কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ঈদে মীলাদুন্নবী কেন বর্জনীয়

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন ১২ই রবীউল আওয়ালকে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিবস মনে করে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ‘জেশন বেলাদাতের’ নামে অনুষ্ঠান করে আসছে। মীলাদ, মাহফিল, জলুস বের করা হয়, গলি বাজার সাজানো হয়। আলোকসজ্জার মধ্য দিয়ে চারিদিক আলোকিত করা হয়, সুন্দর সুন্দর গেট তৈরি করা হয়। ঝান্ডা উড়ানো হয়, পতাকা উড়ানো হয়, বিভিন্ন ধরনের মজাদার খাবার তৈরি করে বিলি-বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। এসবের কোনো কিছুই কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত নয়।

‘মীলাদ’-এর পরিচয় : ‘ঈদে মিলাদুন্নাবী’ একটি বহুল প্রচলিত পরিভাষা। এ নামটি তিনটি আরবী শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। শব্দ তিনটি হলো : عيد (ঈদ), ميلاد (মিলাদ) النبى (নবী)।

عيد (ঈদ) শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো— বারংবার ফিরে আসা, সমবেত হওয়া, আনন্দ উৎসব ইত্যাদি।

পরিভাষায় ঈদ হলো, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যা রহিমাহুল্লাহ বলেন,العيد اسم لما يعود من الاجتماع على وجه معتاد عائد إما بعود ألسنة أوبعود الأسبوع أو الشهر أونحوذالك ‘ঈদ হচ্ছে এমন সাধারণ সমাবেশ যা নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসে, যা বছর বা মাস অথবা সপ্তাহ ঘুরে আসে’।[1]

মীলাদ-এর আভিধানিক অর্থ জন্মসময়। এই অর্থে ‘মাওলিদ’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়।[2] আল্লামা ইবনে মানযূর তাঁর সুপ্রসিদ্ধ আরবী অভিধান লিসানুল আরবে লিখেছেন,ﻣﻴﻼد اﻟﺮﺟﻞ :ﻓﻴﻪ اﺳﻢ اﻟﻮﻗﺖ ‘লোকটির মীলাদ : যে সময় সে জন্মগ্রহণ করেছে সে সময়ের নাম’।[3]

ঈদে মীলাদুন্নবী অর্থ হলো নবীর জন্মদিনের আনন্দ উৎসব। বর্তমানে ১২ই রবীউল আওয়ালকে শেষ নবীর জন্মদিন ধরে কিছু সুবিধাবাদী আলেমের পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়ায-নছীহত যিকির-আযকার ও ক্বিয়াম করে পরিশেষে মিষ্টিমুখ করে অনুষ্ঠান ত্যাগ করা হয়। এটাই মীলাদ বা মীলাদুন্নবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়।[4]

সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নাবী’-এর অর্থ হলো— নবীর জন্মে খুশী বা উৎসব। নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম উপলক্ষ্যে যে আনুষ্ঠানিকতা বা ঈদ উৎসব পালন করা হয় তাকে ‘ঈদে মিলাদুন্নাবী’ বলা হয়। 

কারো জন্মোৎসব পালন করার বিধান : শায়খ আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ বিন বায রহিমাহুল্লাহ বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অন্য কারও জন্মোৎসব পালন করা জায়েয নয়, বরং তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কারণ এটি দ্বীনের মাঝে একটি নতুন প্রবর্তিত বিধান। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো এ কাজ করেননি। তাঁর নিজের বা তাঁর পূর্ববর্তী কোনো নবী বা তাঁর কোনো আত্মীয়, কন্যা, স্ত্রী অথবা কোনো ছাহাবীর জন্মদিন পালনের নির্দেশ দেননি। খোলাফায়ে রাশেদীন, ছাহাবায়ে কেরাম অথবা তাবেঈনের কেউ এ কাজ করেননি। এমনকি পূর্বযুগের কোনো আলেমও এমন কাজ করেননি। তাঁরা সুন্নাহ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞান রাখতেন এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার শরীআত পালনকে সর্বাধিক ভালোবাসতেন। যদি এ কাজটি ছওয়াবের হতো, তাহলে আমাদের আগেই তাঁরা এটি পালন করতেন।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মবার্ষিকী পালনে মানুষ এমন কর্মে লিপ্ত হয় যা প্রকাশ্য শিরক। যেমন— তাদের বিশ্বাস হলো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটির তৈরি নন, তিনি নূরের তৈরি, তিনি গায়েব জানেন, তিনি সর্বত্র উপস্থিত হয়ে থাকেন ইত্যাদি। এমনকি সে দিশেহারা নির্বোধরা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছেই তাদের ফরীয়াদ পেশ করে, তার কাছে প্রার্থনা করে সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি। এভাবে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তারা আল্লাহ তাআলার সমপর্যায়ে পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَوْ أَشْرَكُواْ لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ ‘আর যদি তারা শিরকে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের অতীতের সব আমল বিনাশ হয়ে যাবে’ (আল-আনআম, ৬/৮৮)

