কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ নিয়ে বিতর্ক : একটি পর্যালোচনা

রাষ্ট্র একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কোনো নির্দিষ্ট ভূ-ভাগের মধ্যে আইনের মাধ্যমে সংগঠিত জনসমূহকে রাষ্ট্র বলে। অন্যদিকে ধর্ম মানবজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি নৈতিক ভিত্তি বিধায়ক। ধর্ম মানুষের জীবনে শান্তি, সৌহার্দ-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ও মানবিক অধিকার সংরক্ষণে সহায়ক শক্তি। এটি জীবন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে শৃঙ্খলাবোধ সৃষ্টি করে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নিরাপত্তা বিধান করে। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মের অস্তিত্ব বিদ্যমান। আবহমানকাল থেকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা ও গুরুত্ব মানুষের চিরন্তন বৈশ্বিক চেতনায় পরিণত হয়, যা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এ যুগেও সমভাবে বিদ্যমান। সে কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মানুষ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। বলা যায়, ধর্ম মানুষের রক্ত-মাংস, অস্থি-মজ্জার সঙ্গে মিশে আছে।

‘ধর্ম’ শব্দটি বাংলা অভিধানে সৎকর্ম, নিয়মতান্ত্রিক আচার, রীতি-নীতি, স্রষ্টা, পরকাল এবং অলৌকিক বিশ্বাস ও উপাসনাপ্রণালির ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়। সংস্কৃত ভাষায় ধৃ’ সঙ্গে মন প্রত্যয় যোগে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এর ধাতুগত অর্থ হলো, যা ধারণ করে তাই ধর্ম। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Religion, যা Religere শব্দ থেকে নির্গত। ইংরেজি অভিধান অনুযায়ী Religion শব্দটির অর্থ হলো Bond বা বন্ধন, যা দৃঢ়ভাবে কোনোকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। আরবী অভিধানে ধর্মের প্রতিশব্দ হলো দ্বীন (دين)। এটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যা প্রতিদান, শরীআত বা ব্যবহারিক নিয়ম-পদ্ধতি, আনুগত্য, বিচার বা ফয়সালা, অনুসরণ, আত্মসমর্পণ, আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার, আইনকানুন, শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, কর্তৃত্ব, মতাদর্শ, মতবাদ, মনোনীত জীবনবিধান ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, ধর্ম বা দ্বীন হলো আল্লাহ প্রবর্তিত এমন এক জীবনব্যবস্থার নাম, যা মানুষকে তার বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সত্যাশ্রয়ী হিসেবে গড়ে তোলে এবং আচার-আচরণের ক্ষেত্রে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। নৃ-বিজ্ঞানীদের নিকট ধর্মের অধিক পরিচিত সংজ্ঞাটি হলো— ‘ধর্ম হলো আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করার নাম’। অধিকাংশ সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, ধর্ম হলো মানুষের এমন কোনো উচ্চতর শক্তিকে স্বীকার করে নেওয়া বা তার কাছে আত্মসমর্পণ করা, যে শক্তি মানুষের অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করে। মোটকথা, ধর্ম হলো মানব ও স্রষ্টার মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টিকারী একটি পবিত্র মাধ্যম, যার মাধ্যমে মানবতা বিকশিত হয় এবং কর্মাচরণ সুশৃঙ্খল হয়। সুতরাং রাষ্ট্রধর্ম বলতে বুঝায়— কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো বিশেষ ধর্মকে সাংবিধানিকভাবে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধজীবন তার একান্ত কাম্য। সমাজ ছাড়া সে বসবাস করতে পারে না। আর ধর্ম হলো মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। তাই মনুষ্য সমাজ কাঠামো ও সামাজিক কাঠামো ধর্মীয় অনুশাসন ও আচার বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মানুষের সাথে ধর্ম ও সামাজের সম্পর্ক এমন অবিচ্ছেদ্য যে কখনো একটি থেকে অপরটি আলাদা করা যায় না। সে কারণে পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতাতেই ধর্মের অবস্থান ছিল অতি উচ্চতায়। ধর্ম ছাড়া আজও কোনো জাতির সন্ধান পাওয়া যায় না। বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মের সংখ্যা প্রায় ৪৩০০টি। তন্মধ্যে প্রধান ধর্ম ১০টি। যথা : ইসলাম, খ্রিষ্ট, হিন্দু, বৌদ্ধ, হানজু বা হান, শিখ, ইয়াহূদী, বাহাই, জৈন, শিন্তো। সবচেয়ে বেশি অনুসারী হলো খ্রিষ্টধর্মের। তাদের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২৪০ কোটি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হলো ইসলাম। এর অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১৮০ কোটি। তবে এটি পৃথিবীর দ্রুত প্রসারমান ধর্ম। সাম্প্রতিক অনেক গবেষণায় বলা হচ্ছে, খ্রিষ্ট অধ্যুষিত ইউরোপ অর্ধশতাব্দীকাল পর মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে পরিণত হতে পারে।

