কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

শবেবরাত সম্পর্কে আলোচনা

post title will place here

শবেবরাতের পরিচয় : ‘শব’ ফারসী শব্দ। এর অর্থ রাত বা রজনি। ‘বরাত’ শব্দটিও মূলে ফারসী। অর্থ ভাগ্য। দু’শব্দের একত্রে অর্থ হবে, ভাগ্য রজনি। বরাত শব্দটি আরবী ভেবে অনেকেই ভুল করে থাকেন। কারণ বরাত বলতে আরবী ভাষায় কোনো শব্দ নেই। যদি বরাত শব্দটি আরবী বারাআত শব্দের অপভ্রংশ ধরা হয়, তবে তার অর্থ হবে সম্পর্কচ্ছেদ বা বিমুক্তিকরণ। কিন্তু কয়েকটি কারণে এ অর্থটি এখানে অগ্রহণযোগ্য, মেনে নেয়া যায় না—

(১) আগের শব্দটি ফারসী হওয়ায় বরাত শব্দটিও ফারসী হবে, এটাই স্বাভাবিক।

(২) শা‘বানের মধ্য রজনিকে আরবী ভাষার দীর্ঘ পরম্পরায় কেউই বারাআতের রাত্রি হিসেবে আখ্যা দেননি।

(৩) রামাযান মাসের লায়লাতুল ক্বদরকে কেউ কেউ লায়লাতুল বারাআত হিসেবে নামকরণ করেছেন; শা‘বানের মধ্য রজনিকে নয়।

আরবী ভাষায় এ রাতটিকে ‘লায়লাতুন নিছফি মিন শা‘বান’ বা শা‘বান মাসের মধ্য রজনি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

উপমহাদেশের কথিত ছূফী-সুন্নীরা শা‘বান মাসের ১৫তম রাতকে বিশেষ মর্যাদায় পালন করে, যা বিদআত। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে শা‘বান মাসের কোনো রাতকে সৌভাগ্যের রাত বলে ঘোষণা করা হয়নি; ইসলামে সৌভাগ্যের রাত হলো লায়লাতুল ক্বদর।

শবেবরাত কি ভাগ্য রজনি?

অনেকে শবেবরাতকে ভাগ্য রজনি বলে থাকে। তারা দলীল হিসেবে পেশ করেন এই আয়াতটি,إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ- فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ‘অবশ্যই আমরা তা (কুরআন) এক বরকতপূর্ণ রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি, অবশ্যই আমরা সতর্ককারী, এ রাত্রিতে যাবতীয় প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়’ (আদ-দুখান, ৪৪/৩-৪)

এ আয়াতদ্বয়ের তাফসীরে অধিকাংশ মুফাসসির বলেন, এ আয়াত দ্বারা রামাযানের লায়লাতুল ক্বদরকেই বুঝানো হয়েছে। যে লায়লাতুল ক্বদরের চারটি নাম রয়েছে— ১. লায়লাতুল ক্বদর ২. লায়লাতুল বারাআত ৩. লায়লাতুছ ছফ ৪. লায়লাতুন মুবারাকা। শুধু ইকরিমা রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, এ আয়াত দ্বারা শা‘বানের মধ্যরাত্রিকে বুঝানো হয়েছে। এটা একটি অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা।

আল্লামা ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আলোচ্য আয়াতে মুবারক রাত্রি বলতে লায়লাতুল ক্বদরকে বুঝানো হয়েছে, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, اِنَّا اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةِ الْقَدْرِ ‘আমরা এ কুরআনকে ক্বদরের রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি’ (আল-ক্বদর, ৯৭/১)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ‘রামাযান মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং হেদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও ফুরক্বান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীস্বরূপ)। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন ছিয়াম রাখে। আর যে অসুস্থ অথবা সফরে থাকে সে অন্য সময়ে আদায় করে নেবে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)

