আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘নিশ্চয় যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জানো না’ (আন-নূর‚ ২৪/১৯)। এই আয়াত নাযিল হয় ‘ইফক্ব’ বা অপবাদ রটনার এক ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে। নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে মুনাফেক্ব ও গুজব রটনাকারী কিছু লোক মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল। সেই সময় দীর্ঘ ১০ আয়াত নাযিল হয় (আন-নূর, ২৪/১১-২০), যা অপবাদ রটনাকারীদের বিরুদ্ধে নাযিল হয় এবং আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর সতীত্বের সাক্ষ্য প্রদান করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে অপবাদ রটনা বা গুজব ছড়ানো শুধু একটি সামাজিক অপরাধ নয়, বরং তা একটি আধ্যাত্মিক ব্যাধিও বটে। কারণ এটি মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করে। এই অপরাধের ভয়াবহতা এতটাই মারাত্মক যে, আল্লাহ নিজেই এর প্রতিদান হিসেবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কথা ঘোষণা করেছেন। হাদীছে এসেছে, كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ ‘মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা কিছু শুনবে, তা-ই (যাচাইবিহীন) বলে বেড়াবে’।[1] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ ‘প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের রক্ত‚ সম্পদ ও মান-সম্মান (বিনষ্ট করা) হারাম’।[2]
উক্ত হাদীছগুলো সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখার মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করে। ইসলাম সম্মানিত জীবনের প্রতি যে গুরুত্ব দেয়, তা আধুনিক মানবাধিকার ঘোষণার আগেই প্রবর্তিত হয়েছিল।
ইসলামের চেতনা অনুযায়ী, অপরের চরিত্রের কুৎসা রটানো এক প্রকার নৈতিক সন্ত্রাস। মানুষ যখন নির্দোষ হয়েও সামাজিক অপবাদের শিকার হয়, তখন তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে এবং সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
বর্তমানে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, মানব মস্তিষ্ক অপমান ও সামাজিক অপবাদকে শারীরিক আঘাতের মতোই গ্রহণ করে (Lieberman & Eisenberger, UCLA Neuroscience Study, 2003)। অর্থাৎ একে অদৃশ্য, অথচ মারাত্মক আঘাত হিসেবে ধরা হয়।
কুরআন এইসব মানসিক বিষবাষ্প থেকে বাঁচার পথ নির্দেশ করে ঘোষণা করেছে,لَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بِأَنْفُسِهِمْ خَيْرًا وَقَالُوا هَذَا إِفْكٌ مُبِينٌ ‘যখন তোমরা এটা শুনলে, তখন কেন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা তাদের নিজেদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করল না এবং বলল না যে, এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ?’ (আন-নূর‚ ২৪/১২)। এই আয়াতে মানুষকে শেখানো হয়েছে, কোনো কিছু শোনামাত্র বিশ্বাস করা যাবে না; বরং সত্য যাচাই করতে হবে। আজকের মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেখানে প্রতি মুহূর্তে অসত্য তথ্য ভাইরাল হয়, সেখানে এই নীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ। আজকের সমাজে একটি মেয়ের কোনো ছবি বা ভিডিও এডিট করে মিথ্যা রটানো যায় এবং এর মাধ্যমে তার জীবন ধ্বংস করে দেওয়া যায়। ইসলাম এই কাজকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।
অপবাদ রটনার সামাজিক অভিঘাত ও নৈতিক পতন:
অপবাদ ছড়ানো শুধু একজন ব্যক্তির নয়, বরং পুরো সমাজের আত্মিক ও নৈতিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে। কুরআনে বারবার সতর্ক করা হয়েছে, অশ্লীলতা ও অপবাদ ছড়ানো সমাজে ফেতনা ও অস্থিরতা তৈরি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, الْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ ‘ফেতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর’ (আল-বাক্বারা‚ ২/১৯১)।
মানবসমাজে সম্মান ও বিশ্বাসই পারস্পরিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। যখন গুজব, অপবাদ ও চরিত্র হননের কৌশল ছড়িয়ে পড়ে, তখন সমাজে শঙ্কা, সন্দেহ, হিংসা ও বিচ্ছিন্নতা জন্ম নেয়। এমন সমাজে কেউ নিরাপদ নয়।
মানব আচরণ নিয়ে গবেষণাকারী মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ফিলিপ জিমবার্ডো বলেন, Dehumanizing someone through slander deactivates empathy and encourages cruelty অর্থাৎ অপবাদ মানুষকে নির্দয় ও নির্মম করে তোলে, কারণ তা সহমর্মিতা নষ্ট করে দেয়। এই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় দীর্ঘমেয়াদে একটি সমাজকে হিংস্র ও আত্মঘাতী করে তোলে।[3]
ইমাম ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ তার তাফসীর গ্রন্থে বলেন, ‘এই আয়াতগুলো আমাদের শেখায়, কীভাবে একটিমাত্র অপবাদ সমাজের স্থিতি ও ঈমানী পরিবেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে’।[4]