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মীলাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ধারণা : অনেকের ধারণা, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। তাই তারা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দাঁড়িয়ে যায়। এটা বিরাট মূর্খতা ও অজ্ঞতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামত দিবসের পূর্বে আপন কবর থেকে বের হবেন না বা কারো সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করবেন না এবং কোনো সমাবেশেও উপস্থিত হবেন না। বরং কিয়ামত পর্যন্ত অন্যান্য নবীদের মতোই স্বীয় কবরে অবস্থান করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ثُمَّ إِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ - ثُمَّ إِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ ‘এরপর তোমাদেরকে অবশ্যই মরতে হবে। অতঃপর তোমাদেরকে কিয়ামতের দিনে পুনরায় জীবিত করা হবে’ (আল মুমিনূন, ২৩/১৫-১৬)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ ‘কিয়ামতের দিন আমি আদমের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমার কবরই সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করা হবে। আমিই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই সবার আগে গৃহীত হবে’।[5]

হানাফী মাযহাবের কিতাব ফাতাওয়া বাযযারিয়াহ, আল-বাহরুর রায়েক্ব প্রভৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বলে যে, পীর-মাশায়েখদের রূহ হাযির হয়ে থাকে, তুমি জানো যে, সে ব্যক্তি কুফরী করল। আরও বলা হয়েছে, যদি কেউ ধারণা করে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মৃত ব্যক্তি কোনো কাজের ক্ষমতা রাখে এবং সে এ বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে, তাহলে সে কুফরী করল।[6]

রাসূলের প্রতি ভালোবাসার নামে সময় ও সম্পদের অপচয় : রাসূলের প্রতি ভালোবাসার নামে সময় ও সম্পদের অপচয় করা হয়। যেমন ১২ই রবীউল আওয়াল উপলক্ষ্যে আলোকসজ্জা, জশনে জুলুস ইত্যাদি করা হয়। আলোকসজ্জার তো কোনো বৈশিষ্ট্য নেই; বরং এর মধ্য দিয়ে বিজাতীয় সভ্যতার অন্ধ অনুসরণ প্রকাশ পায়। এই আলোকসজ্জার ইসলাম ও নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনধারার সাথে কোনো সম্পর্ক নাই। আমাদের এই আলোকসজ্জা দেখলে কেউ বলবে সেই মহামানবের আগমনে আমরা প্রজ্বলিত করেছি, যাঁর ঘরে মাটির প্রদীপটি পর্যন্ত ছিল না। জুলুসের রাস্তায় শত শত গজের ব্যানার, ফেস্টুন অকারণে ব্যবহারকে তিনি কীভাবে ভালোভাবে নিতেন? একটু ভেবে দেখুন। ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশের এ পন্থার এক বড় খারাপ দিক হলো, এজন্য এক বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মহব্বত প্রকাশের জন্য এক বছরের ভুল দিবসের অপেক্ষা? মহব্বত তো এত ধৈর্য ধরতে পারে না।

জশনে জলুসের আরেকটি বিপরিত দিক হলো— এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কোনো উদাহরণ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে এমনকি ছাহাবীদের যুগে, আয়িম্মায়ে আরবাআ ও মুজতাহিদীনের যুগে কোথাও ছিল না। নয়শ বছর পর গভর্নর আরবাল ইরানীর (কোনো কোনো ইতিহাসে মিশরীর) যুগে প্রচলিত হয়।

যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ড রাসূল প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হয়, তাহলে তো এর আবিষ্কার এ যুগে কেন হতে যাবে? ছাহাবী, তাবেঈগণ এ কাজে কেন পিছনে থাকবেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান ও মহব্বতের কোনো দাবি তারা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? আর এখন আমরা তা পূরণ করে দেখাচ্ছি!

