কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ছিয়াম ও তাক্বওয়ার সমীকরণ

post title will place here

রামাযান মাসে ছিয়াম সাধনার কিংবা ফরয হওয়ার বিশেষ একটি উপলক্ষ্য আছে। উপলক্ষ্যটি মহান আল্লাহ নিজেই তাঁর কুরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ‘রামাযান হলো সেই মাস, যাতে নাযিল হয়েছে আল-কুরআন, মানুষের জন্য হেদায়াত, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকরণ ও হেদায়াতের সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এই মাসটি পাবে, সে যেন এই মাসে ছিয়াম পালন করে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)। এখানে রামাযানকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে কুরআন নাযিলের মাস হিসেবে, আবার সেই কুরআনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে হেদায়াত ও ফুরক্বান তথা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে, আবার তাক্বওয়াকে ভালোভাবে রপ্ত করতে ছিয়াম ফরয করা হয়েছে। যেমন অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর; যেন তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পারো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৩)

এবার আসুন, একটি সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করি—

সমীকরণ-১: কুরআন নাযিল করা হয়েছে রামাযান মাসে হেদায়াত ও ফুরক্বান হিসেবে। একে উপলক্ষ্য করে ফরয করা হয়েছে ছিয়াম।

সমীকরণ-২: ছিয়াম ফরয করার উদ্দেশ্য হলো তাক্বওয়া অর্জন।

প্রশ্ন হলো এই সমীকরণের সমাধান কীভাবে হতে পারে?

এর সমাধান হতে পারে নিচের আয়াতটিকে গভীরভাবে ধারণ করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمَنْ يَكْفُرْ بِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ ‘আর যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা এটা যথাযথভাবে তেলাওয়াত করে, তারা এর প্রতি ঈমান আনে। আর যারা এর প্রতি কুফরী করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’ (আল-বাক্বারা, ২/১২১)। তথা আয়াতে উল্লিখিত যথাযথ তেলাওয়াতকারীই হলো সেই ব্যক্তি, যার পক্ষে এই সমীকরণকে সহজভাবে মিলানো সম্ভব! তাহলে এই ‘যথাযথ তেলাওয়াত করে’ কিংবা حَقَّ تِلَاوَتِهِ শব্দ দ্বারা কুরআন কী বুঝিয়েছে? এর একটি অর্থ সম্পর্কে উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, هُمُ الَّذِينَ إِذَا مَرُّوا بِآيَةِ رَحْمَةٍ سَأَلُوهَا مِنَ اللَّهِ، وَإِذَا مَرُّوا بِآيَةِ عَذَابٍ اسْتَعَاذُوا مِنْهَا ‘যারা রহমত সংবলিত কোনো আয়াত দেখতে পেলে আল্লাহর কাছে তাঁর রহমত প্রার্থনা করে আর যখন আযাব সম্পর্কিত কোনো আয়াত সামনে আসে, তখন সেই আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়।[1]

হাসান বাছরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, هُمُ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ بِمُحْكَمِهِ، وَيُؤْمِنُونَ بِمُتَشَابِهِهِ، وَيَكِلُونَ مَا أَشْكَلَ عَلَيْهِمْ إِلَى عَالِمِهِ ‘এরা তো তারাই, যারা মুহকামাত বিষয়গুলোর উপর আমল করে, মুতাশাবিহাত বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের কাছে যা জটিল মনে হয়, তা আলেমদের দিকে সোপর্দ করে’।[2]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أَنْ يُحِلَّ حَلَالَهُ وَيُحَرِّمَ حَرَامَهُ، وَيَقْرَأَهُ كَمَا أَنْزَلَهُ اللَّهُ، وَلَا يُحَرِّفَ الْكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ، وَلَا يَتَأَوَّلَ مِنْهُ شَيْئًا عَلَى غَيْرِ تَأْوِيلِهِ ‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন! নিশ্চয়ই ‘যথাযথ তেলাওয়াত’ এর অর্থ হলো এর হালালকে হালাল হিসেবে গ্রহণ করা, হারামকে হারাম হিসেবে গ্রহণ করা, আল্লাহ যেভাবে নাযিল করেছেন, সেভাবে এর তেলাওয়াত করা, কোনো রকম বিকৃতি সাধন না করা, যা তার ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত নয়, এমন কোনো ব্যাখ্যা বা তাফসীর না করা।[3]

সুতরাং উপরিউক্ত সমীকরণ দুটির ফলাফল দাঁড়াল—

(১) রামাযানের গুরুত্ব বুঝতে হলে আপনাকে কুরআনের গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং পুরো রামাযান মাসে সেই গুরুত্বকে অর্থবহ করতে আপনাকে ছিয়াম পালন করতে হবে।

(২) ছিয়ামের মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জন কেবল তখনই সাধিত হতে পারে, যখন কুরআনের সাথে আপনার যাপিত জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য এবং সুগভীর সম্পর্ক গড়ে উঠবে। হোক তা তেলাওয়াত কিংবা বুঝার ক্ষেত্রে, হোক তা আপনার বিশ্বাস কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে, হোক জীবনঘনিষ্ঠ কোনো বিষয়ে তথা সকল বিষয়ে।

মনে রাখবেন, তাক্বওয়া কোনো চাট্টিখানি বিষয় নয়; বরং মহান আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদার মানদণ্ড হলো তাক্বওয়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে। আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাক্বওয়ার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী, সবকিছুর খবর রাখেন’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১৩)

আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে ও তাক্বওয়ার সাথে ছিয়াম পালন করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মেরাজুল ইসলাম প্রিয়

 ধলপুর লিচুবাগান জামে মসজিদ গেইট, বউ বাজার, সায়েদাবাদ, ঢাকা।


[1]. তাফসীরে কুরতুবী, ২/৮৬।

[2]. তাফসীরে কুরতুবী, ২/৮৬।

[3]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ১/৪০৩।

Magazine