দিন যত যাচ্ছে, তত মানুষের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ ও অহংকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে একজন আরেকজনের ক্ষতি করার জন্য, একজন আরেকজনকে হত্যা করার জন্য কালো যাদুর আশ্রয় গ্রহণ করছে। এই যাদুর প্রভাব থেকে কীভাবে বাঁচা যাবে, তা নিয়ে বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মানুষ যেন সমস্যার সম্মুখীন না হয় এজন্য ইসলাম আগে থেকেই সতর্ক করেছে। মানুষের যেন কেউ ক্ষতি করতে না পারে এজন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগে থেকেই সব কিছু বলে দিয়েছেন। প্রবন্ধটি শুরু করার আগে কিছু কথা না বললেই নয়।
মানুষের দুই ধরনের শত্রু রয়েছে— (১) মানুষ শত্রু আর (২) জিন শত্রু। মানুষ শত্রু আমাদের সাথেই চলাফেরা করে। তাকে দুচোখে দেখা যায়। আমাদের সাথে মিশে। মাঝেমধ্যে মুচকি হাসি দিয়ে কথা বলে। এই শত্রু ভালোমন্দ বুঝে। নিজের লাভ-লোকসান আঁচ করতে পারে। কিছু উপহার দিলে বা তাকে সম্মান করলে সে আনন্দিত হয়। এই শত্রুকে আমাদের করতলগত করার পন্থা আল্লাহ তাআলা বাতলে দিয়েছেন। এই শত্রুকে দুভাবে কাবু করা যায়।
(১) উপহার বা উপঢৌকন দিলে: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,تَهَادُّوْا تَحَابُّوْا ‘উপহার দাও, ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে’।[1] আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ ‘আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত করো তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর, ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে, সে যেন হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩৪)।
(২) সালাম দিলে: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করলেন। তাঁর আসার আগে মদীনাতে আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় হরহামেশা দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত থাকত। সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে তারা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এসে তাদের পরস্পরের শত্রুতার তিক্ততা সালামের মিষ্টতার মাধ্যমে শেষ করলেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাপকভাবে ঘোষণা করলেন,لَا تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَوَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ ‘মুমিন না হলে তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে না। আর একে অপরকে ভালো না বাসলে মুমিন হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয় বাতলে দিব না, যা করলে তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসবে? তোমাদের মাঝে সালামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটাও’।[2]
মানুষের দ্বিতীয় শত্রু হলো শয়তান। শয়তান আমাদের সাথে চলাফেরা করে না। আমাদের সাথে থাকে না। আমরা তাকে দেখি না। সে উপহার বা উপঢৌকন গ্ৰহণ করে না। সালাম দিলে কোনো কাজ হবে না। তাকে দেখা-ই যায় না, আবার সালাম দিব কীভাবে? শয়তানকে আমরা দেখি না ঠিকই, কিন্তু শয়তান আমাদেরকে ভালো করেই দেখে। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ ‘সে (শয়তান) ও তার দলবল তোমাদের দেখতে পায়; কিন্তু তোমরা তাদের দেখতে পাও না। আমরা শয়তানদেরকে তাদের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছি, যারা ঈমান আনে না’ (আল-আ‘রাফ, ৭/২৭)।
শয়তানকে যেহেতু দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, সেহেতু তাকে প্রতিহত করতে হবে এমন এক সত্তার মাধ্যমে, যিনি শয়তানকে দেখেন; কিন্তু শয়তান তাঁকে দেখতে পায় না। বলুন তো তিনি কে? হ্যাঁ, তিনিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। শয়তানকে কাবু করতে হলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। কারণ সে মানুষের মতো শত্রু নয়। উপহার বা উপঢৌকন ও সালাম গ্ৰহণ করে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘শয়তানের কোনো ধোঁকা টের পেলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবে। কেননা তিনি সবকিছু শ্রবণ করেন ও জানেন’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩৫)।
