বিয়ে হচ্ছে ইসলামী শরীআতের একটি বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুমিন নর-নারী তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। এই পারিবারিক এবং ধর্মীয় বন্ধনটি ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা একটি সুন্দর ইসলামী পরিবারেই প্রকৃত ইসলামের চর্চা হতে পারে। যে পরিবারে যত বেশি দ্বীনের চর্চা হবে, সেই পরিবার তত বেশি আল্লাহর কাছে প্রিয় হবে।
অথচ বর্তমান সময়ে পরিবারগুলোতে দ্বীনের চর্চা হয় না বললেই চলে। আর তাই এই বিবাহ বন্ধনগুলো খুব বেশি আকারে বিচ্ছেদে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু কেন বর্তমান সময়ে অধিক হারে ডিভোর্স হচ্ছে? আমরা যদি বর্তমান সময়ের বিবাহবিচ্ছেদের কারণগুলো অনুসন্ধান করি, তাহলে দেখতে পাব যে, দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে চরম অজ্ঞতাই ডিভোর্সের অন্যতম কারণ। তাহলে আসুন জানার চেষ্টা করি, কীভাবে ইসলামী জ্ঞানের অভাবে দিন দিন আমাদের দেশে বিবাহবিচ্ছেদ মহামারি আকার ধারণ করছে।
বিবাহবিচ্ছেদের বর্তমান পরিসংখ্যান:
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এই হার রীতিমতো ভয়াবহ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে একটি করে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। ২০২২ সালে শুধু রাজধানী ঢাকায় তালাকের ঘটনা হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি করে। প্রতিনিয়ত সারাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েই চলেছে।
এই বিবাহবিচ্ছেদ হঠাৎ করেই বেড়ে যায়নি। আমরা যদি গত এক যুগের বিবাহবিচ্ছেদের জরিপ দেখি, তাহলে বুঝতে পারব কীভাবে ধীরে ধীরে আমাদের সমাজে এই পারিবারিক নীরব ঘাতক প্রতিটি পরিবারকে গ্রাস করে চলেছে।
একটি জরিপে দেখা যায় যে, ঢাকায় ২০২১ সালে ১৪৬৫৯টি এবং ২০২০ সালে ১২৫১৩টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ২০২২ সালে চট্টগ্রামে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ৫৯৭৬টি। ২০২১ সালে রংপুরে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে ৭২১৫টি। ২০২০ সালে ময়মনসিংহে তালাকের ঘটনা ঘটেছে ৬৩৯০টি।
জরিপে আরও দেখা যায় যে, ঢাকা সিটি করপোরেশনে ২০১২ সালে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করা হয়েছিল ৭৪০২টি, ২০১৩ সালে ৭৭০৮টি, ২০১৪ সালে ৯০৪৫টি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রতি ঘণ্টায় একটি তালাকের জন্য জন্য আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনে। এভাবে চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে ১৮টি তালাক হয়।
মোটকথা আজকে আমরা বিবাহবিচ্ছেদের যে ব্যাপক পরিমাণ দেখছি, সেটা মূলত ধীরে ধীরেই আমাদের সমাজে বেড়ে উঠেছে। একটি জাতীয় পত্রিকার পক্ষ থেকে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা নিয়ে পরিচালিত একটি জরিপে উঠে এসেছে যে, অধিকাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে মেয়েদের পক্ষ থেকে। তাদের হিসেবে শতকরা ৭০ ভাগ বিচ্ছেদ হচ্ছে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে। একইসাথে তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে। জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি। বিবাহবিচ্ছেদের এসব তথ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBহাফিযাহুমুল্লাহ) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২’ শীর্ষক জরিপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
