মুরদানের সাথে কোলাকুলি করা ও তাকে চুমু খাওয়ার বিধান:
সম্মানিত পাঠক! আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, দাড়িবিহীন কিশোর-যুবকের দিকে তাকানোর চেয়ে তার সাথে নির্জনে যাওয়া বা থাকা বেশি মারাত্মক এবং এদুটোর চেয়ে মারাত্মক হচ্ছে তাকে চুমু খাওয়া। আর তাদের দিকে তাকানো বা তাদের সাথে নির্জনে অবস্থানের ব্যাপারেই যদি বিশেষ সতর্কবার্তা থাকে, তাহলে তাদেরকে চুমু খাওয়া কতটা মারাত্মক হতে পারে, একটু ভাবুন। তবে যে বিষয়টি এখানেও লক্ষণীয়, সেটি হচ্ছে কামভাব থাকা বা না থাকা। অনুরূপভাবে দাড়িবিহীন সেই কিশোর-যুবক সুদর্শন নাকি সুদর্শন নয়, সে বিষয়টিও এখানে লক্ষণীয়। তদুপরি শরীরের কোন অঙ্গে চুমু খাওয়া হচ্ছে— মুখে নাকি অন্য কোথাও সেটাও কিন্তু খেয়াল করতে হবে। কারণ এসব দিক বিবেচনায় চুমু খাওয়ার হুকুম বিভিন্ন রকম হতে পারে। নিচের আলোচনা থেকে এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
الصَّبِيُّ الْأَمْرَدُ الْمَلِيحُ بِمَنْزِلَةِ الْمَرْأَةِ الْأَجْنَبِيَّةِ فِي كَثِيرٍ مِنْ الْأُمُورِ وَلَا يَجُوزُ تَقْبِيلُهُ عَلَى وَجْهِ اللَّذَّةِ؛ بَلْ لَا يُقَبِّلُهُ إلَّا مَنْ يُؤْمَنُ عَلَيْهِ: كَالْأَبِ؛ وَالْإِخْوَةِ. وَلَا يَجُوزُ النَّظَرُ إلَيْهِ عَلَى هَذَا الْوَجْهِ بِاتِّفَاقِ النَّاسِ؛ بَلْ يَحْرُمُ عِنْدَ جُمْهُورِهِمْ النَّظَرُ إلَيْهِ عِنْدَ خَوْفِ ذَلِكَ. وَإِنَّمَا يُنْظَرُ إلَيْهِ لِحَاجَةِ بِلَا رِيبَةٍ مِثْلَ مُعَامَلَتِهِ وَالشَّهَادَةِ عَلَيْهِ وَنَحْوِ ذَلِكَ كَمَا يُنْظَرُ إلَى الْمَرْأَةِ لِلْحَاجَةِ.
وَأَمَّا "مُضَاجَعَتُهُ": فَهَذَا أَفْحَشُ مِنْ أَنْ يُسْأَلَ عَنْهُ، فَإِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: {مُرُوهُمْبِالصَّلَاةِلِسَبْعِ،وَاضْرِبُوهُمْعَلَيْهَالِعَشْرٍ،وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ} إذَا بَلَغُوا عَشْرَ سِنِينَ وَلَمْ يَحْتَلِمُوا بَعْدُ فَكَيْفَ بِمَا هُوَ فَوْقَ ذَلِكَ.
