সমকামিতার ব্যাপারে হাদীছ কী বলে?
[১] জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِي عَمَلُ قَوْمِ لُوطٍ ‘আমি আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা ভয় করি, তা হলো লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর ক্বওমের কাজ’।[1] এখানে লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর ক্বওমের কাজ দ্বারা সমকামিতা উদ্দেশ্য, যা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।
[২] আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا اسْتَحَلَّتْ أُمَّتِي خَمْسًا فَعَلَيْهِمُ الدَّمَارُ: إِذَا ظَهَرَ التَّلَاعُنُ، وَشَرِبُوا الْخُمُورَ، وَلَبِسُوا الْحَرِيرَ، وَاتَّخَذُوا الْقِيَانَ، وَاكْتَفَى الرِّجَالُ بِالرِّجَالِ، وَالنِّس َاءُ بِالنِّسَاءِ. ‘যখন আমার উম্মত পাঁচটি বিষয়কে হালাল মনে করবে, তখন তাদের উপর ধ্বংস আপতিত হবে— যখন পরস্পরকে অভিশাপ করার বিষয় প্রকাশ পাবে, মদপান করবে, রেশমি বস্ত্র পরিধান করবে, গায়িকাদের গ্রহণ করবে এবং পুরুষ পুরুষকে ও নারী নারীকে (জৈবিক চাহিদা পূরণে) যথেষ্ট করে নেবে’।[2]
[৩] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لاَ يَنْظُرُ اللَّهُ إِلَى رَجُلٍ أَتَى رَجُلاً أَوْ امْرَأَةً فِي الدُّبُرِ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই পুরুষের দিকে দৃষ্টি দিবেন না, যে অন্য পুরুষের কাছে (জৈবিক চাহিদা পূরণে) গমন করে কিংবা স্ত্রীর পায়ুপথে গমন করে’।[3]
[৪] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لَعَنَ اللهُ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ، وَلَعَنَ اللهُ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ، وَلَعَنَ اللهُ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ ‘আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন, যে লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর জাতির কাজ করে, আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন, যে লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর জাতির কাজ করে, আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন, যে লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর জাতির কাজ করে’।[4]
[৫] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ وَجَدْتُمُوهُ يَعْمَلُ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ فَاقْتُلُوا الْفَاعِلَ وَالْمَفْعُولَ بِهِ ‘তোমরা যদি কাউকে লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর জাতির কাজ করতে দেখো, তাহলে কর্তা ও ভুক্তভোগী উভয়কেই হত্যা করো’।[5]
ইসলামে সমকামিতার ক্ষতি:
সমকামিতা অনৈতিক, অপমানজনক, ন্যক্কারজনক, জঘন্য, নিকৃষ্ট, অধঃপতিত, লাঞ্ছনাদায়ক, সর্বোচ্চ পর্যায়ের নোংরা ও নীচু কাজ। এটি বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক, বরং পশুত্বকেও হার মানানো অপরাধ। এটি মানবতা বিধ্বংসী অপরাধ।
এর মাধ্যমে আল্লাহর চিরাচরিত নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়, আল্লাহর সৃষ্টিরহস্যের সাথে ঠাট্টা করা হয়, আল্লাহর শাস্তি ও অভিশাপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দম্ভ করা হয়।
এতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, সম্মান, মর্যাদা সবই হারিয়ে দেয়। হায়া-শরম, লাজলজ্জার মাথা খায়। এটি মানুষের মনুষ্যত্ব ও ঈর্ষা নষ্ট করে দেয়, পুরুষত্ব ও নারীত্বের ধ্বংস সাধন করে। চোখ ও অন্তর্দৃষ্টি মেরে ফেলে, অন্তরের অপমৃত্যু ঘটায়। অপমানের পচা কাদায় মানুষকে নিমজ্জিত করে। এতে পরিবার ও পারিবারিক পবিত্র বন্ধন নষ্ট হয়। মানুষের বংশধারার বারোটা বাজে।
এতে সার্বক্ষণিক আফসোস ও যন্ত্রণা হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে রাখে আর এটাই তো শাস্তি হিসেবে যথেষ্ট।
এটি সমাজ বিধ্বংসী এবং নানা ধরনের নতুন রোগের জন্মদাতা।
ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘সব পাপের মধ্যে এ পাপটির (সমকামিতা) ক্ষতি ও বিপর্যয় সবচেয়ে ভয়াবহ। এটি কুফরীর পর সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয়। বরং অনেক সময় এটি হত্যা করার পাপ থেকেও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। ...আল্লাহ তাআলা লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর জাতির আগে জগতের আর কাউকে এই মহাপাপ দ্বারা পরীক্ষা করেননি। আর তাদেরকে তিনি এমন ভয়াবহ শাস্তি দিয়েছেন, যা তারা ছাড়া অন্য কাউকে দেননি। তিনি তাদেরকে একত্রে অনেক ধরনের শাস্তি দিয়েছেন: সম্পূর্ণ ধ্বংস, তাদের উপর তাদের শহর উল্টে ফেলা, ভূমিধসে মাটির নিচে ডুবিয়ে দেওয়া এবং আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করে ধ্বংস করা। আল্লাহ তাদের এমনভাবে শাস্তি দিয়েছেন, যা তারা ছাড়া অন্য কোনো জাতিকে তিনি দেননি। এমন ভয়াবহ শাস্তির কারণ হলো, এই গর্হিত অপরাধের ভয়াবহতা এতটাই নিকৃষ্ট যে, যখন এই পাপ কোথাও সংঘটিত হয়, তখন যেন পৃথিবী নিজেই চারিদিক থেকে কেঁপে ওঠে, ফেরেশতাগণ যখন তা প্রত্যক্ষ করেন, তখন আল্লাহর আযাব সেই অধিবাসীদের উপর আপতিত হওয়ার ভয়ে তাঁরা আসমানসমূহ ও জমিনের বিভিন্ন প্রান্তে পালিয়ে চলে যান, যাতে অধিবাসীদের সাথে তাদেরকেও সেই আযান পাকড়াও না করে। পৃথিবী তখন আল্লাহর কাছে আর্তনাদ করে, এমনকি পাহাড়সমূহ পর্যন্ত তাদের স্থানচ্যুত হওয়ার উপক্রম হয়।[6]
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছলেহ আল-উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘লিওয়াত্ব হলো পুরুষে-পুরুষে যৌনাচার। এটি মহা অশ্লীলতা ও অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। এটি দুনিয়া ও দ্বীনের ভয়ানক ধ্বংস ডেকে আনে। এটি নৈতিকতার বিনাশ ঘটায় এবং পুরুষত্ব ধ্বংস করে। এটি সমাজকে নষ্ট করে এবং মনোবল ভেঙে দেয়। এটি যাবতীয় কল্যাণ ও বরকত ধ্বংস করে দেয় এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও বিপদ ডেকে আনে। এটি ধ্বংস ও বিপর্যয়ের হাতিয়ার। এটি লাঞ্ছনা, অপমান ও কলঙ্কের কারণ। সুস্থ বিবেক একে ঘৃণা করে, সুস্থ স্বভাব একে প্রত্যাখ্যান করে এবং আসমানী শরী‘আতগুলো এ থেকে শুধু কঠোর নিষেধই করে না; বরং একে জঘন্য অপরাধ হিসেবেও গণ্য করে।
এতকিছু একারণে যে, সমকামিতা এক ভয়াবহ ক্ষতি এবং চরম যুলম। এটি সমকামীর প্রতি যুলম একারণে যে, তা তার নিজের প্রতি লাঞ্ছনা ও কলঙ্ক ডেকে আনে এবং নিজের জীবনকে ধ্বংস ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। আর এটি ভুক্তভোগীর প্রতি যুলম একারণে যে, সে নিজেই নিজের সম্মানহানি করে, নিজেকে অপমান করে এবং নিজের জন্য নীচুতা, অধঃপতন ও পুরুষত্বহীনতা মেনে নেয়। এ কারণে দেখা যায়, যে এই পাপে লিপ্ত, সে পুরুষদের মাঝেও নারীর মতো হয়ে যায়; তার মুখ থেকে লাঞ্ছনার অন্ধকার কখনো দূর হয় না— এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্তও নয়। এটি পুরো সমাজের