কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

শা‘বান মাসের করণীয় আমল

post title will place here

ভূমিকা:

শা‘বান মাস হলো রজব ও রামাযানের মধ্যবর্তী মাস। এ মাসের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। আজ আমরা এই মাস সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। অথচ তিনি এতে গুরুত্বের সাথে ছিয়াম পালন-সহ অন্যান্য আমল করতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ আমরা মুসলিমরা এই মাসকে কেন্দ্র করে নানান বিদআতী কাজে জড়িয়ে আছি। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করে দিনটি মূল্যায়ন করতে পারছি না। নিম্নে আমরা মুসলিম উম্মাহর কল্যাণার্থে শা‘বান মাসের করণীয় দিক নিয়ে আলোচনা করব ইনশা-আল্লাহ।

শা‘বান নামকরণের কারণ:

শা‘বান হিজরী বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস। শা‘বান শব্দের অর্থ- বেরিয়ে পড়া, পৃথক হয়ে যাওয়া, ছড়িয়ে পড়া। আরবের লোকেরা রজব মাসে আরাম-আয়েশ করার পর এই মাসে বিভিন্ন কারবার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আক্রমণের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়ত। এজন্য এ মাসকে তারা শা‘বান বা বেরিয়ে পড়ার মাস বলত। আল্লামা ইবনু মানযূর রাহিমাহুল্লাহ বলেন,وَشَعْبَانُ اسْمٌ لِلشَّهْرِ سُمِّيَ بِذَلِكَ لِتَشَعُّبِهِمْ فِيْهِ أَيْ تَفَرُّقِهِمْ فِيْ طَلَبِ الْمِيَاءِ وَقِيْلَ فِي الْغَارَاتِ ‘শা‘বান একটি মাসের নাম। এ নামে নামকরণের কারণ হচ্ছে, এ মাসে তারা পানি অনুসন্ধানের জন্য ছড়িয়ে পড়ত। একথাও বলা হয়ে থাকে যে, আক্রমণের জন্য তারা ছড়িয়ে পড়ত’।[1] আল্লামা আলীমুদ্দীন সাখাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,شَعْبَانُ: مِنْ تَشَعُّبِ الْقَبَائِلِ وَتَفَرْقُهِاَ لِلْغَارَةِ ‘শা‘বান নাম রাখা হয়েছে। কারণ গোত্রগুলো আক্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়ত’।[2]

শা‘বান মাসের গুরুত্ব ও ফযীলত:

শা‘বান মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ একটি মাস। হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এ মাসেই ক্বিবলা পরিবর্তন হয়।[3] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পাঠের নির্দেশনা সংবলিত আয়াতটিও নাযিল হয় শা‘বান মাসে। নিম্নে এ সম্পর্কিত কিছু হাদীছ বর্ণনা করা হলো—

এ মাসে বান্দার (বাৎসরিক) আমলনামা আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়: উসামা ইবনু যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে শা‘বান মাসে যত ছিয়াম রাখতে দেখি, অন্য মাসে তত ছিয়াম রাখতে দেখি না! (এর রহস্য কী?) উত্তরে তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,ذَاكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ فِيْهِ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبٍ وَرَمَضَانَ، وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيْهِ الْأَعْمَالُ ﺇِلَى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِيْ وَأَنَا صَائِمٌ ‘এটা তো সেই মাস, যে মাস সম্পর্কে মানুষ উদাসীন। যা রজব ও রামাযানের মাঝের মাস। আর এটা তো সেই মাস, যে মাসে বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছে বান্দার আমলসমূহ পেশ করা হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে, ছিয়াম রাখা অবস্থায় আমার আমল আল্লাহর নিকট পেশ করা হোক’।[4]

শা‘বান মাসের প্রতি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন এত গুরুত্বারোপ করতেন, এই হাদীছে তিনি তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। উক্ত হাদীছের মর্ম হলো— যেহেতু এই মাসে বান্দার আমল আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়, সেহেতু এ মাসটি গুরুত্বের দাবীদার। ইমাম ইবনু রজব হাম্বালী রাহিমাহুল্লাহ উক্ত হাদীছ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে একটি গভীর বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই হাদীছে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, যখন কোনো একটা সময়, ব্যক্তি বা স্থানের ফযীলত প্রসিদ্ধ হয়ে যায়, তখন সবাই সেই প্রসিদ্ধ স্থান, কাল, পাত্র নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অথচ ভিন্ন বিবেচনায় অন্য কোনো স্থান, কাল, পাত্র সেই স্থান, কাল, পাত্রের চেয়েও উত্তম হতে পারে। কিন্তু অনেকে সেদিকে লক্ষ্য করে না’।[5]

