আমরা অধিকাংশ মুসলিম ইবাদতের ক্ষেত্রে খুবই আবেগপ্রবণ। যখনই কোনো সন্মানিত আলেম গুরুত্বের সাথে বিভিন্ন ইবাদতের ফযীলত বর্ণনা করেন বা লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন, তখনই আমরা তাতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি এবং অগণিত ছওয়াবের আশায় বিনা দ্বিধায় ঐ সকল ইবাদত পালন করতে শুরু করি। কারণ অধিকাংশ মানুষই বিভিন্ন ইবাদত এবং এর ফযীলত সম্পর্কে সরাসরি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে জানার ব্যাপারে উদাসীন, ফলে তারা নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন মত, পথ ও ত্বরীক্বার আলেমদের অনুসরণ শুরু করে। ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে মানুষ প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত: ১. যারা আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, ২. যারা কোন পীর, বুজুর্গ, উস্তায, ইমাম, খত্বীব সাহেবদের অনুসরণ করে আর এই শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি। ৩. যারা শেষ নবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পূর্ণ অনুসরণ করে আর এই শ্রেণির অনুসারীর সংখ্যা খুব কম।
আমাদের মনে এই প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয় যে, ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে আমরা কি স্বাধীন? উল্লেখিত প্রথম দুই শ্রেণির কোনো একটিতে শামিল হয়ে ইসলাম পালন করলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কী আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন? এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটি সম্পুরক প্রশ্ন করা যাক, শ্রেষ্ঠ আদম সন্তান, সাইয়্যেদুল মুরসালীন, রহমাতুল্লিল আলামীন মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন ছিলেন? তিনি কি অহীর অনুসরণের পাশাপাশি কখনো কখনো নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছেন? কিংবা অন্য কাউকে অনুসরণ করেছেন? উত্তর হলো, না, বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তাঁকে এভাবে সতর্ক করেছেন,وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ ‘আর তুমি যদি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামতো চলো তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমানভিত্তিক কথাবার্তা বলে’ (আল-আনআম, ৬/১১৬)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর রাসূলকে শুধু অহীর অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে,إِنَّ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَ الَّذِي جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ ‘আল্লাহর পথনির্দেশই প্রকৃত পথনির্দেশ। জ্ঞান প্রাপ্তির পরও তুমি যদি অন্যদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো, তবে আল্লাহর পক্ষে তোমার কোনো অভিভাবক থাকবে না আর থাকবে না কোন সাহায্যকারীও’ (আল-বাক্বারা, ২/১২০)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ ‘তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে যে অহী তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়, তুমি শুধু তারই অনুসরণ করো’ (আল-আনআম, ৬/১০৬)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, وَاتَّبِعْ مَا يُوحَى إِلَيْكَ وَاصْبِرْ حَتَّى يَحْكُمَ اللَّهُ وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ ‘তোমার প্রতি যে অহী অবতীর্ণ হয়, তুমি তার অনুসরণ করো আর ধৈর্যধারণ করো, যে পর্যন্ত না আল্লাহ ফয়সালা করেন এবং আল্লাহই সর্বোত্তম ফয়সালাকারী’ (ইউনুস, ১০/১০৯)। আল্লাহ তাআলা বলেন, قُلْ إِنَّمَا أَتَّبِعُ مَا يُوحَى إِلَيَّ مِنْ رَبِّي ‘বলো, আমার প্রতিপালক থেকে যে প্রত্যাদেশ আমার নিকট আসে, আমি শুধু তারই অনুসরণ করি’ (আল-আ‘রাফ, ৭/২০৩)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى - إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى ‘তিনি (রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোন কিছু বলেন না, যা বলেন তা অহী থেকে প্রাপ্ত’ (আন-নাজম, ৫৩/৩-৪)।
সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেননি কিংবা মানবজাতির মধ্যে অন্য কাউকেও অনুসরণ করেননি। তিনি শুধু তাই অনুসরণ করেছেন, যা অহীসূত্রে আল্লাহর পক্ষ থেকে পেয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুনির্দিষ্টভাবে আমরা সাধারণ মুসলিমরা কাকে অনুসরণ করব? কার অনুসরণ করার জন্য আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট দায়বদ্ধ? আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
‘বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আলে-ইমরান, ৩/৩১)। অনুসরণ করার ক্ষেত্রে যে কোন ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা সংশয় দূর করতে এই আয়াতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহজ সমীকরণটির প্রতি লক্ষ্য করুন, চির আকাঙ্ক্ষিত জান্নাতে প্রবেশাধিকার পেতে প্রয়োজন আল্লাহর ক্ষমা এবং ভালোবাসা। আমরা সবাই কম-বেশি পাপ করি, আমরা কেউই জানি না, মীযানের পাল্লায় পাপ এবং পুণ্যের মধ্যে কোনটা হালকা হবে বা কোনটা ভারী হবে। আসলে, আল্লাহর ক্ষমা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর দয়া ও রহমত ছাড়া শুধু আমলের উপর নির্ভর করে আমরা কেউই জান্নাতে যেতে পারব না। সুতরাং চূড়ান্ত সফলতার জন্য ক্ষমার পাশাপাশি আল্লাহর ভালোবাসাও অপরিহার্য। আল্লাহর মহামূল্যবান ক্ষমা এবং ভালোবাসা পাওয়া যাবে শুধু তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনুসরণ করলে। আল্লাহ কখনো বলেননি, তাঁর প্রেরিত রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া উম্মতের মধ্যে অন্য কাউকে অনুসরণ করলে আল্লাহর ক্ষমা এবং ভালোবাসা পাওয়া যাবে।