যিনি এ রাত্রিকে শা‘বানের মধ্যবর্তী রাত বলে মত প্রকাশ করেছেন, যেমনটি ইকরিমা রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি অনেক দূরবর্তী মত গ্রহণ করেছেন। কেননা কুরআনের সুস্পষ্ট বাণী, যা রামাযান মাসে বলে ঘোষণা দিয়েছে।[1] যেমন হাদীছে এসেছে, আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْـرِ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ‏‏‏‏ ‘তোমরা লায়লাতুল ক্বদর রামাযানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে খোঁজ করো’।[2]

হাদীছে শবেবরাত : শবেবরাতের অস্তিত্ব হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। হাদীছে এসেছে, আবূ মূসা আল-আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ মধ্য শা‘বানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন’।[3]

তবে শবেবরাতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আমল ছহীহ দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। এই ব্যাপারে যতগুলো দলীল রয়েছে, তার একটিও ছহীহ নয়। কাজেই এই রাত উপলক্ষ্যে কোনো ইবাদত করা হলে সেটা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে। হাদীছে এসেছে, আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কেউ আমাদের এ শরীআতে নেই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তা প্রত্যাখ্যাত’।[4]

শবেবরাতের ছালাত : শবেবরাতের ছালাতের প্রথম প্রচলন হয় হিজরী ৪৪৮ সনে। ফিলিস্তীনের নাবলুস শহরের ইবনু আবিল হামরা নামের এক লোক বায়তুল মাক্বদিসে আসেন। তার তেলাওয়াত ছিল সুমধুর। তিনি শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে ছালাতে দাঁড়ালে তার পেছনে এক লোক এসে দাঁড়ায়, তারপর তার সাথে তৃতীয়জন এসে যোগ দেয়, তারপর চতুর্থজন। তিনি ছালাত শেষ করার আগেই বিরাট একদল লোক এসে তার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তী বছর এলে তার সাথে অনেকেই যোগ দেয় ও ছালাত আদায় করে। এতে করে মাসজিদুল আক্বছাতে এ ছালাতের প্রথা চালু হয়। কালক্রমে এ ছালাত এমনভাবে আদায় হতে লাগে যে, অনেকেই তা সুন্নাত মনে করতে শুরু করে।[5]

প্রথা অনুযায়ী এ ছালাতের পদ্ধতি হলো, প্রতি রাকআতে সূরা আল-ফাতেহার পর সূরা আল-ইখলাছ ১০ বার করে পড়ে মোট ১০০ রাকআত ছালাত পড়া হয়, যাতে করে সূরা আল-ইখলাছ ১০০০ বার পড়া হয়।[6]

মিশকাতের ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ১০১৪ হি.) বলেন, জেনে রাখুন, ইমাম সুয়ূত্বী রাহিমাহুল্লাহ (৮৪৯-৯১১ হি.) তার কিতাবে দায়লামী ও অন্যদের আনীত হাদীছসমূহ যেখানে মধ্য শা‘বানে প্রতি রাকআতে ১০ বার করে সূরা আল-ইখলাছ সহ ১০০ রাকআত ছালাতের যে অগণিত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তা সবই মাওযূ‘ বা জাল। তাছাড়া আলী ইবনে ইবরাহীম রাহিমাহুল্লাহ এক পুস্তিকায় বলেছেন, ‘মধ্য শা‘বানের রাত্রিতে ‘ছালাতে আলফিইয়াহ’ নামে প্রতি রাকআতে ১০ বার করে সূরা আল-ইখলাছ সহ ১০০ রাকআত ছালাত জামাআত সহকারে যা আদায় করা হয় এবং যাকে লোকেরা জুমআ ও ঈদায়েনের চাইতে গুরুত্ব দিয়ে আদায় করে থাকে, সে বিষয়ে যঈফ বা মাওযূ‘ ব্যতীত কোনো হাদীছ বা আছার বর্ণিত হয়নি’।[7]