সুতরাং একাধিক ফযীলতের কারণে যেভাবে মাসকে গুরুত্ব প্রদান করা হয় (তথা পবিত্র হিসেবে ‘আশহুরুল হুরুম’ বা পবিত্র চার মাসকে যেভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়), তেমনি সারা বছরের আমলনামা পেশ হওয়ার মাস হিসেবে শা‘বান মাসকেও যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা কর্তব্য। আর এই গুরুত্ব প্রদান করার উপায় হলো, সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে নেক আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া। শা‘বান মাসের অধিকাংশ দিন ছিয়াম রেখে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে এই নির্দেশনাই দিয়ে গেছেন।

প্রসঙ্গত, জেনে রাখা ভালো হবে যে, বাৎসরিক আমলনামা যেমন উক্ত শা‘বান মাসে আল্লাহর কাছে উঠানো হয়, তেমনি সাপ্তাহিক সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর নিকট আমলনামা পেশ করা হয়। যেমন—

আল্লাহর কাছে বান্দার সাপ্তাহিক আমলনামা পেশ: আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‌تُعْرَضُ ‌الْأَعْمَالُ ‌يَوْمَ ‌الِاثْنَيْنِ ‌وَالْخَمِيْسِ، ‌فَأُحِبُّ ‌أَنْ ‌يُعْرَضَ ‌عَمَلِيْ ‌وَأَنَا ‌صَائِمٌ ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর নিকট বান্দার আমলনামা পেশ করা হয়। তাই আমি চাই আমার আমল পেশ করার সময় আমি ছিয়াম অবস্থায় থাকি’।[6]

আল্লাহর কাছে বান্দার দৈনিক আমলনামা পেশ: আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

يَتَعَاقَبُوْنَ ‌فِيْكُمْ ‌مَلَائِكَةٌ ‌بِاللَّيْلِ وَمَلَائِكَةٌ بِالنَّهَارِ، وَيَجْتَمِعُوْنَ فِيْ صَلَاةِ الْعَصْرِ وَصَلَاةِ الْفَجْرِ، ثُمَّ يَعْرُجُ الَّذِيْنَ بَاتُوْا فِيْكُمْ، فَيَسْأَلُهُمْ - وَهُوَ أَعْلَمُ - كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِيْ؟ فَيَقُوْلُوْنَ: تَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّوْنَ، وَأَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّوْنَ.

‘তোমাদের মাঝে একদল ফেরেশতা রাত্রিতে এবং একদল ফেরেশতা দিনে আগমন করেন। অতঃপর তারা উভয়ই মিলিত হন ফজর এবং আছর ছালাতে। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা ছিলেন, তারা উঠে যান’। তখন আল্লাহ তাদের জিজ্ঞেস করেন, অথচ তিনি তাদের অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবগত, ‘তোমরা আমার বান্দাদের কী অবস্থায় ছেড়ে এসেছ?’ উত্তরে তারা বলেন, ‘আমরা তাদের ছেড়ে এসেছি ছালাতরত অবস্থায় এবং যখন পৌঁছলাম তখনও তাদেরকে ছালাতরত অবস্থায় দেখেছি’।[7]

প্রতিদিন আরও কয়েকবার বান্দার আমলনামা উপরে উঠানো হয়: হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ أَيُّوْبَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّيْ قَبْلَ الظُّهْرِ أَرْبَعًا إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ، لَا يَفْصِلُ بَيْنَهُنَّ بِتَسْلِيْمٍ، وَقَالَ: إِنَّ أَبْوَابَ السَّمَاءِ تُفْتَحُ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ.