যদি প্রশ্ন করা হয়, ইসলাম পালন করে আল্লাহর ভালোবাসা ও রহমত লাভ করে জান্নাতে যেতে আমরা কার আদর্শে অনুপ্রাণিত হব? কোন পীরের? কোন বুজুর্গের? কোন ওস্তাযের? কোন মুজতাহিদ ইমামের? কোন খত্বীবের? কোন সূফীকুল শিরোমণির? কোন হাকীমুল উম্মতের? কোন অলী-আওলিয়ার? এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি প্রশ্ন, ব্যক্তি পর্যায়ে এই প্রশ্নটির উত্তর একেক জন একেকভাবে দিবেন, কারণ আমরা সবাই একই মতাবলম্বী নই। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির সঠিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে পবিত্র কুরআনে। আল্লাহ তাআলা বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ এবং আখিরাতে বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আল-আহযাব, ৩৩/২১)। লক্ষ্য করুন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানবজাতির মধ্যে আর কাউকেও আমাদের জন্য আদর্শ নির্বাচিত করেননি। একমাত্র রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই হলেন উম্মতের সকলের জন্য উত্তম আদর্শ। পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল, কোনো পীর, ফক্বীর, মাওলানা, বুজুর্গ, উস্তায, মুজতাহিদ ইমাম, খত্বীব, সূফীকুল শিরোমণি, হাকীমুল উম্মত, অলী-আওলিয়া কেউই উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত আদর্শ নন। সুতরাং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনুসরণের লক্ষ্যে নিজ নিজ সুবিধামতো উম্মতের কাউকে মডেল বানিয়ে অন্ধভাবে অনুসরণ করা যাবে না। তবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যথাযথভাবে অনুসরণ করার সুবিধার্থে উল্লেখিত সকলের অহীভিত্তিক সহযোগিতা অনস্বীকার্য।
আফসোস! বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিমের ইবাদত-বন্দেগী তথা আমলের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, খুবই অল্প সংখ্যক মুসলিম সরাসরি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উত্তম আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে তাঁর অনুসরণ করছে। অধিকাংশ মুসলিম হয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের মধ্যে কাউকে আদর্শ বানিয়ে তাদের অনুসরণ করছে, নতুবা নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনেকেই অনুমানভিত্তিক অহী বহির্ভূত বিষয়সমূহকে অহী কিংবা অহীর অন্তর্ভুক্ত বিষয় মনে করে প্রতারিত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো, অহীভিত্তিক জ্ঞান অর্জনে অনীহা। অথচ পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত প্রথম আয়াত, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (আল-আলাক্বা, ৯৬/১)। আমরা প্রায় সবাই জানি, ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয’।[1]
বর্তমানে যে সকল ইবাদত-বন্দেগী তথা আমলের ক্ষেত্রে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনুসরণ করা হচ্ছে না, তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে পেশ করা হলো।
(১) ‘নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি...’ এভাবে নিয়্যত পড়ে ছালাত শুরু করা। স্মর্তব্য যে, নিয়্যত করার বিষয়টি সম্পূর্ণ মনের বিষয়, পড়ার নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ছাহাবীগণ কখনোই গদবাঁধা নিয়্যত পড়ে ছালাত শুরু করেননি। বরং তাঁরা প্রতিটি ইবাদতে মনে মনে নিয়্যত করেছেন। সুতরাং যারা এই পদ্ধতিতে নিয়্যত পড়ে ছালাত শুরু করেন, তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনুসরণ না করে হয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের মধ্যে কাউকে অনুসরণ করছেন, না হয় নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করছেন!
(২) ‘নাওয়াইতু আন আছূমা গাদান...’ এভাবে নিয়্যত পড়ে ছিয়াম শুরু করা। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ছাহাবীগণ কখনো নিয়্যত পড়ে ছিয়াম শুরু করেননি। সুতরাং যারা নিয়্যত পড়ে ছিয়াম শুরু করেন, তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনুসরণ না করে হয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের মধ্যে কাউকে অনুসরণ করছেন, না হয় নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করছেন!
(৩) অস্থির এবং যত্নহীনভাবে ছালাত আদায় করা (বিশেষ করে রুকূ এবং সিজদায় তাড়াহুড়া করা)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত তাঁর ছাহাবীগণ কখনো অস্থির এবং যত্নহীনভাবে ছালাত আদায় করেননি। সুতরাং যারা অস্থির এবং যত্নহীনভাবে ছালাত আদায় করেন, তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনুসরণ না করে হয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের মধ্যে কাউকে অনুসরণ করছেন, না হয় নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করছেন!
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
ধানমন্ডি, ঢাকা।
[1]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪; ছহীহুল জামে‘, হা/৩৯১৩; মিশকাত, হা/২১৮।