‘একজন সুদর্শন, দাড়িহীন বালক অনেক দিক থেকেই একজন বেগানা মহিলার মতো এবং স্বাদ গ্রহণের জন্য তাকে চুম্বন করা জায়েয নয়। বরং তার ব্যাপারে যারা বিশ্বস্ত, কেবল তারাই তাকে চুম্বন করতে পারেন। যেমন- বাবা, সহোদর ভাই। সকলের ঐকমত্য অনুসারে, ঐ একই উদ্দেশ্যে তার দিকে দৃষ্টি দেওয়াও জায়েয নয়। বরং তাদের অধিকাংশের মতে, যদি সেই আশঙ্কা থাকে, তবে তার দিকে তাকানো হারাম। তার দিকে কেবল প্রয়োজন পড়লে এবং সংশয়মুক্ত হলে তাকানো যাবে। যেমন- তার সাথে লেনদেনের সময়, সাক্ষ্য গ্রহণের সময় ইত্যাদি। ঠিক যেমনটা প্রয়োজন পড়লে নারীদের দিকে তাকানো যায়।
আর তার সাথে শোয়া অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ, এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস না করাই ভালো। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তাদেরকে সাত বছর বয়সে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দাও এবং এর জন্য দশ বছর বয়সে তাদেরকে প্রহার করো। আর এসময় তাদের বিছানায় আলাদা করে দাও’। যখন তারা দশ বছর বয়সে পদার্পণ করেছে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি, তখন যদি তাদের বিছানা আলাদা করে দিতে হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় হলে কী হতে পারে?![1]
কুয়েতী ফিক্বহ বিষয়ক বিশ্বকোষে এসেছে,
الأَمْرَدُ إِذَا لَمْ يَكُنْ صَبِيحَ الْوَجْهِ فَحُكْمُهُ حُكْمُ الرِّجَالِ فِي جَوَازِ تَقْبِيلِهِ لِلْوَدَاعِ وَالشَّفَقَةِ دُونَ الشَّهْوَةَ، أَمَّا إِذَا كَانَ صَبِيحَ الْوَجْهِ يُشْتَهَى فَيَأْخُذُ حُكْمَ النِّسَاءِ وَإِنِ اتَّحَدَ الْجِنْسُ، فَتَحْرُمُ مُصَافَحَتُهُ، وَتَقْبِيلُهُ، وَمُعَانَقَتُهُ بِقَصْدِ التَّلَذُّذِ عِنْدَ عَامَّةِ الْفُقَهَاءِ.
‘যদি দাড়িবিহীন ছেলে সুদর্শন না হয়, তাহলে বিদায় দেওয়া ও তার প্রতি স্নেহ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তাকে চুমু দেওয়া বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে তার হুকুম পুরুষদের মতোই। তবে, যদি সে সুদর্শন হয়, যাকে দেখে সাধারণত কামভাব জাগতে পারে, তাহলে সে নারীদের হুকুম গ্রহণ করবে— যদিও তারা একই লিঙ্গের হয়। সেজন্য অধিকাংশ ফক্বীহের মতে, আত্মতৃপ্তি লাভের আশায় তার সাথে মুছাফাহা করা, তাকে চুম্বন করা এবং তার সাথে কোলাকুলি করা হারাম’।[2]
একই বিশ্বকোষে আরো এসেছে,
لاَ يَجُوزُ لِلرَّجُل تَقْبِيل فَمِ الرَّجُل أَوْ يَدِهِ أَوْ شَيْءٍ مِنْهُ، وَكَذَا تَقْبِيل الْمَرْأَةِ لِلْمَرْأَةِ، وَالْمُعَانَقَةُ وَمُمَاسَّةُ الأْبْدَانِ، وَنَحْوِهَا، وَذَلِكَ كُلُّهُ إِذَا كَانَ عَلَى وَجْهِ الشَّهْوَةِ، وَهَذَا بِلاَ خِلاَفٍ بَيْنَ الْفُقَهَاءِ.
‘কামভাবসহ কোনো পুরুষের জন্য কোনো পুরুষের মুখ, হাত বা অন্য কোনো অঙ্গে চুমু খাওয়া যেমন জায়েয নেই, তেমনি কোনো নারীর জন্য কোনো নারীকে চুমু খাওয়া, কোলাকুলি করা, শরীর স্পর্শ করা ইত্যাদিও জায়েয নেই। আর এ ব্যাপারে ফক্বীহগণের মধ্যে দ্বিমত নেই’।[3]
উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কামভাব বা স্বাদ লাভের আশায় পরস্পর কোলাকুলি করা ও স্পর্শ করা যাবে না। তবে বিশেষ অবস্থায় নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে কোলাকুলি করা যাবে।
ইমাম বাগাবী রাহিমাহুল্লাহ আলিঙ্গন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন,فَأَمَّا الْمَأْذُوْنُ فِيْهِ، فَعِنْدَ التَّوْدِيْعِ، وَعِنْدَ الْقُدُوْمِ مِنَ السَّفَرِ وَطُوْلِ الْعَهْدِ بِالصَّاحِبِ، وَشِدَّةِ الْحُبِّ فِي اللَّهِ ‘কাউকে বিদায় দেওয়ার সময়, সফর থেকে কারো আগমনের সময়, লম্বা সময় বিরতির পর বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সময় এবং আল্লাহর জন্য গভীর ভালোবাসার ক্ষেত্রে আলিঙ্গন করা অনুমোদিত’।[4]
আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,كَانَ أَصْحَابُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا تَلَاقَوْا تَصَافَحُوا وَإِذَا قَدِمُوا مِنْ سَفَرٍ تَعَانَقُوا ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাহাবীগণ যখন পরস্পর সাক্ষাত করতেন, তখন তারা মুছাফাহা করতেন। আর যখন তারা সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন তারা একে অপরকে আলিঙ্গন করতেন’।[5]
অনুরূপভাবে আরো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চুমু খাওয়া যাবে না। তবে একটা প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে চুমু খাওয়া জায়েয— এমন কি কোনো ক্ষেত্র নেই? অনুরূপভাবে পরস্পর কোলাকুলি ক্ষেত্রগুলো কী কী?
