কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সমকামিতা: ইতিহাস ও পরিণতি

post title will place here

সমকামিতা হলো সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ অথবা যৌন আচরণ। মোটাদাগে বললে পুরুষে পুরুষে অথবা নারীতে নারীতে যৌনকর্ম সম্পাদনকে সমকামিতা বলে। সমকামিতাকে ইংরেজিতে বলা হয় হোমোসেক্সুয়ালিটি (Homosexuality)। আরবী ভাষায় বলা হয় লিওয়াতাহ (لِوَاطَةٌ)। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম অপরাধের একটি। এটি একটি নিকৃষ্ট ও বিকৃত যৌনাচার। যারা মানবতাবিধ্বংসী এই ঘৃণ্য অপরাধে জড়িত, তাদেরকে বলা হয় সমকামী। লূত আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ের মাঝে সর্বপ্রথম এই নিকৃষ্টতম কাজটির প্রচলন হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জর্দানের যে অঞ্চলে বর্তমান মৃত সাগর বা লূত সাগর অবস্থিত, ওখানেই সাদুম ও আমুরা গোত্রদ্বয়ের বসতি ছিল। এখানকার অধিবাসীরা ছিল দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাপাসক্ত, সংকীর্ণমনা ও কাফের। তারা দস্যুবৃত্তি করত। প্রকাশ্যে অশ্লীল ও বেহায়াপনার কাজ করত। কোনো পাপ থেকেই তারা বিরত থাকত না। তারা সমকামিতার মতো অশ্লীল কাজের জন্ম দেয়, তাদের পূর্বে কোনো আদমসন্তান এ কাজ করেনি। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ছিনতাই, লুটতরাজ ও প্রতারণা। দৃষ্টান্তমূলক শান্তি দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন। বর্তমান ‘ডেড সি’ বা ‘মৃত সাগর’ সমকামী লূত সম্প্রদায়ের ধ্বংসের স্মারক হয়ে আছে।

সমকামিতার ইতিহাস সম্পর্কে ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, তাদের আবাসিক এলাকায় এবং পথের ধারে তাদের ফলের বাগান ছিল। দুর্ভিক্ষের সময় তারা ভাবল, পথের পাশের বাগানগুলোর ফল পথিক-মুসাফিরকে খেতে নিষেধ করলে তা দিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করা যেত। তারা একটি কৌশল অবলম্বন করল। অপরিচিত কোনো বিদেশী তাদের জনবসতিতে এলে তার মালপত্র লুট করবে এবং তাদের সাথে কুকর্মে লিপ্ত হবে। এরূপ করলে লোকেরা আর তাদের এলাকা দিয়ে যাতায়াত করবে না। তাতে তাদের পথের ধারের বাগানের ফল রক্ষা পাবে। এরপর নিকটস্থ পাহাড় থেকে সুদর্শন ও সুশ্রী যুবকের বেশে শয়তান পথিক সেজে তাদের কাছে এলো। তারা তাকে দেখামাত্র তার দিকে ধাবিত হয়ে তার সাথে কুকর্ম করল এবং তার সর্বস্ব লুট করে নিল। এরপর সে চলে গেল। এরপর থেকে কোনো আগন্তুকের আবির্ভাব হলে তারা তার সাথে একই কদর্য আচরণ করত। এক পর্যায়ে এ জঘন্য পাপাচার তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল।

