পবিত্র রামাযান হলো ছিয়াম সাধনা এবং সংযমের মাস। আল্লাহর কাছে বছরের ১২ মাসের মধ্যে এই একটি মাসের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অত্যধিক। তাই প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব হলো সারা বছরের ইবাদতের পাশাপাশি এই মাসে অতিরিক্ত এবং পরিপূর্ণ ইবাদতে নিয়োজিত থাকা। এই মাস যেহেতু মুসলিমদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু এই মাসের ইবাদত-বন্দেগী নিয়েও আমাদের যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রয়েছে। আজকে আমরা ছিয়াম পালন নিয়ে উপমহাদেশের মুসলিমদের ভুলভ্রান্তিগুলো জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
(ক) সাহরীসম্পর্কিত ভুল :
(১) আমরা সাহরীতে মানুষকে জাগানোর জন্য বিভিন্ন মাধ্যম যেমন— মাইকে দীর্ঘ সাইরেন দেওয়া, ঢোল পিটানো, হইহুল্লোড় ইত্যাদি করি। সেইসাথে মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি, গযল ইত্যাদি উচ্চৈঃস্বরে করা হয়, যা অনুচিত; বরং বিদআত।
(২) অনেকেই ছওম পালন করে কিন্তু ছওমের নিয়্যত করে না। অনেকে মুখে আরবীতে নিয়্যত করে, যা একটি ভুল পদ্ধতি। ছওম পালনের জন্য মুখে উচ্চস্বরে নয়; বরং অন্তরে নিয়্যত করা জরুরী।[1]
(৩) ‘সাহরী খেতে না পারলে ছওম হয় না’ এই কথাটি সম্পূর্ণ ভুল ও বিভ্রান্তিকর। সাহরী খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। অনেকেই মনে করেন সাহরীতে ভারী খাওয়াদাওয়া দরকার। তাই ভারী খাবার না থাকলে বা খেতে না পারলে অনেকে ছওম পালন করে না। এটা অনুচিত। কিছু না থাকলে পানি খেয়ে হলেও ছওম পালন করতে হবে। আবার অনেকে ছওমের নিয়্যতে রাত যাপন করল, কিন্তু সাহরী খেতে পারল না, তাই সে ওই দিন ছওম পালন করে না। এটাও ভুল। কেননা সাহরী খাওয়া সুন্নাহ।[2] আর ছিয়াম পালন করা ফরযে আইন।
(খ) ইফতার সম্পর্কিত ভুল :
(১) অনেকেই ইফতার ছহীহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ইফতার করতে বিলম্ব করে, যা সুন্নাহসম্মত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহরী দেরিতে ও ইফতার দ্রুত করার নির্দেশ দিয়েছেন।[3]
(২) কিছু মানুষ রয়েছে যারা মুয়াযযিন আযান শেষ করার পরে ইফতার শুরু করে, যা উচিত নয়। কেননা মাগরিবের আযানের আগেই কিন্তু ইফতারের সময় হয়ে যায়। তাই আযান শোনার সাথে সাথে ইফতার করা উচিত। এছাড়াও কিছু মানুষ আযানের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। এটাও ভুল।
(৩) সবচেয়ে মারাত্মক ভুল হচ্ছে, বেশি পরিমাণ ইফতার করতে গিয়ে মাগরিবের ছালাত জামাআতে আদায় না করা। আবার অনেক মসজিদের ইমাম-মুছল্লী আছেন, যারা দু’লোক্বমা মুখে দিয়ে তড়িঘড়ি করে মাগরিবের ছালাত আদায় করে ফেলে। যার ফলে অধিকাংশ লোক জামাআত পায় না। মোটকথা, ন্যূনতম ইফতার করে জামাআত আদায় করা উচিত।
