রামাযান মাস দান-ছাদাক্বার মাধ্যমে অধিক ছওয়াব অর্জনের মাস। রামাযান দয়া ও করুণার মাস। এ মাসে ছিয়াম পালনকারী না খেয়ে থাকার মাধ্যমে অভাবী মানুষের প্রতিদিনের দুঃখগুলো অনুভব করতে পারেন। মাহে রামাযান মানুষকে দানশীলতা, বদান্যতা, উদারতা ও মাহাত্ম্যের শিক্ষা দেয়। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক উদার ও দানশীল ছিলেন। রামাযানের অন্যতম আমল হলো দান-ছাদাক্বা। তাই ছিয়াম পালনকারী ব্যক্তিকে ইবাদতে মগ্ন থেকে সহানুভূতি, সদয় আচরণ, দানশীলতা ও বদান্যতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রশস্ত করার জন্য বিশেষভাবে তাকিদ দেওয়া হয়েছে। দানশীলতা ও বদান্যতা একটি মহৎ গুণ। ইসলাম যেমন দানশীলতাকে উৎসাহিত করেছে, তেমনি পরনির্ভরশীল হওয়াকে নিরুৎসাহিত করেছে। রামাযানে ছিয়াম পালনকারীগণ ছিয়াম পালনের মাধ্যমে দানশীল ও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উদ্বুদ্ধ হন। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধনসম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রামাযানে জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরও অধিক দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন আর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি প্রেরিত বায়ুর চেয়ে অধিক দানশীল হতেন’।[1]
রামাযান মাসে তিনি ও জিবরীল আলাইহিস সালাম মিলিত হতেন আর জিবরীল আলাইহিস সালাম হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত ফেরেশতা। তারা উভয়ে মিলে নাযিলকৃত কুরআন পরস্পরকে পড়ে শুনাতেন। কুরআন হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কিতাব, যা ইহসান ও উত্তম আখলাকের প্রতি উৎসাহিত ও অনুপ্রেরিত করে আর এ সম্মানিত কিতাবই ছিল রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র। যেহেতু এ কিতাব সেসব বিষয়ে উৎসাহিত করেছে, তিনি যেসব কাজ করতে দ্রুত এগিয়ে আসতেন এবং যা কিছু থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করেছেন, তিনিও তা থেকে বিরত থাকতেন। এ মাসে তাঁর দান-খয়রাত ও দয়া বহুগুণে বৃদ্ধি পেত, যখন জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর সাথে রামাযানে সাক্ষাৎ করতেন ও পরস্পরকে বেশি বেশি কুরআন পড়ে শুনাতেন।
আলোচ্য হাদীছে মূলত দুটি বিষয় ফুটে উঠেছে— ১. রামাযান মাসে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বেশি বেশি দান এবং ২. এ মাসে বেশি বেশি কুরআন পড়া।
এর কারণ হলো, রামাযান মাসে সৎকাজ করলে অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেকগুণ ছওয়াব বৃদ্ধি পায়। কেননা রামাযান মাসের রয়েছে নিজস্ব সম্মান ও মর্যাদা, যা অন্যান্য মাসের নেই। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ لَهُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللَّهُ سُبْحَانَهُ إِلاَّ الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ ‘আদম সন্তানের প্রতিটি কাজের ছওয়াব ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, তবে ছিয়াম ব্যতীত। কেননা তা শুধু আমার জন্য এবং আমিই তার পুরস্কার দিব’।[2] অন্য হাদীছে, আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ বনী আদম এর প্রতিটি ছওয়াবকে ১০ গুণ থেকে ৭০০ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু ছিয়ামের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, এটি বিশেষ করে আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। ছিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি খুশি রয়েছে। একটি খুশি ইফতারের সময় এবং অন্যটি তার প্রভুর সাথে সাক্ষাতের সময়। ছিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ মহান আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধি হতেও বেশি পছন্দনীয়; ছওম ঢালস্বরূপ, ছওম ঢালস্বরূপ’।[3]
রামাযান মাসে বেশি বেশি দান করা: রামাযানকে দানের মাস হিসেবে গ্রহণ করতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা রয়েছে। প্রিয়নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন রামাযান মাসে দান ও বদান্যতার হাত সম্প্রসারিত করতে। হাদীছেও রামাযান মাসকে ‘সহানুভূতির মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মাহে রামাযানে ছিয়াম সাধনার মাধ্যমে ছিয়াম পালনকারীর অন্তরে দানশীলতা ও বদান্যতার গুণাবলি সৃষ্টি হয়।
রামাযানের অন্যতম আমল হলো দান-ছাদাক্বা। তাই ছিয়াম পালনকারী ব্যক্তিকে ইবাদতে মগ্ন থেকে সহানুভূতি, সদয় আচরণ, দানশীলতা ও বদান্যতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রশস্ত করার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
