মসজিদ আল্লাহর ঘর এবং এটি ইবাদত ও সামাজিক কার্যকলাপের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। আল্লাহ তাআলার যমীনে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ জায়গা হলো আল্লাহর ঘর তথা মসজিদ। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَحَبُّ الْبِلاَدِ إِلَى اللَّهِ مَسَاجِدُهَا وَأَبْغَضُ الْبِلاَدِ إِلَى اللَّهِ أَسْوَاقُهَا ‘আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো মসজিদসমূহ আর সবচেয়ে খারাপ জায়গা হলো বাজারসমূহ’।[1]
প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায়ের জন্য মুমিন বান্দাগণ মসজিদে যান। আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা মসজিদের আদব-কায়দা বিষয়ে আমাদের উদাসীনতা এবং কম জানার কারণে আমরা অনেক ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হচ্ছি অথবা অনেক ক্ষেত্রে গুনাহগার হয়ে যাচ্ছি। পূতপবিত্র হয়ে সুন্দর পোশাকে মসজিদে যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা যেকোনো পোশাকেই মসজিদে চলে যাচ্ছি। কখনো কখনো পোশাকে নানা ধরনের লেখা বা ছবি অন্যের ছালাতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। দু‘আ পড়ে ঘর থেকে বের হওয়া এবং পথে যেতে যেতেও দু‘আ পড়ার নিয়ম আছে। ডান পা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করা, বাম পা দিয়ে বের হওয়া এবং দু‘আ পাঠ করা মসজিদের অন্যতম আদব ও আমল। মসজিদে প্রবেশের পর দুই রাকআত তাহিয়্যাতুল মসজিদের ছালাত আদায় করে বসার বিধান থাকলেও না জানার কারণে অনেকেই মসজিদে প্রবেশের পর প্রথমে বসে যায় এবং পরে ছালাত আদায় করে। ফরয ছালাত খুশূ-খুযূ (বিনয়, নম্রতা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও তন্ময়তা) সহকারে জামাআতে আদায় করার ছওয়াব ২৭ গুণ বেশি।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الْمَلاَئِكَةُ تُصَلِّى عَلَى أَحَدِكُمْ مَا دَامَ فِى مُصَلاَّهُ الَّذِى صَلَّى فِيهِ مَا لَمْ يُحْدِثْ أَوْ يَقُمِ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ.
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত তার ছালাত আদায়ের স্থানে বসে থাকে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তার জন্য দু‘আ করতে থাকেন। তার ওযূ নষ্ট হওয়া অথবা উঠে চলে যাওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ এই বলে দু‘আ করতে থাকেন, হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করে দিন। হে আল্লাহ! তার প্রতি রহম করুন’।[2] আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদীছে বলা হয়েছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,سَوُّوا صُفُوفَكُمْ فَإِنَّ تَسْوِيَةَ الصُّفُوفِ مِنْ إِقَامَةِ الصَّلاَةِ ‘তোমরা তোমাদের কাতারগুলো সোজা করে নিবে। কেননা কাতার সোজা করা ছালাত প্রতিষ্ঠার অন্তর্ভুক্ত’।[3]
মোবাইল ফোনের যন্ত্রণায় এখন মসজিদে মুছল্লীরাও অতিষ্ঠ। মসজিদের ভিতর ‘মোবাইল ফোন বন্ধ রাখুন’ সংবলিত সাইনবোর্ড দিয়েও কাজ হচ্ছে না। অন্যের অসুবিধার কথা চিন্তা না করে কেউ কেউ আবার জোরে জোরে যিকির-আযকার করছেন। অথচ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী কাউকে কষ্ট দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এমতাবস্থায় অধিকতর প্রচারের নিমিত্তে মসজিদের আদব-কায়দা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমল আগ্রহী মুছল্লীদের জন্য সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো।
মসজিদের আদব-কায়দা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহ:
(১) উত্তম পোশাকে মসজিদে যাওয়া (আল-আ‘রাফ, ৭/৩১)।
(২) বাড়ি থেকে ওযূ করে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হওয়া।[4]
(৩) মসজিদে কিছু সময় অবস্থান করার নিয়্যত থাকলে নফল ই‘তিফাকের নিয়্যতে মসজিদে প্রবেশ করা।[5]
(৪) মসজিদে যাওয়ার আগে কাঁচা রসুন-পেঁয়াজ না খাওয়া, মিসওয়াক করা এবং দুর্গন্ধ মুক্ত হয়ে যাওয়া।[6]
(৫) তাড়াহুড়ো না করে ধীরস্থিরভাবে মসজিদে গমন করা।[7]
(৬) মসজিদের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথসমূহ যেকোনোভাবে প্রতিবন্ধকতামুক্ত রাখা।[8]
(৭) ডান পা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করা, বাম পা দিয়ে বের হওয়া এবং দু‘আ পাঠ করা।[9]