সমকামী লূত জাতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত এসেছে। যেমন, ‘লূতের কথা স্মরণ করো! যখন তিনি তার ক্বওমকে বলেছিলেন, তোমরা জেনেশুনে কেনো অশ্লীল কাজ করছ? অথচ তোমরা এর পরিণতি সম্পর্কে অবগত। তোমরা কি যৌনতৃপ্তির জন্য নারীকে ছেড়ে পুরুষে উপগত হবে? তোমরা তো এক মূর্খ জনগোষ্ঠী’ (আন-নামল, ২৭/৫৪-৫৫)। ‘আর লূত। তিনি তার ক্বওমকে বলেছিলেন, তোমরা এমন পাপাচারে লিপ্ত, যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেউ করেনি; তোমরা তো যৌনলালসা পূরণের জন্য নারীদের ছেড়ে পুরুষের কাছে গমন করো। নিশ্চয়ই তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী জনগোষ্ঠী’ (আল-রাফ, /৮০-৮১)। ‘লূতের জনগোষ্ঠী রাসূলগণকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করেছিল। যখন ওদের ভাই লূত ওদেরকে বললেন, তোমরা কি সাবধান হবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না। আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের কাছে। সকল সৃষ্টির মধ্যে তোমরাই কেবল পুরুষদের কাছে উপগত হও এবং তোমাদের রব তোমাদের জন্য যে দাম্পত্যসাথী সৃষ্টি করেছেন, তাদেরকে তোমরা পরিত্যাগ করে থাকো। স্পষ্টতই তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী জনগোষ্ঠী’ (আশ-শুআরা, ২৬/১৬০-১৬৬)

কিন্তু দুর্ভাগা জাতির একজনও লূত আলাইহিস সালাম-এর আহ্বানে সাড়া দেয়নি এবং তার ওপর ঈমান আনেনি। বরং তারা তাদের ভ্রান্তি, বিদ্রোহ, পাপ ও কুফরের প্রতি অবিচল থেকে যায়। এমনকি তারা তাদের রাসূলকে সমাজ থেকে বের করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। আল-কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উত্তরে তার জনগণ শুধু বলল, এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক, যারা বেশি পবিত্র হতে চায়’ (আল-রাফ, /৮১; আন-নামল, ২৭/৫৬)। ‘উত্তরে তার জনগণ শুধু বলল, লূত পরিবারকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক, যারা পবিত্র থাকতে চায়’ (আন-নামল,২৭/৫৬)। এখানেই শেষ নয় এই সমকামী সম্প্রদায় স্বয়ং লূত আলাইহিস সালাম-কে হুমকি দিয়ে বলেছিল, ‘হে লূত! তুমি যদি নিবৃত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হবে’ (আশ-শুআরা, ২৬/১৬৭)

লূত আলাইহিস সালাম-কে তারা শুধু বহিষ্কারের হুমকিই দেয়নি, সাথে সাথে তারা আল্লাহর শাস্তি নিয়ে আসার জন্য তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর লূত, যখন তিনি তার ক্বওমকে বলেছিলেন, তোমরা তো সুস্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত। তোমাদের আগে বিশ্বে কেউ এরকমটা করেনি। তোমরাই কি? তোমরা তো পুরুষদের কাছে উপগত হও, পথে পথে ছিনতাই করো এবং তোমাদের সভার মধ্যে জঘন্যকর্মে লিপ্ত হও। তখন তার ক্বওমের উত্তর ছিল কেবল একটি। তারা বলেছিল, যদি তুমি সত্যবাদী হও, আমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নিয়ে এসো’ (আল-আনকাবূ, ২৯/২৮-২৯)। এরপর লূত আলাইহিস সালাম এ অবাধ্য জাতির বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে বলেন, ‘হে আমার রব! বিপর্যয় সৃষ্টিকারী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৩০)

অবশেষে আল্লাহ তাআলা লূত আলাইহিস সালাম-এর দু‘আ কবুল করেন। ফেরেশতাদের পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করেন। আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তিনজন সিনিয়র ফেরেশেতা জিবরীল, মীকাঈল ও ইসরাফীল আলাইহিমুস সালাম প্রথমে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর কাছে মেহমান বেশে আগমন করেন। তারা লূত আলাইহিস সালাম-এর সাথে তার কৃষিভূমিতে কর্মরত অবস্থায় সাক্ষাৎ করলেন এবং তার বাড়িতে মেহমান হওয়ার আবেদন জানালেন। তিনি তাদের সম্পর্কে চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেও তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে লজ্জাবোধ করলেন । এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতারা লূতের কাছে এলেন, তিনি তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হলেন, নিজেকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করলেন এবং বললেন, এটি অবশ্যই একটি সঙ্কটময় দিন’ (হূ, ১১/৭৭)

