হেদায়াত কী?
হেদায়াত আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়া। হেদায়াত ছাড়া দুনিয়াতে যেমন সফলতা লাভ ও আলোকিত জীবন গড়া সম্ভব নয়, তেমন আখেরাতেও মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। এজন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত পাওয়া এবং তার উপর আমরণ অবিচল থাকা একজন মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অতীব জরুরী। কেননা এটা চরম বাস্তব স্বীকৃত কথা যে, হেদায়াত পাওয়া সহজ বটে; কিন্তু হেদায়াতের উপর টিকে থাকা তত সহজ নয়। হেদায়াত হলো আলো, নূর, নিকষ অন্ধকারের বুক চিরে একটি সুসভ্য সমাজ, আলোকিত জাতি এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ার নাম। সেকারণে হেদায়াতের উপর টিকে থাকার জন্য মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে হয় এবং সেই সাথে ইবাদতের পথ ও পন্থা অবলম্বন করে তার উপর টিকে থাকার প্রচেষ্টা চালাতে হয়। এজন্য মহান আল্লাহ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের হেদায়াতের উপর অবিচল থাকার জন্য আমলের শিক্ষা দিয়েছেন এবং সেই সাথে প্রচেষ্টা করতে বলেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ ‘আর যারা আমাদের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, আমরা তাদেরকে অবশ্যই আমাদের পথসমূহের হেদায়াত দিব। আর নিশ্চয় আল্লাহ মুহসিনদের সঙ্গে আছেন’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৬৯)। আল্লাহ তাআলা হেদায়াতের পথে চলার এবং তার উপর অবিচল থাকার লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন,اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ ‘আমাদেরকে সরল পথের হেদায়াত দিন’ (আল-ফাতিহা, ১/৬)। মহান আল্লাহ কুরআনে কারীমে হেদায়াতকে দুইভাবে আলোচনা করেছেন—
(ক) হেদায়াতুত দালালা ওয়াল ইরশাদ (পথপ্রদর্শন করা): এখানে আল্লাহ তাআলা সকলের হেদায়াতের পথনির্দেশনার কথা বলেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘আপনি তো অবশ্যই সরল পথের দিকে দিকনির্দেশনা করেন’ (আশ-শূরা, ৪২/৫২)। হেদায়াতের এই প্রকার দ্বারা প্রমাণিত যে, স্বয়ং নবী, রাসূল, মুমিনগণ কেবল হেদায়াতের পথ ও পন্থার দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন; এটা তাদের উপর ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য।
(খ) হেদায়াতুত তাওফীক্ব: এখানে মহান আল্লাহ যাকে হেদায়াতপ্রাপ্তির তাওফীক্ব দান করেন, কেবল সেই হেদায়াতপ্রাপ্ত হন। যে কেউ যাকে খুশি তাকে হেদায়াতপ্রাপ্ত করতে পারবে না; বরং এটা কেবল মহান আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত এবং তাঁর নিকটেই চাইতে হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ ‘আপনি যাকে ভালোবাসেন, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না। বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা, সৎপথে আনয়ন করেন। আর সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন’ (আল-ক্বছাছ, ২৮/৫৬)। অতএব, দলীল দ্বারা হেদায়াতের বিষয়টি পরিষ্কার যে, এটা কোনো গৌণ বিষয় নয়, বরং এর মধ্যে রয়েছে জীবনের মর্মকথা এবং উত্থান ও পতন। যুগে যুগে নবী-রাসূল ও উম্মতের সৎ, পরহেযগার ব্যক্তিগণ হেদায়াতের পথে পথহারা জাতিকে দাওয়াত দিয়েছেন এবং তাদেরকে অন্ধকারের পথ থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন আমলের পথনির্দেশনা দিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে আজকের প্রবন্ধের দাবি ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত পাওয়ার উপায়’ শীর্ষক লেখনী। যেহেতু হেদায়াত ছাড়া কোনো মানুষই সফল নয়, তাই মহান আল্লাহর কাছে হেদায়াত চাইতে হবে, সেইসাথে হেদায়াতের উপর অবিচল থাকার তাওফীক্ব অর্জনের লক্ষ্যে আমলকে জীবনের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
(১) ঈমান এবং আমলে ছালেহ করা:
ঈমান আনয়ন করা, অতঃপর আমলে ছালেহ সম্পাদন করা আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত পাওয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম।
