ঋতুচক্র আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন। পৃথিবীর অঞ্চলভেদে ঋতুপরিক্রমা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতের মৌসুম চলে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে এই শীতকালে মুমিনদের জন্য বিশেষভাবে কিছু করণীয় থাকে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে একজন মুমিন কীভাবে তার শীতকালকে অর্থবহ করে তুলতে পারে, সে সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করার প্রয়াস পাব।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় : শীতকাল আমাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ দান। এ সময় প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল পাওয়া যায়। এই সবকিছুর প্রাচুর্যের জন্য আমাদের সর্বপ্রথম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ إِلَى طَعَامِهِ-أَنَّا صَبَبْنَا الْمَاءَ صَبًّا-ثُمَّ شَقَقْنَا الْأَرْضَ شَقًّا-فَأَنْبَتْنَا فِيهَا حَبًّا-وَعِنَبًا وَقَضْبًا-وَزَيْتُونًا وَنَخْلًا-وَحَدَائِقَ غُلْبًا-وَفَاكِهَةً وَأَبًّا-مَتَاعًا لَكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি তো অঝোর ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। অতঃপর মাটিকে বিদীর্ণ করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্যাদি, আঙুর, শাকসবজি, জলপাই, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগান, ফলফলাদি ও ঘাস। এসব তোমাদের ও তোমাদের পালিত পশুকুলের জীবনধারণের জন্য’ (আবাসা, ৮০/২৪-৩২)।
এজন্য আমাদের উচিত মনপ্রাণ উজাড় করে সর্বান্তকরণে আমাদের উন্নত মস্তক মহান রবের শানে অবনত করা।
বেশি বেশি নফল ছিয়াম রাখা : শীতকাল নফল ছিয়াম রাখার উপযুক্ত সময়। কারণ শীতকালে দিন থাকে খুবই ছোট। শীতকালে ছিয়াম রাখলে খুব অল্প সময় না খেয়ে থাকতে হয় এবং তেমন একটা পানিপিপাসাও লাগে না, যা ছিয়াম রাখার জন্য খুবই উপযোগী। তাই এই ঋতুতে সম্ভব হলে বেশি বেশি ছিয়াম রাখবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শীতকালকে গনীমত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, الْغَنِيمَةُ الْبَارِدَةُ الصَّوْمُ فِى الشِّتَاءِ ‘শীতল গনীমত হচ্ছে শীতকালে ছিয়াম রাখা’।[1]
শীতকালে শেষরাতের ছালাত আদায়ের চেষ্টা করা : শীতকালের রাত অনেক দীর্ঘ হয়। ফলে কেউ যদি চায় তাহলে সে তৃপ্তি সহকারে ঘুমিয়ে শেষরাতে তাহাজ্জুদ ছালাত অনায়াসে আদায় করতে পারে। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে বলেন,تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ ‘তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে আর আমি তাদেরকে যে রিযিক্ব দান করেছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে’ (আস-সাজদাহ, ৩২/১৬)।
জাহান্নাম থেকে বেশি বেশি নাজাত চাওয়া : শীত ও গরম উভয়ই আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,أَنَّ النَّارَ اشْتَكَتْ إِلَى رَبِّهَا فَأَذِنَ لَهَا فِى كُلِّ عَامٍ بِنَفَسَيْنِ نَفَسٍ فِى الشِّتَاءِ وَنَفَسٍ فِى الصَّيْفِ ‘জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করে বলে, হে রব! আমার এক অংশ অন্য অংশকে খেয়ে ফেলেছে। মহান আল্লাহ তখন তাকে দুটি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি দেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে, আরেকটি গ্রীষ্মকালে। কাজেই তোমরা গরমের তীব্রতা এবং শীতের তীব্রতা পেয়ে থাকো’।[2]
সুতরাং আমাদের উচিত তীব্র শীতে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে বেশি বেশি মুক্তি চাওয়া। কারণ তীব্র শীত বা তীব্র গরম জাহান্নামের আযাবের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আর এসব নিদর্শন আমাদেরকে আল্লাহমুখী হতে সাহায্য করে।
ওযূ ও গোসলের ব্যাপারে সচেতন হওয়া : শীতকালে ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করতে কষ্ট হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। গ্রীষ্মকালে অনেকে ইবাদত-বন্দেগী স্বাভাবিকভাবে করলেও শীতকালে কিছুটা অলসতাবোধ করে। তাই এ বিষয়ে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে; এমনকি শীতের মৌসুমে গরম পানি দিয়ে ওযূ করলেও ছওয়াবে কমতি হবে না। এই ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে যথাযথভাবে ওযূ ও গোসল সম্পন্ন করতে হবে। কারণ পূর্ণাঙ্গরূপে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধৌত না করলে ওযূ ও গোসল ঠিকমতো আদায় হয় না। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللَّهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ « إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন (কাজের) কথা বলব না, যা দ্বারা আল্লাহ তাআলা পাপরাশি দূর করে দিবেন এবং মর্যাদা উঁচু করে দিবেন?’ ছাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তিনি বললেন, ‘তা হলো অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণভাবে ওযূ করা, মসজিদে আসার জন্য বেশি পদচারণা করা এবং এক ছালাতের পর অন্য ছালাতের জন্য অপেক্ষা করা। জেনে রাখো, এটাই হলো রিবাত্ব (নিজেকে আটকে রাখা ও শয়তানের মোকাবিলায় নিজেকে প্রস্তুত রাখা)’।[3]
শীতার্ত মানুষকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসা : শীতকাল আমাদের কাছে আসে পরীক্ষাস্বরূপ। এই শীতকাল অনেকের কাছে রুমহিটার চালিয়ে উষ্ণতা উপভোগের চমৎকার উপলক্ষ্য আবার অনেকের কাছে হাড়কাঁপানো শীতে জীবনবাজি রেখে অস্তিত্ব রক্ষার এক চরম লড়াই। দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে বিত্তশালী মানুষদেরকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। মানবতার সেবায় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়ে মহান আল্লাহর আদেশ পালনে আমাদেরকে ব্রতী হতে হবে। কারণ বিপন্ন সব মানুষের পাশে দাঁড়ানোই ইসলামের আদর্শ। মহান আল্লাহ বলেন,وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا ‘আত্মীয়-স্বজনকে দাও তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। আর কিছুতেই অপব্যয় করো না’ (আল-ইসরা, ১৭/২৬)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,وَاللَّهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ ‘আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ বান্দার সহযোগিতায় থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহযোগিতায় রত থাকে’।[4]
গরম পোশাক পরিধান করা : পোশাক মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ দান ও অনুগ্রহ। আল্লাহ তাআলা পোশাকের মাধ্যমে মানুষকে সম্মানিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। প্রচণ্ড শীত থেকে বাঁচার জন্য মহান আল্লাহ বিশেষ পোশাক দান করেছেন। আল্লাহ বলেন,وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ ‘তিনি তোমাদের জন্য পোশাক সৃষ্টি করেছেন, যা তোমাদেরকে তাপ থেকে রক্ষা করে। আর সৃষ্টি করেছেন এমন পোশাক, যা তোমাদেরকে সংঘাতের সময় রক্ষা করে’ (আন-নাহল, ১৬/৮১)।
অতএব, আমাদের উচিত তীব্র শীতে গরম পোশাক পরিধান করে শীত নিবারণ করা আর এ জন্য বেশি বেশি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।
মোজার ওপর মাসাহ করা : আল্লাহ তাআলা মুমিনদের কষ্ট লাঘবের জন্য তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে মোজার উপর মাসাহ করার বিধান দিয়েছেন। পায়ে মোজা পরা থাকলে পা ধৌত করার পরিবর্তে মোজার উপর মাসাহ করলে ধৌত করার ফরয আদায় হয়ে যায়। এজন্য শর্ত হলো ওযূ অবস্থায় মোজা পরতে হবে। ওযূ অবস্থায় মোজা পরিধান করলে গৃহে অবস্থানকারীর জন্য এক দিন ও এক রাত আর মুসাফিরের জন্য তিন দিন ও তিন রাত মাসাহ করার সুযোগ রয়েছে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَلِىٍّ tقَالَ جَعَلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِلْمُسَافِرِ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ وَلَيَالِيَهُنَّ وَيَوْمًا وَلَيْلَةً لِلْمُقِيمِ يَعْنِى فِى الْمَسْحِ.
আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাসাহের ক্ষেত্রে মুসাফিরের জন্য সময় নির্ধারণ করেছেন তিন দিন ও তিন রাত এবং মুক্বীম তথা গৃহে অবস্থানকারীর জন্য এক দিন ও এক রাত।[5]
পরিশেষে বলা যায়, ঋতুচক্র আমাদের কাছে আসে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে আরো নিবিড়ভাবে চেনার জন্য। এসবকিছুর মধ্যে আল্লাহর সত্যান্বেষী বান্দাদের জন্য চিন্তার খোরাক রয়েছে। বছরের অন্য সময়ের মতো শীতকালও হোক মহান রবের আরো নিকটবর্তী হওয়ার একটি সত্যিকারের মাধ্যম। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-আমিন
সহকারী শিক্ষক (ধর্ম), মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়, তানোর, রাজশাহী।
[1]. তিরমিযী, হা/৭৯৭, হাদীছ ছহীহ।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১৭।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫১।
[4]. আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৬, হাদীছ ছহীহ।
[5]. সুনানে নাসাঈ, হা/১২৮, হাদীছ ছহীহ।