এ ধরনের ছালাত সম্পূর্ণ বিদআত। কারণ এ ধরনের ছালাতের বর্ণনা কোনো হাদীছের কিতাবে আসেনি। কোনো কোনো বইয়ে এ সম্পর্কে যে সকল হাদীছ উল্লেখ করা হয়, সেগুলো কোনো হাদীছের কিতাবে আসেনি। আর তাই আল্লামা ইবনুল জাওযী,[8] ইমাম নববী,[9] আল্লামা আবূ শামাহ,[10] শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া,[11] আল্লামা ইবনু আররাক,[12] আল্লামা সূয়ূত্বী,[13] আল্লামা শাওকানী[14] o-সহ আরও অনেকেই এগুলোকে বানোয়াট হাদীছ বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন।

১০০ রাকআত ছালাত পড়া সংক্রান্ত সমস্ত হাদীছই জাল বা বানোয়াট। ঐ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কিছুই প্রমাণিত নেই।[15]

১০০ রাকআত ছালাত পড়ার বিদআতটি কিছু মসজিদের মূর্খ ইমামগণ অন্যান্য ছালাতের সঙ্গে যুক্ত করে এই ছালাত চালু করেন। এর মাধ্যমে তারা জনসাধারণকে একত্রিত করার এবং তাদের উপর সর্দারী করা ও পেটপূর্তি করার একটি ফন্দি এঁটেছিলেন মাত্র। এই বিদআতী ছালাতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে নেককার, পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবে যমীন ধসে যাওয়ার ভয়ে শহর ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।[16]

হাফেয ইরাক্বী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মধ্য শা‘বানের রাতে ছালাত আদায় সম্পর্কিত হাদীছগুলো বানোয়াট বা জাল এবং এটা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যা আরোপের শামিল’।

শবেবরাতের হালুয়া-রুটি : শবেবরাতের দিন ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছিল। এজন্য তিনি শক্ত খাবার খেতে না পারায় নরম খাদ্য হিসেবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন। তাই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত ভাঙার ব্যথায় সমবেদনাস্বরূপ হালুয়া-রুটি খেতে হবে। এ যুক্তিটি হাস্যকর। কারণ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত ভেঙেছিল ওহুদ যুদ্ধে। আর এ যুদ্ধ শা‘বান মাসে হয়নি বরং তা হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবার সকাল বেলায়।[17]

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত ভাঙল শাওয়াল মাসে, আর আমরা শাওয়াল মাস আসার কয়েক মাস আগেই সেই দাঁত ভাঙার ব্যথা অনুভব করে হালুয়া-রুটি খাচ্ছি!

শবেবরাতের রাতের অন্যান্য কুসংস্কার : এ রাতে অনেক কুসংস্কার রয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মানুষ এগুলোকে নেক কাজ মনে করে শুধু বিভ্রান্তই হচ্ছে না, বরং কাবীরা গুনাহে লিপ্ত হচ্ছে। এ জাতীয় আপত্তিকর কাজগুলো হলো :

(১) আতশবাজি, তারাবাতি, পটকা ইত্যাদি ফুটানো।

(২) মসজিদ, ঘর-বাড়ি, দোকানপাট ও অন্যান্য জায়গায় আলোকসজ্জা করা; এসব অপচয়ের শামিল। তাছাড়া এটি হিন্দু দিওয়ালি বা দীপাবলি উৎসব হতে গৃহীত। তাই এ ধরনের কর্মকাণ্ড বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার কারণে অবশ্যই পরিত্যাজ্য ও বর্জনীয়।

আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিছ দেহলভী হানাফী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘এই রাতে আলোকসজ্জা করা হিন্দুদের দীপাবলি উৎসবের অনুকরণ মাত্র। তিনি মধ্য শা‘বানের ফযীলত বিষয়ে বিভিন্ন যঈফ ও মাওযূ‘ হাদীছ উল্লেখ করার পর বলেন, নিকৃষ্ট বিদআতসমূহ যা হিন্দুস্তানের অধিকাংশ দেশে প্রচলিত আছে, সেগুলোর অন্যতম হলো বাড়ি-ঘরে ও প্রাচীরসমূহের উপর আলোকসজ্জা করা ও এগুলো নিয়ে গর্ব করা। আর এ উপলক্ষ্যে দলবদ্ধভাবে আতশবাজি ও আগরবাতি পোড়ানোর খেল-তামাশায় মত্ত হওয়া। এগুলো ঐসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যেসবের কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি কোনো বিশুদ্ধ গ্রন্থে নেই। এমনকি অগ্রহণযোগ্য কোনো কিতাবেও নেই। এ বিষয়ে কোনো হাদীছ বর্ণিত হয়নি; না কোনো যঈফ না কোনো মাওযূ‘। হিন্দুস্তানের দেশগুলোর বাইরে এটি কোথাও প্রচলিত নেই। আরব দেশসমূহের মধ্যে হারামাইন শরীফাইনে নেই। আল্লাহ এ দুই হারামের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। এ দুটি স্থান ছাড়াও অন্য কোনো স্থানে নেই। অনারব দেশগুলোতেও নেই, হিন্দুস্তানের দেশগুলো ব্যতীত। বরং সর্বোচ্চ ধারণা মতে এটি হিন্দুদের দীপাবলি উৎসবে আলোকসজ্জার প্রথা হতে গৃহীত। কেননা সাধারণভাবে নিকৃষ্ট বিদআতসমূহের রেওয়াজ কুফরী যামানা থেকে হিন্দুস্তানে রয়ে গেছে। সেগুলো মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পারস্পরিক প্রতিবেশী হওয়া ও মেলামেশার কারণে এবং তাদের মহিলাদের গৃহকর্মী হিসেবে গ্রহণ করা ও তাদের নারীদের বিবাহ করার কারণে। পরবর্তী বিদ্বানগণের মধ্যেকার কেউ কেউ বলেছেন, বিশেষ বিশেষ রাত্রে অধিকহারে আলোকসজ্জা করা নিকৃষ্ট বিদআতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। কেননা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অধিকহারে আলো জ্বালানো ‘মুস্তাহাব’ হওয়ার পক্ষে শরীআতের কোথাও কোনো ‘আছার’ বর্ণিত হয়নি’।[18]

একটি বিভ্রান্তির নিরসন : ১৫ শা‘বানে দিনের ছিয়াম ও রাতের ইবাদত-বন্দেগী, কুরআন তেলাওয়াত, নফল ছালাত, কান্নাকাটি, দু‘আ-মুনাজাত, কবর যিয়ারাত, দান-ছাদাক্বা, ওয়ায-নছীহত প্রভৃতি নেক আমল গুরুত্ব সহকারে পালন করাকে যখন কুরআন ও হাদীছসম্মত নয় বলে আলোচনা করা হয়, তখন সাধারণ ধর্মপ্রাণ ভাই-বোনদের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্ন আসে যে, জনাব! আপনি শবেবরাতে উল্লিখিত ইবাদত-বন্দেগীকে বিদআত বা কুরআন ও সুন্নাহসম্মত নয় বলেছেন, কিন্তু ছিয়াম পালন করা ছওয়াবের কাজ ও রুটি তৈরি করে গরীব দুঃখীকে দান করা ভালো কাজ নয় কি? আমরা কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে দোষের কেন হবে?

