যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ পবিত্র ঈদুল আযহা। এটা মুসলিম সমাজে কুরবানীর ঈদ নামেও পরিচিত। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্ন নামে পরিচিত। ভারত ও পাকিস্তানে এটাকে ‘বকরা ঈদ’ বলা হয়ে থাকে। ইসলামের অন্যতম ইবাদত হলো এ কুরবানী। পূর্ববর্তী নবীগণের উপরও এ বিধান চালু ছিল। আল্লাহ বলেন,وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا ‘আমি প্রত্যেক জাতির উপর কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩৪)।
কুরবানীর ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, মানব ইতিহাসে প্রথম কুরবানী অনুষ্ঠিত হয়েছিল আদম আলাইহিস সালাম-এর পুত্র হাবীল ও কাবীলের মাধ্যমে। হাবীলের ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠার কারণে তার কুরবানী আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়েছিল। অপরদিকে কাবীলের অনাগ্রহ ও নিষ্ঠাহীনতার কারণে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল (আল-মায়েদা, ৫/২৭)। আর আজ থেকে ঠিক ৫ হাজার বছর আগের কথা। ইসলামে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। আল্লাহর পথে তাদের ত্যাগ এবং উৎসর্গ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সোনালি আবরণে রচিত আছে পিতা-পুত্রের নজিরবিহীন ঘটনা। এরশাদ হচ্ছে, فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ - وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ - قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ - إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ ‘আর যখন পিতা-পুত্র দুজনেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করল। জবাই করার জন্য পিতা যখন পুত্রকে উপুড় করে শোয়ালো। তখন আমি ডাকলাম, হে ইবরাহীম! নিশ্চয়ই তোমার স্বপ্নকে তুমি সত্যে পরিণত করেছো। আমি বিশিষ্ট বান্দাকে এরূপ পুরস্কার প্রদান করে থাকি। আর প্রকৃতপক্ষে এটা একটি বড় পরীক্ষা’ (আছ-ছফফাত, ৩৭/১০৩-১০৬)। পিতা কর্তৃক পুত্রকে জবেহ করার এ মর্মান্তিক দৃশ্যে বিস্মিত হচ্ছিল ধরণি। বিস্ময়ে প্রকম্পিত হচ্ছিল মহাশূন্য। রুদ্ধশ্বাসে প্রত্যক্ষ করছিল গোটা সৃষ্টিজগৎ। অহীভিত্তিক প্রামাণ্য এ ঘটনার কারণে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বিশ্বব্যাপী ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের কাছে তাই অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সনাতন ধর্মের অনুসারীরাও তাকে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে অনুসরণ করে থাকে। আর একারণে দেখা যায়, সব ধর্মের লোকেরা নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। যদিও সেটাকে কুরবানী বলা হয় না।
হিন্দু ধর্মের অর্থবেদ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আদিকালে ব্রহ্মার দুই পুত্র ছিল। ১. অথর্ব এবং ২. অঙ্গিরা। ব্রহ্মা ঐশী আদেশ মোতাবেক জ্যৈষ্ঠ পুত্র অথর্বকে বলি দিতে উদ্যত হন। শাস্ত্রে এটা পুরুষ মেধযজ্ঞ নামে পরিচিত। তারই ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি নরবলির জায়গায় পশুবলি দ্বারা উহা উদযাপিত হয়ে আসছে’।[1] আলোচ্য মন্ত্রে ব্যবহৃত ব্রহ্মা শব্দটি মূলত ইবরাহীম শব্দের পরিবর্তিত রূপ। যা হিন্দু ধর্মের সাহিত্য ও ধর্মীয় রচনাবলিতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।[2] আবার এটা ইয়াহূদী এবং খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মীয় সাহিত্যে আব্রাহাম ও ব্রাহাম ব্যবহার করে থাকে। মুসলিম বিশ্বে যিনি জাতির পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নামেই সমধিক পরিচিত। এ একই ধারাবাহিকতায় ইয়াহূদী ধর্মেও কুরবানী প্রথা প্রচলিত আছে। এ ধর্মে কয়েক ধরনের কুরবানী রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো : পোড়ানো কুরবানী, শস্য কুরবানী, গুনাহের কুরবানী, যোগাযোগ কুরবানী ও দোষের কুরবানী।[3]
খ্রিষ্টান ধর্মের কিতাবুল মুক্বাদ্দাসে উল্লেখ রয়েছে যে, ইউসুফ ও মারইয়াম আলাইহিমাস সালাম ঈসা মসীহ আলাইহিস সালাম-এর জন্মের সময় দুটি কবুতর কুরবানী করেছেন। সেই থেকে গ্রিসে পশু উৎসর্গ একটি কমন প্রথা হিসেবে প্রচলিত। সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে একেশ্বরবাদী অর্থোডক্স চার্চে বকরি ও মুরগি দেওয়া একটি প্রাচীন রীতি। এছাড়া খ্রিষ্টানতত্ত্বের কেন্দ্রে আত্ম বলিদান ও শহীদের ধারণা এখনও বিদ্যমান। আদিপুস্তক ১৪:১৮ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, ‘এই হচ্ছে আমার শরীর যা ঈশ্বরের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। আর এই হলো রক্ত যা পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা’। এছাড়া প্রাচীনকালে বিভিন্ন মহাদেশে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এবং বিভিন্ন ধর্মে বলিদান প্রথা প্রচলিত ছিল। নতুন মন্দির উদ্বোধন উপলক্ষ্যে প্রাচীনকালে নরবলি দেওয়া হতো। নতুন সেতু উদ্বোধনের সময় নরবলি দেওয়া হতো। কোনো রাজা বা পুরোহিত মৃত্যুবরণ করলে নরবলি দেওয়ার প্রথা চালু ছিল। তারা মনে করত, বলিদানকৃত এই লোকটি রাজার সেবা করবে। ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঈশ্বরের অসন্তোষের কারণ’ মনে করে ঈশ্বরকে খুশি করতে তারা নরবলি প্রদান করত। প্রাচীন কলম্বিয়া সভ্যতায় প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় একটি করে নরবলি দেওয়া হতো। মেক্সিকোতে স্প্যানিশ আক্রমণ ঠেকাতে একাধিক বন্দীকে বলি দেওয়া হতো। বর্তমান পৃথিবীর কোনো দেশই বলিদানকে সমর্থন করে না। প্রতিটি দেশ এ বলিদান প্রথাকে অপরাধ মনে করে। তারপরেও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ধর্মে গোপনীয়ভাবে এ প্রথা এখনও চালু রেখেছে।[4] প্রাচীন মানুষেরা পশুর মাংস ও দুধ খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করত। পশুর চামড়া বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। আর হাড় ব্যবহার করত হাতিয়ার হিসেবে। পশু হত্যার এ সংস্কৃতি নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ডে চালু ছিল না। যেখানে জনবসতি ছিল, সেখানেই এই সংস্কৃতি চালু ছিল। এটা যেমন চালু ছিল বরফে ঢাকা হিমাচলে, ঠিক তেমনি সবুজে ঘেরা বনাঞ্চলেও।
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যায়, কুরবানীর ইতিহাস অতি প্রাচীন। এটা যেমন একেশ্বরবাদী ধর্মে প্রচলন আছে। তেমনি প্রচলন আছে, বহু ঈশ্বরবাদী ধর্মেও। তবে ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মে কুরবানীর ব্যাপারে পদ্ধতি ও বিশ্বাসগত দিক দিয়ে পার্থক্য রয়েছে। নেপালিরা দেবী গাধিমাইকে খুশি করার জন্য হাজার হাজার পশুবলি দেয়। নেপালে প্রতি পাঁচ বছরে দুদিন ধরে ‘গড়িমাই’ উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। এ দুদিনে তারা ৫ লক্ষ গরুবলি দিয়ে থাকে। গরু ছাড়াও প্রতি উৎসবে তারা ৬ থেকে ৮ হাজার মহিষ নির্বিচারে হত্যা করে। এসব পশুকে তারা এলোপাথাড়ি কুপিয়ে উৎসব পালন করে থাকে। এমনও দেখা গেছে যে, পশুটি হাঁটছে আর তার মাথা দেহ থেকে ঝুলছে। আর মানুষেরা নৃত্য ও উল্লাস করছে।[5] পশুর সাথে এ জাতীয় আচরণকে কুরবানী বা বলি কোনোটাই বলা যায় না। এটা প্রাণির সাথে জঘন্য ও নিষ্ঠুর আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইসলামী পরিভাষায় কুরবানী অর্থ হলো sacrifice বা ত্যাগ স্বীকার করা। এর আরেকটি অর্থ নৈকট্য লাভ। আর এ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই কেবল আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। এর আরেকটি অর্থ নৈকট্য লাভ। আর এ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই কেবল আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। আর ত্যাগের ধারণাটা জগৎ সংসারের সব জায়গাতেই বিদ্যমান। স্বামী-স্ত্রীতে ত্যাগের মানসিকতা না থাকলে সংসার থাকে না। ব্যবসাবাণিজ্যে ত্যাগ না থাকলে ব্যবসায় উন্নতি আসে না। রাজনীতিতে ত্যাগী নেতা না থাকলে দল সেখানে অচল। অফিসে ত্যাগ না থাকলে ভালো এসিআর পাওয়া যায় না। বসের সান্নিধ্য পেতে ত্যাগের বিকল্প আর কিছুই হয় না। পার্থিব এ দুনিয়াতে কর্মচারীরা ত্যাগের বিনিময়ে নেতা ও বসের নৈকট্য লাভ করে থাকে। অর্থাৎ পৃথিবীতে ত্যাগ স্বীকারের মানদণ্ডেই মানুষকে মূল্যায়ন করা হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কটাও ত্যাগের মাধ্যমেই নির্মিত ও নির্ণীত হয়। আল্লাহর হুকুম পালন করতে যেমন প্রয়োজন ত্যাগ। আবার নিষেধ বর্জন করতেও প্রয়োজন ত্যাগ। মুসলিম হওয়ার অন্যতম শর্ত ছালাত আদায়। আরামের ঘুম ত্যাগ না করে শীত-গ্রীষ্মের ফজরের ছালাত আদায় করা যায় না। যাকাত এবং হজ্জ আদায় করতে প্রয়োজন মানসিক, শারীরিক এবং অর্থনৈতিক ত্যাগ। আল্লাহর কাছে যে যত বেশি প্রিয়, তাকে তত বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সার্বক্ষণিকই আল্লাহর গোলাম ও প্রতিনিধি। আর পৃথিবীর প্রথম প্রতিনিধি হচ্ছেন আদম আলাইহিস সালাম। আর নবী ও রাসূলের মধ্যে সর্বশেষ প্রতিনিধি মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর পর তাঁর উম্মতগণের উপর এ প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যত প্রতিনিধি প্রেরিত হয়েছেন, তাদের সকলকেই আল্লাহ পরীক্ষা নিয়েছেন। অথচ তাঁরা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ও নির্বাচিত বান্দা। ছিলেন সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। অথচ তাদেরকেই না আল্লাহ সব ধরনের পরীক্ষা নিয়েছেন। খাদ্য সংকটের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়েছেন। রোগ-শোক দ্বারা পরীক্ষা নিয়েছেন। জানমালের ক্ষতির সম্মুখীনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়েছেন। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে পরীক্ষা নিয়েছেন! যালেম রাজারা তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে তাদেরকে অভিযুক্ত করেছে। অনেক নবীকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারে বন্দী করা হয়েছে। দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। আর এমনই এক অত্যাচারী রাজা ছিল নমরূদ। আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে সে জন্ম নিয়েছিল ইরাকে। আর নমরূদের প্রধান পুরোহিত ছিল আযর এবং এই আযরের ঔরসেই জন্ম নিয়েছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। তিনি চারিদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মূর্তিপূজার উৎসব দেখতে পেলেন। এর অসারতা প্রমাণের জন্য একদিন তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। অতঃপর মূর্তিগুলো ভেঙে দিলেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বিচার হলো। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাকে দেওয়া হলো মৃত্যুদণ্ড। জনসম্মুখে তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে যেন এ জাতীয় আচরণ করার সাহস কেউ না দেখাতে পারে। আল্লাহর প্রতি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বিধাহীন বিশ্বাস, আনুগত্য আর ত্যাগ তাকে আগুন থেকে রক্ষা করল। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার জাতির হেদায়াত প্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনা দেখলেন না। তাই তিনি অজানা গন্তব্যে রওনা দিলেন। অথচ তার কাছে নেই কোনো পয়সা-কড়ি। নেই আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো ঠিকানা। আর রূযী-রুটির তো কোনো চিন্তাই ছিল না। কেবলই আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং ভরসা ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। এটা ছিল তাঁর জীবনের প্রথম পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন। ৮৬ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয় পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি হন পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর বাবা। নির্দেশ আসে দুগ্ধপোষ্য এ ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও স্ত্রী হাজেরাকে নির্জন স্থানে রেখে আসার। এ পরীক্ষায়ও তিনি পাস করেন। পুত্র ইসমাঈল দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হলেন। অতঃপর নির্দেশ আসে তাকে কুরবানী করার। বাবা ছেলেকে নির্দেশের কথা অবহিত করেন। ছেলের সোজা জবাব, يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ‘আব্বা! আপনি তাই করুন, যা করতে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন’ (আছ-ছফফাত, ৩৭/১০২)।
