কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসলাম নারীশিক্ষার পথে অন্তরায় নয়

post title will place here

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যে ব্যক্তির অন্তর আছে, অন্তঃকরণ নেই অথবা ভালোমন্দ বুঝার সক্ষমতা নেই, সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে না। তেমনিভাবে যে দেশে এমন একটি জাতি আছে, যাদের শিক্ষা নেই, সে দেশ কখনো উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। একটি জাতির উন্নতির জন্য শিক্ষা অত্যাবশ্যকীয়। এজন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করলেন, তখন মদীনাবাসীর শিক্ষার প্রতি খুবই গুরুত্বারোপ করেন। এমনকি মদীনার শিশুদের পড়ালেখা শেখানোকে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণ হিসেবে নির্ধারণ করেন।

তবে হ্যাঁ, সে শিক্ষা অবশ্যই হতে হবে সুশিক্ষা। যা মানুষকে প্রকৃত অর্থেই মানুষ বানায়, ভিতর থেকে দূর করে পশুত্ব; শিক্ষা দেয় আল্লাহর পরিচয়, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিচয়। যা ইসলাম, আদব-শিষ্টাচার, হারামকে হারাম এবং হালালকে হালাল হিসেবে চেনার পথ বাতলে দেয়।

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকে বিশেষ করে যারা সারাক্ষণ নারীর স্বাধীনতার বুলি আওড়িয়ে পরিবেশ গরম রাখে, তারা মনে করে ও দাবি করে, ইসলাম নারীশিক্ষার পথে অন্তরায়, ইসলাম তাদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে ঘরবন্দি করে রেখেছে এবং তাদের শিক্ষার অধিকার হরণ করেছে (!)। তাদের এ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অমূলক। কেননা ইসলাম সম্পূর্ণভাবে নারীশিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করেছে। যেমন আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বলেন,قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (আয-যুমার, ৩৯/৯)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, قُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا ‘বলুন, হে আমার রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন’ (ত্ব-হা, ২০/১১৪)

এছাড়াও আরো অনেক আয়াত রয়েছে, যাতে ‘আমভাবে (অর্থাৎ কাউকে নির্ধারণ না করে) জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সবাই সমান। এছাড়া বহু হাদীছ আছে, যা নারীশিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করে। সেখান থেকে কয়েকটি উল্লেখ করার প্রয়োজনবোধ করছি। যেমন—

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য দিন নির্ধারণ করেছিলেন এবং সে নির্ধারিত দিনে তিনি তাদের শিক্ষা দিতেন।

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَتِ النِّسَاءُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَلَبَنَا عَلَيْكَ الرِّجَالُ فَاجْعَلْ لَنَا يَوْمًا مِنْ نَفْسِكَ فَوَعَدَهُنَّ يَوْمًا لَقِيَهُنَّ فِيهِ فَوَعَظَهُنَّ وَأَمَرَهُنَّ.

আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একবার) নারীগণ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, পুরুষেরা আপনার নিকট থেকে আমাদের চেয়ে বেশি উপকার গ্রহণ করছে। তাই আপনি নিজে আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারিত করে দিন। তিনি তাদের বিশেষ একটি দিনের অঙ্গীকার করলেন, সেদিন তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, তাদের নছীহত করলেন এবং নির্দেশ দিলেন’।[1]

عَنْ زَيْنَبَ بِنْتِ أُمِّ سَلَمَةَ عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ أَنَّ أُمَّ سُلَيْمٍ قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ اللهَ لاَ يَسْتَحِي مِنَ الْحَقِّ هَلْ عَلَى الْمَرْأَةِ غُسْلٌ إِذَا احْتَلَمَتْ قَالَ نَعَمْ إِذَا رَأَتِ الْمَاءَ‏‏.‏

উম্মুল মুমিনীন উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, উম্মু সুলাইম নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! হক্ব কথা বলতে আল্লাহ তাআলা লজ্জাবোধ করেন না। অতএব, কোনো নারীর পুরুষদের মতো স্বপ্নদোষ হলে তাতে কি গোসল করতে হবে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, যখন সে পানির (বীর্যপাতের) চিহ্ন দেখতে পায়, তখন যেন গোসল করে নেয়’।[2]

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ قَالَتْ فَاطِمَةُ بِنْتُ أَبِي حُبَيْشٍ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي لاَ أَطْهُرُ أَفَأَدَعُ الصَّلاَةَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّمَا ذَلِكِ عِرْقٌ وَلَيْسَ بِالْحَيْضَةِ فَإِذَا أَقْبَلَتِ الْحَيْضَةُ فَاتْرُكِي الصَّلاَةَ فَإِذَا ذَهَبَ قَدْرُهَا فَاغْسِلِي عَنْكِ الدَّمَ وَصَلِّي‏‏.