(৪) ইফতার নিয়ে সম্প্রতি যে কাজটা বেশি হচ্ছে, সেটা হলো নামে-বেনামে ‘ইফতার পার্টি’। মানুষকে ইফতার করানো অবশ্যই ছওয়াবের কাজ। কিন্তু দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে ও অশ্লীলতার জন্য ইফতার পার্টি কখনোই সঙ্গত নয়। কেননা সেখানে ধর্মীয় কোনো আবহ থাকে না; থাকে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং নাচ-গান। সেইসাথে দীর্ঘক্ষণ ইফতার পার্টির কারণে বেশ কয়েক ওয়াক্ত ছালাতও ফৌত হয়ে যায়, যা ছিয়াম সাধনার বিপরীত।
(গ) ছওমভঙ্গের কারণ সম্পর্কিত ভুল :
(১) অনেকেই মনে করে ভুল করে কিছু খেয়ে ফেললে হয়তো ছওম ভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু ভুলে কিছু খেয়ে ফেললে কখনোই ছওম ভাঙে না।[4]
(২) আমরা অনেকেই মনে করি ছওম অবস্থায় মেহেদী লাগানো যায় না। কিন্তু হাতে বা চুলে মেহেদী লাগালে ছওম ভাঙে না।
(৩) মেসওয়াক বা দাঁত ব্রাশ করলে ছওম নষ্ট হয় না। তবে সাবধানতার সাথে করতে হবে। চুল বা নখ কাটলে ছওম ভাঙে না।[5]
(৪) অনিচ্ছাকৃত কারণে বমি আসলে ছওম ভাঙে না। বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও ছওম ভাঙবে না।[6]
(৫) কুলি করার সময় অনিচ্ছায় কণ্ঠনালীতে পানি চলে গেলে ছওম ভাঙবে না।[7]
(৬) অনেকেই মনে করে শরীর থেকে রক্ত বের হলে ছওম ভেঙে যায়। এটি ঠিক নয়।[8]
(৭) অনেকের ধারণা, ছওম অবস্থায় রান্নাবান্নার প্রয়োজনে খাবার চেখে দেখা যাবে না। এটা ভুল। জিহ্বা দিয়ে স্বাদ দেখা জায়েয। কিন্তু গিলা যাবে না। প্রয়োজনে কুলি করে নিতে হবে।[9]
(৮) অনেকে মনে করেন শরীরে, দাড়িতে বা পোশাকে তেল, সুগন্ধি, সুরমা, প্রসাধনী ব্যবহার করা ও তার ঘ্রাণ নেওয়া যাবে না। এটা ভুল। এসব ব্যবহার জায়েয।[10]
(৯) খাদ্য হিসেবে না হলে প্রয়োজনে ইনজেকশন বিশেষ করে ইনসুলিন, ইনহেইলার, টিকা, স্যালাইন ইত্যাদি নেওয়াতে ছওম ভঙ্গ হয় না। সেইসাথে চোখে ঔষধ দিলেও ছওম ভাঙে না।[11]
(১০) ছিয়াম অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে ছিয়াম নষ্ট হবে না। কারণ এটি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এছাড়া ঘুমন্ত ব্যক্তির জন্য শারঈ বিধান প্রযোজ্য নয়।[12]
(ঘ) সাধারণ কিছু ভুল
(১) উপমহাদেশে অধিকাংশ মুসলিমের ধারণা, রামাযান মাসের খাওয়াদাওয়ার কোনো হিসাবনিকাশ নেই। তাই তারা ইচ্ছামতো খায়-দায়-মাস্তি করে। মোটকথা, তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া খরচ করে, যা একটি চরম ভুল। কেননা ইসলাম কখনোই প্রয়োজনের অতিরিক্ত অপচয় করাকে সমর্থন করে না।[13]
(২) রামাযান মাস সংযমের মাস হলেও অধিকাংশ গৃহিণী এবং ঘরের কর্তারা ইফতার-সাহরীর আয়োজন নিয়ে বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকেন। কিন্তু দু‘আ-দরূদ, যিকির-আযকার, কুরআন তেলাওয়াত প্রভৃতি সুন্নাহসম্মত ইবাদত থেকে গাফেল হয়ে পড়েন, যা ঠিক নয়।