আবূ আইয়ূব আনছারী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য হেলে গেলে যোহর ছালাতের পূর্বে চার রাকআত ছালাত পড়তেন। চার রাকআতের মাঝে সালামের মাধ্যমে পৃথক করতেন না (যা তিনি এক সালামে আদায় করতেন)। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সূর্য হেলে গেলে (গুরুত্বের সাথে) চার রাকআত ছালাত আদায় করেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সূর্য হেলার পর আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং যোহরের সময় পর্যন্ত তা খোলা থাকে। আমি চাই এ সময় আমার কোনো ভালো কাজ আকাশে পৌঁছাক’।[8]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ السَّائِبِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «كَانَ ‌يُصَلِّيْ ‌أَرْبَعًا ‌بَعْدَ ‌أَنْ ‌تَزُوْلَ ‌الشَّمْسُ ‌قَبْلَ ‌الظُّهْرِ، وَقَالَ: إِنَّهَا سَاعَةٌ تُفْتَحُ فِيْهَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَأُحِبُّ أَنْ يَصْعَدَ لِيْ فِيْهَا عَمَلٌ صَالِحٌ».

আব্দুল্লাহ ইবনু সায়েব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য হেলে যাওয়ার পর যোহরের ফরয ছালাতের পূর্বে চার রাকআত ছালাত আদায় করতেন। আর বলতেন, ‘এটা এমন সময় যখন আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়। তাই আমার পছন্দ যে, এ সময়ে আমার সৎকর্ম ঊর্ধ্বে উঠুক’।[9] আরেকটি হলো বাৎসরিক আমলনামা পেশ। পূর্বে উল্লিখিত হাদীছে সেটার কথাই বলা হয়েছে।[10]

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য মাসের তুলনায় শা‘বান মাসকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। শা‘বানের দিনগুলোকে গুনে গুনে রাখতেন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنهما قَالَتْ: كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَفَّظُ مِنْ شَعْبَانَ مَالَا يَتَحَفَّظُ مِنْ غَيْرِهِ. ثُمَّ يَصُوْمُ لِرُؤْيَةِ رَمَضَانَ فَإِنْ غُمَّ عَلَيْهِ عَدَّ ثَلَاثِيْنَ يَوْمًا ثُمَّ صَامَ.

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসের হিসাব এত গুরুত্ব সহকারে রাখতেন যে, অন্য কোনো মাসের হিসাব ততটা গুরুত্ব দিয়ে রাখতেন না। তারপর তিনি রামাযানের চাঁদ দেখে ছিয়াম পালন করতেন। আকাশ মেঘলা থাকলে তিনি শা‘বান ৩০ দিন পুরো করার পর ছিয়াম শুরু করতেন।[11] বুঝা গেল যে, শা‘বান মাস দিন-তারিখের দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযানের প্রস্তুতির জন্য শা‘বান মাসকে খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখতেন।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে সবচেয়ে বেশি ছিয়াম রাখতেন: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় পুরো শা‘বান মাসজুড়ে ছিয়াম পালন করতেন। তিনি এ মাসে যত ছিয়াম রাখতেন, রামাযান ব্যতীত অন্য কোনো মাসে তত ছিয়াম রাখতেন না। উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,أَنَّهُ لَمْ يَكُنْ يَصُوْمُ مِنَ السَّنَةِ شَهْرًا تَامًّا إِلَّا شَعْبَانَ يَصِلُهُ بِرَمَضَانَ ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাস ব্যতীত বছরের পূর্ণ একটি মাস কখনো ছিয়াম রাখতেন না। তিনি ছিয়াম অব্যাহত রেখে শা‘বানকে রামাযানের সাথে মিলাতেন’।[12] আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,كَانَ أَحَبَّ الشُّهُوْرِ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَصُوْمَهُ: شَعْبَانُ ثُمَّ يَصِلُهُ بِرَمَضَانَ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মাসের মধ্যে শা‘বান মাসে অধিক ছিয়াম রাখাকে অনেক পছন্দ করতেন। তিনি এ মাসে ছিয়াম অব্যাহত রেখে তা রামাযানের সাথে যুক্ত করতেন’।[13] আবূ সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُوْمُ حَتَّى نَقُوْلَ لاَ يُفْطِرُ وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُوْلَ لاَ يَصُوْمُ فَمَا رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلاَّ رَمَضَانَ وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِىْ شَعْبَانَ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে এত ছিয়াম রাখতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর ছিয়াম ছাড়বেন না। আবার ছিয়াম ছাড়া শুরু করলে এত ছাড়তেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি (হয়তো) আর ছিয়াম রাখবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রামাযান ব্যতীত পূর্ণ কোনো মাস ছিয়াম রাখতে দেখিনি এবং শা‘বান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে অধিক ছিয়াম রাখতে দেখিনি’।[14]