এমনকি আধুনিক সমাজবিজ্ঞান বলে, In collectivistic cultures, reputational damage can lead to significant psychological distress, including depression and anxiety, due to the high value placed on social harmony and group cohesion’. ‘সমষ্টিবাদী (collectivistic) সংস্কৃতিতে বসবাসকারী ব্যক্তিরা সামাজিক সম্মান ও গোষ্ঠীর সংহতির উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেন। ফলে যদি কারও সামাজিক সুনাম ক্ষুণ্ন হয়, তবে তা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও আত্মসম্মানবোধ হ্রাস। এই প্রভাবগুলো দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তি ও সমাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে’।[5]
অর্থাৎ সমাজ যখন সম্মানভিত্তিক হয়, তখন অপবাদ একটি অস্ত্র হয়ে ওঠে, যা আত্মহত্যা, বিচ্ছিন্নতা ও সামাজিক নিঃসঙ্গতা বাড়ায়।
সাস্কিয়া উইরিঙ্গার (Saskia Wieringa) তার ২০১১ সালের প্রবন্ধ ‘Sexual Slander and the 1965/66 Mass Killings in Indonesia: Political and Methodological Considerations’ (Journal of Contemporary Asia–তে প্রকাশিত)–এ ব্যাখ্যা করেন কীভাবে Gerwani (Gerakan Wanita Indonesia) নামক নারীবাদী সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন অপবাদ ছড়িয়ে তাদের সামাজিকভাবে নিঃশেষ করার কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছিল। তিনি দেখান যে‚ এই ধরনের অপবাদ নারীদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
আরো এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিথ্যা অভিযোগের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে PTSD (Post-Traumatic Stress Disorder)-এর লক্ষণ দেখতে পারেন, যেমন- অবসাদ, নিদ্রাহীনতা, আত্মঘাতী চিন্তা ইত্যাদি।
আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি সমাজে অপমান ও অবজ্ঞার শিকার হন, যা তাদের মানসিকভাবে ধ্বংস করে দেয়।
প্রযুক্তির যুগে অপবাদ রটনার নতুন রূপ ও ইসলামী প্রতিরোধ পন্থা:
প্রযুক্তির এই অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে তথ্যের আদান-প্রদান যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি অপবাদের মতো নৈতিক অবক্ষয়ের উপাদানগুলোও ভয়ানক রূপ নিয়েছে। যেই সমাজ একসময় অপবাদ ছড়াতে গুজব বা চিঠির ওপর নির্ভর করত, সেই সমাজ আজ এক ক্লিকেই লক্ষ লক্ষ মানুষের মান-সম্মান ধ্বংস করে দিতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অপবাদের ভাষা হয়েছে চিত্র, শব্দ, স্ক্রিনশট, এডিটেড ভিডিও, ক্লিকবেইট টাইটেল এবং মিথ্যা আখ্যানে মোড়ানো রিলস।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এক্স, টিকটক) এসব প্ল্যাটফর্ম আমাদের সমাজকে এক ধরনের ‘ডিজিটাল গসিপ কালচার’-এর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মস্তিষ্ক নেতিবাচক তথ্যকে ইতিবাচকের চেয়ে গড়ে ৬ গুণ বেশি গুরুত্ব দেয়।[6] এই মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাকে কাজে লাগিয়েই মিথ্যা প্রচারণাকারীরা মানুষের চরিত্র হনন করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করে।
ড্যানিয়েল কানেমান তাঁর ‘Thinking, Fast and Slow’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেন, মানুষ সীমিত তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যা প্রায়শই প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে ঘটে। সামাজিক মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর ক্যাপশন বা ভিডিও ক্লিপ দেখে মানুষ মুহূর্তেই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, কারণ তারা ‘What you see is all there is (WYSIATI)’ নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়।
অপবাদ যে কেবল মানসিক আঘাত দেয় তা নয়; বরং এটি মানবিক সম্পর্ক, সামাজিক আস্থা ও নৈতিক শৃঙ্খলার মৃত্যু ঘটায়। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (APA) রিপোর্ট করেছে, সামাজিক মিডিয়ায় সাইবার বুলিং এবং নেতিবাচক মন্তব্য তরুণদের মধ্যে বিষণ্নতা, আত্মহত্যার প্রবণতা এবং আত্মবিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি করতে পারে।
আধুনিক চিন্তাবিদ Noam Chomsky বলেন, Controlling the narrative is the new form of warfare. এই ‘narrative war’-এ অনেক মুসলিম ব্যক্তি, মুসলিম স্কলার ও ধার্মিক নারীরা নিছক ঈর্ষা, দ্বেষ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বলি হচ্ছেন। অথচ ইসলাম তার প্রতিটি অনুসারীকে শিক্ষা দেয়, যাচাই করো, সত্য জানো, তারপর মত প্রকাশ করো।
আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا ‘যদি কোনো ফাসেক্ব ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা তা যাচাই করো...’ (আল-হুজুরাত‚ ৪৯/৬)। এই একটি আয়াত আজকের ডিজিটাল যুগে মুসলিমদের তথ্য আদান-প্রদানে এক বৈপ্লবিক নীতিমালা হতে পারত, যদি আমরা তা অনুসরণ করতাম।
শুধু ইসলাম নয়, গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসও ‘ত্রি-স্তরীয় সত্য পরীক্ষার’ কথা বলতেন— (১) এটা কি সত্য?, (২) এটা কি ভালো? এবং (৩) এটা কি প্রয়োজনীয়?