যাহোক, তিনি সেখান থেকে তাদেরকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন ও তাদের আগে আগে হাঁটতে থাকলেন। তাঁদের সাথে তিনি এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতে লাগলেন, যাতে তারা এ জনপদ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। লূত আলাইহিস সালাম তাদেরকে বললেন, হে ভাইয়েরা! এ জনপদের লোকের চেয়ে নিকৃষ্ট ও দুশ্চরিত্র লোক ধরাপৃষ্ঠে আর আছে কি-না আমার জানা নেই। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তিনি আবার এ কথা উল্লেখ করলেন। এভাবে চারবার তাদেরকে কথাটি বলেন। ক্বাতাদা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ফেরেশতাগণ এ ব্যাপারে আদিষ্ট ছিলেন, যতক্ষণ নবী লূত আলাইহিস সালাম তার ক্বওমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা যেন তাদেরকে ধ্বংস না করেন। যাহোক, লূত আলাইহিস সালাম অচেনা অতিথিদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসলেন এবং নিজের পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কেউ বিষয়টি জানতে পারল না। কিন্তু তাঁর স্ত্রী জনপদের লোকদের কাছে খবরটি জানিয়ে দেয় যে, লূতের বাড়িতে কয়েকজন এমন সুশ্রী তরুণ এসেছে, যাদের মতো সুন্দর-সুঠাম লোক আর হয় না। তখন লোকজন খুশিতে লূত আলাইহিস সালাম-এর বাড়িতে এলো এবং সেখানে পৌঁছে তাঁর কাছে আগন্তুক মেহমানদেরকে দাবি করল। কিন্তু এরা ঘুর্ণাক্ষরেও টের পেল না যে, তারাই তাদের সমূলে ধ্বংসের বার্তাবাহী দূত। লূত আলাইহিস সালাম তাদেরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। অবশেষে তিনি তাদের বললেন, ‘…হে আমার ক্বওম! এই যে আমার কন্যারা আছে, যারা তোমাদের জন্য পবিত্রতম। তাই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর আমার অতিথিদের ব্যাপারে আমাকে হেয় করো না। তোমাদের মধ্যে কি আলোপ্রাপ্ত মানুষ নেই? তারা বলল, তুমি নিশ্চয় জানো, তোমার কন্যাদের প্রতি আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আর তুমি অবশ্যই জানো, আমরা কী চাই?’ (আল-হূ, ১১/৭৮-৭৯)

লূত আলাইহিস সালাম লোকদেরকে তাঁর ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করলেন এবং তাদেরকে বাধা দিলেন। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। তারা তা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হলো। আর লূত আলাইহিস সালাম দরজার বাইরে থেকে তাদেরকে উপদেশ দিতে এবং ভেতরে যেতে নিষেধ করতে থাকলেন। বাদানুবাদ যখন চরমে পৌঁছল এবং পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হলো, তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের ওপর যদি আমার শক্তি থাকত বা কোনো সুরক্ষিত কোনো স্থানে আশ্রয় নিতে পারতাম!’ (হূ, ১১/৮০)। ‘তারা (ফেরেশতারা) বললেন, হে লূত! আমরা আপনার রবের বার্তাবাহক। ওরা কখনো আপনার কাছে পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং আপনি রাতে একসময় আপনার পরিবার-পরিজনসহ বেরিয়ে যাবেন, আপনার স্ত্রীকে বাদ দিয়ে। কেউ যেন পিছনে না তাকায়। ওদের যা ঘটবে তারও তা-ই ঘটবে। ওদের জন্য নির্ধারিত সময় সকাল। সকাল কি নিকটবর্তী নয়?’ (হূ, ১১/৮১)। এ পরিস্থিতিতে জিবরীল আলাইহিস সালাম লূত সম্প্রদায়ের শাস্তির ব্যবস্থা করতে আল্লাহ তাআলার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। অনুমতি পাওয়ার পর তিনি নিজের একটি ডানা বিস্তার করলেন। ওটার আঘাতে পাপাচারীদের দৃষ্টিশক্তি লোপ পেল এবং তারা অন্ধ হয়ে প্রাচীরের সাথে ধাক্কা খেতে লাগল। এমতাবস্থায় তারা লূত আলাইহিস সালাম-কে পরদিন দেখে নেওয়ার হুমকি দিল। আল-কুরআনের ভাষায়, ‘আর তারা তাকে তার অতিথিদের ব্যাপারে জোর করছিল, তখন আমি তাদের দৃষ্টিশক্তি বিলুপ্ত করে দিলাম এবং বললাম, আস্বাদন করো আমার শাস্তি ও সতর্কবাণীর পরিণাম’ (আল-ক্বামার, ৫৪/৩৭)

