষের অন্তরের বিশ্বাস সংস্কার নিয়ে কাজ করেছেন। বস্তুবাদের পরিবর্তে তিনি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন পরকালমুখী। জান্নাতের জন্য দুনিয়া বিসর্জন দেওয়ার এক ব্যতিক্রম সমাজ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মদীনাতে। সকল পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিগুলো গড়ে দিয়েছিলেন আল্লাহ-কেন্দ্রিক। যা একটি মানবিক সমাজে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। যে সমাজে চাহিদার লাগামহীনতা না থাকার ফলে টাকার অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়নি। ফলশ্রুতিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিবর্তে তৈরি হয়েছিল সাম্যের অর্থনীতি। সম্পদের সুষম বণ্টন সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছিল উদারতা, সচ্ছলতা ও ন্যায়পরায়ণতা। জান্নাতমুখী সমাজ ও সুষম বণ্টনের অর্থনীতি ইসলামী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে করেছিল টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী। ন্যায়-ইনছাফের উপর প্রতিষ্ঠিত মানবিক মূল্যবোধ ও প্রকৃত দৈহিক ও মানসিক সুখ-শান্তির এক অনন্য সমাজ ও রাষ্ট্র। ইসলামের আক্বীদা, আদর্শ ও বিশ্বাসের সবচেয়ে ব্যতিক্রম বিষয়টি হচ্ছে এটি সর্ববিপ্লবী, সর্বগ্রাসী ও অপরিবর্তনীয়। গত ১৪০০ বছরে হাজারো বিপ্লব এসেছে, চলে গেছে কিন্তু ইসলামের বিপ্লব যত কাল ধরে যত বেশি মানুষকে ধরে রাখতে পেরেছে তা অকল্পনীয়। বর্তমানেও যত নতুন নতুন বিশ্বাসের থিউরি দাঁড় করানো হোক সেগুলোও একদিন শেষ হবে। কিন্তু ইসলামের বিশ্বাস টিকে রবে। সকল যুগের জন্য এবং মানবিক জীবনের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য ইসলামের যে গ্রহণযোগ্যতা ও উপযুক্ততা তা চিরন্তন। এটা শুধু ভবিষ্যদ্বাণী নয়; এটা ইসলামের বিশ্বাস ও আক্বীদার নিজস্ব সৌন্দর্য ও ক্ষমতা। এমনকি ইসলামের ঘোর শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, ইসলামের আক্বীদা ও বিশ্বাস এমন একটি কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সংস্কারের কোনো সুযোগ নাই; কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ইসলামের বিশ্বাসের এই অপরিবর্তনীয়তা ইসলামের সবচেয়ে বড় শক্তি।

(৩) অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাসের সীমাবদ্ধতা : ঈমান বা বিশ্বাস অর্থ হচ্ছে অদৃশ্য ও অজানা বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস। যেগুলোর কোনোটাই যুক্তিতর্ক বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এই রকম মৌলিক বিষয় হচ্ছে ছয়টি— আল্লাহ, ফেরেশতা, রাসূল, কিতাব, ভাগ্য, পরকাল। যেহেতু মানুষের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, শারীরিক শক্তি, ঘ্রাণশক্তি ইত্যাদির একটা সীমা আছে, সেহেতু মানুষের চিন্তাশক্তি ও মেধাশক্তিরও একটা সীমা আছে। নির্দিষ্ট দূরত্বের বেশি মানুষ যেমন দেখতে, শুনতে ও ঘ্রাণ নিতে পারে না, ঠিক তেমনি নির্দিষ্ট একটা বলয়ের বাইরে মানুষ চিন্তাও করতে পারে না। মানুষের সকল চিন্তার উৎস তার চোখের সামনে যা সে দেখে তা থেকে। এর বাইরে মানুষের জানারও কোনো উপায় নাই। আজকের অতি আধুনিক বিশ্বে মানুষ চন্দ্র, মঙ্গল বিভিন্ন গ্রহে পৌঁছে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, বিজ্ঞানের এই উন্নয়ন মানুষের অসহায়ত্ব ও শক্তির সীমাবদ্ধতাকে আরো ব্যাপকভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। বিজ্ঞান বলছে, পৃথিবী যে গ্যালাক্সিতে আছে, মহাশূন্যে এই রকম লক্ষ-কোটি অগণিত গ্যালাক্সি আছে— যার মধ্যে আবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো লক্ষ-কোটি গ্রহ-নক্ষত্ররাজি আছে। মানুষ এখনো তার চোখের সামনে যে বিশাল দিগন্ত জুড়ে নীল আকাশ আছে, তার সরিষার দানা সমপরিমাণও পৌঁছতে পারেনি। কিছুদিন পূর্বে জেমসওয়েব টেলিস্কোপ ১৩৫০ কোটি বছর আগের মহাশূন্যের ছবি ধারণ করেছে। আসলে বিষয়টি হচ্ছে ১৩৫০ কোটি বছর আলোর গতিতে চললে যতদূর যাওয়া যাবে ততদূরের ছবি ধারণ করেছে। যেহেতু আলোর গতিতে ছবিটি আমাদের পর্যন্ত আসতে সময় লাগত ১৩৫০ কোটি বছর সেটিই যখন ক্যামেরার শক্তিতে আমরা অতদূর থেকে ধারণ করতে পারছি তখন সেটি অত বছর আগের ছবি। তাহলে কল্পনা করুন মানুষের ক্যামেরার পাওয়ার যতদূর যেতে পেরেছে ততদূর যেতে মানুষের আলোর গতিতে ১৩৫০ কোটি বছর লাগবে। তাহলে প্রথম আকাশ কতদূরে? কত অক্ষম ও দুর্বল মানুষ! ঠিক তেমনি মানুষ জানে পৃথিবী গোলাকার। পৃথিবী বৃত্তের সকল ব্যাসার্ধে মানুষের বসবাস অথচ পৃথিবীর কেদ্রবিন্দু চিরে কোনো সরলরেখা এপার থেকে ওপারে মানুষ নিয়ে যেতে পারেনি। সুতরাং মানুষের অতি উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানও আল্লাহর সামান্য সৃষ্টি আসমান ও যমীনের রহস্যের ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি। এই রকম হাজারো চ্যালেঞ্জ আছে, যা মানুষ ভেদ করতে পারেনি। তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মানুষের রূহ বা জীবন। মানুষকে চিরন্তর ও চিরস্থায়ী করে বাঁচিয়ে রাখতে হলে রূহের রহস্য ভেদ করতে হবে। যার ধারেকাছে আধুনিক বিজ্ঞান যেতে পারেনি। কত দুর্বল মানুষ!