বিবাহবিচ্ছেদের কারণ:
বিভিন্ন কারণে আমাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে থাকে। বিবাহবিচ্ছেদ শুধু পুরুষ কিংবা শুধু নারীর পক্ষ থেকে হয় না; বরং স্বামী-স্ত্রী ছাড়া পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের চাপেও বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে থাকে। নিম্নে আমরা বিবাহবিচ্ছেদের কিছু কারণ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করব।
১. পরকীয়া: বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়া। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে নারী-পুরুষের অবাধ ও সহজ যোগাযোগের ফলে বেড়ে গেছে পরকীয়ার সম্পর্ক। আধুনিক যুগে স্মার্ট ডিভাইসে হাতের আঙুলে চাপ দিলেই পাওয়া যাচ্ছে নর-নারীর সংস্পর্শ। ফলে শয়তানের প্ররোচনা ছাড়াই বিবাহিত নারী-পুরুষ একে অপরের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে পরকীয়ায় জড়িতরা পরবর্তীতে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে নতুন সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যায়।
২. শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন: বিভিন্ন কারণে (যৌতুক, গোঁয়ারতুমি, স্বামীর অবাধ্যতা, বদমেজাজ, জুয়া, মাদকাসক্তি ইত্যাদি) স্বামী কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণেও সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
৩. যৌতুক: সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে বেশিরভাগ সময় যৌতুকের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
৪. জুয়া ও মাদকাসক্তি: আমাদের দেশে গত এক যুগ ধরে জুয়া ও মাদকাসক্তির প্রবণতা বেড়ে গেছে। ফলে এই জুয়াড়ি ও মাদকাসক্ত স্বামীরা সহজে সুস্থভাবে সংসার করতে পারে না। সেজন্য তাদের সংসারে বিচ্ছেদ ঘটে।
৫. স্বামীর অবাধ্যতা: আমাদের দেশে পুরুষরা খুব কমই ডিভোর্স দিয়ে থাকে। যে কয়েকটি কারণে স্বামীরা ডিভোর্স দিয়ে থাকে, তার অন্যতম হলো স্বামীর অবাধ্যতা। একই সাথে স্ত্রীর অতিরিক্ত আধুনিকতার কারণেও স্বামীরা ডিভোর্স দিয়ে থাকে।
৬. ধর্মীয় অনুশাসন চর্চা না করা: স্বামী-স্ত্রীর একজন কিংবা উভয়েই ধর্মীয় অনুশাসন না মেনে চলার কারণে সংসারে নানান অশান্তি দেখা দেয়। আর এইসব অশান্তির ফলে একসময় তারা ডিভোর্সের দিকে এগিয়ে যায়।
৭. নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: বর্তমান সময়ে নারীরা নানান পেশায় জড়িত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে বেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তাদের বৈবাহিক জীবনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে তারা সংসারে মানিয়ে নেওয়ার চাইতে আলাদা থাকাকেই পছন্দ করে বেশি। যে কারণে সংসারে কোনো না কোনো ঝামেলা হলেই এইসব নারীরা ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে ডিভোর্সের দিকে এগিয়ে যায়। এছাড়াও মেয়েদের সেক্যুলার উচ্চশিক্ষা ও নিজেদেরকে পুরুষের সমকক্ষ ভেবে স্বামীকে যথাযথ সম্মান না দেওয়ার কারণেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
৮. মনোমালিন্য: সংসার জীবনে টুকটাক মনোমালিন্য হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অনেকেই নিজেদের ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সৃষ্ট মনোমালিন্যগুলো একসময় বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৯. পারিবারিক প্ররোচনা: কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পরিবারের সদস্যদের নানান কুটিলতা এবং প্ররোচনাও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হয়ে যায়।