চুমু খাওয়া জায়েয ক্ষেত্র অবশ্যই আছে। যেমন-
১. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। কারণ তাদের মধ্যে সহবাস যদি বৈধ হয়ে থাকে, তাহলে চুমু তো ব্যাপারই না। বরং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক শুধু নয়, নেকীর কাজও বটে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীগণকে চুমু খেতেন। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبَّلَ بَعْضَ نِسَائِهِ، ثُمَّ خَرَجَ إِلَى الصَّلاَةِ وَلَمْ يَتَوَضَّأْ ‘নবী তাঁর কোনো একজন স্ত্রীকে চুমু খেলেন। অতঃপর মসজিদে গেলেন, কিন্তু ওযূ করলেন না’।[6] স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার গভীর এসব সম্পর্কের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে অসংখ্য বক্তব্য রয়েছে।
২. আল্লাহভীরু আলেম, ন্যায়পরায়ণ শাসক, মাতা-পিতা, শিক্ষক এবং সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য— এমন প্রত্যেকের হাতে যেমন চুমু খাওয়া জায়েয, তেমনি তাঁদের মাথা, কপাল ও দুই চোখের মাঝখানেও চুমু খাওয়া জায়েয। তবে এসবগুলো হবে সদ্ব্যবহার ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য বা সাক্ষাৎ ও বিদায়ের সময় স্নেহপরবশ হয়ে অথবা দ্বীন পালন হিসেবে। আর তা হবে কামভাব না আসার ব্যাপারে নিরাপদ হওয়ার শর্তে।[7] ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,فَدَنَوْنَا مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَبَّلْنَا يَدَهُ ‘অতঃপর আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে গেলাম, অতঃপর তাঁর হাতে চুমু খেলাম’।[8]
৩. সন্তানকে চুমু খাওয়া জায়েয শুধু নয়, বরং সুন্নাত। মা-বাবা সন্তানের প্রতি ভালোবাসাসিক্ত হয়ে মাথা, কপাল ও গালে চুমু দেবেন— এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হাসান ইবনু আলীকে চুম্বন করেন। ঐ সময় তার নিকট আক্বরা ইবনু হাবিস তামীমী রাযিয়াল্লাহু আনহু বসা ছিলেন। আক্বরা ইবনু হাবিস রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমার ১০ জন সন্তান আছে, কিন্তু আমি তাদের কাউকেই কোনো দিন চুমু খাইনি। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, مَنْ لاَ يَرْحَمُ لاَ يُرْحَمُ ‘যে দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না’।[9]
৪. শর্তসাপেক্ষে অন্যান্য মাহরামকে চুমু দেওয়া যায়। শর্তগুলো নিম্নরূপ:
(ক) হৃদ্যতা, অনুগ্রহ এবং স্নেহের বশবর্তী হয়ে চুমু হতে হবে; রসিকতা বা খেলা হিসেবে হওয়া উচিত নয়; কামভাবের সাথে চুম্বন করার তো প্রশ্নই আসে না।
(খ) চুম্বন চেহারায় হতে হবে, তবে কপালে হলে আরো ভালো হয়, তার চেয়ে ভালো হয় মাথায় চুমু খেলে। মুখে চুমু খাওয়া জায়েয নেই।
(গ) ফেতনার ঝুঁকিমুক্ত হতে হবে। অতএব, যদি কোনো যুবক আশঙ্কা করে যে, তার চুম্বন তার মাঝে বা তার মাহরাম নারীর মাঝে প্রভাব ফেলবে, অথবা মাহরাম মেয়েটি যদি যুবকটির খারাপ চরিত্র বা ধর্মের অভাবের কারণে তার থেকে নিরাপদ বোধ না করে, তাহলে সেক্ষেত্রে চুম্বন জায়েয নেই।