এই তিনটি প্রশ্ন যদি আমরা প্রতিটি পোস্ট, রিলস বা কমেন্ট করার আগে নিজেদের কাছে করি, তবে ডিজিটাল অপবাদ প্রবাহ অনেকটা কমে যাবে।
ইসলামী শিষ্টাচার শুধু মুখের জন্য প্রযোজ্য নয়; বরং কিবোর্ড, ফোন ও ক্যামেরার জন্যও প্রযোজ্য। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন কল্যাণের কথা বলে অথবা চুপ থাকে’।[7]
অপবাদের বিরুদ্ধে ইসলামী বিচারব্যবস্থা ও সামাজিক জবাবদিহিতা:
ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তির সম্মান, সতীত্ব এবং মর্যাদাকে রক্ষা করা ফরয পর্যায়ের দায়িত্ব বলে অভিহিত করেছে। অপবাদ রটনাকে শুধু নৈতিক অপরাধ নয়, বরং ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেও গণ্য করা হয়েছে। কুরআন সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে,وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘আর যারা সতী নারীদের ওপর অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর তা প্রমাণে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারে, তাদেরকে ৮০ বেত্রাঘাত করো এবং তাদের সাক্ষ্য কখনও গ্রহণ করো না। তারা তো ফাসেক্ব’ (আন-নূর‚ ২৪/৪)। এই আয়াতে তিনটি দণ্ডনীয় শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে— ১. শারীরিক শাস্তি (৮০ বেত্রাঘাত), ২. আইনী অযোগ্যতা (সাক্ষ্য গ্রহণ না করা) এবং ৩. নৈতিক কলঙ্ক (ফাসেক্ব আখ্যা)।
এই বিধান সমাজে অপবাদ রটনার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ দেয়াল তৈরি করে। একজন ইসলামী রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব অপবাদ রটনাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিন সম্পর্কে এমন কিছু বলে, যা তার মধ্যে নেই, আল্লাহ তাকে রদগাতুল খাবাল-এ স্থায়ী করবেন, যতক্ষণ না সে তার কথা থেকে ফিরে আসে’।[8] এই হাদীছে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার ভয়াবহতা বর্ণনা করা হয়েছে। ‘রদগাতুল খাবাল’ হলো জাহান্নামের এমন একটি স্থান, যেখানে জাহান্নামবাসীদের পুঁজ ও রক্ত জমা হয়।
সামাজিক জবাবদিহিতাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মুসলিমের উচিত কোনো গুজব শোনামাত্রই তা যাচাই না করে ছড়িয়ে না দেওয়া। একজন মুসলিমের প্রথম দায়িত্ব হলো অপবাদ রটনা ও গুজবের উৎস থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং সতীত্ব রক্ষা করা।
যে সমাজ ইসলামকে শুধু ছালাত ও ছিয়ামে সীমাবদ্ধ রাখে; অথচ মানুষের ইযযত নষ্ট করে আনন্দ পায়, সে সমাজ এক ভয়ংকর আত্মবিধ্বংসী পথে চলছে। অপবাদ রটনাকে ঠেকাতে হলে কেবল আইন দিয়ে নয়; বরং চেতনা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আদর্শ দিয়েই আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একজন প্রকৃত মুসলিম তখনই পূর্ণাঙ্গ মুমিন হয়, যখন সে তার হৃদয়, মুখ ও বর্তমান যুগে ‘কিবোর্ড’-কে আল্লাহভীতির ছায়ায় রাখে। অপবাদ রোধে দরকার সচেতনতা, ধর্মীয় অনুশাসন এবং নৈতিক শুদ্ধতার এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مَا يَتَبَيَّنُ فِيهَا ، يَزِلُّ بِهَا فِى النَّارِ أَبْعَدَ مِمَّا بَيْنَ الْمَشْرِقِ.
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই বান্দা এমন কথা বলে; যা সে যাচাই-বাছাই করে না, সে এর কারণে জাহান্নামে পূর্বের দূরত্বের চেয়েও বেশি গভীরে পৌঁছবে’।[9]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যাবতীয় কুৎসা রটনা এবং মুসলিম ভাই-বোনের সম্মানহানি হয় এমন কাজ করা থেকে যোজন যোজন দূরে থেকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও ইলাহী আলোয় উদ্ভাসিত সমাজ প্রতিষ্ঠার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
হাফেয শাকিরুল ইসলাম
বিএসসি (অনার্স), প্রাণ-রসায়ন বিভাগ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪।
[3]. Stanford Prison Experiment, 1971.
[4]. তাফসীর ইবনু কাছীর, আন-নূর, ২৪/১১-১৯-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[5]. https://pmc.ncbi.nlm.nih.gov/articles/PMC4297733/
[6]. Baumeister et al., 2001, ‘Bad is Stronger Than Good’, Review of General Psychology.
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৩৬।
[8]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৯৭; মিশকাত, হা/৩৬১১।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৭৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৮৮।