কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

প্যারেন্টিং কী, কেন এবং কীভাবে?

post title will place here

পিতা-মাতার জন্য সন্তান হচ্ছে স্রষ্টার বিরাট এক নেয়ামত। সন্তান পিতা-মাতার চক্ষুর শীতলতা, অন্তরের প্রশান্তি, জীবনের পরিপূর্ণতা এবং সকল আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সন্তানের সঠিক লালনপালনের জন্য তাদের জন্মের পর থেকে প্রতিষ্ঠা অবধি পিতা-মাতাকে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়, যার উপর নির্ভর করে সন্তানের সুষ্ঠু গঠন, সুস্থ জন্ম, সুন্দর বিকাশ, সত্যিকারের শিক্ষা এবং সুপ্রতিষ্ঠা।

প্যারেন্টিং পরিচিতি : Parenting ইংরেজি শব্দ। এর প্রতিশব্দ Child rearing। বাংলায় অর্থ সন্তান প্রতিপালন। পরিভাষায় প্যারেন্টিং হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সন্তান জন্মের পর থেকে তার অগ্রগতির প্রতি সজাগ থাকা হয় এবং মানসিক, শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ইত্যাদি দিক দিয়ে তাকে সহযোগিতা করা হয়। এককথায়, সন্তান প্রতিপালনে পিতা-মাতার দায়িত্ব কর্তব্যই প্যারেন্টিং।

প্যারেন্টস পরিচিতি : জন্মদাতা পিতা-মাতা হলেন মূলত প্যারেন্টস। এছাড়া দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, নানা-নানি, খালা-খালু, মামা-মামি, অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কো-প্যারেন্টস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

প্যারেন্টিং-এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : প্যারেন্টিং একটি আমানতদারিতাপূর্ণ কাজ। এটি সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, এটি সন্তানের অধিকার নিশ্চিত করে, এটি পিতা-মাতাকে দায়িত্ব সচেতন করে, এটি পিতা-মাতা ও সন্তান উভয়ের জন্যই একটি গাইডলাইন। এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ। এটি সন্তানদের সঠিক আবেগ-অনুভূতি, তাদের মানসিক অথবা মনো-দৈহিক বিকাশের মূল চাবিকাঠি। এটি সন্তানের ইহ-পারলৌকিক জীবনে সফলতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা। এর উপর নির্ভর করে পিতা-মাতার মান-সম্মান, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সন্তানের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা; সর্বোপরি দেশ ও জাতির কল্যাণ। ভালো প্যারেন্টিংয়ের ফল হলো সুসন্তান, সুখী পরিবার, সুনাগরিক, সুস্থ সমাজ এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্র, সুশৃঙ্খল জাতি। আবার, প্যারেন্টিং ব্যর্থতার ফল হলো নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক অবক্ষয়, পাপাচার বৃদ্ধি, হতাশা, আদর্শহীনতা, চরিত্রহীন সন্তান, অশান্ত পরিবার, বিশৃঙ্খল রাষ্ট্র এবং বিপর্যস্ত বিশ্ব। সন্তানের সুষ্ঠু গঠন, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করে পিতা-মাতার জীবনকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করতে ভালো প্যারেন্টিংয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

প্যারেন্টিংয়ের ধরন : প্যারেন্টিং শব্দটি উন্নত বিশ্বে এটি খুবই আলোচিত একটি পরিভাষা হলেও আমাদের দেশের অধিকাংশ পিতা-মাতাই এ বিষয়ে মোটামুটি অজ্ঞ। তারা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে তাদের বাবা-মা ও আত্মীয়দের অনুশীলন করা রীতি এবং নিজেদের সাধারণ বুদ্ধি বা কমন সেন্সের উপর যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেকেলে, সময় অনুপযোগী, অবৈজ্ঞানিক এবং গবেষণাভিত্তিক নয়।

আমাদের কিছু প্যারেন্ট প্যারেন্টিং বলতে সন্তানের জন্য নামিদামি খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা এবং তাদের নাদুসনুদুস স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা বুঝেন। কিছু প্যারেন্ট শুধু সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। তারা ভোর থেকে গভীর রাত অবধি সন্তানকে বিভিন্ন কোচিং ও প্রাইভেট টিউটরের পেছনে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ান। তারা সন্তানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মোটেই খেয়াল করেন না। কিছু প্যারেন্ট সন্তানের কোনো বিষয়েই খবর রাখেন না। কিন্তু পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হলেই শুরু করেন বকাবকি, মারধর, ভাত বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিসহ নানা শাস্তি। কিছু প্যারেন্ট সন্তানকে নামিদামি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েই নিজেকে দায়মুক্ত মনে করেন। এরপর তারা শুধু সন্তানের চাহিদামতো টাকার জোগানই দেন। এ টাকা কোথায় ব্যয় হয় তারা কিছুই জানেন না। কিছু প্যারেন্ট প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সন্তানের পেছনে ছায়ার মতো লেগে থাকেন; কিন্তু এরপর তাদের আর কোনো খোঁজ রাখেন না।

