জীবনে সফল হতে হলে লক্ষ্য স্থির করতে হয়, নচেৎ সফলতা অর্জন করা দুরূহ হয়ে যায়। কেউ যদি সফলতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে কোনো একজন মহৎ গুণের অধিকারী মানুষের অনুসরণ করা প্রয়োজন। ছাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্য ছিল চিরসুখের আবাস জান্নাতে যাওয়ার; তাই তো তারা মডেল বা আদর্শ হিসেবে গ্ৰহণ করেছিলেন সৃষ্টিকুলের সেরা মানব মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। যত বাধাবিপত্তিই আসুক না কেন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা তাদের নিকট শিরোধার্য। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কথা শুনার সাথে সাথে তা বাস্তবায়নের হিড়িক পড়ে যেত। কার আগে কে করবে তা নিয়ে অন্যরকম একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। নিজেদের জীবন থেকেও অধিক ভালোবাসতেন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে। তিনি পূর্বাহ্ণে, মধ্যাহ্নে ও অপরাহ্ণে কী করতেন, তার খোঁজখবর নিতেন। তাঁর আদেশে রণক্ষেত্রে মরণপণ লড়াই করতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। এজন্যই তো তারা দুনিয়াতেই জান্নাতের সার্টিফিকেট পেয়েছেন। আমরা কি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? ছাহাবীগণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যতটুকু ভালোবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন, আমরা কি ততটুকু করি? আমাদের জীবনটা যদি তাদের মতো হতো! আজকে আপনাদেরকে কিছু হাদীছ শুনাবো, ছাহাবীগণ ইসলামের ব্যাপারে কেমন ছিলেন। তারা কি শুধু সুখ-শান্তি ও সচ্ছলতার সময়ই ইসলামকে আঁকড়ে ধরেছেন, না-কি সর্বাবস্থায়? তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথাকে কি সর্বাবস্থায় শ্রদ্ধা করতেন, না-কি করতেন না?
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى خَاتَمًا مِنْ ذَهَبٍ فِي يَدِ رَجُلٍ فَنَزَعَهُ فَطَرَحَهُ وَقَالَ يَعْمِدُ أَحَدُكُمْ إِلَى جَمْرَةٍ مِنْ نَارٍ فَيَجْعَلُهَا فِي يَدِهِ فَقِيلَ لِلرَّجُلِ بَعْدَ مَا ذَهَبَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خُذْ خَاتَمَكَ انْتَفِعْ بِهِ قَالَ لاَ وَاللَّهِ لاَ آخُذُهُ أَبَدًا وَقَدْ طَرَحَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে একটি স্বর্ণের আংটি লক্ষ্য করে সেটি খুলে ফেলে দিলেন এবং বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আগুনের টুকরো সংগ্রহ করে তার হাতে রাখে’।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্থান করলে লোকটিকে বলা হলো, তোমার আংটিটি তুলে নাও, এর দ্বারা উপকার লাভ করো। তিনি বললেন, না। আল্লাহর শপথ! আমি কখনো ওটা নেব না। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ওটা ফেলে দিয়েছেন।[1] এই হাদীছের প্রতি একটু মনোযোগ দিন, ছাহাবী দেখলেন যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগ করেছেন, আর রাগবশত তিনি তার আংটি ফেলে দিয়েছেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঐ স্থান ত্যাগ করেন, তখন অন্যান্য ছাহাবী বলা সত্ত্বেও তিনি আর ঐ আংটি নেননি। সুবহানাল্লাহ! তিনি বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আংটি ফেলে দিয়েছেন, সেটা আমি কী করে নিই; আমি যে তাকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি! ছাহাবীর স্থানে যদি আমি আপনি হতাম, তাহলে কী করতাম! শুরু করতাম নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে নানাবিধ কথা; হয়তো অনেকেই বলে ফেলতাম আপনার কোনো সমস্যা আছে এই আংটি পরাতে? যেমন আপনি কাউকে যদি বলেন, টাখনুর উপরে প্যান্ট পরুন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টাখনুর নিচে কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন; তাহলে আপনি তার থেকে উত্তর পাবেন ‘আপনার কোনো সমস্যা, আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তো কী হয়েছে? তাঁর সব কথাই মানতে হবে নাকি?’ –নাঊযুবিল্লাহ-