আল্লাহ তাআলা বলেন,وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ -وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ ‘আর (হে নবী!) বলুন, হে আমার রব! শয়তানদের খোঁচা (প্ররোচনা) থেকে আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আরও আশ্রয় প্রার্থনা করছি শয়তান আমার কাছে উপস্থিত হওয়া থেকে’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৯৭-৯৮)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ ‘মুত্তাক্বীদের শয়তানের কোনো দল ধোঁকা দিলে তারা (আল্লাহকে) এমনভাবে স্মরণ করে যেন তারা দেখছে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/২০১)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ ‘যখন কুরআন পড়বে, তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে’ (আল-নাহল, ১৬/৯৮)।
আমাদের উপর যেন যাদুর প্রভাব না পড়ে এজন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু আমল শিখিয়ে গেছেন। আমরা যদি নিয়মিত বিশ্বাসের সাথে এই আমলগুলো করতে পারি, তাহলে যাদুকর যতই যাদু করুক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। চলুন! আমলগুলো জেনে নেই—
(১) সূরাতুল ইখলাছ, আন-নাস ও আল-ফালাক্ব পড়া: ফজর ও মাগরিব ছালাতের পর এই তিনটি সূরা তিনবার করে ৯ বার পড়বেন। আর বাকি তিন ছালাতের পর তথা যোহর, আছর ও এশার ছালাতের পর এই তিনটি সূরা একবার করে পড়বেন। রাতে ঘুমানোর সময় এই তিনটি সূরা তিনবার পড়ে হাতের তালুতে ফুঁক দিয়ে মাথার উপর থেকে সমস্ত শরীরে হাত বুলাবেন। তারপর আবার তিনবার পড়ে একইভাবে হাতের তালুতে ফুঁক দিয়ে মাথার উপর থেকে সমস্ত শরীরে হাত বুলাবেন। আবার তিনবার পড়ে একইভাবে হাতের তালুতে ফুঁক দিয়ে মাথার উপর থেকে সমস্ত শরীরে হাত বুলাবেন।
(২) আয়াতুল কুরসী পড়া: প্রত্যেক ফরয ছালাতের পর আয়াতুল কুরসী পড়া এবং রাতে ঘুমানোর সময় শুয়ে আয়াতুল কুরসী পড়া।
(৩) রাতে সূরা আল-বাক্বারা পড়া: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِي تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ ‘তোমরা তোমাদের ঘরসমূহকে কবর সদৃশ করে রেখো না। নিশ্চয় শয়তান যে ঘরে সূরা বাক্বারা পাঠ করা হয়, সেই ঘর থেকে পালিয়ে যায়’।[3]
(৪) সূরা আল-বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়া: রাতে কেউ যদি সূরা আল-বাক্বারা সম্পূর্ণ করতে না পারেন, তাহলে কমপক্ষে সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত অবশ্যই পাঠ করবেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ قَرَأَ بِالْآيَتَيْنِ مِنْ آخِرِ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ فِيْ لَيْلَةٍ كَفَتَاهُ ‘কেউ যদি রাতে সূরা আল-বাক্বারার শেষ দুটি আয়াত পাঠ করে, সেটাই তার জন্য যথেষ্ট’।[4]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কেউ রাতে সূরা আল-বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়লে শয়তান ওই রাতে তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।[5]
(৫) নিচের দু‘আটি দিনের মাঝে ১০০ বার পড়া: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ. فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ، كَانَتْ لَهُ عَدْلَ عَشْرِ رِقَابٍ، وَكُتِبَتْ لَهُ مِائَةُ حَسَنَةٍ، وَمُحِيَتْ عَنْهُ مِائَةُ سَيِّئَةٍ، وَكَانَتْ لَهُ حِرْزًا مِنَ الشَّيْطَانِ يَوْمَهُ ذَلِكَ حَتَّى يُمْسِيَ، وَلَمْ يَأْتِ أَحَدٌ بِأَفْضَلَ مِمَّا جَاءَ بِهِ، إِلاَّ أَحَدٌ عَمِلَ أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ.