কিছু প্যারেন্ট শুধু নিজের রুজি-রুটি, ব্যবসা-বাণিজ্য আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। সন্তানের কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ তার নেই। তাদের ধারণা বাড়ি-গাড়ি সবই আছে, এগুলো দেখভাল করলেই সন্তানের জীবন অনায়াসে পার হয়ে যাবে। কিছু প্যারেন্ট শুধু সন্তানের বৈষয়িক উন্নতি–অবনতির দিকে নজর রাখেন। তাদের চারিত্রিক শুদ্ধাচার ও পারলৌকিক সফলতা নিয়ে কিছুই ভাবেন না। কিছু প্যারেন্ট শুধু সন্তানের চারিত্রিক শুদ্ধাচার ও পারলৌকিক সফলতা নিয়েই চিন্তা করেন; পার্থিব উন্নতি ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না। এ জাতীয় চিন্তার কারণে প্রকারান্তরে তারা নিজেরাই যে ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন করছেন, সে দিকেও তাদের খেয়াল নেই। কিছু প্যারেন্ট সন্তানকে যমের মতো ভয় করেন। সন্তানের কথায় ওঠা-বসা করেন। সন্তানের উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে কারণে খুব সহজেই পিতা-মাতাকে যিম্মী করে নামিদামি মোবাইল, ক্যামেরা, ট্যাব, মোটরসাইকেলের সাথে ওয়াইফাই সংযোগ এবং হাজার হাজার নগদ টাকা বাগিয়ে নিচ্ছে সন্তানরা। আসলে উপরিউক্ত প্যারেন্টদের কোনো সিদ্ধান্তই সঠিক নয়। আবার সংখ্যায় কম হলেও কিছু প্যারেন্ট তাদের সন্তানের সুষ্ঠু গঠন, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দেন। তারা সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে খুবই যত্নবান। এরা সন্তানের সকল প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি স্নেহের শাসনও করেন। তারা সন্তানকে মন-প্রাণ উজার করে ভালোবাসেন; কিন্তু কোনো অন্যায় কর্ম ও আবদারকে প্রশ্রয় দেন না। এরাই যথার্থ প্যারেন্টস।

প্যারেন্টিং চ্যালেঞ্জ এবং আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি : পরিবার শিশুর প্রথম বিদ্যালয়। সন্তান সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বেশি শিক্ষালাভ করে তার পরিবার থেকে। সে পিতা-মাতা, দাদি-দাদা, চাচা-ফুফু এদের আচরণের ভালো-মন্দ দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই তার দৃষ্টিভঙ্গি গঠিত হয়। সুতরাং পরিবার থেকেই সততা-নৈতিকতার প্রশিক্ষণ শুরু করতে হবে। পরিবার যদি কলহ-বিবাদ, অনৈকতার বিষবাষ্পে ভরা থাকে, সে পরিবারে সন্তানের বেড়ে ওঠা, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা সবই বাধাগ্রস্ত হয়।

পরিবারের পরই শিশু সমাজ থেকে শিক্ষা পায়। সমাজের মানুষের আচরণের ভালো-মন্দ দ্বারাও সে প্রভাবিত হয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তারও দৃষ্টিভঙ্গি গঠিত হয়। সুতরাং সমাজে একটি শিশুর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার উপাদানগুলো অবশ্যই বিদ্যমান থাকতে হবে। কোনো সমাজের পিতা-মাতা, অভিভাবক বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি নিজে ধূমপান, মদপান, জুয়া, ধর্ষণ, ব্যভিচার, গুম, খুন, চুরি, লুটতরাজ, ডাকাতি, অশ্লীলতা ইত্যাদি অপকর্মের সাথে জড়িত থাকেন আর তাদের সন্তান বা অধীনস্তরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তাহলে প্রকৃত দোষী কে? সন্তান না অভিভাবক?