প্রতিটি দেশেই, প্রতিটি জাতির মধ্যেই কোনো না কোনো ধর্ম পালিত হয়ে থাকে। ধর্মহীন জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব কল্পনা করা কঠিন। পৃথিবীতে মোট ২২৮টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৬০টি রাষ্ট্রের সংবিধানে ধর্ম হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টির রাষ্ট্রধর্ম খ্রিষ্টানিটি, ২৬টির রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ৫টির বৌদ্ধ এবং ১টির ইয়াহূদীধর্ম। এসব দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর বোধ-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছে।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে এমন দেশগুলো হলো : ১. বাংলাদেশ, ২. জিবুতি, ৩. ইরাক, ৪. পাকিস্তান, ৫. ফিলিস্তীন, ৬. তিউনিসিয়া, ৭. আফগানিস্তান, ৮. আলজেরিয়া, ৯. ব্রুনাই, ১০. কোমোরোস, ১১.জর্দান, ১২. লিবিয়া, ১৩. মালদ্বীপ, ১৪. মালয়েশিয়া, ১৫. মৌরতানিয়া, ১৬. মরক্কো, ১৭. মিশর, ১৮. কাতার, ১৯. সঊদী আরব, ২০. সোমালিয়া, ২১. সংযুক্ত আরব আমিরাত, ২২. ইরান, ২৩. ওমান, ২৪. কুয়েত, ২৫. ইয়ামান ও ২৬. বাহরাইন।

রাষ্ট্রধর্ম খ্রিষ্টান আছে এমন দেশ হলো : ১. কোস্টারিকা, ২. নিশটেনস্টাইন, ৩. মাল্টা, ৪. মোনাকো, ৫. ভ্যাটিকান, ৬. অ্যানডোরা, ৭. আর্জেন্টিনা, ৮. ডোমিনিকান রিপাবলিক, ৯. এল সালভাদর, ১০. পানামা, ১১. প্যারাগুয়ে, ১২. পেরু, ১৩. পোল্যান্ড, ১৪. স্পেন, ১৫. গ্রীস, ১৬. জর্জিয়া, ১৭. বুলগেরিয়া, ১৮. ইংল্যান্ড, ১৯. ডেনমার্ক, ২০. আইসল্যান্ড, ২১. নরওয়ে, ২২. ফিনল্যান্ড, ২৩. সুইডেন, ২৪. টোঙ্গা, ২৫. টুভালু, ২৬ স্কটল্যান্ড, ২৭. ফ্রান্স ও ২৮. হাঙ্গেরী।

রাষ্ট্রধর্ম বৌদ্ধ এমন দেশগুলো হলো : ১. কম্বোডিয়া, ২. শ্রীলংকা, ৩. থাইল্যান্ড, ৪. মায়ানমার ও ৫. ভুটান। রাষ্ট্রধর্ম ইয়াহূদী আছে শুধু ইসরাঈলে। এছাড়া পৃথিবীতে খ্রিষ্টান, মুসলিম এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক রাষ্ট্র আছে যারা তাদের দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বিশেষ কোনো ধর্মকে স্বীকৃতি না দিলেও জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে বিশেষ ধর্মের প্রাধান্য বজায় রেখে চলে। যেমন— যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, ইউক্রেন, আর্মেনিয়া, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান। আবার পৃথিবীতে এমন দেশও আছে যেখানে নাস্তিকের সংখ্যা বেশি, যেমন- উত্তর কোরিয়া (৭১%), জাপান (৫৭%), হংকং (৫৬%) এবং চীন (৫২%)।

জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৫১৬ জন। মোট জনসংখ্যার ৯১.০৪ শতাংশ মুসলিম, ৭.৯৫ শতাংশ হিন্দু, ০.৬১ শতাংশ বৌদ্ধ, ০.৩০ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ০.১২ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। এখানকার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। মুসলিমরা দেশের প্রধান সম্প্রদায়। তাই স্বাভাবিকভাবে এখানকার মুসলিমদের চিন্তা-চেতনায়, কাজ-কর্মে, চলনে-বলনে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে তথা সামগ্রিক জীবনে ধর্মের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। এটাই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক। সে কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ-বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে ইসলামকে এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত যুগোপযোগী ও যৌক্তিক।

সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের ৫ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে অষ্টম সংশোধনী পাশের মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২ক যুক্ত করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৯ জুন, ১৯৮৮ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ এতে অনুমোদন দেন। অষ্টম সংশোধনীর ২ক-তে বলা হয় ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণাকে বাংলাদেশী তাওহীদপন্থী মুসলিমরা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে স্বাগত জানিয়েছেন। ব্যতিক্রম ছিল কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ ও নাস্তিক ঘরোনার লোক। তারা এই রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ বলে আখ্যায়িত করেন। সেই সাথে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িক প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে ১৫ জন ব্যক্তি আদালতে রিট দায়ের করেন। রিট নম্বর ১৪৩৪/১৯৮৮। রিটকারী ১৫ জন হলেন— সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সাবেক বিচারপতি কেএম সোবহান, অধ্যাপক খান সরওয়ার মুর্শিদ, আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। তাদের আবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নানা ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ বাস করে। এটি সংবিধানের মূল স্তম্ভে বলা হয়েছে। এখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্যান্য ধর্মকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় চরিত্রের প্রতি ধ্বংসাত্মক। এ রিট দায়েরের দীর্ঘ ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ঐ দিনই বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। পাশাপাশি শুনানির জন্য অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা হলেন— টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ড. এম জহির, মাহমুদুল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আখতার ইমাম, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল মতিন খসরু, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এএফএম মেসবাহ উদ্দিন। এ রুল জারির কিছুদিন পর একই বছর ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়। এতে ২ অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে’। এ সংশোধনীর পর আবারো সম্পূরক আবেদন করা হয়। এ আবেদনের পর ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ সম্পূরক রুল জারি করেন। এরপর এ রুলের ওপর হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির জন্য ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আবেদন করেন রিট আবেদনকারী পক্ষ। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে রুল শুনানির দিন ধার্য করা হয় ২৭ মার্চ, ২০১৬। পরে একদিন পিছিয়ে রুল শুনানির জন্য রিট আবেদনটি কার্যতালিকায় আসে (সোমবার) ২৮ মার্চ, ২০১৬ তারিখে। বেলা ২টা ১২ মিনিটে এজলাসে বসেন বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমস্বয়ে তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ।

অতঃপর ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িক প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে এ রিটটি দায়েরের লোকাস স্ট্যান্ডি (রিট করার এখতিয়ার) নেই বলে রিট আবেদনটির নিষ্পত্তি করে দেয় আদালত। ফলে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামই বহাল থাকে। আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী জগলুল হায়দার আফ্রিক ও সুব্রত চৌধুরী এবং রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা উপস্থিত ছিলেন। এদিন রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বহাল থাকার পাশাপাশি অন্য ধর্মের অধিকারও বহাল থাকল। এটা সংবিধানেও রয়েছে। উল্লেখ্য, রায় ঘোষণার আগের দিন ২৭ মার্চ রবিবার সন্ধ্যায় রিট আবেদনকারীদের অন্যতম বদরুদ্দীন উমর গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে রিট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি রিট আবেদনটি পুনরুজ্জীবিত করায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘রিট মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হলেও আমাকে জানানো হয়নি। আমার নামও তার সঙ্গে জড়িত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি, রাজনৈতিকভাবেই আমরা সে সময় আন্দোলন করেছিলাম এবং আন্দোলনের অংশ হিসেবে মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু তখন যে পরিস্থিতিতে মামলা করা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই’।