উপর্যুক্ত হাদীছগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ছিয়াম রাখতেন; এমনকি প্রায় পুরো মাসজুড়েই ছিয়াম রাখতেন। অন্য কোনো মাসে তিনি এত বেশি নফল ছিয়াম রাখতেন না।

১৫ই শা‘বানের পর ছিয়াম রাখার বিধান:

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় পুরো শা‘বান মাস ছিয়াম রাখতেন। শা‘বান মাসে অধিক ছিয়াম রাখা তাঁর আমল ছিল। তবে তিনি উম্মতকে ১৫ই শা‘বানের পর ছিয়াম রাখতে নিষেধ করেছেন। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‌إِذَا ‌انْتَصَفَ ‌شَعْبَانُ ‌فَلَا ‌تَصُومُوا ‘শা‘বান মাসের অর্ধেক বাকি থাকতে তোমরা আর ছিয়াম রাখবে না’।[15] আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا كَانَ النِّصْفُ مِنْ شَعْبَانَ فَلَا صَوْمَ حَتَّى يَجِيْءَ رَمَضَانُ ‘শা‘বান মাসের অর্ধেক অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে রামাযান মাস না আসা পর্যন্ত কোনো ছিয়াম নেই’।[16]

উপর্যুক্ত দুটি হাদীছে ইঙ্গিত পাওয়া গেল যে, তিনি ১৫ই শা‘বানের পর ছিয়াম রাখা নিষেধ করেছেন রামাযানের প্রস্তুতিস্বরূপ। কেননা ১৫ই শা‘বানের পর ছিয়াম অব্যাহত থাকলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে রামাযানের ছিয়াম পালন করা কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি এতে করে রামাযানের ছিয়ামও ছাড়তে হতে পারে।

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযান মাসে শুরু হওয়ার দু’একদিন পূর্বে ছিয়াম রাখতে নিষেধ করেছেন। যেমন- আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لَا تُقَدِّمُوْا صَوْمَ رَمَضَانَ بِيَوْمٍ وَلَا يَوْمَيْنِ إِلَّا أَنْ يَكُوْنَ صَوْمٌ يَصُوْمُهُ رَجُلٌ فَلْيَصُمْ ذٰلِكَ الصَّوْمَ ‘তোমরা রামাযানের একদিন অথবা দুদিন আগে ছিয়াম রাখবে না। তবে কেউ প্রতি মাসের ঐ ছিয়াম পালনে অভ্যস্ত হলে সে রাখতে পারে’।[17]

অর্থাৎ কেউ যদি নিয়মিত সোমবার ও বৃহস্পতিবার ছিয়াম রাখে বা একদিন পরপর ছিয়াম রাখে, তবে সে রামাযানের একদিন ও দুদিন আগে ছিয়াম রাখতে পারে। কারণ এটা তার নিয়মিত আমল। এ অর্থে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে বললেন, يَا أَبَا فُلَانٍ أَمَا صُمْتَ مِنْ سَرَرِ شَعْبَانَ ‘হে অমুক ব্যক্তির পিতা! তুমি কি শা‘বান মাসের শেষ দিনগুলো ছিয়াম রেখেছ?’ লোকটি বলল, না, রাখিনি। তখন তিনি বললেন, فَإِذَا أَفْطَرْتَ فَصُمْ يَوْمَيْنِ‏ ‘যখন তুমি ছিয়াম রাখোনি, তাহলে তুমি (রামাযানের শেষে) দুদিন ছিয়াম রাখবে’।[18]

হাদীছে উল্লিখিত ব্যক্তি মাসের শেষে নিয়মিত ছিয়াম রাখতেন অথবা মান্নতের ছিয়াম রাখতেন। কিন্তু তিনি মনে করেন, রামাযানের একদিন বা দুদিন পূর্বে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন, আমার সে ছিয়াম সে নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। তাই তিনি তা সেই নিয়মিত ছিয়াম রাখার আমল ছেড়ে দেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে তাকে ছিয়াম রাখার অনুমতি দেন।