ঈমান: ঈমান তথা মুখে স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ্বাস এবং কর্মে বাস্তবায়নের সামষ্টিক রূপকে ঈমান বলে। ঈমানের ছয়টি রুকনকে যথাযথ বিশ্বাস করা এবং তার আলোকে জীবনের বাস্তব রূপ পরিস্ফুটিত করা হলো একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيمَانِهِمْ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ ‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের রব তাদের ঈমান আনার কারণে তাদেরকে পথ নির্দেশ করবেন নেয়ামতে ভরপুর জান্নাতে। তাদের পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে’ (ইউনুস, ১০/৯)। অর্থাৎ তারা ঈমান আনে, ঈমানের বিষয়াদিকে আবশ্যকীয়ভাবে একত্রিত করে, সৎ আমল সম্পাদন করে এবং সেইসাথে আত্মার ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমলকে অন্তর্ভুক্ত করে।
এই আয়াতের মধ্যে লক্ষণীয় হলো, তাদের রব তাদের ঈমান আনার কারণে হেদায়াত দান করবেন।
(ক) ঈমানদারদের অভিভাবক স্বয়ং মহান আল্লাহ: আল্লাহ তাআলা বলেন,اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ‘আল্লাহ তাদের অভিভাবক, যারা ঈমান আনে। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান’ (আল-বাক্বারা, ২/২৫৭)।
(খ) ঈমানদার চিরশত্রু শয়তান থেকে মুক্ত: আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ‘নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও তাদের রবেরই উপর নির্ভর করে, তাদের উপর তার কোনো আধিপত্য নেই’ (আল-নাহল, ১৬/৯৯)।
(গ) ঈমানদার ও আমলে ছালেহ সম্পাদনকারী সৃষ্টির সেরা: আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ ‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তারাই সৃষ্টির শ্ৰেষ্ঠ’ (আল-বাইয়্যেনাহ, ৯৮/৭)।
(ঘ) ঈমানদার ও আমলে ছালেহ সম্পাদনকারীর জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা: আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَنْ يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَى ‘আর যারা তাঁর কাছে সৎকর্ম করে মুমিন অবস্থায় আসবে, তাদের জন্যই রয়েছে উচ্চতম মর্যাদা’ (ত্ব-হা, ২০/৭৫)।
(ঙ) ঈমান ক্বিয়ামতের মাঠে নূর হবে: আল্লাহ তাআলা বলেন,يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَى نُورُهُمْ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ بُشْرَاكُمُ الْيَوْمَ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ‘সেদিন আপনি দেখবেন মুমিন নর-নারীদেরকে তাদের সামনে ও ডানে তাদের নূর ছুটতে থাকবে। বলা হবে, আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে, এটাই তো মহাসাফল্য’ (আল-হাদীদ, ৫৭/১২)।
(চ) ঈমানদারদের জন্য প্রতিদান জান্নাত: আল্লাহ তাআলা বলেন,جَزَاؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ ‘তাদের রবের কাছে আছে তাদের পুরস্কার স্থায়ী জান্নাত, যার নিচে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এটি তার জন্য, যে তার রবকে ভয় করে’ (আল-বাইয়্যেনাহ, ৯৮/৮।
(ছ) আল্লাহর নেয়ামতের প্রকৃত অধিকারী ঈমানদার: আল্লাহ তাআলা বলেন,قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘বলুন, আল্লাহ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবকে সৃষ্টি করেছেন, তা কে হারাম করেছে? বলুন, পার্থিব জীবনে, বিশেষ করে ক্বিয়ামতের দিনে এসব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৩২)।
উপরিউক্ত আয়াতগুলো দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, একজন মুমিন ব্যক্তির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কত মর্যাদা, সম্মান এবং কত নেয়ামত গচ্ছিত রয়েছে মহান রবের নিকট! এজন্য বিশুদ্ধ ঈমান পোষণ করা এবং এর স্বাদ আস্বাদন করা সকল মুসলিম ও মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। যদি ঈমান বিশুদ্ধ না হয়, তাহলে আমলের পাল্লা ভারী করেও লাভ হবে না। কারণ বিশুদ্ধ ঈমানেই নাজাতের সম্বল এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের চাবিকাঠি।