মীলাদ অনুষ্ঠানের নামে বিভিন্ন পাপ কাজে অংশগ্রহণ : মীলাদ মাহফিল উপলক্ষ্যে অনেক এলাকায় নানা পাপের কাজে লিপ্ত আছে। যেমন— নারী-পুরুষের মেলা-মেশা, গান-বাজনা ও মাদক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। সর্বোপরি এসব মাহফিলে শিরকে আকবার তথা বড় ধরনের শিরকও সংঘটিত হয়ে থাকে। আর তা হলো রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য আওলিয়ায়ে কিরামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা, তাদের কাছে দু‘আ করা, সাহায্য চাওয়া, বিপদ থেকে মুক্তি কামনা করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, তারা গায়েবের খবর জানেন। এই সমস্ত কাজ করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়।

ঈদে মীলাদুন্নবী মূলত অমুসলিমদের অনুকরণ : মূলত অমুসলিম ইয়াহূদী-নাছারাদের অনুসরণ থেকেই এসেছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম দিবস উপলক্ষ্যে ঈদে মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান। অজ্ঞ মুসলিমরা এবং একদল গোমরাহ আলেম প্রতি বছর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম উপলক্ষ্যে রবীউল আওয়াল মাসে এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কেউ মসজিদে, আবার কেউ ঘরে, আবার কেউ বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত স্থানে এ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এতে শত শত সাধারণ লোক উপস্থিত হয়। খ্রিষ্টানদের অন্ধ অনুসরণই তাদেরকে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বাধ্য করে ।

এ অনুষ্ঠানে বিদআত ও নাছারাদের সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার শিরক ও অপছন্দনীয় কর্মকাণ্ড। এতে এমন কিছু কবিতা আবৃতি করা হয়, যাতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে এমন বাড়াবাড়ি রয়েছে, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দু‘আ কিংবা আশ্রয় প্রার্থনা করা পর্যন্ত নিয়ে যায়। অথচ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,لَا تُطْرُوْنِىْ كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ ‘নাছাররা যেমন মারইয়ামের পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল, তোমরা আমার ব্যাপারে সেরূপ বাড়াবাড়ি করো না। আমি কেবল আল্লাহর একজন বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল বলো’।[7]

নাছারারা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর মর্যাদা বাড়াতে বাড়াতে তাঁকে আল্লাহর পুত্রের স্থানে বসিয়েছিল। আবার কেউ কেউ তাঁকে স্বয়ং আল্লাহ বিশ্বাস করে তাঁর ইবাদত শুরু করছে। কেউ বা তাঁকে তিন আল্লাহর এক আল্লাহ হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছে। কিছু কিছু বিদআতী নবীপ্রেমিক বিশ্বাস করে যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রূহ তাদের মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হয়। এটিও নাছারাদের আক্বীদার শামিল।

মীলাদের অনুষ্ঠানে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যচার : মীলাদের অনুষ্ঠানে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে অনেক বানোয়াট হাদীছ প্রচার করা হয় । তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো, أوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرِيْ ‘সর্বপ্রথম আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন তা হচ্ছে আমার নূর’।[8] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নূর সম্পর্কে আরেকটি ভিত্তিহীন বর্ণনা হলো—

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَابِىْ اَنْتَ وَاُمِّىْ اَخْبِرْنِىْ عَنْ اَوَّلِ شَيْئٍ خَلَقَه اللهُ تَعَالٰى قَبْلَ الْاَشْيَاءِ قَالَ يَا جَابِرُ! اِنَّ اللهَ خَلَقَ قَبْلَ الْاَشْيَاءِ نُوْرَ نَبِيِّكَ مِنْ نُوْرِهِ فَجَعَلَ ذٰلِكَ النُّوْرَ يَدُوْرُ بِالْقَدْرِ حَيْثُ شَاءَ اللهُ وَلَمْ يَكُنْ فِىْ ذَالِكَ الْوَقْتِ لَوْحٌ وَلَا قَلَمٌ وَلَا جَنَّةٌ وَلَا نَارٌ وَلَا مَلَكٌ وَلَا سَمَاءٌ وَلَا اَرْضٌ وَلَا شَمْسٌ وَلَا قَمَرٌ وَلَا جِنٌّى وَلَا اِنْسَانٌ.

‘জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! ঐ প্রথম জিনিস সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন যা আল্লাহ তাআলা সবকিছুর আগে সৃষ্টি করেছেন? তিনি বললেন, হে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূর স্বীয় নূর থেকে তৈরি করেছেন, আর ঐ নূরকে এমন শক্তি দিলেন যে তা নিজে নিজে যেখানে আল্লাহ চাইলেন সেখানে গেল, আর তখন লাওহে মাহফূয ছিল না, কলম ছিল না, জান্নাত ছিল না, জাহান্নাম ছিল না, ফেরেশতা ছিল না, আকাশ-যমীন ছিল না, চন্দ্র-সূর্য ছিল না, জিন এবং মানুষ কিছুই ছিল না’।[9]