১০. পরস্পরের উপর শ্রদ্ধাবোধ না থাকা: সমবয়সী কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য বেশি না হলে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে না। ফলে সংসারে খোঁচাখুঁচি শুরু হলে ঐ সংসার আর বেশিদিন টিকে না।
১১. অমতে বিয়ে দেওয়া: মেয়ের অমতে পারিবারিক সিদ্ধান্তে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার ফলেও সংসার ভেঙে যায়।
১২. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দূরত্ব: সংসারের শুরু থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ এবং বনিবনা না হলে ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এছাড়াও দুজনই চাকরিজীবী হলেও নানান কারণে দূরত্ব বেড়ে যায়। আর এই দূরত্বই একসময় বিবাহবিচ্ছেদের দিকে এগিয়ে যায়।
১৩. কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রীর ব্যস্ততা: আধুনিক জীবনে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরাও প্রয়োজনে বা শখের বশে কিংবা নিজেকে যাহির করার জন্য হলেও অনেকে চাকরি করে। ফলে পেশাগত ব্যস্ততা ও সাংসারিক কাজ একসঙ্গে সামাল দিতে না পারায় তারা অত্যধিক চাপে পড়ে যায়। তখন স্বামীর সাথে বনিবনা না হলে তারা ডিভোর্সকেই সমাধান হিসেবে বেছে নেয়।
দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা- কীভাবে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ:
আমরা যদি বিবাহবিচ্ছেদের কারণগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব যে, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ না থাকাটাই ডিভোর্সের মূল কারণ। আমরা যদি আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে ইসলামের সঠিক শিক্ষার চর্চা করতাম, তাহলে আজ আমাদের দেশে গণহারে ডিভোর্স হতো না।
শুরুতেই যদি আমরা বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণ ‘পরকীয়া’ নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, ইসলাম সরাসরি পরকীয়ার বিরোধী। যেনা-ব্যভিচার প্রতিরোধের ব্যাপারে ইসলাম খুবই কঠোর। বিবাহিত নারী কিংবা পুরুষ যদি যেনা-ব্যভিচার বা পরকীয়ায় লিপ্ত হয়, তাহলে তার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
যদি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে ইসলামী আইনের অনুশাসন চলত, তাহলে কোনো বিবাহিত নারী-পুরুষ কখনোই পরকীয়ায় লিপ্ত হওয়ার সাহস পেত না। অথচ আমাদের সমাজে আজ পরকীয়ায় লিপ্ত হওয়া নারী-পুরুষের অভাব তো নেই, বরং উল্টো বাড়ছে।
আর এই পরকীয়া বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, ধর্মীয় জ্ঞান না থাকা এবং তা প্রতিপালন না করা। একজন মুসলিম নারী বা পুরুষ যদি জানত পরকীয়ার ইসলামী শাস্তি কী এবং পরকীয়ায় জড়িতদের রাষ্ট্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিচ্ছে, তাহলে কেউ সহজে এই পাপে নিজেকে জড়িত করত না।
একইভাবে যৌতুকের কারণে অসংখ্য সংসার ভেঙে যায়। অথচ এই যৌতুক প্রথা সরাসরি হিন্দুদের থেকে আগত। ইসলামে যৌতুকের কোনো সুযোগ নেই। ইসলাম নারীদের সম্মান দিয়েছে এবং কন্যা সন্তানের পিতা-মাতাকে দিয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ। আমাদের দেশে কন্যা সন্তানের পিতা-মাতার কাছে যৌতুকের জন্য দুনিয়াটা হয়ে যায় জাহান্নাম।