ছাহাবীগণ আমল করার জন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কার্যাবলির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন; মাঝে মাঝে তাঁর সহধর্মিণীগণকে জিজ্ঞেস করতেন যে, প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল কেমন ছিল? আর আমাদের সামনে ভূরিভূরি হাদীছ আছে ভাই, কিন্তু আমরা মান্য করি না; অহেতুক গলাবাজি করি। দুষ্কৃতি কত প্রকার ও কী কী সবই আছে আমাদের হৃদয়ে, কিন্তু তাদের হৃদয়টা ছিল প্রশস্ত, ছিল না কোনো ধরনের সংকীর্ণতা ও প্যাঁচ। ভাই আমাদের জীবনটা তাদের মতো করলে কেমন হয়? বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই, শুধু আমাদের মন-মানসিকতা একটু পরিবর্তন করলেই চলবে। আমরাও পাব আল্লাহর অপরিসীম ভালোবাসা, ফিরে আসবে আমাদের মাঝে ভাতৃত্বের বন্ধন, দূরীভূত হবে হিংসা-বিদ্বেষ, জিঘাংসা ও পরশ্রীকাতরতা। আপনি চমকে যাবেন আরেকটি হাদীছ দেখে—
عَنْ عَائِشَةَ i زَوْجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهَا أَخْبَرَتْهُ أَنَّهَا اشْتَرَتْ نُمْرُقَةً فِيهَا تَصَاوِيرُ، فَلَمَّا رَآهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَامَ عَلَى الْبَابِ فَلَمْ يَدْخُلْ فَعَرَفَتْ فِي وَجْهِهِ الْكَرَاهِيَةَ قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَتُوبُ إِلَى اللَّهِ وَإِلَى رَسُولِهِ مَاذَا أَذْنَبْتُ قَالَ مَا بَالُ هَذِهِ النُّمْرُقَةِ فَقَالَتِ اشْتَرَيْتُهَا لِتَقْعُدَ عَلَيْهَا وَتَوَسَّدَهَا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ أَصْحَابَ هَذِهِ الصُّوَرِ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيُقَالُ لَهُمْ أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ وَقَالَ إِنَّ الْبَيْتَ الَّذِي فِيهِ الصُّوَرُ لاَ تَدْخُلُهُ الْمَلاَئِكَةُ.
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একবার) তিনি ছবিযুক্ত গদি ক্রয় করেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তা দেখতে পেলেন, তখন দরজার উপর দাঁড়িয়ে গেলেন; প্রবেশ করলেন না। [আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা] নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ প্রত্যক্ষ করলেন। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিকট ও তাঁর রাসূলের নিকট এ পাপ থেকে তওবা করছি। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এ গদি কোথা থেকে আসল?’ আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আপনার উপবেশন ও হেলান দেওয়ার জন্য আমি এটি ক্রয় করেছি। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, ‘এসব ছবি নির্মাতাদের ক্বিয়ামতের দিন আযাব দেওয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে তোমরা যা বানিয়েছিলে তা জীবিত করো’। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বললেন ‘যে ঘরে (প্রাণীর) ছবি থাকে, সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না’।[2]
দেখুন, আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্রোধ দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে সাথে সাথে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ক্ষমা চান; তিনি কিন্তু ঐ গদিটি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্যই ক্রয় করেছিলেন। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা মনে মনে অনুভব করেন যে, যদি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার উপর রাগ করে থাকেন, তাহলে আমাকে হাওযে কাওছারের স্বচ্ছ-নির্মল সুপেয় পানি পান করাবে কে, তাঁর সুপারিশের মাধ্যমেই তো আমি অনিন্দ্য সুন্দর ছায়াময় জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। যে ব্যক্তি আমার জন্য এত কিছু করবেন, তিনি কি আমার উপর রাগ করে থাকলে হয়; কালবিলম্ব না করে সাথে সাথে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্রোধ নিবারণের চেষ্টা করেন। ছাহাবীগণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কত ভালোবাসাতেন! আমরা তো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কষ্ট দেই, তাঁর সুন্নাতকে গলা চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করি, তাঁর মর্যাদার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করি না। আজকের নারীরা যদি নারী ছাহাবীদের মতো হতো, তাহলে দাম্পত্য জীবনে কখনোই মনোমালিন্য ও বিদ্বেষের ঘনঘটা আসত না, সবসময় বিরাজ করত স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে অনাবিল সুখ-শান্তি। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা স্বামীর রাগ নিবারণের লক্ষ্যে কতকিছুই না করলেন। কয় আপনার স্বামী তো রাগ করেছে, আর আপনি বিরক্তির ভাব নিয়ে অন্য দিকে ফিরে আছেন? অতি সত্বর তার নিকট ভুল স্বীকার করুন। বলুন, আর কখনো এমন হবে না; আমি না জেনে করে ফেলেছি, আমাকে ক্ষমা করে পবিত্র করুন। বর্তমান সময়ের নারীরা সাধারণত ভুল স্বীকার করতে চায় না, উল্টো আরও রাগ করে থাকে, চলে দাম্পত্য জীবনে বিড়ম্বনা। প্রিয় বোন আমার! নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথাকে আপনার ক্রোধের উপর প্রাধান্য দিন; তিনি তো বলেছেন যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সেজদা দিতে বললে নারীদের বলতাম যেন তারা স্বামীকে সেজদা করে’।[3]
সুবহানাল্লাহ! ছাহাবীগণ ইসলামের বিধানকে খুব মযবূত করে পালন করতেন। দুঃখ-কষ্ট যতই আসত, তারা কখনোই পিছপা হতেন না, চলতেন ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে। বিপদ নামক বৈশাখী ঝড় তাদের কখনো হেলাতে পারত না, ছালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। তাদের বিশ্বাসের শেকড়টা ছিল খুবই মযবূত। তাই সহস্র মুছীবতেও তারা উপুড় হয়ে পড়তেন না; নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাতলানো পথে চলতেন।
উম্মে সালামা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘আমার প্রিয়তম সঙ্গী আবূ সালামার প্রয়াণে আমি দুঃখ-কষ্টে নীরব-নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে যাই, যেন আমি শোকের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি; ক্ষণিকের জন্য আমার উপর দিয়ে বয়ে গেল বৈশাখী ঝড়, আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, বাকরুদ্ধকর পরিস্থিতি। বারবার মনে পড়ছে তার ভালোবাসার কথা, তাকে ছাড়া কি আমি একা একা থাকতে পারব? যে আমার কষ্টের সময় ছিল সমবেদনা জ্ঞাপনকারী, আর সুখের সময় ছিল প্রফুল্লতা দানকারী। আমি হেরে গিয়ে ভয় পেলে যে আমাকে অভয় দিতেন ও সাহস যোগাতেন, আমার বিজয়ই ছিল যার বিজয়। কোনো ভুল করলে কটুকথা না বলে যিনি আমার ভুল শুধরে দিতেন; আমাকে করতেন বিভিন্ন কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা। যিনি ছিলেন আমার প্রিয় সন্তানদের শ্রদ্ধাভাজন পিতা; ইবাদতে আমি উদাসীন হয়ে গেলে স্মরণ করিয়ে দিতেন আল্লাহর কথা; হাজার কাজের ব্যস্ততার মাঝেও যিনি ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিতেন আমার গায়ে। কত আনন্দই না পেতাম তার সংস্পর্শে! তিনি তো আমাকে ছেড়ে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে! আমি কীভাবে থাকব? কে আমাকে ও আমার প্রিয় সন্তানদের দেখভাল করবে? এরকম হাজারো দুশ্চিন্তা উঁকি দিল আমার তনুমনে; পরক্ষণেই মনে পড়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর কথা। তিনি বলেন, ‘কারো নিকট বালা-মুছীবত আসলে সে যদি এই দু‘আটি পড়ে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে এর চাইতেও উত্তম জিনিস দান করবেন। দু‘আটি হলো—
إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ اللَّهُمَّ أجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا
‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর সমীপেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ! আমার বিপদে পুণ্য দান করুন এবং এর চাইতেও উত্তম জিনিস দিন’। এই দু‘আটি পড়ে তিনি বলেন যে, আমি সাময়িকের জন্য কল্পনার জগতে চলে গেলাম। আবূ সালামা তো একজন অমায়িক লোক, তার মতো কি কেউ হতে পারে? তিনি আমার প্রতি কতই না খেয়াল রাখতেন? কতই না আবেগময় কথা শুনাতেন? তিনি আমার হৃদয়ে বসন্তের ফল্গুধারা বয়ে দিতেন। এরকম হাজারো বাণী আমার মানসপটে দোলা দিচ্ছিল। এভাবে কিছুদিন অতিক্রান্ত হলো। একদিন আমাকে প্রেয়সীরূপে পাওয়ার জন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিয়ের প্রস্তাব দেন। ঐ সময় আমার অবস্থা হলো ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’-এর ন্যায়। মরুচারি এক ফোঁটা পানি পেয়ে যেমন পুলকিত হয়, তার চেয়েও বেশি আমি আপ্লুত হয়েছিলাম ঐ দিন। শ্রেষ্ঠ মানব আমার প্রিয়তম হবে? হবে আমার দুর্দিনের সাথি? আমি তো ভেবেই আত্মহারা হয়ে যাচ্ছি! আমার এই আনন্দের কথা কার কাছে বলি! আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার স্বামী! আমি কালক্ষেপণ না করে সাথে সাথে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম এবং মনে মনে ভাবলাম নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই তো আবূ সালামার চেয়ে উত্তম। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা বাস্তবে রূপান্তরিত করেছেন।[4]
ছাহাবীগণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ডাকে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। জীবন, পরিবার ও প্রীতির মায়াজালে আবদ্ধ থাকতেন না; ছুটে চলতেন তাঁর আহ্বানে দুরন্ত গতিতে; কোনো বাধাই তাদের প্রতিবন্ধক হতো না। সবকিছুর আগে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথাকে প্রাধান্য দিতেন। এমনি এক চিত্র পাই আমরা হানযালা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর একটি ঘটনা থেকে। উহুদ যুদ্ধের দিন যখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। কাফেরশক্তি যখন ইয়াজূজ ও মাজূজের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল, মদীনার চারদিকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। এদিকে মুনাফেক্বশক্তি গোপনে অপপ্রচারে লিপ্ত। কাফেররা তিন হাজার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী নিয়ে ধেয়ে আসছে মুসলিমদের নির্মূল করার জন্য। কী এক নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এ সময়ের নিরস্ত্র মুসলিমদের; ভাবতেও অবাক লাগে! নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করলেন এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। একজন ঘোষক ঘোষণা করলেন যে, সবাই কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত হও; আর এটা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ। এই ঘোষণাটি হানযালা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর কর্ণকুহরে এসে সবেগে আঘাত হানে। ঐ সময় তিনি ছিলেন নববর; আগের দিন সবেমাত্র বিয়ে করেছেন; এখন পর্যন্ত ফরয গোসল করেননি। এদিকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ আর ঐদিকে ফরয গোসল, কোনটাতে তিনি প্রাধান্য দিবেন? তিনি স্ত্রীকে বললেন, ‘প্রেয়সী আমার! হৃদয়ের স্পন্দন! আমার তো ডাক পড়েছে; যেতে চায় না মন, তবুও যেতে হবে। জানি না দেখা হবে কি না। এ জগতে যদি আমাদের দেখা আর না হয় পরজগতে অবশ্যই হবে। আমাকে যেতে হবে; হ্যাঁ, আমাকে অবশ্যই যেতে হবে। আমার নয়নমণি চক্ষুশীতলকারী রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আমাকে ডেকেছেন। বিদায় হে প্রাণের স্পন্দন! বিদায়! তিনি আর কালবিলম্ব না করে স্নানবিহীন রওনা দিলেন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পানে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধ করতে করতে একপর্যায়ে তিনি শাহাদাতের সুধা পান করেন। যুদ্ধ শেষে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহীদদের দেহ কবরস্থ করার জন্য ছাহাবীদের নির্দেশ দেন। এদিকে হানযালা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল যে, তার মাথা থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। এ দৃশ্যটি ছাহাবীরা দেখে হতভম্ব হয়ে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাদের নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করেন।[5]
সুবহানাল্লাহ! ভাবুন তো, হানযালা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্থানে আমি আপনি হলে কী করতাম! যাই করতাম না করতাম, ঘোষণা শুনে কমপক্ষে বলতাম পাঁচ মিনিটে ফরয গোসলটা সেরে নেই; তারপর রওনা দেই। দেখুন, আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে কত ফারাক্ব, কত ব্যবধান! আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে গুরুত্ব দেই না, কোনো আমলেই নেই না, আর তারা প্রাণ উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। কেউ যদি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো নির্দেশকে অবজ্ঞা করত বা অমান্য করত, তাহলে ভালোবাসার কোনো মায়াজালই তাদের বাধা দিত না; তারা ঐ সময় মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথাকেই অগ্ৰাধিকার দিতেন। চাই ঐ ব্যক্তিটা নিজের কোনো আপনজন হোক বা পর। এমনি একটি দৃশ্য অবলোকন করেছি একজন ছাহাবীর জীবনী থেকে। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা একদিন বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা প্রদান করো না’। তার এক ছেলে একথা শুনে চট করে বলে উঠল, ‘আমি নিষেধ করব’। ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘কী আশ্চর্য! আমি তোমাকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছ শুনাচ্ছি আর তুমি তার বিপরীত কথা বলছ। আল্লাহর শপথ! তোমার সাথে কখনোই কথা বলব না’।[6]