সুধী পাঠক! নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দু‘আ-মুনাজাত, ছালাত, ছিয়াম, দান-ছাদাক্বা, কুরআন তেলাওয়াত, রাত্রি জাগরণ হলো নেক আমল। এতে কারও দ্বিমত নেই। আমরা কখনো এগুলোকে বিদআত বলি না। উম্মাতে মুহাম্মাদী প্রতিদিনই রাতের শেষ ভাগে এ সকল নফল ইবাদত অধিক ছওয়াব লাভের আশায় আল্লাহকে রাযী-খুশী করানোর জন্য আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফাআত লাভ করে জান্নাতবাসী হওয়ার জন্য করতে পারেন। কিন্তু যাকে বিদআত বলি এবং যে সম্পর্কে উম্মাহকে সতর্ক করতে চাই, তা হলো ১৫ শা‘বান রাতকে শবেবরাত বা সৌভাগ্য রজনি অথবা মুক্তি রজনি মনে করে বিভিন্ন প্রকার আমল ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা। এটা কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী। এটাই ধর্মে বাড়াবাড়ি। যা ধর্মে নেই, তা উদযাপন করা ও প্রচলন করার নাম বিদআত।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নবুঅতের ২৩ বছরের জীবনে কখনো তাঁর ছাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মক্কায় মাসজিদুল হারামে অথবা মদীনায় মসজিদে নববীতে কিংবা অন্য কোনো মসজিদে একত্র হয়ে উল্লিখিত ইবাদত-বন্দেগীসমূহ করেছেন এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর ছাহাবায়ে কেরাম তথা খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে কেউ জানত না— শবেবরাত কী এবং এতে কী করতে হয়। তারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের চেয়ে উত্তমরূপে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন। তারা তাতে শবেবরাত সম্পর্কে কোনো দিক-নির্দেশনা পেলেন না। তারা তাদের জীবন কাটালেন আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে, অথচ জীবনের একটিবারও তাঁর কাছ থেকে শবেবরাত বা মুক্তির রজনির সবক পেলেন না? যা পালন করতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে যাননি, যা কুরআনে নেই, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তা‘লীমে নেই, ছাহাবীগণের আমলে নেই, তাদের সোনালি যুগের বহু বছর পরে প্রচলন করা শবেবরাতকে আমরা বিদআত বলতে চাই। আমরা বলতে চাই, এটা একটা মনগড়া ইবাদত পর্ব। আমরা মানুষকে বুঝাতে চাই, এসব প্রচলিত ও বানোয়াট মুক্তির রজনি উদযাপন থেকে দূরে থাকতে হবে, উম্মতকে কুরআন-সুন্নাহমুখী করতে এবং সেই অনুযায়ী আমল করাতে অভ্যস্ত করতে চাই। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর সকলকে বিশেষ করে বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশের মুসলিমদেরকে সকল প্রকার ধর্মীয় বিদআত থেকে আর ভণ্ড পীর-বুযুর্গ নামধারী ইসলামের শত্রুদের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন এবং ছহীহ আমল করার তওফীক্ব দান করুন- আমীন!


[1]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৪/১৩৭।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১৭।

[3]. ইবনু মাজাহ, হা/১৩৯০; জামে‘ ছগীর, হা/১৮১৯; মিশকাত, হা/১৩০৬; সিলসিলা ছহীহা, হা/১৫৬৩; আবূ দাঊদ, হা/১১৪৪, ১৫৬৩, হাসান।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭।

[5]. ত্বরতূসী, আল-হাওয়াদেছ ও বিদা‘, পৃ. ১২১, ১২২; ইবনে কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৪/২৪৭।

[6]. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ১/২০৩।

[7]. মিরক্বাত (দিল্লী ছাপা: তাবি), ৩/১৯৭।

[8]. মাওযূআত, ১/১২৭-১৩০।

[9]. আল-মাজমূ‘, ৪/৫৬।

[10]. আল-বায়স, পৃ. ৩২-৩৬।

[11]. ইক্বতিযাউ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম, ২/৬২৮।

[12]. তানযীহুশ শারীআহ, ২/৯২।

[13]. আল-আমর বিল ইত্তেবা‘, পৃ. ৮১; আল-লাআলিল মাছনূআহ, ২/৫৭।

[14]. ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ, পৃ. ৫১।

[15]. আল-লাআলিল মাছনূআহ, আহকাম রজব ও শা‘বান, পৃ. ৪৩।

[16]. মিরক্বাত (দিল্লী: তাবি), ‘ক্বিয়ামু শাহরি রামাযান’ অধ্যায়, টীকা সংক্ষেপায়িত, ৩/১৯৭-১৯৮।

[17]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত (বৈরূত: ১৯৮৫), ৩/২০১-২০২।

[18]. আব্দুল হক্ব দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ, মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ (দিল্লী মুজতাবাঈ প্রেস : আরবী-উর্দূ, ১৩০৯/১৮৯১ খ্রি.), পৃ. ২১৪-২১৫।

Magazine