(ঘ) তাদের মধ্যকার মাহরাম হওয়ার সম্পর্ক হতে হবে বংশসম্পর্কীয় মাহরাম। যেমন- মা, মেয়ে, বোন। দুধ সম্পর্কীয় ও বিয়ে সম্পর্কীয় মাহরামকে চুমু না দেওয়াই ভালো। যেমন- ছেলের বউ, স্ত্রীর মা, স্ত্রীর (অন্য পক্ষের) মেয়ে। কারণ এই ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কামভাব উদ্রেকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল।
এই শর্তগুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এসব শর্ত পূরণ করা হলে মাহরাম ব্যক্তিদের চুমু দেওয়া যায়।[10] আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর মর্যাদা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, যখন তিনি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসতেন, তিনি তার দিকে এগিয়ে যেতেন, এরপর তাকে চুম্বন করতেন এবং তাকে তার আসনে বসাতেন। আর যখনই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে আসতেন, তিনি তার আসন থেকে উঠে দাঁড়াতেন, এরপর তাকে চুম্বন করতেন এবং তাকে তার আসনে বসাতেন।[11]
বারা ইবনু আযিব রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে তার পরিবারের কাছে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করেই দেখলাম তার মেয়ে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় শুয়ে আছেন। আমি তার বাবাকে দেখলাম, তিনি তার গালে চুমু খেয়ে বললেন, মেয়ে! তুমি কেমন আছো?[12]
ইবনু মুফলিহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনু মানছূর রাহিমাহুল্লাহ আবূ আব্দুল্লাহ অর্থাৎ ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ-কে বললেন, একজন পুরুষ কি তার মাহরাম নারীকে চুম্বন করতে পারে? তিনি বললেন, যদি সে সফর থেকে আসে এবং নিজের জন্য (ফেতনার) ভয় না পায়, তাহলে চুম্বন করতে পারে। তবে কখনই মুখে চুমু দেবে না; বরং কপাল বা মাথায় চুমু দেবে।[13]
এখানে ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো জন্য পরস্পর মুখে চুমু খাওয়া যাবে না।
ছোট মেয়েদের দিকে তাকানো ও চুমু খাওয়ার বিধান কী?
উপরের আলোচনা থেকে আমরা মুরদান তথা দাড়িবিহীন কিশোর ও যুবকদের দিকে তাকানো, তাদের সাথে নির্জনে যাওয়া, তাদেরকে চুমু খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পেরেছি। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, তা হচ্ছে— তাহলে ছোট মেয়েদের দিকে তাকানো, তাদেরকে স্পর্শ করা, কোলে নেওয়া, চুমু খাওয়া ইত্যাদিও কি চলবে না?
সর্বসম্মতিক্রমে কামভাব ও স্বাদ পাওয়ার উদ্দেশ্যে ছোট মেয়ের দিকে তাকানো, তাকে চুমু খাওয়া ইত্যাদি হারাম।[14]
ইবনু কুদামা বলেন,قَالَ أَحْمَدُ، فِي رِوَايَةِ الْأَثْرَمِ فِي رَجُلٍ يَأْخُذُ الصَّغِيرَةَ فَيَضَعُهَا فِي حِجْرِهِ، وَيُقَبِّلُهَا: فَإِنْ كَانَ يَجِدُ شَهْوَةً فَلَا، وَإِنْ كَانَ لِغَيْرِ شَهْوَةٍ، فَلَا بَأْسَ ‘একজন পুরুষ একটি ছোট মেয়েকে তার কোলে নিলে এবং তাকে চুম্বন করলে বিধান কী হবে? সে ব্যাপারে ইমাম আহমাদ বলেন, যদি সে কামনা অনুভব করে, তাহলে এভাবে কোলে নিতে ও চুমু দিতে পারবে না। কিন্তু যদি তা কামনার জন্য না হয়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই’।[15]
তবে যদি কামভাবের কোনো উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে তাদের দিকে তাকানো বা তাদের সাথে মুছাফাহা করা যাবে কিনা?