অতএব, কেউ যদি আগে থেকে নিয়মিত ছিয়াম না রেখে থাকে, তবে সে ১৫ই শা‘বানের পর ছিয়াম রাখতে পারবে; হারাম হবে না। ইবনু হাজার রাহিমাহুল্লাহ-সহ জমহূর উলামায়ে কেরাম উক্ত মত পোষণ করেছেন।[19] বিশেষ করে রামাযানের একদিন বা দুদিন আগে ছিয়াম রাখা থেকে বিরত থাকবে।

শা‘বান মাসে বিগত রামাযানের ছুটে যাওয়া ছিয়াম ক্বাযা আদায়ের সুযোগ: হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ مَا كُنْتُ أَقْضِيْ مَا يَكُوْنُ عَلَىَّ مِنْ رَمَضَانَ إِلاَّ فِيْ شَعْبَانَ حَتّٰى تُوُفِّيَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‏.‏

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি শা‘বান মাস ব্যতীত আমার রামাযান মাসের ক্বাযা ছিয়াম আদায় করতে পারতাম না। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যু পর্যন্ত এই অবস্থা ছিল।[20] অপর বর্ণনায় আছে, তিনি কারণ হিসেবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতের কথা উল্লেখ করেছেন।[21] নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্যান্য স্ত্রীরও একই অবস্থা ছিল।[22]

পরিশেষে, কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী শা‘বান মাসকে যথাযথ মূল্যায়ন ও রামাযানের সুন্দর প্রস্তুতি গ্রহণ করা আমাদের কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

বি.এ, অনার্স, হাদীছ বিভাগ, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।


[1]. লিসানুল আরব, ১/৫১১।

[2]. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৪/১৪৭।

[3]. তিরমিযী, হা/৩৪০; ইরওয়াউল গালীল, হা/২৯০।

[4]. নাসাঈ, হা/২৩৫৭, সনদ হাসান; নাসাঈ, কুবরা হা/২৬৬৬।

[5]. ইবনে রজব হাম্বলী, লাতায়েফুল মাআরিফ, পৃ. ২৫১।

[6]. আবূ দাঊদ, হা/২১০৫; তিরমিযী, হা/৭৪৭; মিশকাত, হা/২০৫৬।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৫, ৭৪২৯, ৭৪৮৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৩২; মিশকাত, হা/৬২৬।

[8]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৫৩২; ইবনু মাজাহ, হা/১১৫৭; মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/৪৮১৪; শায়খ আলবানী বলেন, ‘চার রাকআতের মাঝে সালামের মাধ্যমে পৃথক করতেন না’ বাক্যটি ছহীহ নয়।

[9]. তিরমিযী, হা/৪৭৮; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৮৭; মিশকাত, হা/১১৬৯।

[10]. ইবনে রজব হাম্বলী, লাতায়েফুল মাআরিফ, পৃ. ২৪৪।

[11]. আবূ দাঊদ, হা/২৩২৫; মিশকাত, হা/১৯৮০।

[12]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৩৬; তিরমিযী, হা/৭৩৬, সনদ ছহীহ।

[13]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৩১, সনদ ছহীহ।

[14]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৬৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫৬; আবূ দাঊদ, হা/২৪৩৪; মিশকাত, হা/২০৩৬।

[15]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৩৭; তিরমিযী, হা/৭৩৮; ছহীহুল জামে‘, হা/৩৯৭; মিশকাত, হা/১৯৭৪, সনদ হাসান ছহীহ।

[16]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৫১, সনদ ছহীহ।

[17]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৩৫, সনদ ছহীহ।

[18]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৮৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬১; মিশকাত, হা/২০৩৮।

[19]. ফাতহুল বারী, ৪/১২৯; আল-মাজমূ‘, ৭/৩৯৯-৪০০।

[20]. তিরমিযী, হা/৭৮৩।

[21]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৪৬; আবূ দাঊদ, হা/২৩৯৯; মিশকাত, হা/২০৩০।

[22]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮১।

Magazine