আমলে ছালেহ: আমলে ছালেহ বলতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যমূলক কাজকে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সম্পাদন করা। যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেখানো পথ ও পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনো পথ ও পদ্ধতি অনুযায়ী কোনো আমল সম্পাদন করা হয়, তাহলে সেই আমলকে আমলে ছালেহ বলে গণ্য করা সঠিক হবে না। আমলে ছালেহ একজন মুসলিম মুমিনের জন্য নাজাতের অসীলা এবং দুনিয়ার জীবনে পরহেযগারিতা ও আমল সুসজ্জিত করার অন্যতম মাধ্যম। যে কোনো ব্যক্তিই হোক না কেন যদি আমল সঠিক পদ্ধতিতে তথা আমলে ছালেহ না হয়, তাহলে সেই আমল বৃথা হবে। মহান আল্লাহ সেই আমলকে বিক্ষিপ্ত ধুলার মতো করবেন। তাঁর দরবারে এই সকল আমল কোনো কাজে আসবে না। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورً ‘আর আমরা তাদের কৃতকর্মের প্রতি অগ্রসর হয়ে সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/২৩)। ইবাদতের ক্ষেত্রে আমলে ছালেহ যেমন বিদ্যমান, ঠিক তেমনিভাবে আমলে সূ তথা খারাপ আমলও বিদ্যমান। তাই আমলে ছালেহ সম্পাদন করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সজাগ থাকতে হবে এবং সেইসাথে আমলে ছালেহ খুঁজে সম্পাদন করার মতো মনোবল শক্ত করতে হবে। কেননা এর প্রতিদান জান্নাত।
কতিপয় আমলে ছালেহ নিম্নে পেশ করা হলো, যার প্রতিদান অপরিসীম—
(ক) ফজর এবং আছরের ছালাতকে গুরুত্ব দেওয়া: ছাহাবী আবূ বকর ইবনে আবূ মূসা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ صَلَّى الْبَرْدَيْنِ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি দুই শীতের (ফজর ও আছর) ছালাত আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[1]
(গ)যারা আল্লাহর ৯৯টি নাম মুখস্থ করে: আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمَا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার ৯৯টি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এগুলো মুখস্থ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[3]
(ঘ)যারা লজ্জাস্থান ও মুখের হেফাযত করে: সাহল ইবনে সা‘দ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ يَضْمَنْ لِى مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি তাঁর মুখ এবং লজ্জাস্থান হেফাযত করার যিম্মাদারি গ্ৰহণ করবে, আমি তাঁর জন্য জান্নাতের যিম্মাদারি গ্ৰহণ করব’।[4]
(ঙ)যারা ইয়াতীমদের লালন-পালন করে: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِى الْجَنَّةِ هَكَذَا وَقَالَ بِإِصْبَعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى ‘আমি এবং ইয়াতীমের লালন-পালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব’। অতঃপর তিনি হাতের শাহাদাত আঙুল ও মধ্যমা আঙুল একত্রিত করে দেখালেন।[5]
(চ)যারা তাবীয-ক্ববযের আশ্রয় নেয় না: ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْ أُمَّتِى سَبْعُونَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ هُمُ الَّذِينَ لاَ يَسْتَرْقُونَ وَلاَ يَتَطَيَّرُونَ وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ‘আমার উম্মতের ৭০ হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা এমন লোক, যারা ঝাড়ফুঁক, তাবীয-ক্ববযের আশ্রয় নেয় না, শুভ-অশুভ বিশ্বাস করে না এবং তারা তাদের রবের উপর ভরসা রাখে’।[6]
(২) তাওহীদ:
তাওহীদ মানবজীবনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত। তাওহীদ হলো সকল ইবাদতের মূলভিত্তি। তাওহীদবিহীন কোনো ইবাদত, কর্ম, কথা গ্ৰহণযোগ্য নয়। তাওহীদ আছে যার, ইবাদত তার জন্য আলোকবর্তিকা। স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির গভীর সম্পর্ক স্থাপনের নাম তাওহীদ। তাওহীদের উপর নির্ভর করে একজন মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের মুক্তি। এজন্য শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন,اَلْعَقِيْدَةُ الصَّحِيْحَةُ هِيَ أَصْلُ دِيْنِ الْإِسْلاَمِ وَأَسَاسُ المِلَّةِ অর্থাৎ ‘বিশুদ্ধ আক্বীদা দ্বীন ইসলামের শিকড় এবং মুসলিম মিল্লাতের সুদৃঢ় ভিত্তি’।[7]
বিশুদ্ধ আক্বীদা বা তাওহীদের স্বীকৃতি না দেওয়া ব্যতীত কোনো মুসলিমের ইবাদত চাই তা ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত কোনোকিছুই মহান আল্লাহ কবুল করবেন না। এজন্য মুহাদ্দিছগণ বিশুদ্ধ আক্বীদা বা তাওহীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে এভাবে আলোকপাত করেছেন,مَعْلُوْمٌ بِالْأَدِلَّةِ الشَّرْعِيَّةِ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ أَنَّ الْأَعْمَالَ وَالْأَقْوَالَ إِنْمَا تَصِحُّ وَتُقْبَلُ إِذَا صَدَرَتْ عَنْ عَقِيْدَةٍ صَحِيْحَةٍ فَإِنْ كَانَتِ الْعِقِيْدَةُ غَيْرَ صَحِيْحَةٍ بَطَلَ مَا يَتَفَرَّعُ عَنْهَا ‘শরীআতের দলীল-প্রমাণাদি তথা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সুবিদিত হয়েছে যে, যাবতীয় আমল ও কথা কেবল তখনই বিশুদ্ধ হবে এবং গ্ৰহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, যখন তা বিশুদ্ধ আক্বীদা থেকে নিঃসরিত হবে। আর যদি আক্বীদা বিশুদ্ধ না হয়, তাহলে তাঁর থেকে যা কিছুই বের হোক না কেনো সবই বাতিল বলে গণ্য হবে’।[8]