‘যে লোক ১০০ বার এ দু‘আটি পড়বে, لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ. (আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব একমাত্র তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও একমাত্র তাঁরই জন্য আর তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান), তাহলে ১০টি গোলাম আযাদ করার সমান ছওয়াব তার হবে। তার জন্য ১০০ ছওয়াব লেখা হবে এবং ১০০ গুনাহ মিটিয়ে ফেলা হবে। ঐদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সে শয়তান হতে সুরক্ষিত থাকবে। কোনো লোক তার চেয়ে উত্তম ছওয়াবের কাজ করতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, ঐ ব্যক্তি সক্ষম হবে, যে এর চেয়ে ঐ দু‘আটির আমল বেশি পরিমাণ করবে’।[6]
সকালে ফজর ছালাতের পর এই দু‘আটি ১০০ বার পড়ে নিবেন, তাহলে সারাদিন আর শয়তান আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
(৬) রাতে ঘরে প্রবেশের সময় বিসমিল্লাহ বলা এবং খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলা: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا دَخَلَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ فَذَكَرَ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ وَعِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ لاَ مَبِيتَ لَكُمْ وَلاَ عَشَاءَ . وَإِذَا دَخَلَ فَلَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ . وَإِذَا لَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ عِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ وَالْعَشَاءَ.
‘যখন কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশ এবং খাবার গ্রহণের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে, তখন শয়তান হতাশ হয়ে (তার সঙ্গীদের) বলে, তোমাদের (এখানে) রাত্রিযাপনও নেই, খাওয়াও নেই। আর যখন সে প্রবেশ করে এবং প্রবেশকালে আল্লাহর নাম স্মরণ না করে, তখন শয়তান বলে, তোমরা থাকার স্থান পেয়ে গেলে। আর যখন সে খাবারের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ না করে, তখন সে (শয়তান) বলে, তোমাদের নিশি যাপন ও রাতের খাওয়ার আয়োজন হলো’।[7]
(৭) পায়খানায় যাওয়ার সময় নিচের দু‘আটি পড়া: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন পায়খানায় যেতেন, তখন নিচের দু‘আটি পাঠ করতেন,[8] اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ এই দু‘আটি পাঠ করলে শয়তান মানুষকে কোনো ওয়াসওয়াসা দিতে পারে না।
(৮) বাচ্চাদের যেন কালো যাদু ও বদনযর না লাগে এজন্য নিচের দু‘আটি পড়ে তাদের ফুঁক দেওয়া:
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ.
‘আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমার দ্বারা প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টির অনিষ্ট হতে পানাহ চাচ্ছি’।[9] নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে এই দু‘আ পড়ে ফুঁক দিতেন।
উপরের আমলগুলো যদি আপনি নিয়মিত করে যান এবং সাথে সাথে সকাল ও সন্ধ্যার দু‘আগুলো পাঠ করেন, তাহলে আপনি কালো যাদু ও বদনযর থেকে রক্ষা পাবেন, ইনশা-আল্লাহ!
শয়তান কোথায় থাকে?
শয়তান দুটি জায়গায় বেশি অবস্থান করে—
(১) খালি ও পরিত্যক্ত ঘরে: এটা আমরা বুঝতে পারি নিচের হাদীছ থেকে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,فِرَاشٌ لِلرَّجُلِ وَفِرَاشٌ لاِمْرَأَتِهِ وَالثَّالِثُ لِلضَّيْفِ وَالرَّابِعُ لِلشَّيْطَانِ ‘একটি শয্যা পুরুষের, দ্বিতীয় শয্যা তার স্ত্রীর, তৃতীয়টি অতিথির জন্য আর চতুর্থটি (যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়) শয়তানের জন্য’।[10]
হাদীছে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপ্রয়োজনীয় অর্থাৎ চতুর্থ ঘরটিকে শয়তানের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এজন্যই দেখা যায়, যারা গ্রামের বাড়িতে বড় বড় বিল্ডিং বানিয়ে শহরে অবস্থান করে, তাদের ওই বাড়িগুলোতে শয়তান বসবাস করে।
(২) অন্ধকার স্থানে: এটা আমরা বুঝতে পারি নিচের হাদীছ থেকে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا كَانَ جُنْحُ اللَّيْلِ ـ أَوْ أَمْسَيْتُمْ ـ فَكُفُّوا صِبْيَانَكُمْ، فَإِنَّ الشَّيَاطِينَ تَنْتَشِرُ حِينَئِذٍ، فَإِذَا ذَهَبَ سَاعَةٌ مِنَ اللَّيْلِ فَحُلُّوهُمْ، وَأَغْلِقُوا الأَبْوَابَ، وَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ، فَإِنَّ الشَّيْطَانَ لاَ يَفْتَحُ بَابًا مُغْلَقًا. قَالَ وَأَخْبَرَنِي عَمْرُو بْنُ دِينَارٍ سَمِعَ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ نَحْوَ مَا أَخْبَرَنِي عَطَاءٌ وَلَمْ يَذْكُرْ وَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ.