প্রতিও এক চরম যুলম, কারণ এর ফলে সমাজে বিপদ ও দুর্যোগ নেমে আসে। আল্লাহ তাআলা আমাদের কাছে লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর ক্বওমের ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন, যেখানে তিনি তাদের উপর আকাশ থেকে শাস্তি বর্ষণ করেছিলেন, অর্থাৎ তাদের উপর উপরিভাগ থেকে কঠিন শাস্তি বর্ষণ করেছিলেন। তিনি তাদের উপর পোড়ামাটির প্রস্তরবৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং এমনভাবে তাদের গ্রামকে উল্টিয়ে দেন যে, গ্রামের উপরিভাগ নিচে আর নিচের অংশ উপরে করে দেন’।[7]
সমকামিতা করা মানে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন ও তার প্রাকৃতিক নিয়মকে ভেঙে চুরমার করার অপচেষ্টা করা। আর কুরআন-হাদীছের বক্তব্য স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করা হারাম। এটা শয়তানের এমন আদেশ, যার দ্বারা সে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الْأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ وَمَنْ يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُبِينًا (শয়তান বলে) ‘আমি অবশ্যই তাদের (মানুষদের) পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে মিথ্যা আশা দেখাব, তাদেরকে আদেশ করব, তারা অবশ্যই গবাদি পশুর কান কাটবে, আমি তাদেরকে বলব, তারা অবশ্যই আল্লাহর সৃষ্টি বদলে দেবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে বন্ধু বানায়, সে স্পষ্ট ধ্বংসে পতিত হয়’ (আন-নিসা, ৪/১১৭-১১৯)।
আল্লাহর ইচ্ছা পরিবর্তনের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘন করা গর্হিত অপরাধ ও নিকৃষ্ট কাজ, যার ফলাফল হলো আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া।
ইসলামে সমকামিতার দণ্ডবিধি:
সমকামিতা নৈতিক অপরাধ ও অবক্ষয়গুলোর একটি, যা মানবজাতির জন্য মোটেও শোভনীয় নয় এবং আল্লাহ মানুষকে যে স্বাভাবিক ফিতরাত দিয়েছেন, তার পরিপন্থি। সমকামিতা মানবতার প্রতি প্রকাশ্য আক্রমণ এবং এটি আল্লাহর নির্ধারিত প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধিতা। এজন্য আল্লাহ এটিকে ‘অশ্লীল কাজ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
সমকামিতা পাপটা যেহেতু অত্যন্ত কঠিন, সেহেতু এর দণ্ডও অত্যন্ত কঠিন। এ ব্যাপারে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ-এর বক্তব্যটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘সমকামিতার বিষয়ে কিছু আলেম বলেন, এর শাস্তি যেনার শাস্তির মতোই। আবার কেউ বলেন, এর শাস্তি যেনার শাস্তি থেকে হালকা।
কিন্তু সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হলো, যে এটি করে এবং যার সাথে করা হয়, উভয়কেই হত্যা করতে হবে— তারা বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত, এতে কোনো পার্থক্য নেই। আর এ ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্য রয়েছে। কারণ সুনানে আরবা‘আর সংকলকগণ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা যদি কাউকে লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর জাতির কাজ করতে দেখো, তাহলে কর্তা ও ভুক্তভোগী উভয়কেই হত্যা করো’। আবূ দাঊদের হাদীছে এসেছে, ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কোনো অবিবাহিত ব্যক্তি যদি সমকামিতায় ধরা পড়ে, তবে তাকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হবে। আলী ইবনু আবি ত্বলিব রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকেও এমনই ফতওয়া পাওয়া যায়।
ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ ছিল না যে, তাকে (সমকামীকে) হত্যা করতে হবে। তবে হত্যার পদ্ধতি নিয়ে কিছু মতপার্থক্য ছিল। যেমন:
(১) আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন।
(২) কেউ কেউ তলোয়ার দিয়ে হত্যার কথা বলেছেন।
(৩) কেউ কেউ বলেছেন, তাদের ওপর একটি দেয়াল চাপিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা দেয়ালের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়।
(৪) কেউ কেউ বলেন, তাদের উভয়কে সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত জায়গায় আটকে রাখতে হবে, যতক্ষণ না তারা সেখানে মরে যায়।
(৫) আবার কেউ বলেছেন, তাদেরকে একটি উঁচু প্রাচীরের চূড়ায় উঠিয়ে নিচে ফেলে দিতে হবে, এরপর ক্রমাগত পাথর ছুড়ে মেরে ফেলতে হবে, যেমনটি আল্লাহ লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর ক্বওমের সাথে করেছিলেন। এটি ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর একটি বর্ণনা।
তাঁর আরেকটি বর্ণনা হচ্ছে, তাদেরকে শুধু রজম করাই যথেষ্ট। অধিকাংশ সালাফ এই মতের উপরেই রয়েছেন। তারা বলেন, আল্লাহ তাআলা লূত্ব আলাইহিস সালাম-এর ক্বওমকে পাথর নিক্ষেপ করে ধ্বংস করেছিলেন এবং যেহেতু ইসলামে ব্যভিচারীর শাস্তিও রজম, তাই সমকামিতার শাস্তিও রজম হবে। তাই কর্তা ও ভুক্তভোগী উভয়কে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করতে হবে, তারা মুক্ত হোক বা দাস হোক অথবা একজন দাস হোক আরেকজন মুক্ত হোক— যদি উভয়েই প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তবে যদি যেকোনো একজন প্রাপ্তবয়স্ক না হয়, তাহলে তাকে হত্যা করা যাবে না, বরং কম শাস্তি দেওয়া হবে। রজম (পাথর নিক্ষেপে শাস্তি) শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য’।[8]
এ ব্যাপারে সারসংক্ষেপ বক্তব্য হচ্ছে, ‘ছাহাবীগণ একমত হয়েছেন যে, সমকামীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে তাঁরা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন—
- তাঁদের মধ্যে কেউ বলেছেন, আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। এটি আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত এবং আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুও এ মত গ্রহণ করেছিলেন।
- কারো মতে, অপরাধীকে উঁচু পাহাড় বা স্থানের চূড়া থেকে ফেলে দেওয়া হবে, তারপর পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হবে। এটি ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মত।
- আবার কেউ বলেছেন, অপরাধীকে রজম করতে হবে অর্থাৎ পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে। এটিও আলী ও ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে।
এরপর ছাহাবাগণের পরবর্তী যুগে ফক্বীহগণ বা ইসলামী আইনবিদগণ এ বিষয়ে মতভেদ করেছেন—
- কারো মতে, অপরাধীকে যেকোনো অবস্থায় হত্যা করতে হবে, বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত হোক।
- কারো মতে, অপরাধীর শাস্তি ব্যভিচারীর শাস্তির মতো হবে; যদি বিবাহিত হয়, তবে রজম করা হবে আর যদি অবিবাহিত হয়, তবে বেত্রাঘাত করা হবে।
- আবার কেউ বলেছেন, বিষয়টি শাসকের উপর নির্ভর করবে; তিনি যেভাবে উপযুক্ত মনে করবেন, সেই অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেবেন’।[9]
প্রশ্ন হতে পারে, ভুক্তভোগীকে কেন উক্ত শাস্তি দেওয়া হবে?