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ হুবায়শের কন্যা ফাতেমা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি (একজন ইসতিহাযার রোগী), আমি পবিত্র হই না। তাহলে আমি ছালাত ছেড়ে দিব কি? তিনি বললেন, ‘না, এটা শিরার রক্ত; হায়েয নয়। যখন হায়েয শুরু হবে, ছালাত ছেড়ে দিবে। যখন হায়েযের সময়সীমা শেষ হবে, তোমার শরীর হতে রক্ত ধুয়ে ফেলবে (গোসল করে নেবে) এবং ছালাত আদায় করবে’।[3]

উপর্যুক্ত আয়াতদ্বয় ও হাদীছগুলো থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, ইসলাম নারীশিক্ষার প্রতি যথেষ্ট উৎসাহ প্রদান করেছে, গুরুত্ব প্রদান করেছে। এমনকি এটাকে ওয়াজিব (আবশ্যক) বলেছে। এ ব্যাপারে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয’।[4]

ইমাম ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন,اَلْمَرْأَةُ شَخْصٌ مُكَلَّفٌ كَالرَّجُلِ فَيَجِبُ عَلَيْهَا طَلَبُ عِلْمِ الْوَاجِبَاتِ عَلَيْهَا لِتَكُوْنَ مِنْ أَدَائِهَا عَلَى يَقِيْنٍ অর্থাৎ ‘পুরুষের ন্যায় নারীর ওপর শারঈ বিধান প্রযোজ্য। তাই নারীর ওপর যেসব বিষয় ওয়াজিব, সেসব বিষয়ের জ্ঞানার্জন করাও তাদের ওপর ওয়াজিব। যাতে সে শারঈ বিধানাবলি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে আদায় করতে পারে’।[5]

শুধু তাই নয়, বরং ইসলাম কিছু শর্তসাপেক্ষে ও আদব রক্ষা করে বাড়ির বাইরেও শিক্ষার্জনের অভিপ্রায়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। যেমনটি উপরিউক্ত হাদীছগুলো থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। তবে হ্যাঁ, ইসলাম নারীদের জ্ঞানার্জনের জন্য গাইডলাইন হিসেবে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যেমনভাবে পুরুষের ক্ষেত্রেও আরোপ করেছে। কেননা ইসলাম শান্তির ধর্ম; তা কখনো নগ্নতা, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার অনুমতি দেয় না। তাই এখানে নারীদের জ্ঞানার্জনের কতিপয় শর্ত ও আদব উল্লেখ করা হলো-

(১) ছেলে ও মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশ থাকা। ছেলে-মেয়ে একাকার না হয়ে হয়ে যাওয়া। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلاَّ كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ‏ ‘সাবধান! কোনো পুরুষ কোনো মহিলার সাথে নির্জনে মিলিত হলে সেখানে অবশ্যই তৃতীয়জন হিসেবে শয়তান অবস্থান করে (এবং পাপাচারে প্ররোচনা দেয়)’।[6]

(২) মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ পরিবেশ থাকা।

(৩) সফরের দূরত্বে পড়াশুনা করতে গেলে সাথে মাহরাম পুরুষ থাকা। রাসূলুল্লাহ বলেন, وَلَا تُسَافِرُ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ ‘কোনো মহিলা যেন তার মাহরাম ব্যতীত একাকী সফরে না যায়’।[7]

(৪) চক্ষু অবনত রাখা। পর্দা ও শারঈ বেশভূষা ধারণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ ‘আর ঈমানদার নারীদেরকে বলে দিন, তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে, তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে আর তাদের শোভা-সৌন্দর্য প্রকাশ না করতে যা এমনিতেই প্রকাশিত হয় তা ব্যতীত। তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়’ (আন-নূর, ২৪/৩১)

(৫) সৌন্দর্য প্রদর্শন না করা। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى ‘আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে; প্রাচীন জাহেলী যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না’ (আল-আহযাব, ৩৩/৩৩)

(৬) সুগন্ধি বা আতর ব্যবহার না করা। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নারীরা যখন সুগন্ধি লাগিয়ে জনসমাজকে এর গন্ধ বিলানোর জন্য তাদের পাশ দিয়ে যাতায়াত করে, সে তখন এরূপ এরূপ’। একথা বলে তিনি একটি কঠোর মন্তব্য করেন।[8]

শেষ কথা হলো, বিশ্বাস করো বোন! যারা সারাক্ষণ নারী স্বাধীনতার বুলি আওড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তারা আসলে তোমাদেরকে মাঝপথে বেপর্দা করে ছাড়বে। তারা যেমন পরপুরুষের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে চলছে, তোমাদেরকেও তাদের মতো লজ্জাহীন করে ছাড়বে। তাই এখনই সাবধান হও! তাদের কথায় কান দিয়ো না। তাদের সাজানো-গোছানো মিষ্টি কথায় প্রতারিত হয়ো না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিকটা বুঝার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

কুল্লিয়া ১ম বর্ষ, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১০১।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৯১, ৬১২১; তিরমিযী, হা/১২২; ছহীহ মুসলিম, হা/৩১৩; নাসাঈ, হা/১৯৭; ইবনু মাজাহ, হা/৬০০।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০৬।

[4]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪।

[5]. ইমাম ইবনুল জাওযী, আহকামুন নিসা, পৃ. ৭।

[6]. তিরমিযী, হা/২১৬৫, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/৩১১৮।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪১।

[8]. আবূ দাঊদ, হা/৪১৭৩, হাসান।

Magazine