দানশীলতা ও বদান্যতা মহৎ গুণ। ইসলাম যেমন দানশীলতাকে উৎসাহিত করেছে, তেমনি পরনির্ভরশীল হওয়াকে নিরুৎসাহিত করেছে। রামাযানে ছিয়াম পালনকারীগণ ছিয়াম পালনের মাধ্যমে দানশীল ও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উদ্বুদ্ধ হন। আল্লাহ তাআলা দান-ছাদাক্বা সম্পর্কে বলেন,وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ - وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ‘আমি তোমাদেরকে যে রিযিক্ব দিয়েছি, তোমরা তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে; (অন্যথা মৃত্যু আসলে) সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য কেন অবকাশ দিলে না, তবে আমি ছাদাক্বা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকেও অবকাশ দিবেন না। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত’ (আল-মুনাফিকূন, ৬৩/১০-১১)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন,الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘যারা সচ্ছলতা ও অভাবের মধ্যে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণকারী ও মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৪)।
রহমতের মাস রামাযানে প্রত্যেকের জন্য বরকতময় আমল হলো নিজেদের সবচেয়ে বেশি প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় দান করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ ‘তোমরা কখনও নেকী পাবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় জিনিস আল্লাহর পথে খরচ করো। আর তোমরা যা কিছুই দান করো, আল্লাহ তা জানেন’ (আলে ইমরান, ৩/৯২)। এই আয়াত যখন নাযিল হয়, তখন ছাহাবীগণ কীভাবে উত্তম বস্তু দান করতে ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলেন, তা এই ঘটনা দ্বারা অনুমান করা যায়। আনাস ইবনু মালেক রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মদীনার আনছারগণের মধ্যে আবূ তালহা রযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অন্যতম ধনী ব্যক্তি। তার সবচেয়ে বেশি খেজুরগাছ ছিল। সমস্ত বাগানের মধ্যে ‘বায়রহা’ নামক বাগানটি ছিল তার (আবূ তালহা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর) অধিক পছন্দনীয়। বাগানটি মসজিদে নববীর সামনেই অবস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই বাগানে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন। সেখানকার মিষ্টি পানি পান করতেন। আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন এই আয়াত নাযিল হয়, لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ অর্থাৎ ‘যতক্ষণ তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু (আল্লাহর রাহে) খরচ না করবে, ততক্ষণ তোমরা নেকীর অধিকারী হবে না’। তখন আবূ তালহা রযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, যতক্ষণ তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু (আল্লাহর রাহে) খরচ না করবে, ততক্ষণ তোমরা ছওয়াবের অধিকারী হবে না আর আমার প্রিয় বস্তু হলো এই ‘বায়রহা’। আমি এটা আল্লাহর রাস্তায় ছাদাক্বা করলাম। এর বিনিময়ে আমি নেকীর আশা রাখি এবং এটা আল্লাহর নিকট জমা রাখছি। সুতরাং হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি এটাকে যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় করুন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘বাহবা! এটা অত্যন্ত লাভজনক মাল, এটা অত্যন্ত লাভজনক মাল। তুমি এই বাগান সম্বন্ধে যা কিছু বলেছ, আমি তা শুনেছি। আমার মনে হয়, তুমি এই বাগান তোমার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিতরণ করে দাও’। আবূ তালহা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি তা বিতরণ করে দিব। অতএব, আবূ তালহা রযিয়াল্লাহু আনহু তার আত্মীয়স্বজন ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিলেন।[4] আল্লাহ তাআলা বলেন,مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ‘যারা আল্লাহর পথে তাদের মাল খরচ করে, তাদের উদাহরণ হচ্ছে একটি শস্যদানা যা সাতটি শিষ উৎপন্ন করে। প্রত্যেক শিষে ১০০ শস্যদানা থাকে আর আল্লাহ যাকে চান তাকে বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ প্রশস্তকারী, মহাজ্ঞানী’ (আল-বাক্বারা, ২/২৬১)।