ইসলাম বলে, যে বিয়েতে খরচ কম হয়, সেই বিয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়; অথচ আমাদের দেশে বিয়েতে কে কত খরচ করতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিযোগিতায় বাধ্য হয়ে গরিবদেরও অংশগ্রহণ করতে হয়। ফলে যৌতুক দিতে গিয়ে আজ হাজারো কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবার পথের ফকীরে পরিণত হচ্ছে।
এ থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, যদি ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সঠিক জ্ঞান থাকত, তাহলে কখনোই তারা যৌতুকের মতো বিধর্মী কালচার চর্চা করত না এবং এর কারণে সংসারও ভাঙত না।
এছাড়াও স্বামী জুয়াড়ি ও মাদকাসক্ত থাকার কারণে অসংখ্য সংসার ভেঙে যায়। বিয়ে হওয়ার আগে পারিবারিকভাবে ছেলেকে যাচাই-বাছাই করা হলেও, মোটামুটি বিত্তশালী জুয়াড়ি কিংবা মাদকাসক্ত ছেলের ব্যাপারে কনেপক্ষের নমনীয়তার ভাব লক্ষ্য করা যায়।
অথচ ইসলামে জুয়াসহ যাবতীয় মাদক (বিড়ি, সিগারেট, তামাক, জর্দা ইত্যাদি) হারাম। মানুষ দুনিয়াবী লোভে পড়ে টাকা-পয়সা দেখে এমন হারামখোর ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে কিছুদিন পরেই দেখা দেয় সংসারে অশান্তি। পরবর্তীতে স্বামীর জুয়া আর মাদক কেনার টাকাও দিতে হয় কনেপক্ষকে। যখন সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়, তখন শেষমেশ ডিভোর্সই হয় তাদের শেষ ভরসা।
এছাড়াও আধুনিক মেয়েদের উচ্চশিক্ষা কিংবা পারিবারিক সুশিক্ষা না থাকাও অধিকাংশ বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখা যায়। একইসাথে স্বামীর অবাধ্যতা, স্বামী-স্ত্রীর মতের অমিল, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব ইত্যাদি তো আছেই। অথচ ইসলামের সঠিক অনুসরণ করলে কখনোই এইসব সমস্যার উদ্ভব হতো না।
ইসলাম বলে সংসারের কর্তৃত্ব থাকবে স্বামীর। তবে তা কখনোই স্ত্রীর ওপর জবরদস্তিমূলক নয়। স্ত্রী স্বামীর বাধ্যগত থাকবে, তবে স্ত্রীর মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কখনোই স্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন কিংবা ছোট করা যাবে না।
সুতরাং আমরা যদি সংসারে ইসলামের চর্চা করি, তাহলে কখনোই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিদ্বেষ, কোন্দল, অশ্রদ্ধা ইত্যাদি তৈরি হবে না, যার কারণে তাদের ডিভোর্স হতে পারে। এছাড়াও স্ত্রীদের কাজে সহযোগিতা করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য এক মহান শিক্ষা রেখে গিয়েছেন।
যদি সুন্নাহর অনুসরণ করে প্রতিটি স্বামী তার স্ত্রীকে সম্মান ও গুরুত্ব দিয়ে সংসারে সাহায্য-সহযোগিতা করত, তাহলে সংসারে কখনোই অশান্তি সৃষ্টি হতো না। একটি সংসারে ভুল বোঝাবুঝি তখনই সৃষ্টি হয়, যখন একে অপরের থেকে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা উঠে যায়। আর শয়তান তখনই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়, যখন সে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে।
যে কারণে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি বা মনোমালিন্য হলেই আমাদের সংসারগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। আমরা যদি সংসারে সত্যিকারের শান্তি বজায় রাখতে চাই, তাহলে আমাদের অনুসরণ করতে হবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনী। যিনি দেশও পরিচালনা করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন আবার উত্তমভাবে সংসারও সামলেছেন। সুতরাং ইসলামের আলোকে নারীকে সম্মান দিয়ে তার সুখ-দুঃখে পাশে থেকে সাহায্য-সহযোগিতা করে সংসার করলে, সেই সংসারে সহজে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না।