এতদসত্ত্বেও এ রেওয়ায়েতটি বহুলভাবে উদ্বৃত হয়।[10]اَنَا مِنْ نُوْرِ اللهِ وَالْمُؤْمِنُوْنَ مِنِّىْ وَالْخَيْرُ فِىَّ وَفِىْ اُمَّتِىْ اِلٰى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘আমি আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্টি হয়েছি, আর মুমিনরা সৃষ্টি হয়েছে আমার নূর থেকে, কিয়ামত পর্যন্ত আমার এবং আমার উম্মতের মধ্যে কল্যাণ বিদ্যমান থাকবে’।[11]

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম বা মৃত্যুর মাস হিসাবে রবীউল আওয়াল মাসের কোনো বিশেষ ফযীলত বা বিশেষ আমল কোনো কিছুই হাদীছে বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়ক মিথ্যা গল্প কাহিনীর মধ্যে রয়েছে, ‘এ মাসের ১২ তারিখে বুজুর্গ তাবেঈগণ রাসূলে কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রূহের মাগফিরাতের জন্য ২০ রাকআত নফল ছালাত পড়তেন। এ ছালাত দুই দুই রাকআতের নিয়্যতে আদায় করতেন এবং প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতেহার পরে ১১ বার করে সূরা ইখলাছ পড়তেন। ছালাত শেষে আল্লাহর নবীর প্রতি ছওয়াব রেছানী (পৌঁছানো) করতেন। তারা এটার বরকতের খাবারের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দর্শন লাভ করতেন এবং ইহকাল-পরকাল উভয় জগতের কল্যাণ ও বরকত লাভ করতেন। অন্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, কোনো মুমিন ব্যক্তি এ মাসের যে কোনো তারিখে এশার ছালাতের পরে ১১২৫ বার দরূদ শরীফ পাঠ করলে আল্লাহর রহমতে সে ব্যক্তি নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্বপ্নে দর্শন লাভ করবে...’।[12]

মীলাদুন্নবী দ্বীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কার : এটি দ্বীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কার। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীলাদ বা ঈদে মীলাদুন্নবী উৎসব পালন করেননি এবং করতেও বলেননি। চার খলীফাসহ জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন ছাহাবী রযিয়াল্লাহু আনহুম-এর কেউ এ অনুষ্ঠান পালন করেননি। লক্ষাধিক ছাহাবীর কোনো একজনও এ অনুষ্ঠান পালন করেননি। পরবর্তী যুগের তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণ পালন করেননি। মুহাদ্দিছকুল শিরোমণি ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিমসহ হাদীছ গ্রন্থ সংকলনকারী মুহাদ্দিছগণও পালন করেননি। এমনকি চার মাযহাবের ইমামগণের কোনো একজনও এ অনুষ্ঠান পালন করেননি। তাঁরা কেউ পালন করেছেন মর্মে কোনো প্রমাণ অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। বরং এটি মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর প্রায় ৫৯৪ বছর পর ৬০৪ হিজরীতে আবিষ্কৃত হয়, যা নিঃসন্দেহে বিদআত। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দ্বীন। এ দ্বীন পরিপূর্ণ বিধায় আমাদেরকে তার অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বিদআত থেকে বিরত থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ، فَهُوَ رَدٌّ ‘আমাদের এই দ্বীনের মাঝে যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত হবে’।[13] তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত পালন করবে। আর তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করবে। সাবধান! তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রত্যেক নবপ্রবর্তিত বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।[14] এ সমস্ত হাদীছে বিদআত প্রবর্তনের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং উম্মতকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। ইমাম ইবনু কাছীর রহিমাহুল্লাহ তার তাফসীরে বলেন,

أي عن أمر رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ومنهاجه وطريقته وسنته وشريعته فتوزن الأقوال والأعمال بأقواله وأعماله فما وافق ذلك قبل وما خالقه فهو مردود علي قائله وفاعله كائنا من كان.

‘হুঁশিয়ার হওয়া উচিত যারা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ, পথ ও মত, ত্বরীক্বা, সুন্নাত ও তাঁর বিধি-বিধানের বিরোধিতা করে। আর তাঁর কথা ও কাজই হলো অন্যের কথা ও কাজের মাপকাঠি, যদি তাঁর কথা ও কাজে মিলে যায় তাহলে গ্রহণযোগ্য হবে আর যদি বিপরীত হয় তাহলে তা যে এবং যাই হোক না কেন তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য’।[15]