বিশুদ্ধ আক্বীদা বা তাওহীদের এতই মূল্য যে, তার মানদণ্ডে যেকোনো আমল পরিমাপ করলে যদি সেই আমল বিশুদ্ধ তাওহীদের রূপরেখায় না হয়ে থাকে, তাহলে তা বরবাদ বা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এজন্য মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘আর কেউ ঈমানের সাথে কুফরী করলে তার কর্ম অবশ্যই নিষ্ফল হবে এবং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আল-মায়েদা, ৫/৫)।
তাই বিশুদ্ধ আক্বীদা বা তাওহীদের পথে দৃঢ় থাকার জন্য যুগে যুগে মহান আল্লাহ অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁদেরকে পাঠিয়েছেন মানুষকে জাহান্নামের খাদ থেকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করার জন্য। এজন্য মহান আল্লাহ পথ বাতলিয়ে দিয়ে বলেছেন,قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ - قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ - لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ ‘বলুন, আমার রব তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন, ইবরাহীমের মিল্লাত (আদর্শ), তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। বলুন, আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহরই জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আর আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং আমি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম’ (আল-আনআম, ৬/১৬১-১৬৩)।
তাই তো এই পথের উপর অবিচল থাকার এবং তার পথে জীবন পরিচালিত করার জন্য আমরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে পাঠ করি, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ। অতএব, কথা স্পষ্ট যে, আক্বীদার ক্ষেত্রে কখনও কোনো কিছুর সাথে আপস কিংবা কমতির কোনো সুযোগ নেই। বরং বিশুদ্ধ আক্বীদা, তাওহীদের আহ্বান চলবে মৃত্যু অবধি। যেহেতু এটাই হলো আল্লাহর মনোনীত দ্বীন, কল্যাণ এবং মুক্তির পথ, সেহেতু সেক্ষেত্রে কোনো কিছুর সাথে আপস গ্ৰহণযোগ্য নয়। দ্বীনে হানীফ মূলত এটাই। এখানে কোনো মূর্তি কিংবা খাম্বা, দেবদেবী কিংবা ছবি ও ভাস্কর্যের অনুসরণ, অনুকরণ, উপাসনা চলবে না। বলাও যাবে না, মানাও যাবে না। মক্কার কাফের-মুশরিকদের অভ্যাস ছিল মূর্তিকে ইলাহ হিসেবে গ্ৰহণ করার এবং তারা বিশ্বাস করত ফেরেশতাগণ আল্লাহর কন্যা। উযায়ের অথবা ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর পুত্র। এমন বিশ্বাস লালনের কারণে তারা সকলেই মুশরিক। তারা কেউই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর মিল্লাতের উপর সুদৃঢ় ছিল না। অথচ তারা দাবি করত মুখে।
এটাই ছিল দ্বীন। সেটাই হলো খালেছ দ্বীন ও আল্লাহর জন্য আমল। আর তিনিই এমন এক সত্তা, যিনি মনোনীত করেছেন নবী-রাসূল এবং তাদের জন্য এই দ্বীন মনোনীত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ ‘নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন’ (আলে ইমরান, ৩/১৯)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন,وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত’ (আলে ইমরান, ৩/৮৫)। তাই আমরা বলতে পারি, আক্বীদার ক্ষেত্রে এটাই হলো সবচেয়ে নির্ভেজাল খাঁটি তাওহীদ। নিশ্চয় আমার ছালাত, আমার দু‘আ, আমার কুরবানী, আমার ইবাদত এবং আমার জীবন, মরণ সকল কিছুই একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। একারণে আমি আদিষ্ট হয়েছি আর আমি আনুগত্যশীল, আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নকারী সর্বপ্রথম মুসলিম।[9]