‘যখন রাতের আঁধার নেমে আসবে’ অথবা বলেছেন, ‘যখন সন্ধ্যা হয়ে যাবে, তখন তোমরা তোমাদের শিশুদেরকে আটকে রাখবে। কেননা এসময় শয়তান ছড়িয়ে পড়ে। আর যখন রাতের কিছু অংশ অতিক্রান্ত হবে, তখন তাদেরকে ছেড়ে দিতে পার। তোমরা ঘরের দরজা বন্ধ করবে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করবে। কেননা শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না’।[11]
এই হাদীছের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এই হাদীছ থেকে বুঝা যায়, শয়তান অন্ধকার স্থানে বসবাস করে।[12]
শয়তান তাড়াবেন কীভাবে?
শয়তান দুইভাবে তাড়ানো যায়—
(১) আযান দেওয়ার মাধ্যমে: যেই ঘরে শয়তান বসবাস করে, ওই ঘরে আযান দিবেন। কারণ শয়তান আযান শুনতে পারে না। আযান দিলে চলে যায়। হাদীছ থেকে এর প্রমাণ দেখুন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا نُودِيَ لِلصَّلاَةِ أَدْبَرَ الشَّيْطَانُ وَلَهُ ضُرَاطٌ حَتَّى لاَ يَسْمَعَ التَّأْذِينَ، فَإِذَا قَضَى النِّدَاءَ أَقْبَلَ، حَتَّى إِذَا ثُوِّبَ بِالصَّلاَةِ أَدْبَرَ، حَتَّى إِذَا قَضَى التَّثْوِيبَ أَقْبَلَ حَتَّى يَخْطُرَ بَيْنَ الْمَرْءِ وَنَفْسِهِ، يَقُولُ اذْكُرْ كَذَا، اذْكُرْ كَذَا. لِمَا لَمْ يَكُنْ يَذْكُرُ، حَتَّى يَظَلَّ الرَّجُلُ لاَ يَدْرِي كَمْ صَلَّى.
‘যখন ছালাতের জন্য আযান দেওয়া হয়, তখন শয়তান হাওয়া ছেড়ে পলায়ন করে, যাতে সে আযানের শব্দ না শোনে। যখন আযান শেষ হয়ে যায়, তখন সে আবার ফিরে আসে। আবার যখন ছালাতের জন্য ইক্বামত দেওয়া হয়, তখন আবার দূরে সরে যায়। ইক্বামত শেষ হলে সে পুনরায় ফিরে এসে লোকের মনে কুমন্ত্রণা দেয় এবং বলে, এটা স্মরণ করো, ওটা স্মরণ করো। বিস্মৃত বিষয়গুলো সে মনে করিয়ে দেয়। এভাবে লোকটি এমন পর্যায়ে পোঁছে যে, সে কয় রাকআত ছালাত আদায় করেছে, তা মনে করতে পারে না’।[13]
উপরের হাদীছের প্রতি লক্ষ করুন, শয়তান আযান শুনতে পারে না। আযান শুনলে সে পলায়ন করে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে ঘর থেকে শয়তান তাড়ানোর উপায় হচ্ছে আযান দেওয়া। যদিও স্রেফ শয়তান তাড়ানোর জন্য আযান দেওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।
(২) সূরা আল-বাক্বারা পাঠ করার মাধ্যমে: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِي تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ ‘তোমরা তোমাদের ঘরসমূহকে কবর সদৃশ করে রেখো না। নিশ্চয় শয়তান যে ঘরে সূরা আল-বাক্বারা পাঠ করা হয়, সেই ঘর থেকে পালিয়ে যায়’।[14]
কারো বদনযর অথবা যাদু লেগে গেলে কীভাবে তাকে সুস্থ করবেন?