(৩) যাকাত শুধু রামাযান মাসেই দিতে হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন, এটিও একটি বিভ্রান্তি। যাকাতের সম্পর্ক বর্ষপূর্তির সাথে; রামাযানের সাথে নয়। অর্থাৎ কারো সম্পত্তির মেয়াদ এক বছর হলেই তাকে যাকাত দিতে হবে। তবে রামাযানের বিশেষ ফযীলতের কথা চিন্তা করে একটু এগিয়ে বা পিছিয়ে নিয়ে এ মাসে যাকাত আদায় করা যায়।
(৪) অনেক মা-বাবা সন্তানদের ছোট থেকেই ছিয়াম পালনে উৎসাহ দেয় না। শুধু তাই নয়, বড় হওয়ার পরও স্কুল-কলেজে পড়ার চাপ সইতে পারবে না মনে করে ছওম পালনে বিরত রাখে। যা সম্পূর্ণ সুন্নাহবিরোধী কাজ। কারণ ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিশেষ কারণ ছাড়া রামাযানের ছিয়াম পালন করা ফরয (আল-বাক্বারা, ২/১৮৩)।
(৫) অনেক মানুষ রামাযানের ছিয়াম পালনকে একটি ইসলামিক রীতিনীতি বা রসম মনে করে উপবাস থাকে। অথচ ছিয়াম সাধনা মানে শুধু উপবাস নয়; বরং ছিয়াম পালন হচ্ছে আত্মশুদ্ধি। এই মাসে সকলের উচিত বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগীতে নিজেকে নিয়োজিত রেখে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। যাতে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ পাওয়া যায়। কেননা ছওম আল্লাহর জন্য, তিনিই এর প্রতিদান দিবেন।[14]
(৬) মানুষ উপবাস থাকার কারণে হয়তো কখনো মাথা গরম থাকে। যার ফলে কারণেঅকারণে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়, যা কখনোই উচিত নয়। কেননা উপবাস থাকার নাম ছওম নয়; বরং সংযম থাকার নামই হচ্ছে ছওম।[15]
(৭) অধিকাংশ মানুষই রামাযানের শিক্ষাকে ঈদের দিনেই শেষ করে দেয়। বিলাসিতা, আড্ডাবাজি, হইহুল্লোড়, নাচ-গান, নেশা, নাটক সিনেমা দেখাসহ যাবতীয় পাপ কাজে তারা ফিরে আসে, অথচ এগুলো থেকে পুরো রামাযান মাস তারা বিরত ছিল। এভাবে রামাযান থেকে শিক্ষা না নিয়ে পুনরায় শয়তানী কর্মকাণ্ডে ফিরে আসা খুবই দুঃখজনক এবং অনুচিত।[16]
(৮) অনেকেই আছেন সুখ-অসুখ চিন্তা না করে যে কোনো পরিস্থিতিতেই ছওম পালন করতেই হবে এমন গোঁ ধরে বসে থাকেন। যেখানে ইসলাম শুধু প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ ব্যক্তির জন্য ছওম ফরয করেছে, সেখানে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি (শারীরিক এবং মানসিক), ভ্রমণকারী, ক্ষতিকর মনে হলে অন্তঃসত্ত্বা বা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মহিলার জন্য ঐ সময় ছওম ফরয নয়। অসুস্থতার জন্য যতগুলো ছওম ভেঙে যায় তা পরবর্তীতে সুস্থ হলে পূরণ করে দেওয়া যায়। যদি কারো দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার কারণে ছওম পালন সম্ভবপর না হয় তবে তার জন্য রামাযান মাসে প্রতিদিন ফিদইয়া দেওয়া উচিত।[17]
(৯) উপমহাদেশে অনেক মুসলিম নিয়মিত ছালাত আদায়কারী নয়। অথচ রামাযান আসার সাথে সাথে তারা নিয়মিত মুছল্লী হয়ে যায়। তাদের নিয়্যতই থাকে বছরে এক মাস ছালাত-কালাম করব। অথচ মুমিন ও কাফেরের পার্থক্য ছালাত।[18]