অতএব, এটা চূড়ান্ত কথা যে ইসলাম তথা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যের পথই হলো ছিরাতুল মুস্তাক্বীমের পথ। আর যে তা গ্ৰহণ করবে, বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে, নিঃসন্দেহে সে ছিরাতুল মুস্তাক্বীমের পথের অনুগামী হবে। জান্নাতের পথ সহজ করবে। আর যারা ঈমান এনেছে মহান আল্লাহ ও তাঁর মনোনীত রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর, সেই সাথে তারা বিশুদ্ধ আক্বীদা বা তাওহীদের সাথে কোনোরূপ শিরকের সংমিশ্রণ ঘটায়নি, নিঃসন্দেহে তারাও সফলকাম হবে। তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়ার নিরাপত্তা এবং পরকালে রয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অফুরন্ত চক্ষুশীতলকারী নেয়ামত। তারা সেখানে কোনো প্রকার ভীত কিংবা চিন্তিতও হবে না।
এজন্য বিশুদ্ধ আক্বীদা বা তাওহীদের স্বীকৃতি দেওয়া একজন মুসলিম ও মুমিনের সফল জীবনের বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনী লক্ষ্য করুন! তিনি তাঁর গোটা নবুঅতী জীবনে তাওহীদের মিশন ও ভিশন নিয়ে কাজ করেছেন। তাওহীদের বিপ্লবে সমাজকে যাবতীয় শিরক আর চলমান কুসংস্কারকে তাওহীদের বাণীর উচ্চারণে ভেঙে খান খান করেছেন। তাওহীদের বাণী ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’-এর সামনে জাহেলী যুগের প্রতিষ্ঠিত চলমান শিরকী ও কুসংস্কারে ঘেরা সমাজ এবং সমাজের নেতা আবূ জাহল, আবূ লাহাব, উতবা টিকতে পারেনি। তারা ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে হারিয়েছে। তাদের ত্বাগূতী শক্তির বিনাশ হয়েছে শুধু তাওহীদের মর্মবাণী ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’-এর আওয়াজে। সেই লক্ষ্যে তিনি প্রত্যেক যুগেই নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন,وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ‘আর অবশ্যই আমরা প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছিলাম এ নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং ত্বাগূতকে বর্জন করো’ (আন-নাহল, ১৬/৩৬)।
(৩) অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনা:
অদৃশ্যের উপর ঈমান আনা মুমিন-মুত্তাক্বীদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা মুত্তাক্বী বান্দার পরিচয়ে বলেছেন,الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ ‘যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, ছালাত ক্বায়েম করে এবং তাদেরকে আমরা যা দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে’ (আল-বাক্বারা, ২/৩)।
এখানে গায়েব শব্দ দ্বারা আল্লাহর যাত, ছিফাত, জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর, পুলছিরাতসহ সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গায়েব বলতে যা মানুষের চর্মচক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্যের খবর বা বিষয়াদি, যা মানুষের পক্ষে জানা এবং অবলোকন করা সম্ভব নয়। বরং এর উপর ঈমান আনা সকল মুসলিমের উপর ওয়াজিব এবং সেইসাথে এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা বা একে অস্বীকার করা কুফরী। ঈমানের বিষয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে গায়েবের বিষয়ে ঈমান আনা সবচেয়ে সুন্দর ঈমান হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু (মুসতাদরাকে হাকেম, ২/২৬০)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনার সাথে জিহাদ করেছি, আমাদের থেকে উত্তম কি কেউ আছে? রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, তারা তোমাদের পরে এমন একটি জাতি, যারা আমাকে না দেখে আমার উপর ঈমান আনবে’ (সুনানে দারেমী, ২/৩০৮; মুসতাদরাকে হাকেম, ৪/৮৫)।
সর্বোপরি যখন ঈমানের বিষয়ে আলোচনা আসবে, তখন ঈমান বিল গায়েব তথা অদৃশ্যের উপর ঈমান আনার বিষয়টি খুব সহজেই চলে আসে। তাছাড়া ঈমানের ছয়টি রুকন মূলত এই ঈমানেরই অন্তর্ভুক্ত।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৩৫; মিশকাত, হা/৬২৫।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬২।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭৩৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৭; মিশকাত, হা/২২৮৭।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৭৪; মিশকাত, হা/৪৮১২।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০০৫।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৭২।
[7]. ইবনে বায, আল-আক্বীদাতুছ ছহীহা ওয়ামা ইউযাদ্দুহা, পৃ. ৩।
[8]. প্রাগুক্ত।
[9]. মুহাম্মাদ মাহমূদ আল-হিজাযী, আত-তাফসীরুল ওয়াযেহ, ১/৬৯০।