সুতরাং এই দুর্বলতা নিয়ে মানুষ তার অজ্ঞ মেধা ও সীমিত মস্তিষ্কের যুক্তিতর্ক এবং তার অক্ষম বিজ্ঞানের বিজ্ঞান দিয়ে এই মহাবিশ্বের প্রতাপশালী সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জানবে, এরপর উদ্ভট প্রশ্ন উত্থাপন করবে— তা হাস্যকর বৈ কিছুই নয়। সুতরাং এটাই সত্য, ইসলামী বিশ্বাসে যুক্তি অগ্রহণযোগ্য। আক্বীদায় দর্শনশাস্ত্র অগ্রহণযোগ্য। ঈমানে বিজ্ঞান অগ্রহণযোগ্য। এখানে একমাত্র অকাট্য সত্য অহী। আল্লাহর বাণী ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী যদি কোনো সময় মানুষের যুক্তিচিন্তা ও বিজ্ঞানের বিরোধী হয়, তাহলে অগাধ আস্থা রাখতে হবে যে, অহীই সত্য। অহীর বিপরীত সব মূর্খতা। হয়তো তার মূর্খতা আজ প্রকাশ পাচ্ছে না; আমাদের মেধা ও জ্ঞানের পরিধির উন্নয়নের ফলে কোনোদিন তা প্রকাশ পেতে পারে।

(৪) মৌলিক আক্বীদাসমূহ : মহান আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়; তাঁর কোনো শরীক নাই। সত্তাতেও নয়, নাম-গুণেও নয়, কর্মেও নয়, অধিকার বা ইবাদতেও নয়। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত রাসূল ও তাঁর বান্দা। তিনি যা সংবাদ দিয়েছেন তাঁর সত্যায়ন করতে হবে, তিনি যা নির্দেশ দিয়েছেন তা সাধ্যানুযায়ী মানতে হবে, যা থেকে নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করতে হবে, তার আনীত শরীআত ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করা যাবে না।

মহান আল্লাহর রয়েছে অগণিত নাম, অসংখ্য গুণ। তাঁর রয়েছে সত্তাগত গুণ, যেমন উপরে থাকা, চেহারা, দু চোখ, দু হাত, পা ইত্যাদি। অনুরূপ তাঁর রয়েছে কর্মগত গুণ, যেমন তিনি যখন ইচ্ছা কথা বলেন, হাসেন, আশ্চর্য হন, খুশী হন, রাগ করেন, আসমান-যমীন সৃষ্টির পরে আরশের উপর উঠেছেন, হাশরের মাঠে আসবেন, রাতের শেষাংশে নিকটতম আসমানে নেমে আসেন।