আপনার বাচ্চা মাশা-আল্লাহ ভালো খায়, খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনো বিরক্ত করে না। আপনার পাশের বাড়ির ভাবি এসে বলছে, আপনার বাচ্চা তো অনেক খায়! আমার বাচ্চা একেবারেই খায় না। অথবা আপনার পাশের বাড়ির ভাবি এসে বলছে, আপনার বাচ্চা তো অনেক সুন্দর, ফুটফুটে! এর পরদিন থেকে আপনার বাচ্চা আর আগের মতো খাওয়া-দাওয়া করে না অথবা আপনার বাচ্চার শরীরে ঘা হয়েছে অথবা চোখ-মুখ ফুলে গেছে অথবা অন্য কোনো রোগ হয়েছে! আমাদের সমাজে প্রায়শই এমন হয়ে থাকে। এমন হলে আপনার যদি সন্দেহ হয় যে, পাশের বাড়ির ভাবির এই কথা বলার কারণে এমন হয়েছে, তাহলে আপনি তাকে ডেকে এনে বলবেন, ভাবি! আপনি আমার বাচ্চার জন্য কষ্ট করে ওযূ করুন। মনে হচ্ছে আপনার নযর লেগেছে আমার বাচ্চার উপর। এই মুহূর্তে আপনার ভাবি কিন্তু রেগে যাবেন। তিনি বলবেন, না, না, আমার চোখ লাগেনি! ওই সময় আপনি তাকে বুঝিয়ে বলবেন, ভাবি! কারো চোখ লাগাটা স্বাভাবিক। আমি যেহেতু আপনাকে সন্দেহ করছি, সেহেতু এখন আপনার ওযূ করে পানি দেওয়া ওয়াজিব। আপনি যদি ওযূ করে পানি না দেন, তাহলে গুনাহগার হবেন। তাই অবশ্যই আপনাকে ওযূর পানি দিতে হবে।
ওযূর পানি কীভাবে দিবেন?
বালতির মাঝে পানি নিয়ে ওই বালতিটা কোনো কিছুর উপরে রাখবেন। মাটিতে রাখা যাবে না। তারপর যে ব্যক্তির চোখ লেগেছে তথা পাশের বাড়ির ওই ভাবি বালতি থেকে এক আঁজলা পানি নিয়ে কুলি করে ওই কুলির পানি বালতিতে ফেলবে। তারপর মুখমণ্ডল ধৌত করবে। তারপর বাম হাত দিয়ে পানি নিয়ে ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত ধৌত করবে। তারপর ডান হাতে পানি নিয়ে বাম হাতের কব্জি পর্যন্ত ধৌত করবে। এরপর ডান ও বাম হাতের কনুই ধৌত করবে। এরপর ডান ও বাম পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধৌত করবে। এরপর দুই পায়ের হাঁটু ধৌত করবে। তারপর লুঙ্গি বা পায়জামার নিচের অংশ তথা নাভির নিচে কোমর পর্যন্ত ধৌত করবে। তারপর ওই পানি ওই বাচ্চার পেছন দিক থেকে একবারে তার মাথায় ঢেলে দিবে। এভাবে পানি ঢেলে দিলে অবশ্যই বাচ্চা সুস্থ হয়ে যাবে, ইনশা-আল্লাহ!
আর আপনি যদি না জানেন আপনার বাচ্চাকে কার নযর লেগেছে; তাহলে এর চিকিৎসা হচ্ছে, ৭টি বরই পাতা শিল-পাটায় পিষে নিবেন। এরপর এক বালতি পানি নিয়ে সেগুলো পানিতে মিশিয়ে ওই পানিতে তিনবার করে সূরা আন-নাস, আল-ফালাক্ব ও আল-ইখলাছ পড়ে ফুঁক দিবেন। তারপর সাত বার সূরা আল-ফাতেহা পড়ে ফুঁক দিবেন। তারপর আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁক দিবেন। তারপর সূরা আল-বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়ে ফুঁক দিবেন। এভাবে ওই রোগীকে তিনদিন গোসল করাবেন। আপনার বাচ্চা সুস্থ হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ![15]
আপনি যদি মনে করেন, কেউ আপনাকে যাদু করেছে, তাহলে আপনি এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটা গ্ৰহণ করুন। উপরের পদ্ধতিটা হচ্ছে বদনযর এর ক্ষেত্রে। আর পরের পদ্ধতিটা হচ্ছে বদনযর ও যাদু উভয়টির ক্ষেত্রে।
যাদু ও বদনযর থেকে বাঁচার জন্য তাবীয ব্যবহার করার বিধান: যাদু ও বদনযর থেকে বাঁচার জন্য তাবীয ব্যবহার করা যাবে না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, একটি বাচ্চা জন্মগ্রহণ করলেই দাদি ও নানিরা বাচ্চার হাতে, পায়ে ও গলায় কত ধরনের তাবীয ঝুলায়! কোনো অবস্থাতেই তাবীয ঝুলানো যাবে না। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ ‘যে তামীমা (তাবীয) ঝুলায়, সে শিরক করে’।[16]
তাবীয ব্যবহার করলে কাজ হয় কেন?