এক্ষেত্রে সূত্র হচ্ছে, মেয়ে যদি এমন বয়সে উপনীত হয়, যে বয়সে তার দিকে তাকালে বা স্পর্শ করলে বা চুমু খেলে কামভাব জাগতে পারে, তাহলে তাদের সাথে একাজগুলো করা যাবে না— যদিও তারা এখনও প্রাপ্ত বয়স্কা হয়নি। রমলী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,الأَصْحُّ حِلُّ النَّظَرِ إِلَى صَغِيرَةٍ لَا تُشْتَهَى، لِأَنَّهَا غَيْرُ مَظَنَّةٍ لِلشَّهْوَةِ لِجِرْيَانِ النَّاسِ عَلَيْهِ فِي الأَعْصَارِ وَالأَمْصَارِ ‘সঠিক কথা হলো, এমন অল্পবয়সী মেয়ের দিকে তাকানো জায়েয— যার প্রতি সাধারণত কামভাব জাগে না। কারণ বিভিন্ন যুগ ও দেশে মানুষের স্বাভাবিক প্রচলন অনুযায়ী এমন মেয়ে সাধারণত কামনা জাগ্রত হওয়ার জায়গা নয়’।[16]
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছালেহ আল-উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
إِذَا بَلَغَتِ الْبِنْتُ حَدًّا تَتَعَلَّقُ بِهَا نُفُوسُ الرِّجَالِ وَشَهْوَاتُهُمْ فَإِنَّهَا تَحْتَجِبُ دَفْعًا لِلْفِتْنَةِ وَالشَّرِّ، وَيَخْتَلِفُ هَذَا بِاخْتِلَافِ النِّسَاءِ، فَإِنَّ مِنْهُنَّ مَنْ تَكُونُ سَرِيعَةَ النُّمُوِّ جَيِّدَةَ الشَّبَابِ، وَمِنْهُنَّ مَنْ تَكُونُ بِالْعَكْسِ.
‘যখন মেয়ে এমন এক বয়সে উপনীত হয়, যে সময় পুরুষদের মন ও আকাঙ্ক্ষা তার সাথে যুক্ত হতে পারে, তখন ফেতনা ও অকল্যাণ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে তাকে পর্দা করতে হবে। এটি বিভিন্ন মেয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। কারণ তাদের মধ্যে কেউ কেউ দ্রুত বড় হয় ও তরুণী হয়, আবার কেউ কেউ হয় এর উল্টো’।[17]
কুয়েতী ফিক্বহ বিষয়ক বিশ্বকোষে এসেছে,
وَاتَّفَقُوا –أَي الْفُقَهَاء- عَلَى أَنَّهُ يَجُوزُ لِلرَّجُل أَنْ يَنْظُرَ بِغَيْرِ شَهْوَةٍ إِلَى جَمِيعِ بَدَنِ الصَّغِيرَةِ الَّتِي لَمْ تَبْلُغْ حَدَّ الشَّهْوَةِ سِوَى الْفَرْجِ مِنْهَا.