দানের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, ইয়ায ইবনু গুতাইফ রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রযিয়াল্লাহু আনহু অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা তাকে দেখতে যাই। তার স্ত্রী শিয়রে উপবিষ্ট ছিলেন। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আবূ উবায়দা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর রাত কীরূপ অবস্থায় অতিবাহিত হয়েছে? তিনি বলেন, রাত অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় অতিবাহিত হয়েছে। সেই সময় তার মুখমণ্ডল দেয়ালের দিকে ছিল। এই কথা শোনামাত্রই তিনি জনগণের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, আমার এ রাত কঠিন অবস্থায় কাটেনি। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের উদ্বৃত্ত জিনিস মহান আল্লাহর পথে দান করে, সে ৭০০ পুণ্যের অধিকারী হয় আর যে ব্যক্তি নিজের ও পরিবারবর্গের জন্য খরচ করে, অথবা অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায়, অথবা কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করে, তবে ভালো কর্মের প্রতিদান ১০ গুণ হবে। ছওম হচ্ছে ঢালস্বরূপ যে পর্যন্ত না তা নষ্ট করা হয়। যে ব্যক্তি শারীরিক বিপদাপদ, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা ও রোগে আক্রান্ত হয়, ঐগুলো তার পাপসমূহ ঝেড়ে ফেলে’।[5] আবূ মাসঊদ আনছারী বলেন, এক ব্যক্তি লাগামসহ একটি সুসজ্জিত উট নিয়ে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এটি মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে দিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ক্বিয়ামত দিবসে তুমি এ জন্য ৭০০ উট প্রাপ্ত হবে’।[6]
দান-ছাদাক্বা গুনাহ মাফ করে ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, اتَّقُوْا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ ‘খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো’।[7] ছওম ও ছাদাক্বা একত্রিত হলে জান্নাত পাওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতে একটি প্রাসাদ রয়েছে, যার ভিতর থেকে বাহির এবং বাহির থেকে ভিতর পরিদৃষ্ট হবে’। তখন এক বেদুঈন উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এটি কার হবে? তিনি বললেন, ‘এটি হবে তার, যে ভালো কথা বলে, অন্যকে খাদ্য খাওয়ায়, সর্বদা ছওম পালন করে এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে ছালাত আদায় করে’।[8]
রামাযানে যাকাত ফরয না হলে বেশি করে ছাদাক্বা করা: যাদের ওপর যাকাত ফরয নয়, তারা এই মাসে বেশি বেশি ছাদাক্বা করতে পারেন। যাদের ওপর যাকাত ফরয, তারাও যাকাত আদায়ের পর অতিরিক্ত ছাদাক্বা করতে পারেন। ছাদাক্বার মাধ্যমে মহান আল্লাহ রিযিক্বে বরকত দেন, বিপদাপদ দূর করে দেন, মানুষের হায়াতে বরকত হয়, অপমৃত্যু কমে এবং অহংকার ও অহমিকা থেকে মুক্ত থাকা যায়।[9]
রামাযানে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা: রামাযান মাসে আমরা কুরআন বেশি বেশি তেলাওয়াত করব। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,اَلْمَاهِرُ بِالْقُرْا ٰنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِىْ يَقْرَاُ الْقُرْا ٰنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيْهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ اَجْرَانِ ‘কুরআনে দক্ষ ও পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ সম্মানিত পুণ্যবান ফেরেশতাদের সাথে থাকবেন। যে ব্যক্তি কুরআন আটকে আটকে তেলাওয়াত করে এবং তা তার জন্য কষ্টকর হয়, তার জন্য দুটি প্রতিদান রয়েছে’।[10]
দুটি প্রতিদানের প্রথমটি হলো তেলাওয়াতের এবং দ্বিতীয়টি হলো পাঠকারীর কষ্টের কারণে।
অনুরূপভাবে ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে আবূ মূসা আল-আশআরী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِىْ يَقْرَاُ القُرْا ٰنَ كَمَثَلِ الْاُتْرُجَّةِ، رِيْحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ، وَمَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِىْ لاَ يَقْرَاُ الْقُرْا ٰنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ لاَ رِيْحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ ‘যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে তার দৃষ্টান্ত জামিরের (লেবু জাতীয় ফল) মতো, যার ঘ্রাণ সুন্দর আর স্বাদও সুন্দর। আর যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে না, তার দৃষ্টান্ত খেজুরের ন্যায়, যার কোনো ঘ্রাণ নেই; কিন্তু তার স্বাদ মিষ্টি’।[11] আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীছে, তিনি বলেন, নিশ্চয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন আল্লাহর কোনো ঘরে (মসজিদে) লোকজন একত্রিত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত করে এবং নিজেদের মাঝে তা অধ্যয়ন করে; তখন তাদের ওপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আবৃত করে রাখে, ফেরেশতাগণ তাদের বেষ্টন করে রাখেন এবং আল্লাহ তাদের কথা তাঁর কাছে অবস্থিত ফেরেশতাদের কাছে আলোচনা করেন’।[12]