মহান আল্লাহ সর্বোচ্চ সত্তা, সম্মান-মর্যাদা, ক্ষমতা ও অবস্থানের দিক দিয়ে তিনি উপরে। সপ্তম আকাশে আরশের উপর আছেন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, তাঁর থেকে কেউ জন্ম নেয়নি। তাঁর যে সমস্ত ছিফাতের কথা কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, কোনোরূপ তা‘বীল বা দূরবর্তী ব্যাখ্যা এবং তাহরীফ বা বিকৃতি পরিবর্তন এবং তামছীল বা সাদৃশ্যকরণ ছাড়াই প্রকৃত অর্থে বিশ্বাস করা। যেমন মহান আল্লাহর হাত-পা, ছুরত ও চেহারা আছে তবে তাঁর হাত-পা, ছুরত ও চেহারা তাঁর শানে যেমন মানায় তেমন। ঠিক তেমনি মহান আল্লাহর যে সমস্ত ছিফাতের কথা পবিত্র কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত হয়নি, তা তাঁর জন্য সাব্যস্ত না করা। তাঁর জন্য এমন সব শব্দ ব্যবহার না করা, যা কুরআন-সুন্নাহয় আসেনি। যেমন মহান আল্লাহর দেহ বা অঙ্গ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা সঠিক নয়। এমন শব্দ কেউ ব্যবহার করলে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তার অর্থ শুদ্ধ প্রমাণিত হলে অশুদ্ধ শব্দ পরিত্যাগ করে শুদ্ধ শব্দে তা ব্যক্ত করা, উদ্দেশ্য সঠিক না হলে উক্ত শব্দ ও অর্থ সবটুকুই পরিত্যাগ করা।

আক্বীদার ক্ষেত্রে জাহমিয়া, মুশাব্বিহা, মুজাসসিমা, মাতুরীদিয়া ও আশ‘আরিয়াদের আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকা।

আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিষয়ে আক্বীদা হচ্ছে, তিনি মাটির তৈরি আদম সন্তান; আমাদের মতো মানুষ। তবে তার নিকট অহী আসত। তিনি গুনাহ থেকে মা‘ছূম। অহী গ্রহণ ও পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তিনি কোনো ভুল করেননি। তিনি দুনিয়া থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন; বারযাখী জীবনে জীবিত আছেন। আল্লাহ যা জানাতেন তাঁর বাইরে তিনি গায়বের খবর রাখতেন না।

আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাহাবীগণ সকলেই সৎ ও ন্যায়পরায়ণ। তাদের সকলের হাদীছ গ্রহণযোগ্য। খোলাফায়ে রাশেদীনের সকলকে খলীফা রাশেদা হিসেবে গণ্য করা। তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার বিষয়ে চুপ থাকা। তাদের কারো শানে গোস্তাখী করা শীআ ও খারেজীদের বৈশিষ্ট্য।

ঈমান অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ ও কর্মে বাস্তবায়নের নাম। ঈমান বাড়ে ও কমে। কবীরা গুণাহগার ব্যক্তি কাফের নয় এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়; সে ফাসেক্ব মুমিন এবং সে আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। তিনি চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিবেন আবার চাইলে শাস্তি দিয়ে একদিন ঈমানের কারণে জান্নাতে দিবেন। খারেজী ও মুরজিয়াদের আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকা।

তাক্বদীরকে মহান আল্লাহর জ্ঞান মনে করা। সেই জ্ঞানকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর ইচ্ছা এবং ক্ষমতাতেই সবকিছু সৃষ্টি ও বাস্তবায়ন হয়। সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করা তারপর সে বিষয়টিতে আল্লাহর উপর ভরসা করা ও তার ফলকে নিজের তাক্বদীর হিসেবে মেনে নেওয়াটাই ঈমানের অংশ। তাক্বদীরের ক্ষেত্রে আমরা জাবারিয়া ও ক্বাদারিয়াদের আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

জান্নাত, জাহান্নাম, কবর, ক্বিয়ামত, শাফাআতে কুবরা ও ছুগরা, পুলছিরাত, আরশ, কুরসী, লাউহে মাহফূয, কলম, মে‘রাজ, হাউয ও কাউছার, খতমে নবুঅত, দাজ্জাল, ঈসা আলাইহিস সালাম-এর অবতরণ, ইমাম মাহদী, মুমিনগণের মহান আল্লাহকে দেখতে পাওয়া ও কারামাতে আওলিয়া সহ যে সমস্ত বিষয় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত, তা সবকিছুই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা। সার্বিকভাবে কুরআন ও হাদীছ বুঝার ক্ষেত্রে সর্বদা সালাফে ছালেহীনের বুঝকে প্রাধান্য দেওয়া।

(চলবে)

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।

Magazine