সন্তান লালনপালনের প্রধান দায়িত্ব পিতা-মাতা পালন করলেও সমাজ ও রাষ্ট্র তার সুষ্ঠু প্রতিপালনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কথায় আছে, ‘প্রজারা রাজার চরিত্রে চরিত্রবান হয়’। রাজা অর্থাৎ দায়িত্বশীলরা ভালো তো প্রজা বা নাগরিকরা ভালো। সর্বোচ্চ ৫০০ জন দায়িত্বশীল ব্যক্তিই দেশের চেহারা পরিবর্তন করে দিতে পারেন। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ইতিহাসের অক্ষয় ধ্রুবতারা, সর্বযুগের, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর খলীফাবৃন্দ, তাঁদের অনুসারীবৃন্দ। উমার ইবনু আব্দিল আযীয রহিমাহুল্লাহ তো মাত্র দুই বছরের শাসনামলে তৎকালীন পুরো মুসলিম বিশ্বে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন যে, যাকাত নেওয়ার মতো গরীব লোক সে সমাজে খুঁজে পাওয়া যেত না। আর ন্যায়বিচার, শান্তি ও নিরাপত্তাও ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের পরিবার নীতি-নৈতিকতার চর্চা প্রায় শূন্যের কোঠায়। পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। সর্বত্র অনৈতিকতার সয়লাব এবং নৈতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দায়িত্বশীলতা, আমানতদারিতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শালীনতাবোধ, জবাদিহিতার সোনার চেয়ার আজ দখল করে আছে মিথ্যাচার, গলাবাজি, বিচারহীনতা, দায়িত্বহীনতা, তছরুপ ও যুলুম, অশ্লীলতা, খেয়ানত, অযোগ্যতা আর অদক্ষতা। ন্যায়বোধ আজ নির্বাসনে। মানুষের খুন আজ নুনের চেয়ে সস্তা। রান্নাঘর থেকে সংসদ সর্বত্র নৈতিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এককভাবে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ সম্মানের দাবি করতে পারছেন না। এরকম অরাজক পরিবেশে অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে প্যারেন্টিং কতটা চ্যালেঞ্জিং তা অবশ্যই ভাবনার দাবি রাখে।

সফল প্যারেন্টিং-এর উপায় : পিতা-মাতাকে শুধু ভালো, সৎ, চরিত্রবান সন্তান আশা করে বসে থাকলে চলে না, এজন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সাথে সাথে বিজ্ঞানসম্মত সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হয়। সফল প্যারেন্টিং-এর ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা উচিত:

(১) আদর্শিক মডেল উপস্থাপন করতে হবে। কারণ তারাই সন্তানের সবচেয়ে বড় প্রভাবক। মনে রাখতে হবে, তেঁতুল গাছে কখনো আঙুর ফল ধরে না।

(২) উপার্জনে পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। কারণ হারাম ও অবৈধ অর্থে লালিত সন্তান কখনো আদর্শ মানুষ হতে পারে না।

(৩) উন্নত মূল্যবোধ ও নৈতিকতা যেমন— ধৈর্য, সততা, আমানতদারিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমা, উদারতা, পরার্থপরতা, আত্মসংযম, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি সদগুণ লালন করতে হবে।

(৪) বৈবাহিক ও দাম্পত্য জীবনে পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে।

(৫) বিয়ে, সন্তান জন্মদান ও লালনপালনের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

(৬) বিবাদ ও কলহমুক্ত সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে হবে।

(৭) ইতিবাচক ও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে হবে।

(৮) একান্ত ব্যক্তিগত কর্ম ও বিষয়াদির ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

(৯) সন্তানের শিক্ষকদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।

(১০) নিজের পিতা-মাতা ও আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। মাঝে মাঝে আত্মীয়দের বাসায় সন্তানদের বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে।

(১১) পরিবারে লৌকিকতামুক্ত ইসলাম শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ ধর্মহীন মানুষ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট।

(১২) কথায় ও কাজে দেশপ্রেম প্রমাণ করতে হবে। দেশবিরোধী কোনো কাজে যুক্ত থাকা যাবে না।

(১৩) সামাজিক কাজে ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হবে। এতে থিউরি শিক্ষাদানের পাশাপাশি প্রাকটিক্যালও হয়ে যাবে।

(১৪) সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখতে হবে।

(১৫) নিজেদের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্ন বা ইচ্ছা সন্তানের মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাই একক নয়; সবার সিদ্ধান্তে ভিশন গঠন করতে হবে।

(১৬) প্যারেন্টিং-সংশ্লিষ্ট বই-পুস্তক সংগ্রহ ও এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।

(১৭) আত্মসম্মানবোধ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে হবে।

(১৮) অপরিকল্পিত ও অপরিণামদর্শী ঋণগ্রহণ পরিহার করতে হবে। এগুলো সন্তানের মানসিক গঠনকে বাধাগ্রস্ত করে।