(১০) অনেকে আছেন শুধু উপবাস থেকেই ছওম পালন করেন। ছালাত-কালামের বালাই নাই। শুধু সাহরী খেয়ে ইফতার করা পর্যন্তই তাদের ছওম পালন, যা কখনোই ইসলামসম্মত নয়।
(১১) কিছু কিছু মানুষের ধারণা যে, ছওম অবস্থায় কাউকে কিছু খেতে বা পান করতে দেখলে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত নয় যে, সে ছওম অবস্থায় আছে। অথচ এটা অনুচিত। তাকে অবশ্যই মনে করিয়ে দিতে হবে, সে ছওম পালন করছে।
(১২) অনেকে আছেন যারা রামাযানকে তাদের স্বাস্থ্য কমানোর মাস মনে করে ছওম পালন করে। অথচ ছওম একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া উচিত।
(১৩) ইয়ং জেনারেশনের অনেকে রামাযান মাসকে অলস সময় কাটানোর মাস মনে করে। তারা সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন অলস খেলাধুলা (লুডু, দাবা, তাস, কেরাম মোবাইল গেমিং বা জুয়া ইত্যাদিতে) লিপ্ত হয় যা এমনিতেই শরীআত সমর্থিত নয়। এছাড়াও কিছু মানুষ রয়েছে রাত জেগে অনর্থক মোবাইল ব্যবহার করে আর দিনের বেলা ঘুমায়। আর কিছু রয়েছে সারা দিনই সোশ্যাল মিডিয়াতে ফান-ট্রল করে, গান শুনে, মুভি দেখে সময় কাটায়। এগুলো সবই রামাযানের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক এবং আত্মশুদ্ধির পথে অন্তরায়।
(১৪) রামাযানের ছওম মানে উপবাস নয়; মানুষের খারাপ আচার-আচরণের কারণেও ছওম পরিপূর্ণ হয় না। কিছু অপরাধ আছে যা জিহ্বা দিয়েও হয়। যেমন কেউ যদি কারো নামে দুর্নাম রটান, গুজব, অপবাদ বা গীবত করে থাকেন কিংবা গালাগালি করেন তবে তার ছওম কবুল হওয়ার সম্ভাবনা কম।
(১৫) অনেক মানুষ আবার রামাযানের শেষের দিকে ছিয়াম সাধনা ছেড়ে দিয়ে ঈদের মার্কেটিংয়ে জড়িয়ে পড়েন, যা কখনোই উচিত নয় এবং রামাযানের শিক্ষাবিরোধী।
(১৬) অনেকের ধারণা পুরো রামাযান মাসে বুঝি তার সহধর্মিণীর সাথে সহবাস করতে পারবেন না; করলে অনেকেই খারাপ মনে করে, যা খুবই ভুল। ছওম পালনরত অবস্থা ছাড়া যেকোনো সময় সহবাস করা জায়েয। অনেকে ফরয গোসলের ভয়েও সহবাস করেন না। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। ছওম রেখে পরবর্তীতে গোসল করলেও ছওম আদায় হবে (আল-বাক্বারা, ২/১৮৭)।
(১৭) এছাড়াও স্বপ্নদোষ হলেও গোসল ছাড়া ছওম রাখা যাবে। অনেক নারীর রাতে ঋতুস্রাব শেষ হলেও গোসল করতে না পারার কারণে ঐ দিনের ছওম ছেড়ে দেন, যা কখনোই উচিত নয়। গোসল ছাড়াও ছওম পালনে বাধা নেই। তবে ছালাত আদায়ের জন্য গোসল করতে হবে।[19]
(ঙ)তারাবীহ সম্পর্কিত ভুল :
(১) অনেকে মনে করে তারাবীহ না পড়লে ছওম হয় না। তাই দুনিয়াবী কারণে তারাবীহ আদায় করতে না পারার কারণে অনেকে ছওমই পালন করে না। এটা মোটেও উচিত নয়। কেননা তারাবীহ এবং ছওম দুটো আলাদা আমল। একটার জন্য আরেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।[20]
(২) খতমে তারাবীর উদ্দেশ্যে তাহাহুড়া করে কুরআন পড়ে কুরআনের খতম করাও জরুরী নয়। এখানে মুখ্য বিষয় হচ্ছে ছালাত আদায় করা; কুরআন খতম দেওয়া নয়। অথচ আমাদের উপমহাদেশে কুরআনের খতম দেওয়াকেই তারাবী ধরে বসে আছে।