কুরআন তেলাওয়াতে প্রতিটি হরফে নেকী রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ قَرَاَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ اَمْثَالِهَا لَا اَقُوْلُ الٓمّٓ حَرْفٌ، وَلٰكِنْ اَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيْمٌ حَرْفٌ ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ (অক্ষর) পাঠ করবে, তাকে একটি নেকী প্রদান করা হবে আর প্রতিটি নেকী ১০ গুণ বৃদ্ধি করা হবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ’।[13]
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদকে রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ বলেন, وَاِنَّه لَهُدًى وَّرَحْمُةٌ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ ‘আর নিশ্চিত এটা (কুরআন) মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত’ (আন-নামল, ২৭/৭৭)। অন্য স্থানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,هُدًى وَّرَحْمَةً لِّلْمُحْسِنِيْنَ ‘(এই কুরআন) হেদায়াত ও রহমত সৎকর্মপরায়ণদের জন্য’ (লুক্বমান, ৩১/৩)।
প্রত্যেক মানুষ এই পৃথিবীতে সম্মান, আত্মতৃপ্তি ও ভালো অবস্থা নিয়ে জীবনযাপন করার জন্য আল্লাহ তাআলার রহমতের মুখাপেক্ষী। এই পৃথিবী ত্যাগ করার পর আলামে বারযাখের (কবরের) জিন্দেগীতেও প্রত্যেক মানুষ আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং আরামদায়ক ঘুমের জন্য আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী। কবরের জীবনের পর ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাতপ্রাপ্তির জন্যও প্রত্যেক মানুষ আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী। পৃথিবী, কবর, পরকাল এই তিনটি স্থানে আমরা সম্মানজনক জীবনযাপনের জন্য আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী। আমরা কদমে কদমে ঐ রহমতের মুখাপেক্ষী। আসুন! গভীরভাবে চিন্তা করি, কুরআন মাজীদ কীভাবে পৃথিবী, কবর এবং পরকালে আমাদের জন্য রহমত। কুরআনের আয়াত শ্রবণে ঈমানদারদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ‘নিশ্চয় মুমিনরা এইরূপ হয় যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন ঐ আয়াতসমূহ তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দেয় আর তারা নিজেদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (আল-আনফাল, ৮/২)।
ফাতেমা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর হাদীছে এসেছে, أَنَّ جِبْرِيلَ كَانَ يُعَارِضُهُ بِالقُرْآنِ كُلَّ سَنَةٍ مَرَّةً، وَإِنَّهُ قَدْ عَارَضَنِي بِهِ العَامَ مَرَّتَيْنِ ‘জিবরীল আলাইহিস সালাম প্রতি বছর আমাকে একবার কুরআন পড়ে শুনাতেন। এবছর তিনি তা আমাকে দুবার পড়ে শুনিয়েছেন’।[14]
অতএব, রামাযানে আমরা বেশি করে ছাদাক্বা করব এবং রাতের বেলায় বেশি পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করব। কেননা রাতের বেলায় মানুষ ঝামেলামুক্ত থাকে, সমস্ত হিম্মত একত্রিত হয়, অন্তর ও যবান চিন্তা-গবেষণার জন্য একনিষ্ঠ হয়।
মুহাম্মাদ গিয়াসুদ্দীন
শিবগঞ্জ, বগুড়া।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০২।
[2]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮২৩, হাদীছ ছহীহ।
[3]. মুসনাদে আহমাদ, ১/৪৪৬; আল-মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ৩/১৭৯।
[4]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/১৮৭৩।
[5]. মুসনাদে আহমাদ, ১/১৯৫, ১৯৬; আল-মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ২/৩০০।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৯২; নাসাঈ, হা/৩১৮৭; দারেমী, হা/২৪০২।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/১৪১৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১০১৬।
[8]. তিরমিযী, হা/১৯৮৪, হাসান।
[9]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ২/৬৫।
[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৯৮।
[11]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪২৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৩।
[12]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৯; আবূ দাঊদ, হা/১৪৫৫।
[13]. তিরমিযী, হা/২৯১০, হাদীছ ছহীহ।
[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০।