এর উত্তর হচ্ছে, ভুক্তভোগী (اَلْمَفْعُولُ بِهِ) সমকামীর (الْفَاعِلُ) মতোই অপরাধে অংশীদার। কারণ তারা উভয়েই এই অশ্লীলতায় জড়িত। তাই তাদের শাস্তি হত্যাই— যেমনটি হাদীছে এসেছে।
তবে এর দু’টি ব্যতিক্রম আছে:
(১) যদি ভুক্তভোগীকে মারধর বা হত্যার হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক এ কাজে বাধ্য করা হয়, তাহলে তার ওপর কোনো দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হবে না। বুহূতী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, وَلَا حَدَّ إِنْ أُكْرِهَ مَلُوطٌ بِهِ عَلَى اَللِّوَاطِ بِإِلْجَاءٍ بِأَنْ غَلَبَهُ اَلْوَاطِئُ عَلَى نَفْسِهِ أَوْ بِتَهْدِيدٍ بِنَحْوِ قَتْلٍ أَوْ ضَرْبٍ ‘যদি ভুক্তভোগীকে হত্যা বা মারের হুমকির মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে জোর করে তার সাথে সমকামিতা করা হয়, তাহলে তার ওপর কোনো দণ্ড নেই’।[10]
(২) যদি ভুক্তভোগী অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়, তাহলে তার ওপর দণ্ড প্রয়োগ করা হবে না। তবে তাকে শাস্তিমূলকভাবে শিক্ষা দেওয়া হবে ও শাসন করা হবে, যাতে সে ভবিষ্যতে এই অপরাধ থেকে বিরত থাকে— যেমনটি ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ–এর উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়। কুয়েতী ফিক্বহ বিষয়ক বিশ্বকোষ ‘আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ’-তে বলা হয়েছে,فَلَا حَدَّ عَلَى الْمَجْنُونِ وَالصَّبِيِّ بِاتِّفَاقٍ؛ لِأَنَّ الْحَدَّ عُقُوبَةٌ مَحْضَةٌ، فَتَسْتَدْعِي جِنَايَةً مَحْضَةً، وَفِعْلُ الصَّبِيِّ وَالْمَجْنُونِ لَا يُوصَفُ بِالْجِنَايَةِ؛ فَلَا حَدَّ عَلَيْهِمَا لِعَدَمِ الْجِنَايَةِ مِنْهُمَا ‘পাগল ও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর ওপর কোনো হাদ্ বা শরী‘আতনির্ধারিত কোনো দণ্ড না থাকার ব্যাপারে সর্বসম্মত ঐকমত্য রয়েছে। কারণ, হাদ্ হলো নিখাদ শাস্তি। আর তা প্রয়োগের জন্য নিখাদ অপরাধ থাকা জরুরী। কিন্তু শিশু ও পাগলের কাজকে অপরাধ বলা যায় না; তাই তাদের ওপর কোনো হাদ্ নেই, যেহেতু তাদের পক্ষ থেকে প্রকৃত অপরাধ সংঘটিত হয় না’।[11]
সমকামিতা প্রমাণিত হওয়ার শর্ত: অনেক ফক্বীহ সমকামিতাকে যেনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ এটিও যৌনাঙ্গ ভোগ। তাঁরা সামনের দিক ও পেছনের দিকের মধ্যে পার্থক্য করেননি এবং যেনার জন্য যেসব শর্ত বর্ণনা করেছেন, সমকামিতার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য করেছেন। সেই হিসেবে, যেভাবে যেনা প্রমাণিত হয় স্বীকারোক্তি অথবা চারজন পুরুষ সাক্ষীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে, সমকামিতাও ঠিক একইভাবে প্রমাণিত হতে হবে।
‘আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ’-তে এসেছে, يَثْبُتُ اللِّوَاطُ بِالإِْقْرَارِ أَوِ الشَّهَادَةِ. وَأَمَّا عَدَدُ الشُّهُودِ، فَقَدْ قَال جُمْهُورُ الْفُقَهَاءِ يَنْبَغِي أَنْ يَكُونَ عَدَدُهُمْ بِعَدَدِ شُهُودِ الزِّنَا أَيْ أَرْبَعَةِ رِجَالٍ. ‘সমকামিতা প্রমাণ হয় স্বীকারোক্তি বা সাক্ষ্যের মাধ্যমে। আর অধিকাংশ ফক্বীহ-এর মতে, সাক্ষীর সংখ্যা হতে হবে যেনার সাক্ষীর সংখ্যার মতোই— অর্থাৎ চারজন পুরুষ’।[12]
সমকামিতার দণ্ডবিধি প্রয়োগের শর্ত: ইসলামী শরী‘আতে দণ্ডবিধি কার্যকর করার জন্য কতিপয় শর্ত প্রযোজ্য। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—
(১) অপরাধী মুকাল্লাফ বা শরী‘আতের ভারার্পণের যোগ্য হওয়া: অর্থাৎ তাকে প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে। সুতরাং অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু বা পাগলের উপর হাদ্ কার্যকর হবে না।
(২) অপরাধে জোরজবরদস্তি না থাকা: যদি কেউ হত্যা বা অন্য ভয় দেখিয়ে সমকামিতায় বাধ্য করে, তবে তার উপর দণ্ডবিধি কার্যকর হবে না।
(৩) সমকামিতা প্রমাণিত হওয়া: স্বীকারোক্তি বা সাক্ষ্যের মাধ্যমে সমকামিতা প্রমাণিত হতে পারে।[13]
সমকামিতার দণ্ড কার্যকর করবেন কে?