ভাবুন তো এই স্থানে আপনি থাকলে কী করতেন? অবশ্যই আমার আপনার উপর জেঁকে বসত সন্তানের প্রতি অন্ধ ভালোবাসার মায়াজাল। আমি আপনি কী সেই মযবূত জালের বাঁধন ছিন্ন করে বের হতে পারতাম? পারতাম কি কলিজার টুকরো ছেলেকে বলতে, আমি তোমার সাথে কোনো সম্পর্কই রাখব না। ছাহাবীগণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন, অনমনীয়; চাই সে যেই হোক না কেন।
মনে আছে কি আপনার, মদ হারাম হওয়ার হাদীছটি? ছাহাবীদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল? যে মদ ছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী; একবেলা অনাহারে কাটানো সম্ভব ছিল; কিন্তু মদছাড়া জীবন ছিল অন্তঃসারশূন্য। মদের জন্য একজন অপরজনকে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না; কুণ্ঠাবোধ করত না কারো উপর যুলুম-নির্যাতন করতে। অপরাহ্ণে ছায়াদার বৃক্ষের নিচে মৃদুমন্দ বাতাসে মদপান করার প্রবণতা তাদের মাঝে ছিল। কত আনন্দই না পেত শরাবের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে। এই আনন্দ, এই ফুর্তি নিমিষেই এক ঘোষণাতে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যেদিন মদপান হারাম করা হয়, সেদিন মদীনার অলিগলিতে, ঘরের আঙিনায় সুবিস্তৃত মাঠে-প্রান্তরে নদীর স্রোতের ন্যায় মদের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। যাদের থলিতে, পাত্রে, মটকায় মদ ছিল, তারা সাথে সাথে তা ফেলে দেয়; এমনকি যারা মুখে পুরেছিল ও গিলে ফেলেছিল, তারাও মুখে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে বমি করে দেয়।
সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহ! তাদের মতো হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন। তাদের হৃদয় ছিল কত নির্মল ও স্বচ্ছ, ছিল না কোনো প্রকার কলুষতা। সুন্দর সোনালী ছিল তাদের কাজকর্ম। শরীর ছিল জীর্ণশীর্ণ, কিন্তু ঈমানী মন ছিল তেজস্বী। কাপড় ছিল সংকীর্ণ; কিন্তু মনটা ছিল অথৈ সাগরের চেয়েও বিশাল। তাদের মতো তেজস্বী ঈমান আমাদেরও দাও, হে দয়াময়! চলুন না, বদলে যাই ও বদলে দেই। বেলা ফুরাবার আগেই, পশ্চিম দিগন্ত থেকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আবর্তিত হওয়ার আগেই আপন নীড়ে আপন গৃহে ফিরে যাই; নচেৎ ঘোর অন্ধকার ও আমাদের চিরশত্রুর প্রবঞ্চনায় গন্তব্যে ফেরা মুশকিল হয়ে যাবে। সময় থাকতেই গোছগাছ করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। গাফিলতির মাঝে থাকলে ঘাপটি মেরে বসে থাকা শয়তানের দলবল পুণ্য নামক পুঁজি লুণ্ঠন করে নিয়ে যাবে। তাই আর কালবিলম্ব না করে এখনই রওনা দাও চিরসুখের আবাস জান্নাতের পানে, রওনা দাও ছায়াময় সবুজ অরণ্যের দিকে। যেখানে নেই সূর্যের প্রখর তাপ, নেই কোনো ক্লান্তি-কষ্ট-ক্লেশ; আছে শুধু বিরামহীন আরাম-আয়েশ। চারদিকে সাদর আমন্ত্রণ জানাবে অনিন্দ্য সুন্দরী হূররা; যাদের দেখামাত্রই নয়ন জুড়িয়ে যাবে, যাদের একঝলক মুচকি হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠবে পরিবেশ। পায়ের তলদেশ দিয়ে শোনা যাবে প্রবহমান নহরের কলকল শব্দ। থাকবে না কোনো হট্টগোল ও কোলাহল, চারপাশ নীরব-নিস্তব্ধ। কতই না সৌভাগ্যবান তারা, যারা এই স্থানের অধিকারী হবে! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও তাদের সারিতে অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!
সাঈদুর রহমান
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৩৬৫।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৬১।
[3]. তিরমিযী, হা/১১৫৯; আবূ দাঊদ, হা/২১৪০; হাসান।
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯১৮।
[5]. বায়হাক্বী, ৪/১৫।
[6]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬।