[১]
আমাদের দেশে ইসলামবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা মোটাদাগে তিন প্রকার ইসলামপন্থী দেখতে পাই।
(ক) সরাসরি বিরোধিতাকারী: এদলের লোক কথায় কিংবা সামর্থ্যানুযায়ী কাজের দ্বারা ইসলামের পক্ষে ও ইসলামবিদ্বেষীদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। কোনো সন্দেহ নেই, এরাই আপাত দৃষ্টিতে আমাদের নাজাতপ্রাপ্ত দল।
(খ) নীরব দর্শক: নিজে ইসলাম ভালোবাসেন, কিন্তু পার্থিব বা যে-কোনো স্বার্থে কিংবা ভয়ে নিশ্চুপ থাকেন। এদের ব্যাপারে নাজাতের আশা কম। যদি আল্লাহ অপার মেহেরবাণীতে ক্ষমা করে দেন, সেটা ভিন্ন কথা।
(গ) কৌশল অবলম্বনকারী: আমাদের অনেক বড় আলেমগণই এরূপ কৌশল অবলম্বনের ফাঁদে পড়েছেন। আজকে এ দলকে নিয়েই দু-একটি কথা বলতে চাই।
[২]
আমাদের অনেকে আছেন, তারা মনে করেন, ইসলামবিদ্বেষের এ সময়ে নিজের অবস্থান ধরে রেখে ইসলামের জন্য যতটুকু করা যায়, ততই ভালো। এরা বিদ্বেষীদের (সুশীল, মিডিয়া বা ক্ষমতার) বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেন না; না কথায়, না কাজে। তারা অনেকটা সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেম চেঞ্জ করতে আগ্রহী। এটাই তাদের ইজতিহাদ।
তাদের এ ধরনের চিন্তাভাবনা ভালো। কেননা দ্বীনের স্বার্থে ইজতিহাদও প্রতিদানযোগ্য। তবে সমস্যা হলো এ ইজতিহাদ কি সঠিক? এটি কি ইসলামপন্থার সহায়ক, না-কি আখেরে ক্ষতিকর।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, কৌশল অবলম্বনের ইজতিহাদ সম্ভবত আমাদের বাংলাদেশের ইসলামপন্থার জন্য ক্ষতিকর। কেননা প্রায় ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে বিদ্বেষীদের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করা আর ইসলামকে নির্বাসনে দেওয়া একই কথা; কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
[৩]
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কথাই বলি। বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি, একটু একটু করে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামকে দূর করে সেক্যুলার শিক্ষা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের তৃতীয় দলের ভাইগণ, সরাসরি বিরোধিতার শক্ত অবস্থানে না গিয়ে কম্প্রোমাইজ করে বিভিন্ন ইস্যুর সমাধান চেয়েছেন। তাতে হয়তো সাময়িক সে সমস্যার সমাধান হয়েছে; কিন্তু পরের বছর আবার নতুন আরো অনেক সমস্যার জন্ম নিয়েছে।
আবার এসব ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যার সমাধান করে তুলনামূলক অন্য গৌণ সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। অথচ আপাত এসব গৌণ সমস্যাই ঐ সময়ে উত্থিত না হলে বা বড় সমস্যার সাথে না আসলে বিরোধিতার মুখে পড়ত। বড় একটা সমস্যার সাথে এসে, সে গৌণ সমস্যা কিন্তু পাকাপোক্তভাবে স্থান গেড়ে নেয়। অথচ আমাদের তৃতীয় দলের ভাইগণ, একটি বড় সমস্যার সমাধান করেই তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন।