(৮) মসজিদে প্রবেশের পর দুই রাকআত তাহিয়্যাতুল মাসজিদের ছালাত আদায় করে তারপর বসা।[10]
(৯) জায়গা খালি থাকলে প্রথম কাতারে বসা।[11]
(১০) আযানের উত্তর দেওয়া, তারপর দরূদ পাঠ করা এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য অসীলার দু‘আ করা।[12]
(১১) জামাআত দাঁড়িয়ে গেলে আর কোনো সুন্নাতের নিয়্যত না করা।[13]
(১২) মসজিদে অবস্থানকালে মোবাইলের নানাবিধ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার সীমিত রাখা এবং অন্যের বিরক্তি বা কষ্টের কারণ না হওয়া।[14]
(১৩) জুমআর দিন মসজিদে যাওয়ার আগে উত্তমরূপে গোসল করা, মিসওয়াক করা, ওযূ করা এবং সুগন্ধি ব্যবহার করা।[15]
(১৪) জুমআর দিন মসজিদে অবস্থানকালে জায়গা ফাঁকা না রেখে বসা ও ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে না যাওয়া।[16]
(১৫) জুমআর দুই খুৎবার সময় চুপ থাকা ওয়াজিব।[17]
(১৬) ইমামের ঠিক পিছনে প্রথমে ডানে ও পরে বামে এভাবে পর্যায়ক্রমে দাঁড়িয়ে প্রথম কাতার পূর্ণ করা। একইভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং অন্যান্য কাতার পূর্ণ করা।[18]
(১৭) ফরয ছালাতে কাতার সোজা করা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো[19] এবং মোবাইল বন্ধ রাখা।
(১৮) খুশূ-খুযূ (বিনয়, নম্রতা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও তন্ময়তা) সহকারে জামাআতে ছালাত আদায় করা।[20]
(১৯) ফরয ছালাতের পর কিছু সময় সেখানে বসে অবস্থান করা, অন্যদের বের হতে সুযোগ দেওয়া ও সম্ভব হলে সুন্নাত ছালাতের জন্য স্থান পরিবর্তন করা।[21]
(২০) মসজিদে অবস্থানকালে নীরবে-নিঃশব্দে বা চুপিসারে যিকির-আযকার করা, দু‘আ করা এবং সুন্নাত বা নফল ছালাত আদায় করা।[22]
(২১) মসজিদে অবস্থানকালে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা ও ছালাত চলাকালীন সময়ে সশব্দে কিতাব পাঠ করা থেকে বিরত থাকা।[23]
(২২) মসজিদে বসে অহেতুক দুনিয়াবী কথাবার্তায় মাশগূল হওয়া থেকে বিরত থাকা।[24]
(২৩) মসজিদ সর্বদা পাক-পবিত্র রাখা এবং ওযূখানা, টয়লেট ও মসজিদ সংলগ্ন এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। পাক-পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক।[25]
(২৪) ছালাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করা নিষেধ।[26]
(২৫) মসজিদে অবস্থানকালে কোনোভাবেই অন্যের বিরক্তির বা কষ্টের কারণ না হওয়া এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা। কাউকে কষ্ট দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ।[27]
-ড. আবুল কালাম আযাদ
সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান, বিএআরসি, ঢাকা ও সাবেক মহাপরিচালক, বিএআরআই, গাজীপুর।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৭১।
[2]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬৯।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৩।
[4]. আবূ দাঊদ, হা/৫৬২।
[5]. আদ-দুররুল মুখতার, ১/৪৪৫; আল-মাজমূ, ৬/৪৮৯; আল-ইনছাফ, ৭/৫৬৬।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৫৫।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩৬।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৬৫।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬৮।
[10]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৬৩।
[11]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৫।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৪, ৩৮৫; আবূ দাঊদ, হা/৫২৫।
[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭১০।
[14]. মুসনাদ আহমাদ, হা/১৬৮১৯।
[15]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮১৩।
[16]. ইবনু মাজাহ, হা/১১১৫; আবূ দাঊদ, হা/১১১৮।
[17]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭১৩।
[18]. মিশকাত, হা/১১০৭, ১০৯৪।
[19]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৯।
[20]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪১, ৭৪২, ৬৪৫।
[21]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৩৭; আবূ দাঊদ, হা/৪৬৯, ১০০৬।
[22]. আল-আ‘রাফ ৭/৫৫; ইবনু মাজাহ, হা/৮০০।
[23]. আবূ দাঊদ, হা/১৩৩২।
[24]. বায়হাক্বী, হা/৪৫০৭।
[25]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৮।
[26]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১০।
[27]. মুসনাদ আহমাদ, হা/১৬৮১৯।