আরেকটি কারণ যা আমাদের সুন্দর সংসারগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে তা হচ্ছে, পারিবারিক প্ররোচনা। একজন নববধূ যখন একটি নতুন সংসারে প্রবেশ করে, তখন ঐ পরিবারের মানুষ ও পরিবেশ সবকিছুই তার কাছে নতুন। তাকে ঐ নতুন পরিবেশে টিকে থাকতে হলে সকলের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন।
যখন একজন নববধূ তার সংসারে প্রাপ্য সম্মান পায় না, তখন সে নিজ পরিবারের কাছে ছুটে যায় সাহায্যের আশায়। তখনই শয়তানের চক্রান্ত শুরু হয়। দোষ যারই থাকুক না কেন, তখন দুই পরিবারের মধ্যে এক অলিখিত যুদ্ধ শুরু হয়। যে যুদ্ধের ইন্ধনদাতা স্বয়ং ইবলীস শয়তান।
ইসলাম বলে, যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে হবে সুন্নাহসম্মত পদ্ধতিতে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা হলো স্ত্রীর সাথে যদি সমস্যা হয়, তাহলে তাকে উপদেশ দেওয়া, তাতে কাজ না হলে বিছানা আলাদা করা, তাতেও কাজ না হলে হালকা প্রহার করা, প্রয়োজনে উভয় পরিবার বসে সেটার সমাধান করা।
কিন্তু যখনই কোনো সংসারের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি হয়, তখনই কিছু মানুষ আগুনে ঘি ঢালার চেষ্টা করে। এরা আমাদের পরিবারেরই লোক। আল্লাহ যেখানে বলেন, তোমরা ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করো, এতে রয়েছে কল্যাণ। সেখানে আমাদের সংকীর্ণ জ্ঞানের কারণে আমরা সংসারগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদের প্ররোচনা দেই।
আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীকে শাসন করতে বলেছেন, তবে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করার অনুমতি দেননি। অথচ আমাদের সমাজে যৌতুকের মতো নিকৃষ্ট বিষয় নিয়েই মূলত স্ত্রীকে নির্যাতন করার ঘটনা ঘটে, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। আমরা যদি যৌতুকের মতো বিধর্মী কালচারগুলো নিষিদ্ধ করতে পারতাম, তাহলে আজ আমাদের সংসারগুলো যৌতুকের কারণে বলি হতো না। আমরা ইসলাম থেকে সরে বিধর্মীদের সংস্কৃতি চর্চা করার কারণে আজ আমাদের এই অবস্থা।
এসব ছাড়াও স্বামীর অবাধ্যতা, নারীর উচ্চশিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কারণেও সমাজে ডিভোর্সের হার বেড়ে গেছে। ইসলাম কখনোই নারী নেতৃত্বে বিশ্বাসী নয়, তাই সংসার স্বামীর কর্তৃত্বে থাকবে। তবে তার মানে এই নয় যে, সে স্ত্রীকে অবজ্ঞা করবে; এটা কিন্তু ইসলামের শিক্ষা নয়।
সমাজে স্ত্রীদের অবাধ্যতার মূল কারণ হচ্ছে, সেক্যুলার উচ্চশিক্ষা এবং নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। অর্থাৎ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেক্যুলারিজমকে প্রমোট করার কারণে দেশে নারীবাদের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটছে। যার ফলে উচ্চশিক্ষিত কিংবা শিক্ষিত নারীরা দ্বীন ইসলামের চাইতে সেক্যুলারিজমকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে তারা স্বামীর বশ্যতা স্বীকার না করে নিজেকে স্বামীর ঊর্ধ্বে রাখতে চায়। একইসাথে যেসব নারী চাকরি কিংবা অন্যান্য পেশায় নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পেরেছে, তারাও সংসারে সমান অধিকারের বলে স্বামীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আর এই কারণে এসব নারীরা সংসার না করে ডিভোর্সের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
উপর্যুক্ত কারণ ছাড়াও চাকরিজীবী স্ত্রীরা সংসারে এবং পরিবারের ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো সময় দিতে পারে না, যার ফলে সংসারে স্বাভাবিকভাবেই ঝামেলা লেগে থাকে।