এরপরও ইসলামবিদ্বেষী চিহ্নিত মহলটি বসে থাকেনি। তারা বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। এরই ধারাবাহিক অংশ হিসেবে উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তিকৃত ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাদ দিতে ২০২০ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিএনপি মহাসচিব, জাতীয় পার্টির মহাসচিব, গণফোরামের ড. কামাল হোসেন, জাসদের হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননসহ ১০ জনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান অশোক কুমার ষোঘ নামের একজন আইনজীবী। তিনি বলেন,‘বাংলাদেশ মাইনরিটি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অশোক কুমার সাহার পক্ষে পাঠানো লিগ্যাল নোটিশটি পাওয়ার দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা শুরু করতে হবে। অন্যথা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক জনগণের পক্ষে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হবে। নোটিশে তিনি আরো বলেন, ‘সংবিধানে ২ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনের ফলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখন সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে’। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ চালুর দাবিতে অশোক সাহার লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ায় ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। মীমাংসিত বিষয় নিয়ে লিগ্যাল নোটিশ করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শুরু হয় ব্যাপক তোলপাড়, বইতে থাকে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়। সাংবিধানিক ও মীমাংসিত বিষয় নিয়ে এরূপ ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ ও উস্কানিদাতাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার জোর দাবি ওঠে। শেষ পর্যন্ত ১৯ আগস্ট, ২০২০ বুধবার তিনি লিগ্যাল নোটিশটি প্রত্যাহার করে নেন। এখানেই শেষ নয়। ২০২২ সালে এসেও কিছু জ্ঞানপাপী এবং বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনে প্রয়াসী, ধর্মকর্মের সাথে সম্পর্কহীন, জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বাতিল করার জন্য প্রয়াস চালিয়েছে। লেখনী, বক্তৃতা, বিবৃতির মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সম্পর্কে উন্মাদের মতো প্রলাপ বকেছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামবিরোধীদের প্রলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ১. রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী? ২. রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। ৩. মানুষের ধর্ম থাকলেও রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকা উচিত নয়। ৪. ৭২ সালের সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও ইসলাম না থাকলেও যদি আমরা মুসলমান থাকতে পারি, তাহলে এখন সমস্যা কোথায়? ৫. কোনো বিশেষ ধর্মকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে স্বাভাবিকভাবেই বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। ৬. রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান করলে অন্য ধর্মগুলোকে খাটো করা হয়। ৭. সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম এক সঙ্গে থাকতে পারে না। ৮. একই সাথে ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের জন্য ধর্ম শব্দ ব্যবহার হয় কীভাবে? ৯. ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্যান্য ধর্মকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ১০. বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় চরিত্রের প্রতি ধ্বংসাত্মক আঘাত। ১১. রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের পরিপন্থী। ১২. সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। ১৩. বঙ্গবন্ধুর করা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। ১৪. সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা সাংঘর্ষিক। ১৫. বঙ্গবন্ধুর সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক কলঙ্ক থেকে মুক্ত করুন। ১৬. রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম মানি না ইত্যাদি ইত্যাদি।

উপরিউক্ত প্রলাপমূলক বাক্যগুলো বাংলাদেশের একশ্রেণির তথাকথিত প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী, মুক্তমনা, সুশীল, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদদের।

রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের বিষয়ে উপরিউক্ত মন্তব্যগুলো যারা করেন, তাদের পরিচয়, উদ্দেশ্য জাতির কাছে স্পষ্ট। আসলে তাদের অধিকাংশই ধর্মদ্রোহী, নাস্তিক শ্রেণির। একই সাথে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী, জাতিদ্রোহীও বটে। তারা নিজেদেরকে নাস্তিক পরিচয় দিলেও আসলে তারা ইসলামবিদ্বেষী। উক্ত মন্তব্যকারীদের অধিকাংশই মুখোশধারী ছদ্মবেশী বিশ্বাসঘাতক। তাদের কাছে মানবতার ধর্ম ইসলামের চেয়ে বৈষয়িক স্বার্থই বড়। ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী এ গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য হলো— দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া, আবহমানকাল ধরে বিরাজমান সম্প্রীতির মূলে কুঠারাঘাত করা, চাটুকারিতার মাধ্যমে বৈষয়িক স্বার্থ উদ্ধার করা।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

-মো. হাসিম আলী

সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।

Magazine