(১৯) বাসায় লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

(২০) বিশুদ্ধরূপে মাতৃভাষায় কথা বলতে হবে এবং সন্তানকে শুদ্ধভাবে মাতৃভাষায় কথা বলতে শেখাতে হবে।

(২১) মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুনামের পাশাপাশি এর মূল্যবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, কারিকুলাম, প্রশাসনিক অবস্থা, শিক্ষকের মান, তাদের আচরণ, নৈতিকতাবোধ, যোগ্যতা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

(২২) সন্তানের শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি প্যারেন্টস মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে।

(২৩) সন্তানের চলাফেরা, বন্ধুবান্ধব, বাসায় অবস্থান ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। সন্ধ্যার পর সন্তান যাতে বাসার বাইরে না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

(২৪) উন্মুক্ত পারিবারিক লাইব্রেরির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সন্তানেরা তাদের ইচ্ছামতো বই সেখান থেকে নিয়ে পড়তে পারে। মনে রাখতে হবে, ‘লাইব্রেরি হলো মনের হাসপাতাল’। তবে ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো লেখকের বই লাইব্রেরিতে রাখবেন না।

(২৫) সন্তানের বন্ধু তৈরির ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। মাঝে মাঝে তাদের বন্ধুর বাসায় পরিবারসহ আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

(২৬) মিডিয়া ও প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। সবাই মিলে দেখা যায় না এমন কিছু দেখা বা সার্চ করা যাবে না।

(২৭) প্রয়োজনে ইউটিউব থেকে ভালো ভালো শিক্ষণীয় জিনিস ডাউনলোড করে রাখতে হবে। পরে সময় সুযোগমতো সেগুলো দেখানো যেতে পারে। সপ্তাহে একদিন ইসলামিক প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। পরে সেটির শিক্ষণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

(২৮) সন্তানের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ ও ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে হবে। তার পোশাক ও চুলের কাটিং-এর প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।

(২৯) কারো কাছে কোনো কিছু চাইতে বা ঋণ করতে সন্তানকে পাঠানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৩০) সন্তান সম্পর্কে কোনো খারাপ মন্তব্য বা সমালোচনা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৩১) কোনো ডিভাইস যেমন টিভি, মোবাইল, ট্যাব ইত্যাদি এবং কোনো ব্যাক্তিকে পিতা-মাতার বিকল্প ভাবা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৩২) সন্তানের অন্তত এইচএসসি/আলিম পাশের আগে তাকে পারসোনাল এনড্রয়েড ফোন অথবা মোটরসাইকেল কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৩৩) সন্তানকে ছোট, নির্বোধ বা অবুঝ ভাবা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৩৪) কোনো ভুলের কারণে বকা দেওয়া বা প্রহার করা, অতিরিক্ত শাসন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৩৫) সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। বুঝাতে হবে যে, সকল সংস্কৃতিই সুস্থ নয়।

(৩৬) পারসোনাল হাইজিন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।

(৩৭) মানসিক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

(৩৮) বাসায় সাপ্তাহিক চা-চক্র/পাঠচক্রের আয়োজন করতে হবে।

(৩৯) পরিবারের উপার্জন সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। অতিরিক্ত নগদ অর্থ তার হাতে দেওয়া উচিত নয়।

(৪০) সন্তানের খরচের খাত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

(৪১) সন্তানের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে।

(৪২) শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পিতা-মাতার আসল কাজ বা দায়িত্ব শুরুই হয় তাদের বাসায় ফেরার পর।

(৪৩) কৌশলে হলেও সন্তানের মনের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আপনি উত্তর না দিলে সে অন্যজনকে আপনার চেয়ে জ্ঞানী ও আপনজন ভাববে।

(৪৪) ভার্চুয়াল প্লে-গ্রাউন্ডের পরিবর্তে খেলার মাঠের প্রতি সন্তানকে আগ্রহী করতে হবে।

(৪৫) ভালোবাসা, আদর আর কাউন্সিলিংয়ের সাথে সাথে স্নেহমিশ্রিত শাসনও করতে হবে।

মোটকথা, সন্তানের প্রতিটি পদক্ষেপ সজাগভাবে পর্যবেক্ষণ এবং তার সবরকম উন্নতির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করাই প্যারেন্টিং। সুখী-সমৃদ্ধ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব গঠনের মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন সফলতা নিশ্চিত করতে প্যারেন্টিং শিক্ষার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সন্তানের প্রভাবক তিনটি অঙ্গ— পিতা-মাতা, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে। সফল প্যারেন্টস হিসেবে মহান স্রষ্টা আমাদের সবাইকে কবুল করুন- আমীন!

মো. হাসিম আলী

সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।

Magazine