(৩) খতমের নামে দ্রুত কুরআন তেলাওয়াত করা অনুচিত। কেননা এতে অর্থের বিকৃতি ঘটতে পারে, যা বড় গুনাহের কাজ। ধৈর্যের সাথে স্পষ্ট করে পড়তে না পারলে সূরা তারাবীহ পড়াই উচিত। কেননা কুরআন তেলাওয়াত করতে হয় ধীরে-সুস্থে (মুযযাম্মিল, ৭৩/৪)।
(৪) এছাড়া চার রাকআত পর পর যে বিরতি নেওয়া হয়, তা মূলত বিশ্রামের জন্য। এসময়ে প্রচলিত দু‘আর কোনো ভিত্তি নেই। তবে এ বিরতিতে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে পারে। কেউ নিজের মতো দু‘আ করতেও পারে।
(৫) অনেকেই রামাযানে অনেকগুলো খতমে কুরআন করতে চান। যার ফলে দ্রুত কুরআন খতম করতে গিয়ে তেলাওয়াতের হক্ব আদায় করেন না। বেশি খতমের আকাঙ্ক্ষায় এমনভাবে তেলাওয়াত করবেন না যে, পড়া ছহীহ হয় না। এতে ফায়দার চেয়ে ক্ষতি বেশি। যতটুকুই পড়ি না কেন ধীরে-সুস্থে, আগ্রহ সহকারে, ভালোবাসা নিয়ে পড়তে হবে। পরিমাণ কম হলেও আল্লাহ এতে বেশি খুশি হবেন ইনশা-আল্লাহ।
(চ) লায়লাতুল ক্বদরকেন্দ্রিক বিভ্রান্তি :
রামাযানের একটি অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ রাত্রি হলো লায়লাতুল ক্বদর। তবে এ রাত্রির তারিখ নির্দিষ্ট নয়, বরং রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোর যে কোনো একটি। এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক বিভ্রান্তি চালু আছে উপমহাদেশে। যেমন—
(১) রামাযানের ২৭ তারিখের রাতকেই শবেক্বদর মনে করে শুধু এ রাতকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অথচ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, ক্বদর কোনো নির্দিষ্ট রাত নয়, বরং শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে ঘুরে ঘুরে আসে। তাই প্রতিটি বিজোড় রাতেই যতটুকু পারা যায় ইবাদত-বন্দেগী করা উচিত। যাতে শবেক্বদর পাওয়া যায়।[21]
(২) এ রাতে গোসল করার ফযীলত সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বর্ণনা করে থাকেন, যার সবই বানোয়াট এবং ভুল। একটি দুর্বল হাদীছে বর্ণিত হয়েছে রামাযানের শেষ দশ রাতের প্রত্যেক রাতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে গোসল করতেন।[22] তবে এর সাথে শবেক্বদরের কোনো সম্পর্ক নেই এবং ফযীলত নেই।
(৩) এ রাতের ছালাতের নিয়্যত, নিয়ম, রাক‘আত সংখ্যা, বিশেষ হাদীছ ইত্যাদি যত কথা বলা হয় তা সবই ভিত্তিহীন।[23] মূলকথা, অন্যান্য রাতের নফল ছালাতের মতোই এ রাতের ছালাত। যার কোনো নির্দিষ্ট নিয়্যত, নিয়মকানুন, দু‘আ ইত্যাদি কিছুই নেই।
(৪) এছাড়া এ রাত উপলক্ষ্যে মসজিদে আলোকসজ্জা করা, হালুয়া-রুটি, মিষ্টান্ন বিতরণ, দলবেঁধে কবর যিয়ারত, নেকীর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ওলী-আউলিয়ার কবর যিয়ারত করা— এ সবই বিদআত। আর সব নফল ছালাতের মতো এ রাতের ছালাতও ঘরে একাকী পড়া উত্তম।