হাদীছেও পরিষ্কারভাবে এসেছে যেমন ছাহাবী ইরবায ইবনু সারিয়া রযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রসিদ্ধ হাদীছ। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘তোমরা আমার এবং আমার পথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে গ্রহণ করো এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে তা কামড়িয়ে ধরো। নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয়ে সতর্ক থাকো; কেননা, সকল বিদআতই গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতা’।[16] নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে আমাদের দ্বীনে এমন কিছু উদ্ভাবন করল যা তাতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[17]

‘মীলাদ’-এর ব্যাপারে চার মাযহাব : এ উপমহাদেশে মাযহাবের বাইরে কোনো আমল করতে গেলেই সমস্যা সৃষ্ট করা হয় অথচ আমল হবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মোতাবেক। আমরা তা না করে মাযহাবের ইমাম বা আলেমগণ কী বলেছেন সেটা গুরুত্ব দেই বেশি। অথচ মীলাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করি। মীলাদের ব্যাপারে ‘আল-ক্বাওলুল মু‘তামাদ’ কিতাবে বলা হয়েছে যে, চার মাযহাবের সেরা বিদ্বানগণ সর্বসম্মতভাবে প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠান বিদআত হওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। তাঁরা বলেন, এরবলের গভর্নর ‘কূকুবুরী’ এই বিদআতের হোতা। তিনি তার আমলের আলেমদেরকে মীলাদের পক্ষে মিথ্যা হাদীছ তৈরি করার ও ভিত্তিহীন ক্বিয়াস করার হুকুম জারি করেছিলেন।[18]

মুহাম্মাদ গিয়াসুদ্দীন

শিবগঞ্জ, বগুড়া।


[1]. আল-আইয়াদ ওয়া আছারহা আলাল মুসলিমীন, পৃ. ২১।

[2]. ড. ইবরাহীম আনিস ও তাঁর সঙ্গীগণ, আল-মু‘জাম আল-ওয়াসীত (বৈরুত, দারুল ফিকর), ২/১০৫৬।

[3]. আল্লামা ইবনে মানজুর, লিসানুল আরব (বৈরুত, দারুস সাদের), ৩/৪৬৮।

[4]. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর, মীলাদ ও মীলাদুন্নবী : একটি পর্যালোচনা, মাসিক আত-তাহরীক, এপ্রিল ২০০৪, পৃ. ১৮।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৭৮।

[6]. ইবনু নুজায়েম আল-মিছরী, আল-বাহরুর রায়েক্ব শরহ কানযুদ দাক্বায়েক্ব (দারুল কিতাবিল ইসলামী, তাবি), ৫/১৩৪।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৪৫।

[8]. আব্দুল ক্বাদের জিলানী, সিররুল আসরার, বঙ্গানুবাদ : আব্দুল জলীল (ঢাকা : হক লাইব্রেরী, ১৯৯৮ইং), পৃ. ১১; কারামাত আলী জৈনপুরী, বঙ্গানুবাদ : নূরে মোহাম্মাদী (ঢাকা : বাংলাবাজার, সীরাত লাইব্রেরি, ১৯৮০), পৃ. ৩৭, ৪৪ ও ৫৫; গোলাম মোস্তফা, বিশ্বনবী (ঢাকা : আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ১৯৮৭), পৃ. ২৪ ও ২৬।

[9]. কাশফুল খিফা ওয়া মুযিলুল ইলবাস আম্মা ইশতাহারা মিনাল আহাদিছি আলা আলসিনাতিন নাস, ১ম খণ্ড, হা/৮২৭; আল-কাসতাল্লানী, আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যা বিল মানহিল মোহাম্মাদিয়া, তাহক্বীক্ব : ছালেহ আহমাদ আশ-শামী (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১১৪১২/১৯৯১), ১/৭১-৭২।

[10]. কারামত আলী জৈনপুরী, নূরে মোহাম্মদী (বাংলাবাজার : সীরাত লাইব্রেরি, ১৯৮০), পৃ. ৩৬-৩৭; আব্দুল খালেক, সাইয়েদুল মুরসালীন (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন), ১/২১, মূলত এ রিওয়াতটি ছহীহ নয়।

[11]. ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী আশ-শাওকানী, আল-ফাওয়ায়েদ আল-মাজমূআ ফিল আহাদীছি আল মাওযূআ, পৃ. ২৮৮, হা/১০৫।

[12]. মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৬-১৭।

[13]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭।

[14]. তিরমিযী, হা/২৬৭৬, ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীছটি হাসান ছহীহ।

[15]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, ৩/৩০৭।

[16]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, সনদ ছহীহ।

[17]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭/১৭১৮।

[18]. আব্দুস সাত্তার দেহলভী , মীলাদুন্নবী (করাচী : তাবি), পৃ. ৩৫।

Magazine