তারা ভুলে যান, সেক্যুলারিজম কোনো মুসলিমপ্রধান দেশে একবারে ঢুকে না। অল্প অল্প করে আসে। সেটাই হচ্ছে এদেশে। আর আমাদের তৃতীয় ভাইগণ এটারই সহযোগী, অথচ তারা বুঝতেই পারছেন না। সেক্যুলারিজম কখনোই বলবে না, ইসলাম শিক্ষা বাদ, কিংবা ছালাত অধ্যায় বাদ দিয়ে ব্যায়াম বা অন্য কিছু দিয়ে দেন। তাদের লক্ষ্য প্রথমে ইসলামের বিশ্বাস ও বিধানের মূল উদ্দেশ্য বিকৃতিকরণ, তারপর ধীরে ধীরে অন্য কিছু ঢোকানো; তা হতে পারে, একটি অধ্যায় বা মাত্র একটি লাইন।
একসাথে পরিবর্তন আনতে চাইলে যে মুসলিম জনতার প্রতিবাদে তাদের মূল প্রকল্প সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে, তা সেক্যুলাররা ভালো করেই জানে। এমতাবস্থায় একটু একটু করে পরিবর্তনে আমাদের তৃতীয় দল নিজের অজান্তেই কিন্তু তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।
[৪]
প্রিয় পাঠক, তৃতীয় দল প্রসঙ্গে এখানেই আমার আপত্তি। কৌশল অবলম্বন আমাদের দেশের জন্য নয়। এটা সে স্থানের জন্য প্রযোজ্য, যেখানে মুসলিমরা নিগৃহীত বা সংখ্যায় কম। ফলে আস্তে আস্তে জায়গা নেওয়ার স্বার্থে নানা স্থানে কম্প্রোমাইজ করে কিছু কিছু করে ইসলামের বিধান ও বিশ্বাস ঢুকানোর কাজ করা যেতে পারে।
আর আমাদের দেশে যেখানে ইসলামী বিশ্বাস, ইবাদত ও মূল্যবোধ ভালোভাবেই প্রোথিত, সেখানে কম্প্রোমাইজ করা মানে আস্তে আস্তে ইসলামকে নির্বাসনে দিয়ে অন্যকে জায়গা করে দেওয়া। ফলে তৃতীয় দলের এ ইজতিহাদ যে আদতে বুমেরাং তা বলে দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার হয় না।
[৫]
তৃতীয় দলের এরূপ ভূমিকায় ইসলামপন্থার ক্ষতি বহুবিধ। আমার মতে, দ্বিতীয় দলের চাইতেও তৃতীয় দল ইসলামপন্থার জন্য বেশি ক্ষতিকারক। হয়তো দু-একটি ব্যতিক্রম আছে, তবে মোটাদাগে তা নিফাক্বের মতোই কুফরের চাইতে বেশি ক্ষতিকর। কেননা তৃতীয় দলের কাজের ফলে—
- সাধারণ লোকজন বিভ্রান্ত হয়। তারা বিরোধিতার চাইতে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কৌশল অবলম্বনকেই বেছে নেয়।
- প্রথম দলের লোকদের জন্য অন্যকে বুঝানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে উলামায়ে কেরামের মধ্যে ইখতিলাফ/ইফতিরাক্ব সৃষ্টি হয়।
- প্রথম দলের লোকদের মৌলবাদী বা জঙ্গি ইত্যাদি নামে চাপে রাখা হয়।
- দ্বিতীয় দলের লোকজনও প্রকৃত ইসলামের চেতনা খুঁজে পান না।
এখন আমাদের এসব তৃতীয় দলের ভাইগণ কবে তাদের এ অবস্থান বুঝতে পারবেন আর তার সংশোধন করতে পারবেন সে অপেক্ষা। আমরা দু‘আ করি তারাও যেন ইসলামের জন্য কাজের ক্ষেত্রে নিজেদের নেক নিয়্যতকে সঠিক পন্থায় কাজে লাগান; যে পন্থায় ইসলামবিরোধীদের উপকার হয়, সে পন্থায় নয়। এ উপলব্ধি যত শীঘ্র আসবে ততই মঙ্গল।
মুস্তফা মনজুর
সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।