রামাযান ও ছওমকে কেন্দ্র করে এ ধরনের অসংখ্য ভুলভ্রান্তি রয়েছে, যা আমাদের অজ্ঞতা ও বিজ্ঞ আলেমগণের সাথে সম্পর্কহীনতার কারণে হয়ে থাকে। আমাদের উচিত হবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাধ্যমতো কুরআন-হাদীছ চর্চা করা এবং সর্বদা বিজ্ঞ আলেমগণের পরামর্শ গ্রহণ করা। আমাদের ইবাদত-বন্দেগী এমনিতেই অনেক কম। এগুলোও যদি দোষত্রুটিমুক্ত না হয়, তাহলে কিয়ামতে আমাদের অবস্থা বড়ই শোচনীয় হবে। আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার ভুলভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দিন- আমীন!
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
[1]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৫৪, হাদীছ ছহীহ; তিরমিযী, হা/৭৩০; ছহীহ বুখারী, হা/১।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৯৬, ১১৫৪; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩৪৭৬; মিশকাত, হা/২০৭৬।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৫৩, হাসান; ছহীহ বুখারী, হা/১৯৯৫।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৩৩, ৬৬৬৯।
[5]. ছহীহ বুখারী, ১/২৫৯; বায়হাক্বী, হা/৮৫১২; ফতহুল বারী, ৪/২০৭; কিতাবুল ফাতাওয়া, ৩/৩৮৬।
[6]. তিরমিযী, হা/৭২০, হাদীছ ছহীহ; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৭৬।
[7]. ইবনু হিব্বান, ৮/২৮৮; হাকেম, ১/৪৩০; ছহীহুল জামে‘, হা/৬০৭০।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৩৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১১০৬; আবূ দাঊদ, হা/২৩৭২।
[9]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, হা/৯৩৬৯; ইরওয়াউল গালীল, হা/৯৩৭, ৪/৮৫।
[10]. মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, ৪/৩১৩; আবূ দাঊদ, হা/২৩৭৮, সনদ হাসান ছহীহ; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, প্রশ্ন নং ৪২১।
[11]. ইবনু আবেদীন, ২/৩৯৫, ৩/৩৬৭।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯২৬; আবূ দাঊদ, হা/৪৩৯৮।
[13]. সূরা বানী ইসরাঈল, ১৭/২৭; আহমাদ, হা/১৬৪।
[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[15]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৮৯, ১৬৯১, হাদীছ ছহীহ।
[16]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৩।
[17]. দারাকুৎনী, হা/২৪০৬, সনদ ছহীহ; ইরওয়াউল গালীল, হা/৯১২, ৪/১৭।
[18]. তিরমিযী, হা/২৬২০; আবূ দাঊদ, হা/৪৬৭৮, হাদীছ ছহীহ।
[19]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৩১; কিতাবুল ফাতাওয়া, ৩/৪২৮।
[20]. কিতাবুল মাবসুত, ২/১৪৫; রদ্দুল মুখতার, ১/৬৫৩; ফতাওয়ায়ে ফক্বিহুল মিল্লাত, ৫/৭৭।
[21]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৯।
[22]. ইবনু রজব, লাতায়েফ, ২/৩০৯, ৩১৩-৩১৫।
[23]. আব্দুল হাই লখনবী, আল-আসার, পৃ. ১১৫।