উল্লেখিত ঘটনা প্রমাণ করে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর প্রেরিত একজন বান্দা, নবী, রাসূল ও তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধি। সর্বপ্রথম তিনি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছেন। নিজের রুটি-রূযীর চিন্তাকে পরিহার করে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করেছেন। আল্লাহর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের সন্তান এবং স্ত্রীর প্রতি মায়া ও ভালোবাসা ত্যাগ করেছেন। আর এভাবে বিশ্বব্যাপী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর উপর ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর যেহেতু তিনি অনেক বড় ত্যাগ করেছেন, সেহেতু তিনি অনেক বড় পুরস্কারও পেয়েছেন। তাকে মুসলিম মিল্লাতের পিতা ঘোষণা করা হয়েছে। কা‘বায় ইবরাহীমী পরিবারের স্মৃতি সংরক্ষিত ও সম্পৃক্ত রাখা হয়েছে। সরকারিভাবে তার অনেক স্মৃতি এখানে সুরক্ষিত রয়েছে। যা হজ্জের অনুষ্ঠানাবলির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। হজ্জের সময় হাজীগণ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পরিবারের স্মৃতিকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। হাজীগণ মাক্বামে ইবরাহীমে ছালাত আদায় করেন। ছাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাঈ করেন। যমযম কূপের পানি পান করেন। মিনায় কুরবানী করেন। আর ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর স্মৃতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ ও বরণ করেই যাবেন। হাজীগণ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর এ স্মৃতিকে বুকে ধারণ ও লালন করবেন। এ স্মৃতি লালন ও পালনের মাধ্যমে তারা লাভ করবেন এক বেহেশতী প্রেরণা। আর তাইতো শেষ নবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাতের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ঈদের দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই’।[6] ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করবে না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে’।[7]
কুরবানীদাতা কুরবানীর সময় নিম্নোক্ত ঘোষণা দিয়েই কুরবানী শুরু করেন,إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘আমার ছালাত, আমার যাবতীয় ইবাদত, অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু কেবল আল্লাহর জন্য’ (আল-আনআম, ৬/১৬২)। অন্যান্য ধর্ম এবং সংস্কৃতির সাথে ইসলামে কুরবানীর এটাই হলো মৌলিক পার্থক্য। মুসলিমদেরকে এ পার্থক্য এটাই শেখায় যে, সে মূলত তাঁর নয়, আমি মূলত আমার নই। আমার পরিবারেরও নই এবং জাতিরও নই। সবাই মূলত একান্তভাবে শুধু আল্লাহর। অর্থাৎ মুসলিমদের বেঁচে থাকাটা হবে কেবল আল্লাহর জন্য। আবার মৃত্যুটাও হবে শুধু তাঁরই জন্য। আর পৃথিবীতে তারা ব্যক্তি, পরিবার, আত্মীয় কিংবা দেশের জন্য যা করবে, সেটা হবে আল্লাহর বিধান ও তার আদেশ মোতাবেক। এটাই মূলত কুরবানীর শিক্ষা।
ড. মো. কামরুজ্জামান
অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[1]. অথর্ববেদ, দশম কান্ড, ২৬-৩৩ মন্ত্র।
[2]. rumuj.blogpost.
[3]. লেবীয় পুস্তক, ২৩:১৩, ৭:৩১, ৫:১৬, ১৬:১২ ও ২:১২-১৬।
[4]. উইকিপিডিয়া, ১৫ জুলাই, ২০২১।
[5]. epotrika.com, 15 july, 2021.
[6]. তিরমিযী, হা/১৪৯৩, ছহীহ।
[7]. ইবনু মাজাহ, হা/৩১২৩, হাসান।