ইসলামের দণ্ডবিধিগুলো কার্যকর করা কেবল মুসলিম শাসকের দায়িত্ব। সুতরাং কোনো ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, দল বা সংগঠন কেউই এসব দণ্ডবিধি কার্যকর করতে পারবে না। সঊদী আরবের ফতওয়ার বোর্ডের স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ বলেন,
وَلا يُقِيمُ الحُدُودَ إِلَّا الحَاكِمُ المُسْلِمُ، أَوْ مَنْ يَقُومُ مَقَامَ الحَاكِمِ، وَلا يَجُوزُ لِأَفْرَادِ المُسْلِمِينَ أَنْ يُقِيمُوا الحُدُودَ؛ لِمَا يَلْزَمُ عَلَى ذَلِكَ مِنَ الفَوْضَى وَالفِتْنَةِ.
‘হাদ্ বা দণ্ডবিধি (শরী‘আত নির্ধারিত শাস্তি) মুসলিম শাসক বা শাসকের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ছাড়া আর কেউই কার্যকর করতে পারবে না। সাধারণ মুসলিমদের পক্ষে দণ্ডবিধি কার্যকর করা জায়েয নেই। কারণ এর ফলে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি হবে’।[14]
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
* বিএ (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এমএ এবং এমফিল, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. সুনানে তিরমিযী, হা/১৪৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/২৫৬৩, ‘হাসান’।
[2]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৫০৮৬, ‘হাসান লি-গয়রিহী’।
[3]. সুনানে তিরমিযী, হা/১১৬৫, ‘হাসান’।
[4]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৮১৬, ‘ছহীহ’।
[5]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪৪৬২; সুনানে তিরমিযী, হা/১৪৫৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/২৫৬১, ‘হাসান-ছহীহ’।
[6]. আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়াইশ শাফী, পৃ. ১৬৯।
[7]. মুহাম্মাদ ইবনে ছলেহ আল-উছাইমীন, আয-যিয়াউল লামে‘ মিনাল খুত্বাবিল জাওয়ামে‘, পৃ. ৩৩৯-৩৪০।
[8]. মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২৮/৩৩৪-৩৩৫।
[9]. দ্রষ্টব্য: https://islamqa.info/ar/answers/38622
[10]. বুহূতী, শারহু মুনতাহাল ইরাদাত (আলামুল কুতুব, প্রথম প্রকাশ: ১৪১৪ হি./১৯৯৩ খৃ.), ৩/৩৪৮।
[11]. আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ২৫/৯৭।
[12]. আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ৩৫/৩৪১।
[13]. মুস্তফা খিন, মুস্তফা বুগা প্রমুখ, আল-ফিক্বহুল মানহাজি আলা মাযহাবিল ইমাম আশ-শাফেঈ, ৮/৬৩।
[14]. ফাতাওয়াল লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ২২/৭, ফতওয়া নং- ১৭৭৪৩।