আল্লাহর নির্দেশে লূত আলাইহিস সালাম রাতের অন্ধকারে পরিবারকে সাথে নিয়ে সাদুম থেকে বের হয়ে এলেন। তিনি সিরিয়া অভিমুখে রওনা হওয়ার পর ফেরেশতাদেরকে তাদের ওপর শাস্তি কার্যকর করতে বললেন। ফেরেশতারা বললেন, তারা প্রত্যুষে তাদেরকে ধ্বংস করতে আদিষ্ট। কথিত আছে, লূত আলাইহিস সালাম-এর স্ত্রী তার ক্বওমের লোকদের সাথে থেকে গিয়েছিল। ভিন্ন বর্ণনায়, সে তার স্বামী ও দুই কন্যার সাথে বেরিয়েছিল। কিন্তু আযাব ও শহর ধ্বংস হওয়ার শব্দ শুনতে পেয়ে সে পিছনে সম্প্রদায়ের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল। এভাবে আল্লাহর সব নির্দেশ সে অমান্য করেছিল। হায় আমার ক্বওম! বলে সে বিলাপ করেছিল। তখন ওপর থেকে একটি পাথর এসে তার মাথায় পড়ে এবং তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। এভাবে সে নিজ ক্বওমের ভাগ্যের সাথে একীভূত হয়ে যায়। কারণ, সে ছিল লূত আলাইহিস সালাম-এর শরীআতের প্রতি অবিশ্বাসী এবং নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি বিশ্বাসী, তাদের সংবাদ সরবরাহকারিণী। একথাও উল্লেখ আছে যে, সে একটি লবণস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এরপর তারা যখন সে এলাকা অতিক্রম করে চলে আসল এবং সূর্য উদিত হলো, তখন আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ ও অপ্রতিরোধ্য শাস্তি তাদের ওপর নেমে এল। মুফাসিসরগণ বলেন, জিবরীল আলাইহিস সালাম আপন ডানার এক প্রান্ত দিয়ে লূত জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি গভীর নিচ থেকে উপড়ে দিয়েছিলেন। মোট সাতটি নগরে তারা বসবাস করত। সে এলাকার সমস্ত মানুষ, জীবজন্তু, ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদ যা কিছু ছিল সবকিছুসহ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আকাশের এত কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যে, সেখানকার ফেরেশতারা মোরগের ডাক ও কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে উল্টিয়ে নিচে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সর্বপ্রথম যা নিচে এসে পতিত হয় তা হলো তাদের উঁচু অট্টালিকাসমূহ। আরো উল্লেখ আছে যে, ভীষণ ভূমিকম্পে তাদের ভূখণ্ড ৪০০ মিটার সমুদ্রের নিচে চলে যায় এবং পানি উথলে ওঠে, তখন থেকে তা সমুদ্ররূপ ধারণ করে। এজন্য এর নাম মৃত সাগর। আরেক নাম বাহরে লূত বা লূত সাগর। মোটকথা, ওই জনপদের ভূখণ্ডকে ওপরে তুলে নিচের অংশকে ওপরে ও ওপরের অংশকে নিচে করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর অবিরাম শক্ত পাথর-কঙ্কর বর্ষণ করা হয়, যা তাদের সবাইকে ছেয়ে ফেলেছিল। প্রতিটি পাথরের ওপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম লেখা ছিল। পাথর ওই জনপদের প্রত্যেকের ওপর পতিত হয়েছিল। এমনকি সেখানে অনুপস্থিত ওই জনপদের লোক যারা কোনো না কোনো কারণে দূরে অবস্থান করছিল তাদের সকলের ওপরই শাস্তি পতিত হয়েছিল। এভাবে মুহূর্তের মধ্যে একটি জনপদ পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল এবং চিরদিনের জন্য মানবজাতির শিক্ষা গ্রহণের বিষয় হয়ে থাকল। তাদের ওপর আপতিত শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তারপর যখন আমার আদেশ এলো, তখন আমি জনপদকে উল্টিয়ে দিলাম এবং ওদের ওপর ক্রমাগত বর্ষণ করলাম প্রস্তর-কঙ্কর, যা তোমার রবের কাছে চিহ্নিত ছিল। আর তা যালেমদের থেকে দূরে নয়’ (হূ, ১১/৮২-৮৩)। ‘তাদের উপর শাস্তিমূলক বৃষ্টিবর্ষণ করেছিলাম। যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল, তাদের জন্য এ বৃষ্টি কতই না নিকৃষ্ট!’ (আশ-শুআরা, ২৬/১৭৩)। ‘এরপর সূর্যোদয়ের সময় প্রকম্পিত শব্দ তাদেরকে আঘাত করল। আর আমরা সেটার উপরকে নিচ করে দিলাম এবং তাদের ওপর ক্রমাগত প্রস্তর-কঙ্কর বর্ষণ করলাম’ (আল-হিজর, ১৫/৭৩-৭৪)। ‘তারা বলল, আমাদেরকে এক অপরাধী জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে। যাতে আমরা তাদের ওপর মাটির শক্ত ঢেলা নিক্ষেপ করি, যা সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে চিহ্নিত’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৩২-৩৪)। ‘তিনি উল্টানো আবাসভূমিকে নিক্ষেপ করেছিলেন। সর্বগ্রাসী শাস্তি ওদের আচ্ছন্ন করল’ (আন-নাজম, ৫৩/৫৩-৫৪)। আল্লাহ লূত আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়কে এমন কঠিন আযাব নাযিল করেছিলেন, যা প্রতিহত করার সাধ্য কারো ছিল না। এ শাস্তি ছিল তাদের কল্পনাতীত। তিনি তাদের এলাকাকে দুর্গন্ধময় সমুদ্রে পরিণত করেন। ওই সমুদ্রের পানি ও সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী।