‘তারা– অর্থাৎ ফক্বীহগণ- একমত যে, একজন পুরুষের জন্য কামভাব ছাড়া এমন ছোট বালিকার পুরো শরীরের দিকে তাকানো জায়েয, যাকে দেখে কামভাব হতে পারে এমন বয়স পর্যন্ত সে পৌঁছেনি। তবে তার যোনির দিকে তাকানো যাবে না’।[18]
এখানে একটা কথা স্পষ্ট করা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে— যে বয়সী মেয়েকে দেখে সাধারণত কামভাব জাগ্রত হতে পারে— একথার অর্থ হলো, ভালো মানুষের ভেতর কামভাব জাগ্রত হতে পারে। কারণ খারাপ মানুষের যে কোনো কিছু দেখে কামভাব জাগতে পারে। সুতরাং তার বিষয়টি এখানে বিবেচ্য নয়।
কামভাব উদ্রেক হওয়ার সেই বয়স নিয়ে ফক্বীহগণের মধ্যে মতভেদ আছে। আল-ফাওয়াকেহ আদ-দাওয়ানীতে এসেছে, (وَاخْتُلِفَ فِيهَا) أَيْ الصَّبِيَّةِ (إنْ كَانَتْ مِمَّنْ لَمْ تَبْلُغْ أَنْ تُشْتَهَى) كَبِنْتِ أَرْبَعٍ أَوْ خَمْسٍ ‘ছোট বালিকা কামভাবের বয়স পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। যেমন- চার বা পাঁচ বছরের মেয়ে’।[19] আবার মালেকী মাযহাব মতে, কোনো মেয়ে তিন বা চার বছর বয়সে উপনীত হলে তাকে স্পর্শ করা যাবে না, তবে তার দিকে তাকানো যাবে।[20]
সেজন্য, বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, এর কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। বরং সাধারণত কামভাবের উদ্রেক হয় কিনা সেটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অনুরূপভাবে ছোট বালিকাকে চুমু খাওয়াও জায়েয হবে না— যদি তৃপ্তি লাভের বাসনা জাগ্রত হয়। ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَتَقْبِيلُ الصَّبِيَّةِ الَّتِي لَهَا مِنَ الْعُمْرِ ثَلَاثُ سِنِينَ جَائِزٌ إِذْ لَا شَهْوَةَ تَقَعُ هُنَاكَ فِي الْأَغْلَبِ فَإِنْ وُجِدَ شَهْوَةٌ حُرِّمَ ذَلِكَ وَكَذَلِكَ الْخَلْوَةُ بِذَوَاتِ الْمَحَارِمِ فَإِنْ خِيفَ مِنْ ذَلِكَ حُرِّمَ فَتَأَمَّلْ هَذِهِ الْقَاعِدَةَ.
‘তিন বছর বয়সী মেয়েকে চুম্বন করা জায়েয, কারণ সেখানে সাধারণত কোনো কামভাব জাগে না। তবে যদি কামভাব থাকে, তাহলে তা হারাম হবে। মাহরামদের সাথে নির্জনে থাকার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যদি সেই আশঙ্কা থাকে, তাহলে তা হারাম হবে। এই সূত্রটির ব্যাপারে চিন্তা করুন’।[21]
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ, ৩২/২৪৭-২৪৮।
[2]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ১৩/১৩২।
[3]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ১৩/১৩০।
[4]. বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, ১২/২৯৩।
[5]. ত্ববারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৯৭, ‘হাসান’।
[6]. সুনানে তিরমিযী, হা/৮৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/৫০২, ‘ছহীহ’।
[7]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ১৩/১৩১।
[8]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, হা/২২৬, ‘ছহীহ’।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১৮।
[10]. islamqa.info-এর এই লিংক থেকে গৃহীত:
https://islamqa.info/ar/answers/114193/
[11]. সুনানে তিরমিযী, হা/৩৮৭২, ‘ছহীহ’।
[12]. সুনানে তিরমিযী, হা/৩৮৭২, ‘ছহীহ’।
[13]. ইবনু মুফলিহ, আল-আদাব আশ-শার‘ইয়্যাহ, ২/২৬৬।
[14]. দ্রষ্টব্য: আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ১৩/১৩০; https://islamqa.info/ar/answers/110354/
[15]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী, ৭/১০৩।
[16]. শামসুদ্দীন আর-রমলী, নিহায়াতুল মুহতাজ ইলা শারহিল মিনহাজ, ৬/১৮৯।
[17]. মুহাম্মাদ আল-উছাইমীন, মাজমূ‘আতু আসইলাতিন তাহুম্মুল উসরাহ আল-মুসলিমাহ, পৃ. ৪৩-৪৪।
[18]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ৪০/৩৪৭।
[19]. নাফরাবী, আল-ফাওয়াকেহ আদ-দাওয়ানী আলা রিসালাতি ইবনি আবী যায়েদ আল-ক্বায়রাওয়ানী, ১/৩০১।
[20]. এই লিংকে তথ্যটি পাবেন:
https://www.islamweb.net/ar/fatwa/26186/
[21]. তালবীসু ইবলীস, পৃ. ১৯৯।