তাবীয ব্যবহার করলে কাজ হয় কেন তা স্পষ্ট করার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর একটি আছার উল্লেখ করি।
عَنْ زَيْنَبَ امْرَأَةِ عَبْدِ اللَّهِ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ قَالَتْ قُلْتُ لِمَ تَقُولُ هَذَا وَاللَّهِ لَقَدْ كَانَتْ عَيْنِي تَقْذِفُ وَكُنْتُ أَخْتَلِفُ إِلَى فُلاَنٍ الْيَهُودِيِّ يَرْقِينِي فَإِذَا رَقَانِي سَكَنَتْ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ إِنَّمَا ذَاكِ عَمَلُ الشَّيْطَانِ كَانَ يَنْخَسُهَا بِيَدِهِ فَإِذَا رَقَاهَا كَفَّ عَنْهَا إِنَّمَا كَانَ يَكْفِيكِ أَنْ تَقُولِي كَمَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا.
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্ত্রী যায়নাব রাযিয়াল্লাহু আনহা আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘যাদু, তাবীয ও অবৈধ প্রেম ঘটানোর মন্ত্র শিরক এর অন্তর্ভুক্ত’। তিনি (যায়নাব) বলেন, আমি বললাম, আপনি এসব কী বলেন? আল্লাহর কসম! আমার চোখ হতে পানি পড়ত, আমি অমুক ইয়াহূদী কর্তৃক ঝাড়ফুঁক করাতাম। সে আমাকে ঝাড়ফুঁক করলে পানি পড়া বন্ধ হয়ে যেত। আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এগুলো শয়তানের কাজ। সে নিজ হাতে চোখে যন্ত্রণা দেয়। যখন সে ঝাড়ফুঁক দেয়, তখন সে বিরত থাকে। এর চেয়ে বরং তোমার জন্য এরূপ বললেই যথেষ্ট হতো, যেরূপ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا. ‘হে মানব জাতির রব! যন্ত্রণা দূর করে দিন, আরোগ্য দান করুন, আপনিই আরোগ্যদাতা, আপনার দেওয়া নিরাময়ই যথার্থ নিরাময়, যার পরে আর কোনো রোগ বাকি থাকে না’।[17]
এই আছারের প্রতি আপনি লক্ষ করলে বিষয়টি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে, শয়তান মূলত মানুষকে ভয়-ভীতি দেখায়। যখন মানুষ তাবীয ঝুলায়, তখন শয়তান চলে যায়। কারণ শয়তানের কাজ হচ্ছে মানুষকে বিপথগামী করা, জাহান্নামী করা। যখন মানুষ তাবীয ব্যবহার করে, তখন সে শিরক করে। এর কারণে শয়তান তার থেকে চলে যায়।
যাদুর পরিবর্তে যাদু করার বিধান: কেউ যদি আপনাকে যাদু করে, তাহলে এই যাদু ছুটানোর জন্য যাদু করা যাবে না। কেননা যাদু করা কুফরী। বরং আপনাকে বৈধ ঝাড়ফুঁক করতে হবে। আল-হামদুলিল্লাহ! বর্তমানে ছহীহ আক্বীদার অনেক আলেম আছেন, যারা ঝাড়ফুঁক করেন। আপনি তাদের কাছে যান। আশা করা যায় সুস্থ হয়ে যাবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যাদু ও বদনযরের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করুন- আমীন!
সাঈদুর রহমান
সাবেক শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. ছহীহুল জামে‘, হা/৩০০৪।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৪।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮০।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০০৯।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০০৯।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৯৩।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০১৮।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪২।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৭১।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৮৪।
[11]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩০৪।
[12]. ফাতহুল বারী, হা/৩৩০৪।
[13]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৮।
[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮০।
[15]. ফাতহুল বারী, হা/৫৭৬৫, ১৩/১৮৩।
[16]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৪২২।
[17]. আবূ দাঊদ, হা/৩৮৮৩।