প্রতীয়মান যে, সমকামিতার মতো যৌন বিকৃতি একটি মহাঘৃণিত ও অভিশপ্ত পাপাচার। এ পাপাচারের শাস্তি প্রচণ্ড কঠোর। আল্লামা ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ তার ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে উল্লেখ করেছেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এমন কোনো লোক যদি পাও, যে লূত আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ের অনুরূপ পাপ কাজে লিপ্ত, তখন সংশ্লিষ্ট উভয় ব্যক্তিকেই হত্যা করো’।[1] ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘পুরুষের সাথে সমকামীকে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে ফেলে দিয়ে তার উপর পাথর নিক্ষেপ করতে হবে; যেভাবে লূতের সম্প্রদায়ের সাথে করা হয়েছিল’।[2]

কিন্তু দুঃখজনক যে, তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারীরা আজ আবার সভ্যতাকে ধ্বংসের পথে ধাবিত করছে। এ থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে প্রত্যেক মুমিনের বলিষ্ঠ ভূমিকা সময়ের দাবি।

মো. হাসিম আলী

সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।


[1]. ইবনু মাজাহ, হা/২৫৬১; আবূ দাঊদ, হা/৪৪৬২; তিরমিযী, হা/১৫৫৬, ছহীহ।

[2]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা), ১/৪০৮।

Magazine