এছাড়াও কনের অমতে বিয়ে কিংবা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পালিয়ে বিয়ে করার কারণেও সংসারে ডিভোর্স হচ্ছে। কখনোই কনের অমতে কিংবা পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া বিয়ে ইসলামে গ্রহণযোগ্য হবে না আর তাই এই জাতীয় বিয়েগুলো বেশিদিন টিকে না।
আমরা যদি শরীআত মেনে কনের অনুমতি সাপেক্ষে পরিবার থেকে বিয়ে দিতাম, তাহলে সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটত না। মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আমরা যদি ইসলাম মেনে নিজেদের জীবন পরিচালনা করি, তাহলে অবশ্যই আমাদের সমাজ এবং সংসারে শান্তি বজায় থাকবে।
এছাড়াও আমাদের দেশে দ্বীনদারিতার চাইতে অর্থ-সম্পদকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। যার ফলে পাত্র দ্বীনদার হলেও অর্থ-সম্পদ না থাকার কারণে কোনো অভিভাবকই তার মেয়েকে ঐ পাত্রের কাছে বিয়ে দেয় না। পরবর্তীতে যখন পয়সাওয়ালা ছেলে দেখে মেয়ের বিয়ে দেয়, তখন সেই সংসারে স্বাভাবিকভাবেই নানান কারণে অশান্তি শুরু হয়। তাই দ্বীনদার পাত্র-পাত্রী পছন্দ না করার কারণেও সংসারে ভাঙন দেখা দেয়।
ইসলাম প্রতিপালনই ডিভোর্সের সমাধান:
উপর্যুক্ত কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব যে, আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে ইসলামের চর্চা না থাকার কারণে আমরা বর্তমানে ডিভোর্স নামক ভয়ংকর ব্যাধির সম্মুখীন হচ্ছি। আমরা যদি আমাদের জীবনে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করতাম, তাহলে আমাদের পরিবারগুলোতে আজ এই করুণ দশা হতো না।
আমরা যদি বিয়ের আগে পাত্র বা পাত্রীপক্ষকে ইসলামের মাপকাঠিতে যাচাই করতে পারি, তাহলে আমরা ভবিষ্যৎ ডিভোর্স থেকে রেহাই পেতে পারি। একজন প্রকৃত মুমিন জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামের চর্চা করে। তাই একজন ঈমানদার স্বামী কখনোই তার স্ত্রীর প্রতি অন্যায়-অবিচার করতে পারে না। একইসাথে একজন পরহেযগার মেয়ে সংসারে যতই দুঃখ-কষ্ট থাকুক না কেন, সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা করে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে শত বঞ্চনা সত্ত্বেও সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য।
অতএব, আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে নিজে দ্বীনদার হয়ে একজন দ্বীনদার সঙ্গী খোঁজা। যাতে নিজেদের ভবিষ্যত প্রজন্মও দ্বীনদার হতে পারে। তবে এটা খুবই অনুচিত যে, নিজে ইসলাম পালন না করে একজন পরহেযগার সঙ্গীকে বিয়ে করা। বিশেষ করে আমাদের সমাজে বিয়ের সময় পরহেযগার ছালাত আদায়কারী মেয়েকে বাছাই করা হয়; অথচ ছেলে ছালাত তো দূরের কথা, ইসলামের ছোটখাটো বিষয়গুলোও ঠিকমতো মানে না। আর তাই বিশিষ্ট আলেমদের অভিমত হচ্ছে, বেনামাযীর সাথে নামাযীর বিয়ে বৈধ নয়।
সুতরাং আগে নিজে দ্বীনদার হয়ে, তারপর আরেকজন দ্বীনদার সঙ্গী নির্বাচন করতে হবে। নিজে ইসলাম পালন না করে পরহেযগার স্ত্রী চাওয়াটা এক ধরনের স্ববিরোধিতা।
এই কারণে আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করা। তাই আসুন! আমরা আমাদের জীবনে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করি, যাতে আমরা বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের মতো মর্মান্তিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে পারি। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
* পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।